আমি ক্রুদ্ধ হই না এই কথাটা ঠিক না। অনেক সময় রেগে যাই বটে। কিন্তু রেগে যাওয়া উচিৎ না। অর্বাচীন বালকেরা জানে না ‘তাহারা কী বকিতেছে’।
ওরা যে ইচ্ছা করেই এইসব বলে তাও ঠিক না। এটা চলে আসে। বেশীরভাগ লোকের মাথাটা কাজই করে এইভাবে- নারীকে সোজা হয়ে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে দেখলেই এদের হায় হায় হায়, নারী কেন মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াবে। মগজের ভিতরে ভিতরে ভিতরে কোষের মধ্যে তো এদের নারী মানেই রসগোল্লা, নারী মানেই মুরগি, নারী মানেই মাল। পশ্চিমা শিক্ষার ছোঁয়া, রেডিও টেলিভিশন এইসব দেখে এরা শিখেছে বটে যে নারীকে সম্মান করতে হবে- কিন্তু নারীকে সম্মান করার ধারনাটাও ওদের কাছে একটা ব্যাক্তিগত পর্যায়ে খানিকটা শিভালরি দেখানো পর্যন্তই সীমিত।
এই যে নারীকে কেবল ভোগের বস্তু হিসাবে দেখা এবং পুরুষের চেয়ে একটু কম মানুষ বা উন-মানুষ হিসাবে দেখা, এইটার প্রকাশ দেখবেন আপনি ওদের কথায়, লেখায় আচরণে, সর্বত্র। এমনকি আপাতদৃষ্টে লিবারেল আধুনিক ধরনের মানুষ যারা আছে ওদের কথা শুনলেও লক্ষ্য করবেন নারী স্বাধীনতার প্রসঙ্গটি এলে ওরা একটু অস্বস্তিতে ভোগে। বলতে থাকে নারী স্বাধীনতা মানে কি ছোট কাপড় পরা? নারী স্বাধীনতা মানে কী যার তার সাথে শোয়া? নারী স্বাধীনতা মানে কি ছবির হাতে গাঁজা খাওয়া? এইরকম নানারকম ব্যক্তিগত আচরণ প্রসঙ্গ।
এই যে ওরা বলে যে নারী স্বাধীনতা মানে কী ছোট কাপড় পরে ঘুরে বেড়ানো ইত্যাদি, এইসব কথার অসঙ্গতিটা কোথায়? এইসব কথার মধ্যেও এক ধরনের প্রভুসুলভ প্রেসক্রিপশন থাকে। প্রভুসুলভ প্রেসক্রিপশনের ব্যাপারটা কী? এদের বক্তব্য হচ্ছে নারীর স্বাধীনতা নারীর জন্যে ভালো কী মন্দ সেটা ওরা সিদ্ধান্ত নিবেন, ওরা বলবেন কোঁতা নারীরই জন্যে ভালো কোনটা নারীর জন্যে মন্দ ইত্যাদি এবং সেই মাপে নারীকে স্বাধীনতা দেওয়া হবে।
ওরে গাধার দল, নারী স্বাধীনতার সাথে আচরণের ভাল বা মন্দ বিষয়ক ভ্যালু জাজমেন্টের কোন সম্পর্ক নাই। প্রশ্নটা হচ্ছে যে কে সিদ্ধান্ত নেবে? কে সিদ্ধান্ত নেবে নারী ছোট কাপড় পরে রাস্তায় বেরুতে পারবে কী না বা প্রকাশ্য রাস্তায় নারী সিগারেট খাওয়া উচিত হবে কী না। আপনি যদি নারীকে পুরুষের মত মানুষ মনে করেন, তাইলে আপনি বলবেন যে এইগুলি একেকটা ব্যক্তিগত আচরণ, এইসব বিষয়ে ব্যাক্তি তার নিজের সিদ্ধান্ত নেবে, সে নারীই হোক আর পুরুষই হোক।
পুরুষ নারীকে সীমানা বেঁধে দেওয়ার কে? নারী কী মানুষ না, সে কী তার নিজের সিদ্ধান্ত নিতে পারে না?
(২)
ওরা বলবে যে তাহলে কি আপনি নারীদের যা ইচ্ছা তা করার স্বাধীনতা সমর্থন করেন? জ্বি ভাই। আমি মনে করি নারী ও পুরুষ সকলেই নিজের জীবনের সকল সিদ্ধান্ত নিজেই নিবে। একজন আরেকজনের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী নেবে না। এরপর ওরা হায় হায় শুরু করবে। এটা হলে নাকী পৃথিবী রসাতলে যাবে, নারীরা ইচ্ছামত যার তার সাথে শোয়া শুরু করবে, ঢাকার রাস্তা সয়লাব হয়ে যাবে ন্যাংটা ন্যাংটা মেয়েতে, আর বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠান বলে কিছু থাকবে না, সব নারী পরকীয়া শুরু করবে।
ও ভাই, একটু থামেন।
পুরুষরা যে নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেয়, নিজের পোশাক নিজে পছন্দ করে, ঢাকা শহরের রাস্তায় কয়জন পুরুষকে দেখেছেন ল্যাংটা হয়ে হাঁটতে? মানসিকভাবে যারা অসুস্থ ওদের কথা আলাদা, রাস্তায় লেংটা পাগল মাঝে মাঝে দেখা যায়। কিন্তু সুস্থ স্বাভাবিক পুরুষ মানুষ কয়জন হাফ প্যান্ট পরে অফিসে যায়? কয়জন খালি গায়ে ক্লাসে যায়? খুব একটা কেউ এরকম করে না। কেন করে না? যার যার নিজের শালীনতা বোধ, অপরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এইসব কারণে। এরপরও কোন কোন পুরুষ মানুষ কিন্তু উদ্ভট ধরনের পোশাক পরে। পরে না যে তা নয়। এইটা ব্যক্তিগত পছন্দের ব্যাপার। নারী স্বাধীনতার কথা যারা বলেন, ওদের কথা হচ্ছে এইটাই- ভাই আমি কী কাপড় পরব কী পরব না, সিগারেট খাবো নাকি গাঁজা খাবো, প্রেম করবো নাকী বিবাহ করবো, সেটা আমকে সিদ্ধান্ত নিতে দেন। কোনটা আমার জন্যে ভালো কোনটা আম্র জন্যে মন্দ সেই বিষয়ে আপনার লেকচার আপনার প্রেসক্রিপশনের আমার দরকার নাই। ব্যাস।
পুরুষরা তো যে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বাধীন। তাই বলে সকলেই চুরি করতে থাকে? সকলেই মানুষ মারতে থাকে? সকলেই মদ্যপান করে (মদ্যপানকে খারাপ বলছি না)? সকলেই রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনে? সকলেই ক্রিকেট ভালোবাসে? সবাই গলফ খেলে? সবাই বেশ্যাগমন করে? সকলেই পরকীয়া করে? কেউ কেউ করে, কেউ কেউ করে না। কিন্তু যার যার সিদ্ধান্ত সে নেয়। নারী কী করবে কী করবে না করবে সেই সিদ্ধান্তটা নারীই নেবে- ভাল হোক মন্দ হোক সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। সেই ক্ষেত্রেও যেটা আপনার কাছে মন্দ মনে হয় সেটা নারীর জন্যে যেরকম মন্দ, পুরুষের জন্যেও সমান পরিমাণ মন্দ।
(৩)
এক লেখককে দেখলাম বেশ কায়দা করে নারীবাদীদের নিন্দা করে প্রবন্ধ লিখেছে সেটা আবার ম্যান্সচ্যাপ্টার নামে একটা সাইটে পোস্ট করেছে। সেখানে আবার ঘটা করে লিখছে, তিনি নাকী পুরুষতন্ত্রী নন, এবং তার সমর্থনে প্রমাণ দিচ্ছেন। তাও ভালো। পুরুষতন্ত্রী হওয়া যে মন্দ ব্যাপার সেইটা তো অন্তত মাথায় আছে! এই লেখক একটি নিতান্ত কিশোরীকে আপত্তিকর ইনবক্স করে অপমানিত হয়েছে। এরপর আবার সেই মেয়েটিকে হেনস্তা করতে নেমেছে। তিনি পুরুষতন্ত্রী নন! রঙ্গ করেন নাকী?
এগুলি হচ্ছে সেইসব স্যুডো প্রগতিশীলদের মতো। বর্তমান সমাজ কাঠামো ধরে রাখার জন্যে প্রতিদিন জান পাতলা করে ফেলবেন, কিন্তু ওকে যদি আপনি প্রতিক্রিয়াশীল বলেন তাহলে আবার রেগে যাবে। বুঝছি ভাই, আপনার যুক্তি বুঝতে পারছি! আপনি নারী মুক্তির বিরোধিতা করবেন, নারীর স্বাধীনতার নিন্দা করবেন, ছোট ছোট মেয়েদেরকে হয়রানী করবেন, আপনি তো পুরুষতন্ত্রী হতেই পারেন না! মাঝে মাঝে দুই একবার নারীকল্যাণের কথা বলবেন তাতেই এরা মনে করে বিশাল প্রোগ্রেসিভ হয়ে গেছেন।
এদেরকে বলেন, কল্যাণ আর মুক্তি এক জিনিশ না। প্রিভিলেজ আর স্বাধীনতা এক জিনিশ না। কল্যাণ ব্যাপারটা হয়তো খারাপ না। কিন্তু কল্যাণ আমরা মুরগির জন্যেও চাই, গরু ছাগলের জন্যেও চাই। কিন্তু কল্যাণ চাওয়া আর মুক্তি চাওয়া এক জিনিশ না। স্বাধীনতা ভিন্ন জিনিস। অনেক নারী প্রিভিলেজড থাকেন। কারো সুযোগ থাকে বা কেউ সুযোগ তৈরি করে নেন, নিয়ে নিজেদেরকে পুরুষ শাসিত সমাজের মধ্যেই নিজেদের জন্যে শক্ত অবস্থান তৈরি করে নেন। এইগুলি নারী স্বাধীনতা বা নারী মুক্তির উদাহরণ না। কল্যাণও কোন কোন ক্ষেত্রে জরুরী। সেটাও ঠিক আছে। কিন্তু কল্যাণ আর মুক্তি এক জিনিশ না।
এক তরুণকে বললাম, ওরে মূর্খ, কল্যাণ আর মুক্তি এক জিনিশ না। তরুণ গেল ক্ষেপে। বলে কীনা আমাকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করেছে প্যাঁ প্যাঁ প্যাঁ। এগুলি তরুণকে আবার বলি- ওরে মূর্খ, তোকে কেন মূর্খ বলেছি সেটা বুঝতে চেষ্টা কর। অজ্ঞতাটা আগে দুর কর। এরপর এসে বল, যে ইমতিয়াজ আপনি আমাকে মূর্খ বললেন কেন? সেটা না করে যে চিৎকার শুরু করে দিলি তাতে তো মূর্খতা প্রতিষ্ঠিত হলো। না জানাটা বা অজ্ঞতা তো আর মুখটা নয়, মূর্খতা হচ্ছে অজ্ঞতা বুঝতে না পারা।
এখন এরা হৈ হৈ রৈ রৈ করে উঠেছে- গেল গেল গেল, উইম্যান চ্যাপ্টার নামক একটা গোষ্ঠী হয়েছে, এরা তো নারীদেরকে মুখ খুলতে চোখ খুলতে উৎসাহ দিচ্ছে। এখন তো মেয়েরা মানুষ দাবি করছে নিজেদেরকে। এরা সব বেশ্যা, বুড়ী বেশ্যা ইত্যাদি ইত্যাদি , শিথিল চরিত্র আরও কত কী।
ওরে বেওকুফ ভাইয়েরা, আপনারা যতোবার নারীকে বেশ্যা বেশ্যা বলতে থাকবেন, ততবারই আপনি পুরুষতন্ত্র ও পিতৃত্ববাদী সমাজ যে কত খারাপ সেটা উপস্থাপন করছেন। কীভাবে? সমাজে বেশ্যা বা নারী যৌনকর্মীর উপস্থিতিই প্রমাণ করে নারীকে আমরা কেবল ভোগের পণ্য হিসাবেই দেখতে চাই। ভোগের জন্যে কিছু নারীকে আমরা রাখবো ঘরে- এক্সক্লুসিভ ব্যবহারের জন্যে। আর কিছু রাখবো বাজারে, গণ ব্যাবহারের জন্যে। তাইলে মন্দটা কে? পণ্য? ভিক্টিম? নাকী আমরা পুরুষরা?
(৪)
ওরা যে এইরকম আক্রমণ করছে, গালাগালি করছে, হিস্টিরিয়াগ্রস্ত আচরণ করছে তাতে আমাদের প্রতিক্রিয়া কী? ওয়েল। প্রথম প্রতিক্রিয়া হচ্ছে আনন্দ। নির্মল আনন্দ। আনন্দ কেন? আঘাতটা লাগছে ওদের জায়গামতো। নাইলে ওরা তো এরকম হিস্টিরিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার কথা না। আমাদের নারী অধিকার কর্মীরা নিশ্চয়ই ঠিক পথে আছেন। আঘাতটা জারি রাখতে হবে।
কিন্তু এইসব কথাকে একজন দুইজন মানুষের অসৎ আচরণ মনে করার কিছু নাই। এই যে ওরা উইম্যান চ্যাপ্টারকে গালি দিচ্ছে, এটা একজন দুইজন পুরুষ বা পুরুষবাদী নারীর কথা মনে করলে ভুল হবে। এইটা হচ্ছে পিতৃতান্ত্রিক সমাজেরই প্রতিক্রিয়া বরং বলতে পারেন পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাবে তারই একটু ছোট মাত্রার ডেমো হচ্ছে এইসব। ওরা সংখ্যায় অনেক। ওরাই সংখ্যাগুরু। নারীবাদী বলেন নারী মুক্তির সৈনিক বলেন মানবতাবাদী বলেন বা বিপ্লবীরা বলেন, সকলে মিলেই আমরা এই সমাজে সংখ্যালঘু। অতি ক্ষুদ্র সংখ্যালঘু। এইরকম সংখ্যালঘু হয়ে আপনি গোটা সমাজকে ভেঙে ফেলার হুমকি দিবেন, হাজার বছরের প্রতিষ্ঠিত প্রথা প্রতিষ্ঠানকে ভেঙে ফেলার কর্মসূচি নিবেন, আর সংখ্যাগুরুরা আপনাকে ছেড়ে কথা বলবে?
না। ওরা আমাদেরকে ছেড়ে কথা বলবে না। ওদের জোর বেশী। ওদের লোক বেশী। রাষ্ট্র ওদের। পুলিশ ওদের। মিলিটারি ওদের। পুঁজি ওদের। ওরা একজন হাক মারলে দেখবেন এক লক্ষ লোক শেয়ালের মতো গলা মিলায়। আপনি যদি ধমক দেন, ওরা পিস্তল বের করবে। আপনি যদি হাতুড়ি মারতে চান, ওরা সারি সারি কামান নিয়ে এসে হাজির হবে।
এইটা জেনেই তো লড়াইয়ে নেমেছেন। নাকী? এইটাই তো সমাজ পাল্টানোর লড়াইয়ের নিয়ম। আপনারা এখন অল্প কিছু নারী, সাথে তার চেয়েও কম হাতেগোনা দুইএকজন পুরুষ। আদর্শটা আছে বুকে শক্ত। নেমে গেছেন লড়াইয়ে। কেন? কারণ আপনি জানেন যে আপনি অগ্রবর্তী সৈনিক। আপনারা সংখ্যায় কমই হবেন। জানেন যে আপনার মৃত্যু হবে সবার আগে। আপনাকে মারবে পদে পদে। আঘাত করবে, পাশের বন্ধু সরে যাবে। নিজে পড়ে যাবেন। আবার উঠবেন। লড়বেন। এইভাবেই একদিন দেখবেন আপনার সাথে গোটা বিশ্ব এসে দাঁড়িয়েছে।
(৫)
এই যে এখন যেসব কৃমিকীট আমাদেরকে আক্রমণ করছে, ওরা তো আমাদের শেষ মিছিলের পায়ের নিচে পিষ্ট হয়েই মরবে। সেদিন আপনি হয়তো থাকবেন না। সেই মিছিলটির আগেই হয়তো আপনি হারাবেন প্রাণ বা প্রাণের চেয়ে প্রিয় মানুষদের। কিন্তু এইটাই তো লড়াইয়ের নিয়ম। যেটাকে ঠিক জেনেছি, যেটা দেখতে পাচ্ছি ন্যায়, যেটা দেখতে পাচ্ছি মানবজাতির সঠিক গন্তব্য সেখানে সমাজকে নিয়ে নিয়ে যাবো না? অবশ্যই নিয়ে যাবো-আমার তো একটা মাত্র প্রাণ, আপনার তো একটা মাত্র প্রাণ- এইরকম লক্ষ প্রাণ যাবে গন্তব্যে পৌঁছানোর আগেই। যাক।
যে লড়াইতে নেমেছেন সেখানে অনলাইনের এইসব অর্বাচীন মণ্ডূকগুলির ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর তো কিছুই না। এইগুলি ইগনোর করেন। বড় আঘাত, অনেক বড় আঘাত আসছে, তার জন্যে চলেন দূর্গ সাজাই। জিতবো তা আমরাই- সেটাই বিজ্ঞান। মাভৈ।