০
২৪০৩ বার পঠিত
করোনাপূর্ব বিশ্বের পরিবেশ পরিস্থিতি আলোচনা করতে গেলে আমরা দেখতে পাব সারা বিশ্বে একটা পরিবেশ বিপর্যয় নেমে আসতেছিল। আমাজন থেকে সুন্দরবন দখলদারদের খপ্পরে পড়ে বিলীণ হবার মুখোমুখি, বন ধ্বংসকারি প্রকল্প, লগিং, কৃষি, মাইনিং এসবের কারণে বন উজাড় হয়ে যাচ্ছে। এদিকে সারা বিশ্বের পরিবেশ বিজ্ঞানী এবং আইপিসিসিআর এর কর্মকর্তারা উদ্বেগ প্রকাশ করে যাচ্ছেন একুশ শতকে গ্লোবাল তাপমাত্রা বৃদ্ধি যদি ১.৫ ডিগ্রির নীচে ঠেকিয়ে রাখা না যায় তাহলে আমরা ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে যাচ্ছি। পরিবেশ সম্মেলনে বিভিন্ন দেশের নেতারা তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে ২ ডিগ্রির মধ্যে সীমিত রাখার ব্যাপারে একমত হন। কারণ এর কোন বিকল্প নেই। করোনা মহামারীর আগে আমরা দেখেছি পরিবেশ আন্দোলনে সারা বিশ্বে শিশু-কিশোরদের অংশগ্রহণ, আমেরিকান নতুন প্রজন্মের নেতারা ‘নিউ গ্রিণ ডিল’ প্রকল্পের মাধ্যমে এর মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। সুইডিশ স্কুল ছাত্রী গ্রেটা থুনবেরির নেতৃত্বে সারা দুনিয়াতে স্কুলের ছেলেমেয়েরা আশু পরিবেশ বিপর্যয় মোকাবেলা করার জন্যে প্রতি শুক্রবারে স্কুল থেকে প্রতিবাদ মিছিল বের করতেছিল।
মোটা কথা পরিবেশ বিপর্যয় এমন এক পর্যায়ে পৌঁছায় যে বিখ্যাত রাজনীতি ও পরিবেশ কর্মী নাওমি ক্লেইন তার বই ‘দিস চেইঞ্জেস এভরিথিং’ বইয়ের মাধ্যমে বলেছেন কিভাবে বর্তমানে আন্তর্জাতিক সকল সমস্যার মূলে পরিবেশ বিপর্যয় প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভূমিকা রাখছে। দশ বছর আগের আরব স্প্রিং আন্দোলন, গৃহযুদ্ধ, তৃতীয় বিশ্ব থেকে উন্নত বিশ্বে ব্যাপক হারে অভিবাসন সব কিছুর মূলে পরিবেশ বিপর্যয়ের একটা ভূমিকা ছিল।
বর্তমান করোনা পরিস্থিতির মূলেও কাজ করেছে পরিবেশ বিপর্যয়, ডিফরেস্টেশন, বন্য প্রাণিদের আবাসস্থল ধ্বংস হওয়া এসব কারণ। এর সাথে বর্তমান ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ, ল্যান্ড গ্র্যাবিং এবং আনসাস্টেইনেবল ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টও অনেকটা দায়ী। বন বাদাড় ধ্বংস হবার কারণে বন্য প্রাণির সাথে মানুষের ইন্টারেকশান বাড়তেছে। ব্রাজিলের বলসোনারো সরকার এমাজন বনাঞ্চলে লগিং করে বিশাল এলাকা খালি করে সেখানে কৃষি, মাইনিং প্রকল্প চালু করছে। ভারতের মুম্বাই শহরে এখন রাতের বেলা চিতাবাঘ ঘুরাঘুরি করে, খাবারের সন্ধানে তারা লোকালয়ে চলে আসছে। বাংলাদেশে বিশ্বের সর্ববৃহত ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবনে বনাঞ্চল নষ্ট করে বিদ্যুৎ প্রকল্প করা, রোহিঙ্গাদের আবাসস্থল বানানোর কারণে হাতী ও অন্যান্য বন্যপ্রাণি লোকালয়ে চলে আসছে।
বন্যপ্রাণিদের সাথে মানুষের সংস্পর্শ বাড়ায় প্রাণিবাহিত যুয়োনটিক জীবাণু মানুষের শরীরে সংক্রমিত হচ্ছে। কোভিড-১৯ সেরকম একটি রোগ যার কারণে আজ সারা বিশ্বে লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা যাচ্ছে, ক্রমবর্ধমান বেকারত্বের কারণে বিশ্বের নানা দেশের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়ছে।
করোনা বেশির ভাগ মানুষের জন্য অভিশাপ হলেও কিছু কিছু জায়গায় এটি আশীর্বাদ হিসেবে এসেছে। মধ্যপ্রাচ্যে যেসব জায়গায় যুদ্ধ চলছিল, করোনার কারণে যুদ্ধ বিরতি চলায় সেখানে মানুষ অনেকদিন পরে দম ফেলার ফুরসত পেল। এরমধ্যেও সাম্রাজ্যবাদী, আঞ্চলিক ও জাতীয়তাবাদী আগ্রাসন, আস্ফালন ইত্যাদি থেমে নেই, যেটা আমরা সাম্প্রতিক ভারত-চীন সীমান্তের উত্তেজনা থেকে টের পাই। তবে করোনার কারণে সবচেয়ে লাভবান হচ্ছে প্রকৃতি। প্রকৃতির কোন ভ্যালু জাজমেন্ট নেই, তার কাছে সব প্রজাতি সমান। মানুষ আক্রান্ত হবার কারণে আজকে বাকি সব প্রাণি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ পেল, অথচ আমরা মানুষেরা নিজেদের সৃষ্টির সেরা জীব বলে মনে করি, এ ব্যাপারে আস্তিক-নাস্তিক, বিজ্ঞানী-অবিজ্ঞানী সবাই একমত পোষণ করেন। বর্তমান সময়ে এসে আমাদের এসব কথা পূনর্মূল্যায়নের সময় এসেছে।
যেটা বলেছিলাম করোনার পরে মানুষ যখন তার মুভমেন্ট কমিয়ে দিতে বাধ্য হল তখন মাস খানেকের মধ্যে আমরা চারদিক থেকে ভাল সংবাদ শুনতে শুরু করলাম। গোটা বিশ্বে পরিবেশ দূষণ কমে এসেছে, বিভিন্ন জায়গায় ওয়াইল্ড লাইফ ফিরে আসতেছে, প্রকৃতিতে গ্রিণ হাউস গ্যাস নিঃসরণ কমায় ওজোন স্তরের ক্ষয় কমে ওজোন হোল ভরাট হচ্ছে, ইত্যাদি।
তবে প্রাকৃতিক প্রাণ বৈচিত্র্যের জন্য এমন সুদিন বেশিদিন থাকবে না। এক সময় করোনা চলে যাবে, মানুষ আবারো তার ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করে দিবে। সেজন্য করোনা পরবর্তী আচার-আচরণ, লাইফ-স্টাইল কেমন হবে সেটা আমাদের এখনই ঠিক করতে হবে। এটা ঠিক যে আমরা আর আগের মত চলতে-ফিরতে পারব না, আমাদের আচার-আচরণে একটা স্থায়ী পরিবর্তন আনতে হবে। পরিস্থিতি এমন হয়েছে পরিবেশ রক্ষার জন্য গাছ লাগানোর মত ফ্যাশনেবল ভাল কাজ করেও এখন আর রক্ষা হবে না। তাই বলে গাছ লাগানো বন্ধ করা যাবে না। এমন পরিস্থিতিতে বন নষ্ট করে গাছ লাগিয়ে সেটা পুষিয়ে নেবার মত যেসব যুক্তি আমাদের সরকারগুলো দিচ্ছে সার্বিক পরস্থিতি আসলে সে জায়গায় নেই। আমাদের হাতে অতো সময় নেই, করোনা থেকে মুক্তির পরে অর্থনৈতিক মন্দা আসবে, অর্থনৈতিক মন্দা থেকে বাঁচা গেলেও পরিবেশ বিপর্যয়ের হাত থেকে সহজে রক্ষা পাওয়া যাবে না। এজন্য আমাদের নীতি নির্ধারণ করার সময় অনেক চিন্তা-ভাবনা করতে হবে, পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়, পরিবেশ, বনাঞ্চল ধ্বংস করে আনসাস্টেইনেবল কোন প্রকল্প হাতে নেয়া যাবে না।
প্রযুক্তিতে ‘লিপ ফ্রগিং’ বলে একটা কথা চালু আছে প্রয়োজনে আমাদেরকে সেটা করতে হবে। একটা উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টাকে বুঝিয়ে বলা যাক, বাংলাদেশে একসময় খুব কম মানুষের বাড়িতে ল্যান্ডফোন ছিল, এখন সবার হাতে হাতে মোবাইল ফোন। বহির্বিশ্বে কিন্তু তেমনটা ঘটেনি, তারা নিজেদের এক প্রযুক্তি থেকে আরেক প্রযুক্তিকে ট্রান্সফার করেছেন। ল্যান্ডফোন থেকে সেলফোনে গিয়েছেন। আমরা যদি সেরকম ভাবতাম যে আগে সবাইকে ল্যান্ড ফোনের আওতায় এনে তারপরে সেলফোন প্রযুক্তিতে যাব, তাহলে হয়ত এতদিনে দেশের অর্ধেক মানুষও ফোনের সেবা পেত না। জ্বালানী এবং শক্তির চাহিদার ক্ষেত্রে আমাদেরকে ঠিক তেমন পদক্ষেপ নিতে হবে। সারাবিশ্বে যেসব প্রযুক্তি বাতিল হয়ে গেছে, যেমন কোথাও নতুন করে কয়লা এবং পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প হচ্ছে না। আমাদেরকেও তাই নবায়নযোগ্য, পরিবেশ বান্ধব জ্বালানী ও শক্তির দিকে ঝুঁকতে হবে। আমাদের লেইট এনট্রান্সের কারণে অতীতের টেকনোলজি এডপ্ট করতে হবে এমন কোন দিব্যি কেউ দেয়নি। সেলফোনের মত আমরা লিপ ফ্রগিং করে রামপালে কয়লা বিদ্যুৎ এবং রূপপুরে পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্পের মত দূষিত, তেজষ্ক্রিয় শক্তির উৎস বাতিল করে সরাসরি নবায়নযোগ্য জ্বালানী এবং শক্তির উৎসের দিকে ফোকাস করতে হবে।
আরেকটা বিষয় লক্ষ্য করলাম গত কয়েক মাসে দেশে-বিদেশে অনেক আলোচনা অনুষ্ঠান হয়েছে, দেশের বিশিষ্টজনেরা সেখানে বিজ্ঞ মতামত রাখছেন কিন্তু কেউই বাংলাদেশের জনসংখ্যা সমস্যার কথা বলছেন না। দেশের কাঠমোল্লাদের চাপে হোক, জনপ্রিয় ধরে রাখতে অথবা তারা হয়ত সত্যিই মনে করেন জনসংখ্যা কোন সমস্যা নয়। কিন্তু পরিবেশ বিপর্যয়ের পেছনে মেগা প্রজেক্টের মাধ্যমে মুনাফালোভী লুটেরা শাসক গোষ্ঠির লুটপাটের সাথে অতিরিক্ত জনসংখার চাপও অন্যতম একটা কারণ। মাত্রাতিরিক্ত জনসংখ্যার কারণে কৃষি জমি ভরাট করে বসত বাড়ি হচ্ছে, নদী-নালা, খাল-বিল, পতিত জমি, বনাঞ্চল দখল হচ্ছে। করোনা মহামারী নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার পেছনে বিপুল জনসংখ্যার চাপকে কোনভাবে অগ্রাহ্য করা যায় না।
জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে আমাদের উল্লেখযোগ্য সাফল্য আছে, তাই বর্তমানে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার আগের চেয়ে কম। কিন্তু সেখানে থেমে থাকলে চলবে না, বর্তমানে আঠার কোটি মানুষ যে হারে বংশবৃদ্ধি করছে সেটাও দুনিয়ার সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশের জন্য অনেক বেশি। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার অব্যাহত রেখে দেশে ৩-৪ কোটি বেকার যুবক, ১ কোটি দেশের পানি দূষণ করে পরিবেশ ধ্বংসকারি টেক্সটাইল ও গার্মেন্টস শিল্পে, দেড় কোটি আদম সন্তানকে বিদেশে শ্রমদাস হিসেবে পাঠিয়ে দেয়া কোন সমাধান হতে পারে না। করোনা পরবর্তী পরিবেশ বিপর্যয় রোধের অংশ হিসেবে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে আরো কঠোর অবস্থান নিতে হবে। মানব সম্পদ উন্নয়নের বিষয়টাকেও মাথায় রেখে পলিসি করতে হবে। এসব বিষয় নিয়ে আপোষ করার মত সময় এবং রিসোর্স আমাদের হাতে নেই, তাই যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন