০
১৪৭৫ বার পঠিত
বাংলাদেশের অনেক গণমাধ্যম যে প্রাইভেসির ধারণাটা ভুলতে বসেছে, তা আগেই বলেছি। ‘প্রেমের টানে দেশে’, ‘ছাত্র-শিক্ষিকার বিয়ে’সহ না-না খবরে তা প্রমাণিত হয়েছে আগেই। মানুষের ব্যক্তিগত বিষয়গুলোকে খবর বানানো যে নৈতিক অপরাধ তা বিস্মৃত হয়েছেন গণমাধ্যমের কর্তাব্যক্তিরা। কদিন আগেই একটা কলামে লিখেছিলাম ছাত্র-শিক্ষিকার বিয়েসহ ব্যক্তিগত ব্যাপারে গণমাধ্যমের বাড়াবাড়ি রকমের উৎসাহ নিয়ে। তাদের বাড়াবাড়ি আজ কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে, তা বোঝা যায় সেই শিক্ষিকার মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে। যিনি হয়তো এসব কারণেই আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন। নতুন টিভি চ্যানেল এখন- এর প্রধান তুষার আবদুল্লাহ’র সামাজিকমাধ্যমের মন্তব্য সে কথাই বলে। তিনি লিখলেন, ‘কোন কোন আত্মহনের দায় গণমাধ্যম(!)কেও নিতে হবে।’
সাংবাদিকতার জগতের লিজেন্ডদের একজন ছিলেন ইত্তেফাকের এক সময়ের উপদেষ্টা সম্পাদক মরহুম আখতার-উল-আলম। ইত্তেফাক অফিসের দোতলায় তার সাথে কথা হচ্ছিলো সেসময়। তিনি বলেছিলেন, ‘আত্মহত্যার খবর করো না। যদি সেটা স্রেফ আত্মহত্যা হয়ে থাকে। এমনিতেই সেই পরিবার থাকে শোকগ্রস্ত, ট্রমায়। তা খবর করে সবাইকে জানিয়ে দেয়া পুরো পরিবারটাকেই সামাজিকভাবে হত্যার শামিল।’ আমি আত্মহত্যা বিষয়ক খবর যতটা পারি এড়িয়ে গেছি। হালের অনেক গণমাধ্যমের লোকজন বোধহয় এসব গায়ে মাখেন না। তাদের দরকার খবর করা, যেটা হয় না সেটাকেও খবরের আকৃতি দেয়া এবং তারপর গর্বভরে বলা ‘হু কেয়ারস’। শিক্ষিকার আত্মহত্যা নিয়ে তাদের বাড়াবাড়িও সেই ‘হু কেয়ারস’ এর ফসল। কোনো টেলিভিশন তো রীতিমত লাইভ করেছে, ট্রায়াল কোর্ট বসিয়ে ফেলেছে, তার স্বামী তাকে হত্যা করেছে কিনা তা প্রমাণের জন্য। অথচ এটা যদি স্রেফ আত্মহত্যা হয়ে থাকে তাহলে ওই স্বামী তথা ছেলেটির বাকি জীবন শুধুমাত্র গণমাধ্যমের বাড়াবাড়িতে নরক হয়ে উঠবে। হয়তো শেষ পর্যন্ত তাকেও আত্মহত্যার মতন চরম পথ বেছে নিতে হবে। তাই যদি হয়, তবে দুটো মৃত্যুর জন্যই দায়ী থাকবে গণমাধ্যম। আর তাদের ‘লাইভ’ নামের চ্যাংরামো।
মরহুম গিয়াস কামাল চৌধুরী একদিন দৈনিক খবরপত্রের অফিসে বলেছিলেন, ‘কোন ঘটনায় নিশ্চিত না হয়ে, বিশেষ করে চিকিৎসকের কথা ছাড়া মৃত্যুর খবর দিও না।’ আরো বলেছিলেন, ‘তুমি আহতকে নিহত বলতে পারবে যদি সে মারা যায়, কিন্তু নিহতকে আহত বানাতে পারবে না।’ সুতরাং খবর করতে হয় নিশ্চিত হয়ে। রয়ে-সয়ে। ‘ফাস্ট নিউজ-ফার্স্ট সার্ভ’ এটা অনেক সময় ব্যাকফায়ার করে। অনেক টেলিভিশন ও নিউজ পোর্টালকেই এমন ফার্স্ট হতে গিয়ে স্ক্রল বা হোম থেকে চুপিসারে খবর নামিয়ে ফেলতে দেখা গেছে।
সিএনএন, বিবিসি, আল জাজিরা কোন বিষয়গুলোতে লাইভ করে, তাও সম্ভবত দেখেন না এদেশের অনেক গণমাধ্যম প্রধানগণ। আলু-পটল, প্রেম-বিয়ে-আত্মহত্যা, পরিমনির বাচ্চা এসব নিয়ে ‘লাইভ’ করতে গিয়ে তারা ‘লাইভ’ বিষয়টাকেই ‘ডেড’ বানিয়ে ফেলেছেন। যেসব খবর করা উচিত সেগুলোর অনেকগুলোই উঠে আসে না হালের গণমাধ্যমে। দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ খবর দেশের মাধ্যমের আগে বিবিসি কিংবা পাশের দেশের আনন্দবাজার করে ফেলে। উল্টো মূল খবর বাদ দিয়ে গসিপ নিয়েই উৎসাহ বেশি কতক গণমাধ্যমের। জাতীয় ক্যাটাগরিতে চলে আসে নায়িকার বাচ্চা হওয়ার খবর। কোনটা বিনোদন, কোনটা খেলাধূলা, কোনটা জাতীয় বা আন্তর্জাতিক সব ধারণা গুলিয়ে যায় দেশের এসব মাধ্যমের দিকে চোখ বুলালে।
ছাত্র-শিক্ষিকার বিয়ে নিয়ে তুলকালাম ছিলো গণমাধ্যমে। শিক্ষিকার আত্মহত্যার পরেও তাকে রেহাই দিচ্ছে না তারা। সেটা নিয়েও ধুন্ধুমার কাণ্ড সৃষ্টি করেছে ‘লাইভ’ নামের চ্যাংরামো দিয়ে। অথচ তার বিপরীতে একটা কলেজের শিক্ষকদের প্রকাশ্যে পেটানো হলো, তা নিয়ে তাদের কোনো আলাপ নেই। সে ঘটনার ফলোআপ নেই, তা নিয়ে ‘লাইভ’ নেই। এমনকি নিজেদের কর্মীরা যে লাঞ্ছিত হচ্ছে, নির্যাতিত হচ্ছে, খুন হচ্ছে সে ব্যাপারেও তাদের খুব একটা নড়াচড়া নেই। ওই এক কোনায় মানববন্ধনের ছবি দিয়েই তাদের দায়িত্ব শেষ। সামাজিকমাধ্যমে চোখ বুলালেই বোঝা যায়, সাধারণ মানুষের গণমাধ্যম বিষয়ে মনোভাব। সুযোগ পেলেই ধুয়ে দিচ্ছে তারা। অনেকেই ট্রল করতে শুরু করেছেন, ‘এমন গণমাধ্যম লইয়া আমরা কী করিব’ বলে। তারপরেও গনমাধ্যমের সেই ‘হু কেয়ারস’ অবস্থা। ‘পিঠে বেঁধেছি কুলো, কানে দিয়েছি তুলো’ অবস্থাও বলতে পারেন।
ফুটনোট : অনেকে বলবেন সামাজিকমাধ্যম তো গসিপ বিষয়ে অগ্রগণ্য, তাহলে গণমাধ্যমের দোষ কোথাও। গণমাধ্যমের কাজ কী, কাজ হলো সম্পাদিত খবর করা। সোজা কথায় ভালো জিনিসগুলো রেখে ক্ষতিকরগুলো বাদ দেয়া। অর্থাৎ গণমাধ্যম সামাজিকমাধ্যমের গাইডলাইন। গাইডলাইন যদি গাইড না করে এবং নিজেই লাইন হারায় তাহলে তো ‘ভজঘট’ বাঁধবেই।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন