বৃষ্টির সিকোয়েন্সটা দুইদিন পর শ্যুট করলে কী ক্ষতি হইতো! মৌলীর একশো দুই জ্বর, এই জ্বর নিয়া সে সিঁড়ির রেলিং ধরে দাঁড়ায়ে আছে। অবশ্য এই সিনটার পরে মৌলীর কাজ মোটামুটি শেষ। কালকে সকালে এই ক্যাম্প ছেড়ে চলে যাবে তারা। পরে টুকটাক কাজে আসতে হবে হয়তো। আজকে মৌলীর বাবার আাসার কথা।
কাবেরী উপরের দিকে তাকায়, জাহিদ কবুতরের পা লাটিমের মতো আঙুলের ফাঁকে রেখে উপরের দিকে উড়ায়ে দিতেছে। মোট তেরো জোড়া কবুতর আনা হইছিলো, এখন আছে পাঁচ জোড়া। যেই বাড়িতে বিড়াল থাকে , সেই বাড়িতে কবুতরের পাল টিকবে না– এইটাই স্বাভাবিক। সিনেমার প্রয়োজনে একটা কাকাতুয়াও আনা আছে এই সেটে,বিড়াল সেইটার ঝুঁটি আর লেজ সাবাড় করে দিছে। ছাদে দুইটা খরগোশ, ওদের কানগুলিও ঝাঁঝরা। এই পাখি আর খরগোশ কী কাজে আসবে, কে জানে! কাবেরী এই পর্যন্ত একটা শ্যুটও মিস করে নাই, মেয়ে মৌলী ক্যামোরার সামনে– আর সে পিছনে। একটা সিনও নাই যেইখানে কাকাতুয়া আর খরগোশ ফ্রেমে আসছে।
তিন মাস ধরে এই পালবাড়িতে তারা, মেয়ে মৌলী নিজে নিজে বারোহাতের কাপড়গুলি ঘাটে গিয়ে ধোয়– কাবেরীর সেইসব কাজে হাত দেওয়া নিষেধ। ডিরেক্টরের একটাই কথা, ক্যারেকটারগুলি শ্যুটের বাইরেও স্ক্রিপ্ট এর মতো কাজকর্ম করবে– সবসময় কস্টিউমে থাকবে। পাটভাঙা ঝকঝকা কাপড় পরবে… তা হবেনা। যে যার কাপড় ধোও, ঘরের কাজ কর। কাবেরী তবু লুকায়ে লুকায়ে মৌলীর কাজগুলি করে দেয়।
ডিরেক্টর এখনো নীচে নামে নাই, সে দোতালার বারান্দায় । তারে পুরাপুরি দেখা যায় না, মুখটা একটু আড়ালে। সিগারেট ধরা একটা হাত শুধু রেলিং এর উপর। ডিরেক্টরের কুকুর জ্যানিথ সেই হাতটার ধরার জন্য রেলিংয়ে প্রায় উঠে যায় যায় অবস্থা । দোতালায় এই জ্যানিথ সর্বক্ষণ একটা বড় শিকলে বাধা থাকে। কুকুরটারে নীচে নামানো বা কারো উপরে যাওয়ার অনুমতি নাই।
মাছরাঙা টিভি থেকে লোকজন আসছে।পুরা বাড়ি ঘুরে ছবিটবি নেয়া শেষ। তারা মৌলীর সাথে কয়েকবার কথা বলার চেষ্টা করছে, কিন্তু মৌলী কথা বলবে না–
আগে প্রবীর কাকু নীচে আসুক, তারপর।
আচ্ছা, ইন্টারভিউ না দিলেন– এমনি একটু কথা বলি!
না!
ডিরেক্টর নীচে নেমে আসছে, সে কথা বলতেছে চোখ বন্ধ করে। তার কান দোতালার দিকে তাক করা।
ক্যামেরা থেমে আছে–
প্রবীরদা, চোখটা খুলে যদি বলতেন।
ডিরেক্টর বিরক্ত হয়ে তাকায়–
হ্যাঁ, যা বলতেছিলাম– এই সিনেমায় স্থায়ী অস্থায়ী মিলে প্রায় দুইশো ক্যারেক্টার, সিনেমার কাজ নিরানব্বই ভাগই শেষ। আমরা এই পালবাড়িতে বত্রিশ জন স্থায়ী ক্যারেক্টার নিয়ে তিন মাস ধরে অবস্থান করছি। গল্পটা চৌষট্টি সালের একটা অদ্ভুত ঘটনা নিয়ে। জনপ্রিয় গল্পকার সৌমেন মিত্রর ‘ দগ্ধ কুসুম’ এর উপর বেইজ করে আমরা এই সিনেমা করছি। গত তিন মাস ধরে বত্রিশ জন ক্যারেক্টার তাদের কস্টিউম নিয়ে এইখানে আছে। ঐ যে সেন্ট্রাল ক্যারেক্টার মৌলী, তার বয়স তেরো– সে তার শাড়ি-কাপড় নিজেই ধোয়, নিজেই ঘাটলায় গিয়ে বাসন মাজে। এই যে মৌলীর কাছেই শোনেন, ওর ইন্টারভিউ নেন আগে–
আপনার নাম মালবিকা ঘোষাল?
না! আমি তো রঞ্জনা । সৌমেন মিত্রের ‘দগ্ধ কুসুম’ এর রঞ্জনা। দোতালায় আমার থাকার ঘর। ঐ যে ছাদে আমার স্বামী দাঁড়ায়ে পায়রায় ঠোঁটে আফিংয়ের বড়ি পুরে দিচ্ছে। ওরা পোষ মানছে না, একটু উপরে উঠলেই পথ হারিয়ে ফেলছে– খোপে ফিরছে না।
আচ্ছা, মৌলী! কেমন লাগছে বাড়ি ছেড়ে আপনি এতোদিন এইখানে!
এটাই তো বাড়ি আমাদের, এখানেই তো সবাই আছে– মাও আছে যে!
প্রবীর মৌলীকে হাত দিয়ে থামায়– দেখেন, তেরো বছরের মৌলী কেমন ক্যারেকটারে ঢুকে গেছে। একশো দুই জ্বর নিয়ে আজকে বৃষ্টিতে ভিজবে সে। সিকোয়েন্স সামান্য, ঝুপ করে বৃষ্টি নামবে– আর সে রান্নাঘর থেকে দৌড়ে এসে কাপড় তুলতে গিয়ে তাড়াহুড়ায় বিড়ালের লেজে পাড়া দেবে। এই বিড়ালও আমাদের পোষা — দেখেন বাচ্চারা কেমন করে দুধ খাচ্ছে ওর। আমরা এই দৃশ্যটাই নেবো।
দিলীপ এই নিয়ে ছয়বার আসছে পালবাড়িতে। পেট্রোল পাম্প থেকে অটো নিতে হয়। প্রতিবারই সিপাহীপাড়ায় আসার পর সে দিক ভুলে যায়, লোক জনরে থামায়ে থামায়ে জিজ্ঞেস করা লাগে। পালবাড়িতে পালদের বংশধর কেউ নাই। মুক্তিযুদ্ধের সময় নাকি বাইশতেইশ জনরে একসাথে মেরে ফেলছিলো পাকবাহিনী। এইখানকার কেয়ারটেকার মনোজ সুপুরুষ মানুষ, দিলীপরে খুব সন্মান করে। আবার যখন শুনছে যে সে ডাক্তার, তখন আরো খাতির বাড়ছে। মনোজের কোনো সমস্যা নাই, সমস্যা তার বাচ্চাটার। আসলে বাচ্চাটারও সমস্যা নাই, সমস্যা মনোজের মনে।মনোজ ভাবতেছে বাচ্চটার নুনুতে কোনো সমস্যা। গতবার সে বাচ্চাটার প্যান্ট খুলে দেখাইতেছিলো–
দিলীপদা, দেখেন ওর বিচা নাই। হাত দিয়া দেখেন।
দিলীপ যতই বলে– সমস্যা নাই, ততই সে বাচ্চারে নিয়া আরো দুশ্চিন্তা করতে থাকে। বারবারই বলে, একটা মাত্র সন্তান।
এক মাত্র সন্তানের জ্বালা দিলীপ জানে। এইযে তিনটা মাস ধরে মৌলী আর মৌলীর মা এই বাড়িতে। অশান্তি লাগে তার– মেয়ে ছাড়া একলা বাড়ি মনে হয় কামড়াইতে আসে।
বাবু, তুমি আসছো?
দিলীপ হতভম্ব হয়ে তাকায়ে আছে মৌলীর দিকে, পায়ের কাছে সাষ্টাঙ্গপ্রণাম নিয়া আছে সে । মেয়েরে চেনা যায় না, মনে হয় পনেরো দিনে আরো এক বিঘত লম্বা হয়ে গেছে… চুল লম্বায় বাড়ছে আরো বেশী। সিঁথিতে মোটা করে মেটে সিঁদুর আঁকা। বাচ্চা মেয়ের এই দুর্দশা দেখে দিলীপের কান্না আসে। গতবার এসে দেখছে ঘাটলায় হাড়িবাসন নিয়ে বসা , হাত ভর্তি কালী। দৌড়ে এসে বলতেছিলো, বাবু! গত রাতেই তোমাকে স্বপ্নে দেখেছি, দেখেছি তুমি দুইটা ধুতি কিনেছো– একটা মেয়ে জামাইর জন্যে, অন্যটা তোমার।
দিলীপের দুশ্চিন্তার সীমা নাই। তার মেয়ে ফিল্ম করতে এসে ক্যারেক্টারে ঢুকে গেছে এইটা ভালো। তেরো বছরেও নিজেরে গিন্নি ভাবতেছে এইটাও মেনে নেয়া যায়। থালবাসন, ঝাড়ামোছা, কাপড় ধোয়া চললে চলুক। কিন্তু ‘জাহিদ’ নামের ছেলেটারে স্বামীজ্ঞান করে– এইটা কেমন কথা!
ফিল্মে জাহিদ ‘অসীম’ এর রোল প্লে করতেছে। সেও ধুতি- পৈতা পরে সারাদিন ঘুরে। কিন্তু মৌলীর মতো সিরিয়াস না, সে স্বাভাবিক । কিন্তু একটা মুসলমান ছেলেরে মৌলীর সত্যিকারের স্বামী মনে করাটা… দিলীপের জন্য দুশ্চিন্তার । এই ছেলের জন্য তার মেয়ে লোকনাথ বাবার আশ্রমে গিয়ে মোমবাতি দিয়ে আসছে।
মৌলী বলে, বাবু! মোমবাতি নেবো চারটা। একটা তোমার, একটা মায়ের, আরেকটা আমার আর আরেকটা উনির।
দিলীপ অবাক হয়ে বলছিলো, উনিটা কে? তোমার প্রবীর কাকু?
মৌলী লজ্জা পেয়ে বলতেছিলো, নাম কেমনে বলি? অমঙ্গল হবে না !
দিলীপ খুব বিরক্ত হয় মেয়ের কথায়। ফিল্ম করা পর্যন্ত ঠিক আছে, কিন্তু একটা বাচ্চা মেয়ের মাথাটা যে বিগড়ায়ে গেল– এর ফলাফল কী হবে কে জানে!
পালবাড়ির উঠানে ছয়টা হ্যাজাক জ্বলতেছে। একটা হ্যাজাক নষ্ট, ঐটার কলকব্জা খুলে পরিষ্কার করতেছে জাহিদ। তার মুখচোখ অন্ধকার। প্রবীরদা আজকে সবার সামনে তারে বকাঝকা করছে।সারটাদিন ধুতি ফতুয়া পরে থাকতে হয়, চুল দাড়ি কাটা নিষেধ– গোসল করাও নিষেধ। মাথা ভর্তি উকুন আর ময়লা। এর মধ্যে সেটের কাজ, নালা কাটা, ঘাস লাগানো থেকে কলসী দিয়ে পানি টানা–সব কিছু করতে হয় তার। এতো কাজের পরও কথা শুনতে হয়। আজকে বিকালে মিটিংয়ে প্রবীরদা সবার সামনে ওরে খুব লজ্জার কথা বলছে। সেখানে মৌলীর বাবা মা, বাড়ির কেয়ারটেকার মনোজদাও উপস্থিত ছিলো।
কথা নাই বার্তা নাই, প্রবীরদা বলে-
অসীম, তুমি যাও– চা বানায়ে আনো। এইভাবে বসে থাকবে না। পুরুষমানুষের সবসময় কাজের মধ্যে থাকতে হয়, আর যদি নিতান্তই কোনো কাজ না থাকে– তবে সেই সময় পুরুষ মানুষের কী করতে হয় জানো?–নিজের বিচি চুলকাইতে হয়, বুঝলা?
ঘটনা এখানেই শেষ না, এই কথা শোনার পর মৌলীর বিশাল সিনক্রিয়েট পুরা পরিবেশটা থমথমে করে দিছে।
প্রবীরদার আরেকটা বিষয় যেইটা জাহিদের খুব খারাপ লাগে, সেটা হইলো সবাইরে ক্যারেক্টার যে নামে আছে সে নামেই ডাকা। নিজের নাম যে জাহিদ সেইটাই আজকাল মনে থাকেনা। মৌলী মেয়েটার জন্য বেশী খারাপ লাগে। বাচ্চা একটা মেয়ে ক্যারেক্টার থেকে বের হতে পারতেছেনা। কালকে সকালে ওর চলে যাওয়ার কথা। ক্যাম্পে আসার প্রথম সপ্তাহেই মৌলীর ডেথ সিনটার শ্যুটিং এর কথা ভুলতে পারেনা জাহিদ। এইটার গ্রুমিংয়ের জন্য মৌলীরে তিনদিন শুধু নিথর হয়ে শোয়ায়ে রাখা হইছিলো। শরীরে পিঁপড়া উঠানোর জন্য চিনির শিরা মেখে…। ঐ ঘটনার একটা ইমপ্যাক্ট তো আছেই, মৌলী ওইটার পর থেকেই কেমন যেন হয়ে গেলো। মা হয়ে কাবেরী দিদি বিষয়টা ধরতে পারতেছেনা, প্রবীরদাও খুব খুশী। কিন্তু জাহিদ জানে, ঘটনা খারাপ।
শুক্রবার সকালবেলা। মৌলীর বাবা-মা রেডি।ব্যাগট্যাগ গোছানো শেষ। মৌলি কিছুতেই অন্য জামা পরবে না। কপালে সিঁদুর , হাতে শাখা নিয়ে বসে কানতেছে। তার গায়ে একপ্যাঁচে পরা গরদের শাড়ি। কারো কথা সে শুনবে না। ডিরেক্টর মৌলীর থুতনী ঝাকায়ে অল্প অল্প বকা দিতেছে, একটু আদুরে বকা।
মা! এই মা! তুই এতো বোকা কেন রে? তুই তো মৌলী।
না, তুমি মিথ্যা বলো কেনো? আমি রঞ্জনা।
ধুর পাগলী, রঞ্জনা তো সেই কবে মরে গেছে। তুই তো এ্যাক্ট্রেস–গ্রেট আর্টিস্ট তুই।
মৌলী প্রবীরের হাঁটু জড়ায়ে ধরে কাঁদতেছে–
আমি চলে গেলে তুলসীমঞ্চে প্রদীপ দেবে কে? ঠাকুরঘর ধুবে কে? পুকুরের জলে পা ডুবায়ে মাছ দেখবে কে? তুমি রঞ্জনা বলে কারে ডাকবে!
প্রবীর কানতেছে, মৌলীও। প্রবীরের হাঁটু থেকে হাত ছাড়ায়ে কাবেরী তার মেয়েরে নিয়ে সামনে আগায়ে যায়। সবাই তাকায়ে আছে মৌলীর দিকে। এমন দৃশ্য বোধকরি তারা আগে কখনও দেখে নাই।
প্রবীরের নিঃশ্বাসে খুব যন্ত্রণা । বুকে চাপ দিয়ে ধরতেছে। লক্ষণ মোটেই ভালোনা। দেরী করা ঠিক হবেনা। ঢাকার জন্য রওনা দেয়া জরুরী, গাড়ি ডাকতে হবে। এ্যাম্বুলেন্স হলে আরো ভালো হয়।
এই অসীম, এই… শোন।
জাহিদ সহ সবাই মৌলীদের আগায়ে দিতে সামনে গেছে। মৌলী পালবাড়ির ফটকের সামনে তুলসীমঞ্চে মাথা ঠেকায়ে–প্রবীর স্পষ্ট দেখতেছে। প্রবীরের ডান হাত অবশ হয়ে আসতেছে। চেয়ারের হাতলে ভর দিয়েও সে উঠতে পারতেছে না। মাত্র দশ গজ দূরে সবাই, অথচ প্রবীরের গলা সেই পর্যন্ত…। কন্ঠনালী চেপে আসতেছে। মনে হয় যেন, ভেতর থেকে এক টনের একটা পাথর জিভের গোড়া দিয়ে ঝুলানো।
প্রবীর চেয়ার নিয়া মাটিতে আছড়ায়ে পড়ে–শুনতে পায় দোতালায় জ্যানিথ চিকন স্বরে ডাকতেছে, তার এই ডাক অাযানের মতো করুণ।