গ্রিক দার্শনিক এপিকিউরাস (৩৪২-২৭০ খ্রিস্টপূর্ব) প্রাচীন বস্তুবাদী, মানবতাবাদী দার্শনিক হিসেবে বিখ্যাত, তাঁর দর্শন এপিকিউরিয়ানবাদ, সুখবাদ নামেও পরিচিত। দার্শনিকেরা যদিও নিজেদের মধ্যে তর্ক-বিতর্কে, ঝগড়ায় লিপ্ত হতেন কিন্তু একটা ব্যাপারে সবার মধ্যে মিল ছিল, প্রাচীন কাল থেকে প্রায় সব বিখ্যাত দার্শনিক ঘরাণা এপিকিউরাসের দর্শনের বিরোধী ছিলেন। সংশয়বাদীদের কাছে সে ছিল গোঁড়া বেকুব। খ্রিস্টান ধর্মও গ্রিক দার্শনিকদের মত তাকে পরিত্যাগ করে। যদিও অনেকবার তার বিরুদ্ধে চালু এসব অভিযোগ খন্ডন করা হয়েছে তবু প্রাচীন কাল থেকে এখন পর্যন্ত এপিকিউরাসের নামে যে বদনাম চালু আছে সেটা হল, এপিকিউরাস ঈশ্বরত্যাগী, আনন্দ উল্লাসে উন্মত্ত একজন শিক্ষক। যার নিকট বস্তুগত ভোগ হল সবচেয়ে সুখের বিষয়, এবং এর বাইরে সে কিছু জানে না।
এপিকিউরাস ছিলেন একজন স্বশিক্ষিত দার্শনিক, তিনি নিজে কোন দার্শনিক ঘরাণার সদস্য ছিলেন না, কিন্তু ডেমোক্রিটাসের দর্শন খুব ভালভাবে জানতেন। তাঁর সমসাময়িক হলেও এপিকিউরাসের প্লেটো বা এরিস্টটলের দর্শন সম্বন্ধে কোন ধারণা ছিল না।
নিজস্ব দর্শন চর্চা এবং সমমনা মানুষদের নিয়ে থাকার জন্য তার একটা একাডেমি ছিল, যাকে তারা ‘বাগান’ বলত। সে বাগান ছিল সমাজের ব্রাত্যজন যেমন, দাস-দাসী, নারী, রক্ষিতা ইত্যাদি সবার জন্য উন্মুক্ত। সভায় যোগদানের জন্য জন্ম পরিচয়, পরিবার এবং ধন-সম্পত্তি কোন বাধা হিসেবে পরিগণিত হত না।
এপিকিউরাস তাঁর দর্শনে সুখের সন্ধান করেছেন। জন্ম থেকে আমরা সুখটাকে উপভোগ করি, আর দুঃখ-কষ্টকে পরিহার করার চেষ্টা করি। দর্শনের লক্ষ্যই হল সুখ অর্জন করা। উল্লেখ্য, দর্শনের মাধ্যমে আনন্দ খোঁজার ব্যাপারে ইপকিউরাস একা নন, ভারতীয় দর্শনেও আমরা শুনি, জীবনের লক্ষ্য হল আমাদের শরীরের আনন্দময় কোষগুলোকে জাগানো। কিন্তু দর্শনের প্রতি সাধারণ মানুষের অনীহা দেখে এপিকিউরাস বলেন, “যারা বলে দর্শনের সময় এখনও আসেনি অথবা চলে গেছে তারা আসলে বলতে চায়, সুখের সময় এখনও আসেনি অথবা চলে গেছে।”
“Whoever says that the age for philosophy has not yet come or is already past is like the man who says that the age for happiness is not yet come to him or has passed way.”
কেন আমরা সুখের সন্ধান করব?
কারণ মানুষের জীবন দুঃখময়। এখানে মনে রাখা দরকার, এপিকিউরাসের ঠিক দু’শ আগে ভারতবর্ষে গৌতম বুদ্ধ ঠিক একই কথা বলে গেছেন, কিন্তু একই জায়গা থেকে শুরু করেও দুজনের দর্শন সম্পূর্ণ ভিন্ন জায়গায় গিয়ে পৌঁছেছে। মানুষ নানাবিধ দুঃখ-দুর্দশা, ভয়-ভীতি আর শারীরিক-মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে থাকে। এপিকিউরাসের মতে এ দুর্দশার পেছনে তিনটা কারণ জড়িতঃ প্রথমত, দুনিয়ার কাজ-কর্ম নিয়ন্ত্রণ করে এমন ঈশ্বরে বিশ্বাস, মানুষের প্রতি তাদের আচরণ থেকে যাদের উদ্দেশ্য বোঝা মুশকিল। দ্বিতীয়ত, মৃত্যু এবং তৎপরবর্তী জীবন সম্পর্কে ভুল ধারণা। এবং তৃতীয়ত, আমাদের বস্তুগত প্রয়োজন এবং শারীরিক অবস্থানের জন্য কষ্ট, দুর্ভোগ।
ঈশ্বর ভীতি, মৃত্যু ভীতি এবং শারীরিক কষ্ট আমাদের যাবতীয় দুর্দশার মূল কারণ, তাই এদের অবশ্যই দূর করতে হবে।
এপিকিউরাসের দর্শন এ ত্রিবিধ কষ্ট দূর করার বিধান দেয়। প্রথমত, কাউকে ঈশ্বরে ভয় পাবার দরকার নেই। দ্বিতীয়ত, মৃত্যু মানে ইন্দ্রিয়ানুভূতির লোপ, তাই সেটা আমাদের জন্য কিছুই না। তৃতীয়ত, ভাল কিছু সহজেই অর্জন করা যায়, আর মন্দকে সহজে সহ্য করা যায়। তিন নম্বর পয়েন্টকে যদি দুটি পৃথক নিদান হিসেবে দেখা যায় তাহলে আমরা এপিকিউরিয়ান দর্শনের চার স্তরের (tetra-pharmakon) উপশম পাই। একে বুদ্ধের চার আর্যসূত্রের সাথে তুলনা করা যেতে পারে।
গ্রিক দর্শনে প্রায়ই দর্শনকে ঔষধের সাথে তুলনা করা হয়। দর্শন আত্মার কষ্ট উপশম করে। দার্শনিক ডেমোক্রিটাস এ ধরণের তুলনা করেছেন, সক্রেটিস এবং প্লেটোও তাই করেছেন। স্টইকদের দর্শনেও এ ধারণা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। ঔষধ যেমন শারীরিক রোগ-বালাই দূর করে; দর্শন তেমনি আত্মাকে নানাবিধ আবেগ থেকে মুক্তি দেয়। যেসব দর্শন সেটা করতে পারে না সেসব দর্শন ফাঁকাবুলি ছাড়া আর কিছু নয়।
আনন্দ কী? সুখের জন্য আমাদের আনন্দের দরকার কেন?
আমাদের সত্ত্বা নিত্য আনন্দময়, এর বৈশিষ্ট্যই হল আনন্দে থাকা। তাই আমাদের স্বভাবে আনন্দ আছে কিন্ত সেটা নানাবিধ আবরণে ঢাকা। এজন্য বাহ্যিক কিছু থেকে আনন্দ নিলে সেটা হয় ক্ষণস্থায়ী, চিরস্থায়ী আনন্দের জন্য বরং আমাদের ভেতরের আনন্দময় সত্ত্বাকে মুক্ত করতে হবে, তাকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ কারণে আমরা দেখি দর্শনে আনন্দকে সবসময় ঋণাত্মকভাবে বুঝানো হয়ঃ আনন্দ মানে দুঃখের অবসান, আনন্দ মানে কষ্টের অনুপস্থিতি। আমরা আনন্দের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি যখন আনন্দের অভাব হয়, যখন আমরা কষ্ট ভোগ করি। কিন্তু যদি আমরা কষ্ট বা ব্যথা অনুভব না করি, তাহলে তখন আমাদের আর আনন্দ খোঁজারও প্রয়োজন পড়ে না।
“We feel a need for pleasure only when, due to its absence, we experience pain. But if we do not feel pain, pleasure is not needed any longer, either.” (Letter to Menoikeus)
সর্বোচ্চ আনন্দ কখনই শক্তিশালী নেশা বা অপরিমিত ভোগের থেকে আসে না, বরং এর পরিণামে নতুন দুঃখ-কষ্ট ভোগ করতে হয়। আত্মার শান্তি আসে নিশ্চল স্থিরতা থেকে, কিন্তু শারীরিক আনন্দ এর বিপরীত, শারীরিক আনন্দ আসে গতিময়তা থেকে। তাই বলে শারীরিক আনন্দকে অস্বীকার করা ঠিক না, আত্মার শান্তি এবং আনন্দের জন্য শারীরিক আনন্দের প্রয়োজন আছে।
শারীরিক আনন্দ আমাদের আত্মারই একটা অংশ। শারীরিক আনন্দময় অভিজ্ঞতা বা শারীরিক আনন্দের পূর্বাভাস আত্মাকে শান্ত করে। কিন্তু সব ধরণের সুখ-শান্তির মূলে হল পেট। পেট শান্তি তো দুনিয়া শান্তি।
“The beginning and the root of all good is the pleasure of the stomach; even wisdom and culture must be referred to it.”
যার পেট ভরা, খাবারের নিশ্চয়তা আছে যার, ক্ষুধা-তৃষ্ণায়, শীতে যাকে কষ্ট পেতে হয় না, দেবতা জিউসের সাথে তার তুলনা চলে।
বিশুদ্ধ আনন্দ লাভের জন্য আমাদের কী করতে হবে?
মুক্তির পথ হল দর্শনের পথ। তাই প্রথমে দুনিয়া, বাস্তব জগত, মানুষ, আত্মা এবং ঈশ্বর (ভয়) সম্বন্ধে সঠিক জ্ঞান লাভ করতে হবে। তারপরে মৃত্যু ভয় কাটাতে হবে, এবং সবেশেষে শরীর এবং এর চাহিদা সম্পর্কে একটা সুস্থ এটিচুড থাকতে হবে।
দুনিয়া সম্বন্ধে এপিকিউরাসের জ্ঞান আসে ডেমোক্রিটাসের পরমাণুর ধারণা থেকে। জগতে আছে শুধু পরমাণু এবং ফাঁকা স্থান, এরা চিরস্থায়ী, কখনো ধ্বংস হয় না। শুন্য থেকে কোন কিছু সৃষ্টি হয় না, আবার যেসব বস্তু আছে তারাও শুন্যে মিলিয়ে যায় না। যদি তাই হত তাহলে আমরা কোন কিছু দেখতে পেতাম না সবকিছু শুন্যে মিলিয়ে যেত। (Conservation of matter and energy). আমরা দেখতে পাচ্ছি মহাবিশ্বে বস্তু সৃষ্টি হয় আবার মিলিয়ে যায় এবং নতুন বস্তুর সৃষ্টি হয়। বস্তুর গঠনের মূলে আছে পরমাণু, একমাত্র পরমাণুই চিরস্থায়ী।
আত্মা কোন বিমূর্ত ধারণা নয়, আত্মারও অবয়ব আছে, সূক্ষতম পরমাণুর সমন্বয়ে আত্মা গঠিত। আত্মার কঠিনত্বের প্রমাণ হল আত্মা কাজ করতে পারে, তার উপরে কাজ করা যায় এবং আত্মা ব্যথিত হয়, এবং কেবল গতিশীল বস্তুই ব্যথা বোধ করে। আত্মার বোধশক্তি আছে, বহির্বিশ্ব থেকে বস্তুর ছায়া আমাদের আত্মায় প্রবেশ করে আমাদের বোধ জন্মায়।
ঈশ্বর কোন জগতে বাস করেন না, কিন্তু তারা অন্তর্বতী জগতের বাসিন্দা। তারা সবচেয়ে সূক্ষ পরমাণু দিয়ে তৈরি। তাদের ছবি (eidola) স্পেসে চিন্তার গতিতে ভ্রমণ করে। তারা মানুষের রূপ ধারণ করে। স্বপ্নে সব জাতির মানুষের মধ্যে তারা দেখা দেন। ঈশ্বরেরা চিরঞ্জীব, আনন্দময় প্রাণ, অনায়াস অবস্থান, কোন কাজ ছাড়া থাকেন। তারা মানুষের ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে মাথা ঘামান না। মানুষ তাদেরকে ইমেজ দিয়ে চেনে এবং তারা মানুষের চিন্তায় ধরা দেন। যে বহু মানুষের ঈশ্বরকে স্বীকার করে না সে অধার্মিক নয়, কিন্তু যে বহু মানুষের ধারণাকে ঈশ্বরের উপর আরোপ করে সেই অধার্মিক।
“And the impious man is not he who denies the gods of the many, but he who attaches to the gods the beliefs of the many.”
মৃত্যু সম্বন্ধে সঠিক জ্ঞানঃ
মৃত্যুতে আত্মার পরমাণুগুলো ছড়িয়ে পড়ে। আত্মার জন্য কোন মৃত্যু পরবর্তী জীবন নেই। শবদেহের কোন অনুভূতি থাকে না। মৃত্যু আমাদের কাছে কিছু না, “Death is nothing to us”, কারণ আমরা যা অনুভব করতে পারি না সেটা আমাদের উদ্বিগ্ন করে না।
যতক্ষণ আমরা জীবিত থাকি, ততক্ষণ মৃত্যু আমাদের সাথে থাকে না; আবার মৃত্যু যখন আসে, তখন আমরা থাকি না, কিছু অনুভব করতে পারি না। মৃত্যু তাই জীবিত বা মৃত কারোই উদ্বেগের বিষয় নয়। বেঁচে থাকার মধ্যে ভয়ঙ্কর কিছু নাই। বেঁচে থাকতে ক্লান্ত হয়ে নিজেকে মৃত্যুর কাছে সঁপে দেয়ার মত হাস্যকর কিছু আর হয় না। আরও খারাপ হল যে বলে জন্ম না নেয়াটাই ভাল ছিল। একজন দার্শনিক জীবনকে কখনও দায়ী করে না, সে জীবন ভালবাসে।
“So long as we exist, death is not with us; but when death comes then we do not exist. It does not then concern either the living or the dead.”
শারীরিক চাহিদা সম্পর্কে সচেতনতাঃ
আমাদের সকল ক্ষুধা তৃপ্তি পেতে চায়। তৃপ্তি এবং আনন্দই তাদের একমাত্র কামনা, এজন্য আমরা তাদের দোষী সাব্যস্ত করতে পারি না। কোন আনন্দই নিজে থেকে মন্দ নয়। ক্ষুধা-তৃষ্ণা প্রাকৃতিক অথবা আমাদের নিজেদের মনগড়া। তবে আমাদের কখনই প্রকৃতির নিয়মের বাইরে যাওয়া উচিত নয়, বরং আমাদের কামনা-বাসনাকে চরিতার্থ করতে প্রাকৃতিক নিয়ম-কানুন মেনে চলা উচিত।
জীবনের নিয়মঃ
এপিকিউরাস জীবন চলার পথে অনেক উপদেশ দিয়ে গেছেন। ভবিষ্যত নিয়ে দুশ্চিন্তা না করে আমাদের বর্তমান সম্বন্ধে সচেতন হওয়া উচিত। এপিকিউরাসের অনুসারী রোমান কবি হোরেসের (৬৫-৮ খ্রিস্টপূর্ব) বিখ্যাত বাণী, ‘carpe diem!’ বা বর্তমান সময়ে থাকো/বাঁচো। হোরেস নিজেকে এপিকিউরাসের খোঁয়াড়ের শুকর হিসেবে ( a pig of Epicurus’ herd) পরিচয় দিতেন।
“In the moment of our talking, envious time has ebb’d away.
Seize the present; trust tomorrow e’en as little as you may.”
“আগামীকাল সম্পর্কে যে সবচেয়ে কম দুশ্চিন্তা করে সেই আগামীর পথে সবচেয়ে বেশি আনন্দের সাথে এগিয়ে যেতে পারে।”
একজন ভাল মানুষ সবেচেয়ে বেশি মূল্য দেয় প্রজ্ঞা এবং বন্ধুত্বকে। বন্ধুত্বের চেয়ে বড় সম্পদ, বড় আনন্দের আর কিছু নাই। বন্ধুত্ব জীবনের চলার পথে বৈচিত্র্য নিয়ে আসে। কিন্তু মানব প্রকৃতি শুধু শুধু ভালবাসে না, এবং বেনেফিট ছাড়া বন্ধুত্বের সম্পর্কে জড়ায় না।
“বন্ধুকে ব্যবহার করার জন্য বন্ধুত্ব পাতাবার দরকার নেই, এ বিশ্বাসে বন্ধুত্ব করা দরকার যে প্রয়োজনে তাদেরকে ব্যবহার করা যাবে।”
বন্ধুর জন্য সহানুভূতি দেখাতে আমাদের তাদের সাথে কাঁদার প্রয়োজন নেই, বরং তাদের কীভাবে উপকার করা যায় সেটা করা দরকার।
যদিও আমরা আনন্দের জন্য বন্ধুত্বের সম্পর্কে জড়াই, কিন্তু বন্ধুত্বের কারণেই আমরা সবচেয়ে বেশি ব্যথিত হই।
খুব তাড়াতাড়ি বন্ধুত্বের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া বা বন্ধুত্ব নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগা কোনটাই প্রশংসনীয় নয়। বন্ধুত্বের খাতিরে কিছুটা রিস্ক নিতে দ্বিধা করা উচিত না।
সামাজিক সম্পর্কঃ
এপিকিউরাস রাজনীতি বিমুখ ছিলেন, জ্ঞানী মানুষ রাজনীতিতে জড়াবে না এবং কখনই শাসক হতে চাইবে না।
বেশি মানুষের কাছ থেকে দূরে থাকো! “ আমি কখনই বেশি মানুষের সঙ্গ পছন্দ করি না, কারণ আমি জানি না কীভাবে তাদের খুশি করাতে হয়; আর আমি যা জানি সেটা তাদের বোধগম্যতার বাইরে।”
আর যদি বেশি মানুষের মধ্যে বাস করতেই হয়, তাহলে নিজেকে নিজের মধ্যে গুটিয়ে নাও।
ধর্মঃ
এপিকিউরাসের অনুসারীরা তাঁকে একজন সাধু হিসেবে জানতেন। একজন সাধু, দার্শনিক ঈশ্বরকে সম্মান করবে। “The sage will venerate the gods.” ঈশ্বর যারা অন্তর্বর্তীকালীন জগতে চিরঞ্জীব হয়ে আছেন, যারা সব সময় অনাবিল আনন্দে থাকেন, সাধু নিজেকে তাদের কাতারে ওঠাতে চাইবেন। ঈশ্বরের চিন্তায় তারা তাদের নিজের লক্ষ্য পূরণ করবেন।
দারিদ্রতা ও সম্পত্তিঃ
স্বাধীন জীবন যাপন করতে হলে বেশি জিনিস থাকা চলবে না, কারণ ক্ষমতাসীন মানুষ বা অমার্জিত জনগোষ্ঠির কাছে নতি স্বীকার না করে বেশি জিনিস অর্জন করা যায় না। কিন্তু যদি কোন কারণে ধন-সম্পত্তি হাতে আসে, তাহলে সেটা প্রতিবেশীর উপকারের জন্য খরচ করা যেতে পারে। টাকা-পয়সা, ধন-দৌলত, প্রভাব-প্রতিপত্তি, ক্ষমতা দিয়ে সুখ আসে না, বরং একমাত্র স্বাধীনতা, আবেগের নিয়ন্ত্রণ, এবং প্রাকৃতিক জীবনের লক্ষ্য নিয়ে আত্মার সন্তুষ্টি থেকে সুখ আসে।
সোনার চেয়ার-টেবিলে বসে শান্তি হারানোর চেয়ে মানসিক স্থিরতা নিয়ে খড়ের গাদায় শুয়েও আরাম, বেশি সুখ।
এপিকিউরাসের দর্শনের সমালোচনাঃ
এপিকিউরাসের দর্শনের সাথে এক্সিয়াল যুগের আরেক দর্শন বৌদ্ধ দর্শনের অনেক মিল পাওয়া যায়। বৌদ্ধ দর্শন এবং এপিকিউরিয়ান দর্শন দুটোই প্রতিবাদী দর্শন। দু’ দর্শনেই দুঃখ-কষ্টময় জীবন থেকে মানুষকে মুক্তি দেবার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করতে দেখা যায়। তবে তাদের মধ্যে পার্থক্যও অনেক। বৌদ্ধ দর্শন অবস্তুবাদী, বস্তু স্বীকার করে না, অপরদিকে এপিকিউরাসের দর্শনে বস্তু বা এটম নিত্য, এর কোন ক্ষয় নেই। বৌদ্ধ বস্তুর মত আত্মাকেও স্বীকার করেন না, কিন্তু এপিকিউরাস আত্মাকে স্বীকার করেন। দু’ দর্শনেই ঈশ্বর বিশ্বাস নিয়ে সংশয় দেখা যায়। বৌদ্ধ ঈশ্বর আছে কী নেই এ ব্যাপারে নিরুত্তর, অপরদিকে এপিকিউরাস ঈশ্বর (গ্রিক) আছে স্বীকার করেন, কিন্তু তারা অন্তর্বর্তী জগতে থাকেন, দুনিয়ার কোন কিছু নিয়ে মাথা ঘামান না, জগত চলে তার জাগতিক নিয়মে।
ডেমোক্রিটাসের সাথে এপিকিউরাসের দর্শনের মিল এবং অমিল নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। এপিকিউরাসের দর্শন ডেমোক্রিটাসের কণাবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত, কিন্তু তাদের দুজনের দর্শনে মৌলিক পার্থক্য আছে। এদের দুজনের দর্শনের পার্থক্য নিয়ে কার্ল মার্ক্স তার পিএইচডি অভিসন্দর্ভ রচনা করেন, “The Difference Between the Democritean and Epicurean Philosophy of Nature”। মার্ক্সের মতে, যে কোন ঘটনার ব্যাখ্যায় দুটি ভিন্ন পথ নেয়া যায়, একটা হলো, ‘সবই চান্স বা দৈবক্রমে ঘটছে’, অথবা, ‘সবই প্রয়োজনের ফলে ঘটছে’। এপিকিউরাস ছিলেন প্রথম ধারার অনুসারী, অপরদিকে ডেমোক্রিটাস দ্বিতীয় ধারার অনুসারী।
কণা থেকে যদি সব সৃষ্টি হয় তাহলে জীব এবং জড়বস্তুর সংগঠনের মধ্যে বিশাল ফারাক রয়ে গেছে। প্রাণির দৈহিকতা এবং চেতনার মধ্যেও পার্থক্য আছে। কীভাবে কোন রকমের পদ্ধতি ছাড়া একটা থেকে আরেকটায় পৌঁছানো সম্ভব?
কার্য-কারণ এবং অর্থবোধক সমন্বয়ের মধ্যে পার্থক্য আছে। কণাবাদের মতে জৈব সংগঠন দৈবক্রমে মিলিত পরমাণুর সমষ্টি মাত্র যেটা দৈবক্রমে সৃষ্ট অবয়ব নিয়ে টিকে থাকে। এর সাথে তুলনায় বলা যেতে পারে, ‘সকল কবিতা হল বর্ণমালার বিভিন্ন অক্ষরের সমাবেশ মাত্র’, কবিতার মাত্রা, লয়, ছন্দ নিছক দৈব দূর্ঘটনা। এপিকিউরাসের দর্শন সম্ভাবনার উপর নির্ভর করে, কোন বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান বা গঠনমূলক পর্যবেক্ষণ এর ভিত্তি নয়। এপিকিউরাসের কাছে যা স্বজ্ঞায় (ইনটুইশান) প্রামাণ্য বলে বোধ হয়, তার দর্শনে সেটাকে আনুমানিক তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হয়।
উপসংহারঃ
এপিকিউরাসের দর্শন মানুষের জীবনকে সুখময় করার জন্য। তার দর্শনের অনুসারীদের মধ্যে কোন জাত-পাতের ভেদাভেদ ছিল না, সেই প্রাচীন কালে সমাজের সবস্তরের মানুষকে তিনি তাঁর দর্শনের ছায়াতলে আসার সুযোগ দেন। যেটা তখনকার উচ্চবিত্ত, সমাজপতিদের রোষের অন্যতম কারণ বলে মনে করা হয়। তার দর্শন এজন্য মানবতাবাদী। রাজনীতি এবং গণ মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন জীবনের আহবান তাঁর দর্শনের একটা দূর্বল দিক। ঈশ্বর সম্বন্ধে তাঁর চিন্তা-ধারাও ছিল বিপ্লবী। তাঁর দর্শন মানুষকে ঈশ্বর এবং মৃত্যুভয়ে ভীত না হয়ে বাস্তব জগতে আনন্দময় জীবন যাপনে উদ্বুদ্ধ করে। ডেমোক্রিটাসের মত পরমাণুকে চিরন্তন ভাবলেও তাঁর দর্শন সত্য, ঈশ্বর সম্পর্কিত চিন্তা এবং জগতের উৎপত্তি নিয়ে ডেমোক্রিটাসের চেয়ে ভিন্ন ছিল। তাঁর দর্শনকে সেজন্য প্রাচীন কালের বৈজ্ঞানিক দর্শনের সূত্রপাত বলে মনে করা হয়। দার্শনিক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও যুগে যুগে মানবতাবাদী, বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার অনুসারী মানুষদের মাঝে এপিকিউরাসের দর্শন একটা প্রেরণা হয়ে থাকবে।
নভেম্বর ৪, ২০১৭; ৫:৪৮ অপরাহ্ন
আমি যতটা বুঝেছি, এপিকিউরাস ছিলেন মূলত ভোগবাদ-এর (এপিকিউরিয়ানিজম) জনক। বর্তমান ভোগবাদী পাশ্চাত্য সমাজ অনেকটা তারই ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে । অথচ বন্ধুরা বলেন মানবতাবাদের আধার হচ্ছে চীন, রাশিয়া, কিউবা। কেমন যেন গোলমেলে লাগছে। শোষণমূলক পুজিবাদী, ভোগবাদী পাশ্চাত্য সমাজ ব্যবস্থার সাথে মানবতাবাদের কোন সম্পর্ক থাকতে পারে কি?