০
১৭৪৬ বার পঠিত
বৃটেনের ব্যভিচারি রাজা পঞ্চম জর্জ, যৌনব্যাধি থেকে রাজাকে রক্ষা করতে তার একান্ত চিকিৎসক একটা আশ্চর্য আবিষ্কার করলেন। সেই ডাক্তারের নামানুসারেই তার বানানো লিঙ্গ আচ্ছাদনের নাম হলো কনডম। যদিও এর অনেক ডাকনামও আছে বটে। ডাকনাম না বলে স্ল্যাংও বলা চলে, যেমন রবার বুট! প্রাচীন মিশরেও সঙ্গমের সময় পাতলা রেশমি রুমাল লিঙ্গ আচ্ছাদকের কাজ করতো। বস্তুত পৃথিবীর প্রায় সব সভ্যতায় যৌন সম্পর্কের সময় লিঙ্গ আচ্ছাদন ব্যবহার করার চল ছিলো। সেইটে মাথায় রেখেই কনডমের জন্ম। সঙ্গমের সময় নারীর যৌনরস থেকে লিঙ্গ সুরক্ষা। সারা পৃথিবীতে যাই হোক কিন্তু বাংলাদেশের পুরুষদের কাছে কনডম কখনোই জনপ্রিয় ছিলো না, এখনও না৷
এদেশে জন্মনিরোধকের ভূমিকা পালন করতে কনডম বরাবরই ব্যর্থ হয়েছে। বরং বাঙালি পুরুষের ধারণা কেবলমাত্র অনিরাপদ শারিরীক সংসর্গের সময়ই কনডম ব্যবহারের প্রয়োজন আছে, নচেৎ নয়। কনডম যৌনব্যাধি থেকে রক্ষা করে, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে। এতোকিছু স্বত্বেও বিবাহিত পুরুষের কাছে কনডম গুরুত্ব পায় না৷
এমনিতেও নব্বই শতাংশ মুসলমানের দেশে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের চিন্তাটাই বড়ো কঠিন। বাড়ি বাড়ি রাজা কি প্যানথার কনডম, সুখী বড়ি বিলিয়ে কাজ হয় নাই।
পুরুষদের ভ্যাসেকটমি আর নারীর লাইগেশনকে উৎসাহিত করতে শাড়ি লুঙ্গি বিতরণ, বিজ্ঞাপন কোনোটাই কাজে আসে নাই। গ্রামে বা শহরের বস্তি এলাকার বাচ্চাদের কাছে কনডম পরিচিত হয়েছে বেলুনের বিকল্প ফোটকা হিসেবে৷ লুকিয়ে কখনো কোনো উঠতি তরুণের ব্যবহারে হয়তো লেগেছে কিন্তু গোত্রে কুলীন হতে পারে নাই৷ সোশাল মার্কেটিংয়ের কনডমের যা দাম, সেটা মধ্যবিত্তের কাছে তাই ব্রাত্য।
কনডম কেনার একটা নির্দিষ্ট ক্রেতা আছে, আছেই। তবে এই ক্রেতাদের ঠিক সাধারণ কাতারে ফেলা যায় না, এরা কিছুটা এডভেঞ্চার প্রিয় বলা চলে। আর মধ্যবিত্ত পরিবারের পুরুষের কাছে কনডম আদতেই কখনো জনপ্রিয় ছিলো না। ল্যাটেক্স আসার আগে পর্যন্ত কনডম তৈরীর মূল উপাদান ছিল রাবার। এখন প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে কনডমের গায়েও৷ সরকার সোশ্যাল মার্কেটিং কোম্পানির মাধ্যমে যে কনডম বাজারে ছাড়ে তার দাম এখনো ঠিক কম বলা চলে না। পুরুষের কাছে কনডম অস্বাচ্ছন্দ্যের বিষয়, জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অপছন্দের।
তাই সংসারে বাড়তি মুখের চাপ এড়ানোর দায়টা আরো বহু রকমের ঝক্কির মতো চেপে বসেছে নারীর কাঁধেই।
স্বাস্থ্য ঝুঁকি আছে জেনেও নারী ব্যবহার করে হর্মোন ইঞ্জেকশন, পিল, কপার-টি। পিছপা নয় লাইগেশন করাতেও। পুরুষের ভ্যাসেকটমি জনপ্রিয় করাতে সব রকম পদক্ষেপ ব্যর্থ হয়েছে। দায়িত্বশীল পুরুষ জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে বা পরিবার ছোট রাখতে ভ্যাসেকটমি করে, এমন বিজ্ঞাপন কাজে আসে নাই। বিজ্ঞাপন হয়েছে কনডমেরো কিন্তু বাংলাদেশে এমনকি রোহিঙ্গারাও কনডম ব্যবহারে উৎসাহী না। কেবল যে জনসংখ্যার চাপ বাড়ছে তা না, বাড়ছে যৌনবাহিত রোগের ঝুঁকিও। এমনিতেই বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্হানের কারণে এইডসের ঝুঁকি বেশি। আরো কিছু রোগের মতো জানা যাচ্ছে, ডেঙ্গু ও জিকা ভাইরাসও যৌন সম্পর্কের মাধ্যমে ছড়ায়। পরিস্থিতি এমন যে কনডম ব্যবহারে পুরুষদের উৎসাহিত করার জন্য ব্যবস্হা নেয়া জরুরী। দাম কমিয়ে প্রয়োজন ভর্তুকি দিয়ে হলেও সরকারের উচিৎ হতো এর ব্যবহারকারী বাড়ানো৷
বাংলাদেশে আরো কিছু ক্যানসারের মতো জরায়ু মুখের ক্যান্সারের ঝুঁকি ভয়াবহ। বছরে ছয় হাজার নারী মারা যান এই রোগে প্রতি বছর নতুন করে আরো বারো হাজার নারী আক্রান্ত হচ্ছেন। কেবল যে অপরিচ্ছন্নতা বা সচেতনতার অভাবে এই রোগে নারী আক্রান্ত হচ্ছেন তা না, জরায়ু মুখের ক্যান্সারে অনিরাপদ যৌন সম্পর্ক একটা বড় কারণ। সঙ্গে মাসিকের সময়ে অপরিষ্কার কাপড় ব্যবহার, প্রসবকালীন পরিচ্ছন্নতার অভাব তো আছেই।
গ্রামের মেয়েদের কাছে হুইসপার বা সেনোরা সহজলভ্য না। এমনকি তারা মোনালিসাও ব্যবহারের স্বপ্ন দেখে না। শহরের মোড়ে মোড়ে যেমন বিভিন্ন কোম্পানিগুলো প্রচারের স্বার্থে বাই ওয়ান গেট ওয়ান ফ্রি বলে দুই প্যাকেট হুইসপার বিক্রি করে গ্রামে সেই সুযোগ নাই। তবে গ্রামের মেয়েরাও স্যানিটারি প্যাড ব্যবহারের আওতায় এসছে এখন। আর সেনোরা না তারা কেনে জয়া বা জলি। স্কুল কলেজের অবিবাহিত নারীরাই এসব ব্যবহারের আহ্লাদ করতে পারে। আর বিবাহিত নারীদের কথা যদি জানেন তবে সেটা যথেষ্ট রকম ভয়াবহ।
গ্রাম দেশে সমস্ত ফার্মেসিতে একজন করে গ্রাম্য ডাক্তার নামের বুজরুক বসে। আর বিবাহিত নারীরা হলো তাদের প্রধান টার্গেট। সংসারের খরচ কমাতে এবং জন্ম নিয়ন্ত্রণের উপায় হিসেবে তারা ব্যবহার করে তিন মাস মেয়াদি ইঞ্জেকশন ডিপো প্রভেরা। পঞ্চাশ টাকায় চলে যাবে মাস তিনেক, নিয়ম মতো। আর সত্যি হিসাব হলো একবার এই ইঞ্জেকশন দিলে ফের মাসিক চালু হবে প্রায় পাঁচ মাস পরে। আর তাই বিবাহিত নারীরা হিসাব করে সারা বছর ধরে ইঞ্জেকশন নেয়।
যেখানে ডাক্তারি শাস্ত্র মতে সারা বছর মানে বারো মাসে কম করে তিনবার মাসিক হওয়া জরুরী সেখানে এদেশের গ্রামের নারীদের বছরের পরে বছর ধরে মাসিক বন্ধ রাখার চল চালু আছে। এদেশে স্যানিটারি প্যাডকে বিলাস পণ্য মেনে ভ্যাট বসানো হয়, দামও কমিয়ে আনার পদক্ষেপ নাই।
শহরের বিবাহিত নারীদের একটা বড় অংশ নিজের মিন্সট্রুয়েশন পিরিয়ড নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন সারা বছর। আমি মনে করি, কনডম এবং স্যানিটারি প্যাড উভয়ের উপরে সমস্ত রকম ভ্যাট প্রত্যাহার করা হোক। সহজে, সুলভে মধ্য ও নিম্ন আয়ের মানুষের হাতের নাগালে আনা হোক। বিজ্ঞাপন প্রচারে কেবলমাত্র জন্মহার নিয়ন্ত্রণ, ছোট পরিবারে গুরুত্ব বা স্বাচ্ছন্দ্য উল্লেখ না করে সঙ্গে সঙ্গে যৌনরোগের ঝুঁকি ও ভয়াবহতার কথা জানানো হোক।
পাশাপাশি নারীর স্বাচ্ছন্দ্যের কথা চিন্তা করে মেন্সট্রুয়েশন ক্যাপ এবং ট্যাম্পন আমদানি করা হোক। এখনও পর্যন্ত ট্যাম্পন এদেশে বিক্রি হয় না, ব্যক্তি পর্যায়ে কেউ কেউ ব্যবহার করেন৷ কেউ বিদেশ থেকে কারো মাধ্যমে বা নিজে নিয়ে আসেন। আর মেন্সট্রুয়েশন ক্যাপ এদেশে কিছু উন্নয়ন সংস্থার প্রতিনিধি বিদেশ থেকে আনেন এবং এখন পর্যন্ত এর গ্রাহক সংখ্যা সীমিত। কিন্তু স্যানিটারি প্যাডের চাইতে মেন্সট্রুয়েশন ক্যাপ বেশি সুবিধাজনক, সাশ্রয়ী এবং কম ঝুঁকির।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন