০
১৩৩৫ বার পঠিত
সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের ‘টাকার পাহাড়’। যুগান্তরের এই শিরোনামটায় বড় আনন্দ পেয়েছি। বলতে পারেন, আনন্দ কেনো। কথায় আছে, ‘মারো তো গন্ডার লুটো তো ভান্ডার’, বাংলাদেশিরা সেই কাজটাই করেছে। সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা সুইস ব্যাংকগুলিতে নামেই জমা রয়েছে। তবে নাগরিকত্ব তথা নাম গোপন রাখা অ্যাকাউন্টগুলির তথ্য জানায়নি ব্যাংকগুলো। অর্থাৎ প্রকাশিত সংখ্যা সম্ভবত পাহাড়ের চূড়া, মানে দৃশ্যমান অংশ। গোড়াটার কথা চিন্তা করে দেখুনতো। প্রকাশিত টাকাই আমাদের দেশের ১২ ব্যাংকের মূলধনের সমান। অর্থাৎ কত বারোটা বাজিয়েছেন আমাদের ‘লুটো তো ভান্ডারে’র কারিগররা। সাবাশ, এই না হলে লুটেরা। গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘ওয়েল এক্স’ এর মতে বাংলাদেশের কিছু ব্যক্তি দ্রুত ধনী হবার দৌড়ে বিশ্বে শীর্ষে রয়েছেন। অ্যামেরিকা, চীনের ধনীরা এর পেছনে। সুতরাং দ্রুত ধনীর দৌড়ে শীর্ষে থাকাদের পক্ষে এরচেয়ে কম কিছু মানায় না। মানায় কি?
একজনের কাছে প্রশ্ন করেছিলাম, টাকা রোজগারের সহজ উপায় কী? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, গন্ডার হওয়া। বুঝিনি বলাতে বললেন, চামড়া মোটা হতে হবে। এই যে আপনি লিখছেন, এই রকম হাজারও লিখার খোঁচা যেনো অনুভূত না হয়, সেই রকম চামড়া হলেই আপনি সুইস ব্যাংকে নাম লেখাতে পারবেন। ভেবে দেখলাম ভদ্রলোক মিথ্যা বলেননি। এই করোনাকাল তার প্রমান। আক্রান্তের সংখ্যা দুই লাখ ছুঁইছুঁই করছে। মৃত্যু আর উপসর্গে মৃত্যু মিলিয়ে প্রায় তিন হাজার। এ অবস্থাতেও চলছে নির্লজ্জ লুটপাট। স্বাস্থ্যখাত জুড়ে চলছে হরিলুট অবস্থা। চলছে সমালোচনা ও দোষারোপও। কিন্তু কে শোনে কার কথা, গন্ডারে পরিণত হওয়া মানুষগুলো তাদের কাজ করেই যাচ্ছেন! কোনো সমালোচনাকে গায়ে মাখছেন না!
‘মাফিয়া’ শব্দটায় একধরণের আকর্ষণ রয়েছে। আর এর মূলে রয়েছে ‘মারিয়ো পুজো’র ‘গডফাদার’ বইটি। সেবা’র অনুবাদ করা ‘গডফাদার’ পড়েননি এমন লোক কমই রয়েছেন। যারা পড়েছেন তারা জানেন, ‘গডফাদার’দের কার্যক্রম। তাদের ধান্ধায় কোনো দয়া-মায়া, লাজ-লজ্জা, প্রেম-ভালোবাসা থাকতে নেই। ধান্ধা মানে ধান্ধা। আমাদের স্বাস্থ্যখাতে সেই ‘মাফিয়া’রা জুড়ে বসেছেন। সেখানে মৃত্যুও ধান্ধা। কিট নিয়ে ধান্ধা। পরীক্ষার রিপোর্ট নিয়ে ধান্ধা। অক্সিজেন নিয়ে ধান্ধা। আইসিউ আর কেবিন নিয়ে ধান্ধা। মাস্ক, পিপিই নিয়ে ধান্ধা। ভেন্টিলেটর নিয়ে ধান্ধা। ধান্ধা আর ধান্ধা। ধান্ধার বাইরে কিছু নেই। পুরো ‘মাফিয়াতন্ত্র’ কায়েম হয়েছে এ খাতটিতে। আগামি বছর নিশ্চিত এই খাত থেকেই মোটা অঙ্কের টাকা যোগ হবে সুইস ব্যাংকগুলিতে।
যুগান্তর তাদের রিপোর্টটিতে এক দশকে দেশ থেকে পাচার হওয়া টাকার একটি হিসাব দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই)কে উদ্ধৃত করে গণমাধ্যমটি জানিয়েছে, ২০০৬ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত দশ বছরে দেশ থেকে পাচার হয়ে যাওয়া টাকার পরিমান চার লক্ষ কোটি। ২০১৫ সাল, এই এক বছরেই পাচার হয়েছে ১ লক্ষ কোটি টাকা। ২০১৫ এর পর তো অবস্থা আরো রমরমা হয়ে উঠেছে। চিন্তা করুন ২০২০ পর্যন্ত অবস্থা কেমন দাঁড়িয়েছে!
বৈরী সময়ের অত্যন্ত সাহসী এ রিপোর্টতে মোটামুটি একটি ধারণা দেয়া হয়েছে লুটপাটের চিত্র সম্পর্কে। জানানো হয়েছে, এসব পাচারকৃত টাকার উৎস দুর্নীতি ও চোরাচালান। অর্থাৎ ‘মাফিয়াতন্ত্র’। বাংলাদেশের আইনে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া বিদেশি ব্যাংকে টাকা রাখার বৈধ উপায় নেই। আর সে অনুমোদন হতে হয় ‘বিশেষ’। আর সে বিশেষ অনুমোদন কাউকে দেয়া হয়নি বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। তাহলে বাংলাদেশিদের এই টাকা অবৈধ এবং মাফিয়াতন্ত্রের।
মুশকিল হলো, এই মাফিয়া’রা কারা অনেকেই তা জানেন কিন্তু অফিসিয়ালি নাম প্রকাশ করতে পারেন না। কেউ ভয়ে করেন না, কেউ সুবিধা পান বলে করেন না। আর সুইস ব্যাংকগুলি তো আরও বদের ধাড়ি। তারা সংখ্যা প্রকাশ করে, দেশের নাম প্রকাশ করে কিন্তু অ্যাকাউন্ট কাদের তা প্রকাশ করে না। অবশ্য সুইস ব্যাংকগুলোর ব্যবসাটাই অবৈধ টাকার উপর। যার ধারাবাহিকতায় যোগ হয়েছে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরসহ আরো কয়েকটি দেশের ব্যাংক। যুগান্তরের রিপোর্টতেও যা উঠে এসেছে। লুটেরাদের টাকা জমা রাখার নিরাপদ স্থান হয়ে দাঁড়িয়েছে এই ব্যাংকগুলো।
বিদ্যুতের কুইক রেন্টাল কাহিনি যারা জানেন, তারা বোঝেন এ খাত থেকে কী পরিমান লোকসানের শিকার হয়েছে দেশ। সরকার বাধ্য হয়েই বন্ধ করে দিচ্ছে বেশিরভাগ কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো। এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র সক্ষমতার মাত্র ৩০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পেরেছে। একরকম বসিয়েই টাকা দিতে হয়েছে সরকারকে। আর সে টাকার পরিমান অর্ধ লক্ষ কোটি টাকারও বেশি। অর্থাৎ এখানেও সেই ‘মাফিয়াতন্ত্রে’র ছায়া। এ নিয়েও দেশের অন্যতম একটি গণমাধ্যম বিস্তারিত রিপোর্ট করেছে। রিপোর্ট হয়েছে অভিযুক্ত মানবপাচারকারী মাফিয়া এমপি পাপুলের কীর্তি-কাণ্ড নিয়ে। তাতে উঠে এসেছে সেই মাফিয়াতন্ত্রেরই ছবি।
যুগান্তর এবং আরো দু’একটি গণমাধ্যমের এ ধরণের রিপোর্ট গণমাধ্যমের সোনালী দিনের কথা মনে করিয়ে দেয়। খবরের কর্মীদের হৃত সম্মান উদ্ধারের আশা জাগায়। মাফিয়াতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের লুপ্ত বাসনা জাগিয়ে তোলে। যদিও গণমাধ্যমেও রয়েছে মাফিয়াতন্ত্রের কালো ছায়া। একটা খবর করতে গেলে প্রথমে সেই ছায়ার সাথে যুদ্ধ করতে হয়, তারপর প্রকাশ ও প্রচারের চিন্তা। এ ধরণের রিপোর্টগুলো সেই যুদ্ধ জয়ের কথাই বলে। সোনালী ভবিষ্যতের কথা বলে।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন