১৫২৮ বার পঠিত
ইস্ট বেঙ্গল কোম্পানিতে দিনমান ‘এসো দুর্নীতি করি’ শীর্ষক কর্মশালা চলে। সমাজের নানা পেশা শ্রেণির মানুষ সে প্রশিক্ষণে যোগ দেয়। নবজাত সন্তান কোলে মায়েরা যোগ দেন সে কর্মশালায়।
প্রত্যেকটি প্রশিক্ষণের আগে প্রশিক্ষকরা জানিয়ে দেন, এই প্রশিক্ষণের সঙ্গে রাজনৈতিক আদর্শের কোন সম্পর্ক নেই। এ প্রশিক্ষণ আপনাকে ক্ষমতা-কাঠামোতে চিরস্থায়ী জায়গা করে দেবে। ক্ষমতার বেনিফিশিয়ারি হবেন আপনি।
প্রতিদিনের প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষণার্থীদের আগ্রহ বাড়তে থাকে। রিসোর্স পারসনেরা আসেন; শেখাতে থাকেন ক্ষমতার প্রাসাদে নৃত্যের কলাকৈবল্য।
এক রাজনৈতিক নেতা বলেন, আমাদের লক্ষ্য সংসদের নব্বুই
ভাগ আসন ব্যবসায়ীদের দখলে আনা। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতবর্ষের ক্ষমতা দখলের মাধ্যমে যেভাবে বণিকের মানদণ্ডকে রাজদণ্ডরূপে প্রতিষ্ঠিত করেছিলো; ইস্ট বেঙ্গল কোম্পানির উদ্দেশ্যও একই। আমরা দেশের ভেতরেই উপনিবেশ তৈরি করবো। আপনারা হয়ে উঠবেন এক একজন লর্ড ক্লাইভ।
এক সাবেক আমলা প্রশিক্ষণে বক্তৃতার সময় মহানগরীর মানচিত্র খুলে দেখান, নগরীর আদি বাসিন্দাদের পুরান নগরে রেখে; নতুন নগরে প্লট নিয়েছেন, রাজনৈতিক নেতা, সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী, ঠিকাদার আর কিছু সরকারি সেবক জনতা (সসেজ)। কাজেই এই কয়েকটি চিরস্থায়ী পেশার জন্য আপনাদের গড়ে তোলাই আমাদের লক্ষ্য।
ইস্ট বেঙ্গল কোম্পানিতে ঠিকাদারদের হাতে-কলমে প্রশিক্ষণের সময় শেখানো হয়, কীভাবে দালান নির্মাণে রডের পরিবর্তে বাঁশ ব্যবহার করতে হয়, রেললাইনে স্লিপারের পরিবর্তে বাঁশ দিতে হয়। আরো শেখানো হয় কীভাবে প্রকল্প কর্মকর্তা ও প্রকৌশলীদের ঘুষ দিয়ে ম্যানেজ করতে হবে। কিংবা কিভাবে বালিশ সরবরাহের সময় বালিশের দাম নির্ধারণ করতে হবে। কীকরে হাসপাতালের জন্য উচ্চমূল্যে স্ট্রেথিসস্কোপ, মেডিক্যাল শাস্ত্রের বই কিনতে হবে; আর এসব কাজে প্রকল্প কর্মকর্তা ও ডাক্তারদের ঘুষ দিয়ে ম্যানেজ করতে হবে।
বেসামরিক কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণে ঘুষ দিয়ে লুক্রেটিভ পোস্টিং ম্যানেজ করে দুবছরে একশো গুণ ঘুষ খেয়ে নিরাপদে বিদেশে পাচারের কলাকৌশল শেখানো হয়।
সামরিক কর্মকর্তাদের শেখানো হয় কীভাবে ব্যবসায়ী সাংসদদের সমর্থন দিয়ে টিকিয়ে রাখতে হবে; নিজেদের ব্যবসা-বানিজ্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর ভুলে গেলে চলবে না, অস্ত্রই ক্ষমতার মেরুদণ্ড।
পুলিশ ও সেনা সমন্বয়ে গঠিত এলিটফোর্সকে শেখানো হয়, বাগানকে পরিচ্ছন্ন রাখতে যেমন আগাছা কেটে ফেলতে হয়; ঠিক ঐ রকম করে যেসব নাগরিককে আগাছা মনে হবে তাদের উপড়ে ফেলতে হবে। কারণ সাধারণ মানুষের জীবন আগাছার মতো গুরুত্বহীন; কর্তনযোগ্য।
সরকারি সেবক জনতাকে শেখানো হয়, কী করে সরকারের ভুল গুলোকে ফুল করে ফোটাতে হবে। সত্য ঘটনাকে সতত অস্বীকার করে ধামাচাপাবিদ্যায় দক্ষ করে তোলা হয় তাদের। শেখানো হয়, কীভাবে বর্তমানের সমস্যার মুখে জনগণকে টাইম মেশিনে চড়িয়ে অতীতে নিয়ে যেতে হবে। দায় চাপাতে হবে অতীতের শাসকদের ওপর। আর ‘যন্ত্র ঐ একটাই ষড়যন্ত্র’ শব্দটা তোতা পাখির মতো আউড়ানোর কন্ঠশীলন করানো হয়।
সরকারি সেবক জনতার মাঝ থেকে কিছু সাংবাদিক ও শিক্ষককে বেছে নিয়ে শেখানো হয়, কীভাবে মিডিয়ায় সরকারের গুণগান করতে হবে। শত্রু চিহ্নিত করতে হবে। শত্রু চিহ্নিত করার খেলায় জমিয়ে দিতে হবে মিডিয়ার পুতুল নাচ। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের শেখানো হয়, কী করে উপাচার্য ও ডিন পদ কিনে নিয়ে ‘দেবে আর নেবে মিলিবে মেলাবে’। জাতিকে শিক্ষা ও জ্ঞান বিমুখ করে তোলাই তাদের প্রধান কাজ হবে।
সরকারি সেবক জনতাকে ইসলামপন্থী, হিন্দুত্ববাদি দুইভাগে ভাগ করে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়, তোমাদের কাজ হচ্ছে পরস্পরবিরোধী কাইজ্জায় মাঠ গরম করে রাখা। যাতে অধিকারবঞ্চিত মানুষ; যাদের কাছ থেকে জমি-সম্পদ কেড়ে নিয়ে উপনিবেশের নব্য ধনিক শ্রেণি গড়তে হবে; সেই উপায়হীন মানুষের ওপর চলা প্রতিদিনের শোষণ-নির্যাতনের খবরগুলো গুরুত্ব না পায়। বেশ চর্বি জমানো ইসলামপন্থী আর নধর হিন্দুত্ববাদীর কুঁচকুঁচানিতে কেটে যাবে একটি শতক।
রাজনীতিক, সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাদের শেখানো হয়, নৈশভোট অত্যন্ত সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের কৌশলাদি।
ব্যবসায়ীদের শেখানো হয় কীভাবে শেয়ার-বাজার ও ব্যাংক লুট করতে হবে।
একজন দক্ষ একাউন্ট্যান্ট প্রশিক্ষণে বলেন, অর্থই হচ্ছে ঈশ্বর; এই ঈশ্বরকে পাহারা দিতে রয়েছে ধর্মের আর রাজনীতির ঈশ্বর। আপনাকে এই তিন ঈশ্বরের সেবা করতে হবে একই সঙ্গে। সবসময় এমনভাবে চলবেন যেন আপনি সাধুসন্ত। কোথাও কোন অনৈতিকতার দেখা পেলেই নৈতিকতার বাণী ছাড়বেন।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে প্রশিক্ষণের জন্য মায়ের কোলে চড়ে আসা শিশুদের প্রশিক্ষিত করতে তাদের মনোপলি খেলা শেখানো হয়। শিশুদের প্রশিক্ষকরা বলেন, রাজনীতিক, সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী, ঠিকাদার, সরকারি সেবক জনতা যাই হও জীবনে; আসল কাজ হচ্ছে চাঁদাবাজিশাস্ত্র চর্চা, ক্ষমতার অপব্যবহার আর টিকে থাকা। মনে রাখবে জীবনটা একটা জুয়া খেলা।
প্রশিক্ষণের শেষ দিনে সবাইকে বলা হয়, আমরা সবাই জানি ইস্ট বেঙ্গল কোম্পানির উপনিবেশে লুন্ঠনটাই আসল কথা। কিন্তু সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বপ্নটা বাঁচিয়ে রাখতে হবে। তাদের সুইটযারল্যাণ্ড, সিঙ্গাপুর, লস এঞ্জেলেস হবার লোভ দেখাতে হবে। সেই জন্য মাঝে মাঝেই দুর্নীতি দমন অভিযান, সন্ত্রাসী দমন অভিযান, মাদক বিরোধী অভিযানের রোমহর্ষক নাটক মঞ্চস্থ করতে হবে। সততা- স্বপ্ন-সুখ এসব অবাস্তব ধারণা। একমাত্র নাটকই পারে এইসব অবাস্তব অনুভূতি উপনিবেশের প্রজাদের মাঝে বাঁচিয়ে রাখতে।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন