১৩১৮ বার পঠিত
চারদিকে ছুটির আমেজ। সামনে বড়দিন, হানুকা, নিউ ইয়ার। আমেরিকাতে এখন হলিডে সিজন, গিফট দেবার মৌসুম। এখানে সাধারণত থ্যাঙ্কস গিভিং এর ছুটির পর থেকে শীতকালীন ছুটি নিয়ে আলাপ-আলোচনা শুরু হয়ে যায়। তারপর থেকে মানুষ গিফট কেনা শুরু করে। যেভাবে হোক এসব গিফট ক্রিসমাসের আগে সবার কাছে পাঠাতে হবে।
থ্যাঙ্কস গিভিং এর ছুটিতে ট্রাভেলের কারণে করোনার অবস্থা এখন সবচেয়ে খারাপ। এখন প্রতিদিন আড়াই থেকে তিনহাজার মানুষ মারা পড়তেছে। সবাই একে ৯/১১ এর সাথে তুলনা করছে, বলছে প্রতিদিন একটা করে নাইন-ইলেভেন ইভেন্ট ঘটতেছে। সচেতন মহল থেকে বারবার নিষেধ করা সত্ত্বেও মানুষ কথা শুনেনি। লক্ষ লক্ষ মানুষ অনেক দূরত্ব পাড়ি দিয়ে পরিবার-পরিজনের সাথে উৎসব পালন করতে গ্যাদারিং করেছে। যানবাহনের বদ্ধ পরিবেশ, পার্টির কারণে থ্যাংকসগিভিং হয়ে দাঁড়িয়েছে একটা ‘সুপার স্প্রেডার’। সামনে ছুটির দিনেও একই ঘটনা ঘটবে, সরকারের কথায় স্বাধীনচেতা আমেরিকান মানুষেরা তাদের চলাফেরার স্বাধীনতা বিসর্জন দিবে না। এদিকে ভ্যাকসিন চালু হলেও একটা বড় জনগোষ্ঠি ভ্যাকসিন নিবে না। ফলে আগামী কয়েক মাস আমেরিকাকে বড় ধরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। ক্রিসমাস, হলিডে সিজন হবে আরেকটা সুপার স্প্রেডার। যার ধাক্কা জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গড়াবে।
করোনার কারণে এবারে রাস্তা-ঘাটে মানুষ কম, শপিং মলে ভীড় নেই। সবাই অনলাইনে কেনা-কাটা করছে। করোনার ধাক্কায় এবার ই-কমার্স অনেক বাণিজ্য করে নিল। যারা এতদিন ডেলিভারি দিত না, তারাও এখন ডেলিভারি সার্ভিস শুরু করে দিল। ওয়ালমার্ট, টার্গেট এরাও এখন ডেলিভারি দিচ্ছে। যারা অনলাইনে অর্ডার নিয়ে ডেলিভারি দিতে পারবে না তারা বিজনেস হারাবে।
করোনার কারণে ইতোমধ্যে অনেক বিজনেস চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে। ছোট-খাট বিজনেস যেটা এখানে মম-এন্ড-পপ শপ নামে পরিচিত এমন অনেক বিজনেস বন্ধ হয়ে গেছে। করোনা থেকে একসময় মানুষ হয়ত রক্ষা পাবে, কিন্তু সেটা হবে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন ও জীবিকার বিনিময়ে।
এখন পর্যন্ত কয়েক মিলিয়ন মানুষ জব হারিয়েছেন। সরকারি হিসেবে জবলেস সংখ্যা কম। কিন্তু ছোটখাট ব্যবসায়ী, বিভিন্ন রিক্রিয়েশনাল সেক্টরে যারা জড়িত তারা ঠিকই জব হারিয়েছেন। ফুড ব্যাংকগুলো ঠিকমত ফুড সাপ্লাই দিতে পারছে না। আমেরিকার মত দেশে অনেকে না খেয়ে আধাপেটা খেয়ে আছে। সরকারি সাহায্য, বেকার ভাতার ফাণ্ড শেষ। সেখানে বিশাল ব্যাকলগ, নতুন করে যারা এপ্লাই করছে তারা সহজে কোন সাহায্য পাবে না।
ওয়াশিংটনে গত মে মাস থেকে কংগ্রেস, সিনেট, ট্রেজারি, ট্রাম্প জনগণকে স্টিমুলাস বিল দেবার ব্যাপারে আলোচনা করে যাচ্ছে ,কিন্তু এখন পর্যন্ত কোন সুরাহা হয়নি। সাধারণ মানুষের ওয়াশিংটনের প্রতি যে অবিশ্বাস সেটা এ ঘটনা থেকে স্পষ্ট। এটাকে পুঁজি করেই ট্রাম্প ক্ষমতায় এসেছিল, সামনেও শয়ে বা তার মত কারো ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা আছে। সাধারণ মানুষ না খেয়ে মরছে এদিকে ‘জনপ্রতিনিধি’ কংগ্রেস ও সিনেট তাদেরকে সাহায্য করতে একমত হতে পারছে না। কর্পোরেশনকে সাহায্য করা, তাদেরকে ট্যাক্স ব্রেক দেয়া ইত্যাদি নানা বিষয়ে তারা বিভক্ত। তবে ডিফেন্স বাজেটে টাকার সংকট নেই। আমেরিকাতে এমনিতে টাকার সংকট নেই, ফেডারেল রিজার্ভ দরকার মত ছাপিয়ে নেয়। কিন্তু সিনেট কংগ্রেসের কিছু সদস্যের কথা শুনলে মনে হবে তারা যেন নিজের পকেট থেকে টাকা দিচ্ছে।
একদিকে কিছু মানুষের খাওয়া-পরার নিশ্চয়তা নেই, বাড়ি ভাড়া, বিল বাকি পড়ে আছে। অপরদিকে গত কয়েক মাসে কিছু মানুষ অঢেল টাকার মালিক হয়েছে। এদের কেউ কেউ এখন সেকেণ্ড হোম কিনছে। শুনতে অস্বাভাবিক শোনালেও এটা সত্য যে করোনার মধ্যে আমেরিকার বাড়ির দাম উর্ধ্বমুখী। সূদের হার এখন সর্বনিম্ন ফলে বাড়ির দাম বাড়ছে। হাউজিং মার্কেটও এখন ইনফ্লেশান ফেইজে আছে। কিছু মানুষ বাড়ি থেকে এভিক্টেড হচ্ছে, অনেক মাসের বকেয়া বাড়ি ভাড়া মাথায় নিয়ে দিন গুজরান করতেছে। আবার কিছু মানুষ উদ্ধৃত টাকা দিয়ে নগদে বাড়ি কিনছে।
করোনার এ সময়ে এসে আমেরিকার ধনী আর গরীবের মধ্যে একটা বড় ধরণের ডিভাইড হয়ে গেছে। এ ব্যবধান আর ঘুচবে না। স্টিমুলাস দিয়ে মানুষকে কোনরকম টিকিয়ে রাখা যাবে কিন্তু এর দ্বারা সার্বিক অর্থনীতি চাঙ্গা করা যাবে না। করোনার কারণে যেসব চাকরি, ব্যবসা হারিয়েছে এদের বেশিরভাগ আর ফেরত আসবে না। নতুন করে যেসব চাকরি পাওয়া যাবে সেগুলো হবে মেনিয়াল জব। লং হাওয়ার, লো পে, নো বেনেফিট, গিগ ইকনমির জব। এ আই, অটোমেশনের কারণেও অনেক জব চিরতরে হারিয়ে যাবে। এর সাথে ক্লাইমেট চেইঞ্জের কারণে ফসিল ফুয়েল ভিত্তিক উন্নয়ন এর মডেলও প্রশ্নবিদ্ধ, ফলে এনার্জি সেক্টরেও অনেক জব হারিয়ে যাবে। যেমন সম্প্রতি সানকোর কর্পোরেশন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কানাডার পুরো আলবার্টা অঞ্চলে শোকের ছায়া নেমে আসে।
তবে মানুষের জীবন-জীবিকার সাথে সার্বিক অর্থনীতির কোন সংযোগ নেই। শেয়ার বাজার এখন নিকট অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে চাঙ্গা, এস এণ্ড পি ফাইভ হাণ্ড্রেডের কিছু শেয়ার এখন গড়ে ২০০% ওভারভ্যালুড। ইনডেক্স দেখে বুঝা যাবে না দেশ একটা মহামারীর ভিতর দিয়ে যাচ্ছে। ২০২১ সালে আরেকটা ধ্বসের সম্ভাবনার কথা শোনা যাচ্ছে। যদি হয় সেটা ২০০৮ এর অর্থনীতিক ধ্বসের চেয়ে ভয়ংকর হতে পারে।
স্টিমুলাস দিয়ে অতিদ্রুত অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার না করলে আমেরিকার অর্থনীতির অবস্থা যে কোন সময় খারাপ দিকে মোড় নিতে পারে। এরমধ্যে খবরে এসেছে আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চলে চুরি-চামারি বেড়ে গেছে। দোকানপাট থেকে মানুষ খাবার-দাবার, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি চুরি করতেছে। জানুয়ারির বিশ তারিখে জো বাইডেন ক্ষমতা নেবার আগেই কিছু একটা ব্যবস্থা নিতে হবে, না হলে হয়ত অনেক দেরি হয়ে যাবে।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন