১
১৪০৬ বার পঠিত
কর্কশ ধমক দিয়ে শেখানোর দক্ষিণ এশীয় আদিম কৌশল
দক্ষিণ এশিয়ার সমাজে সবচেয়ে বড় সমস্যা শৃংখলা-সততা ও দায়িত্ববোধের অভাব। যুদ্ধাহত জার্মানি ও জাপান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মাটিতে মিশে যাবার পর মাত্র বছর তিরিশের মাঝেই একটি সুশৃংখল সমাজ হিসেবে গড়ে ওঠে। কল্যাণ রাষ্ট্র হিসেবে রাষ্ট্র হবার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্ত পূরণ করে।
কিন্তু ভারত-পাকিস্তান স্বাধীনতার পর প্রায় ৭০ বছরে আর বাংলাদেশ স্বাধীনতার প্রায় ৪০ বছর পরে রাষ্ট্র হবার কোন পূর্বশর্তই পূরণ করতে পারেনি। আফ্রিকার অনেক দেশ সভ্যতায় দক্ষিণ এশিয়াকে অতিক্রম করেছে এরি মাঝে।
পৃথিবীর সব অঞ্চলেই কিছু অগ্রসরতার চিহ্ন চোখে পড়ে। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়া যেন তৈলাক্ত বাঁশে ওঠা বানর হয়ে রয়ে যায়। শৃংখলা, সততা ও দায়িত্ববোধের দৈন্য এই অঞ্চলটিকে প্রতিদিনই বসবাস অনুপোযোগী করে তুলছে। খুব নিরপেক্ষভাবে দেখলে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়; এগুলো আজো রাষ্ট্র হয়ে ওঠেনি।
এই সমাজে শৃংখলা-সততা-দায়িত্ববোধ শেখানোর একমাত্র কৌশল ধমক দেয়া, গালাগাল করা, প্রহার করা, পারলে গুম করে দেয়া। সাম্প্রতিক সময়ে সাংসদ হয়ে ওঠা ক্রিকেটার মাশরাফি একটি হাসপাতালে গিয়ে ডাক্তার ও নার্সদের বিশৃংখলা, অসততা ও দায়িত্ব জ্ঞানহীনতা দেখে বিক্ষুব্ধ হয়ে জনসমক্ষে রাগ দেখিয়ে প্রশংসিত ও সমালোচিত হয়েছেন।
এ কেবল মাশরাফি নন; দক্ষিণ এশীয় সমাজের বেশির ভাগ অভিভাবক, শিক্ষক, প্রশাসক, আইন শৃংখলা রক্ষাকারী আর জন প্রতিনিধি বিশ্বাস করেন; ডান্ডা মেরে ঠান্ডা করতে হয় জনগণকে। কিছু তারাওয়ালা সেনা শাসক এই বিশ্বাস প্রোথিত করে গেছেন; ডান্ডা মেরে ঠান্ডা করার দর্শন।
শুধু সেনা শাসকের কথা বলি কেন, বার্তা কক্ষের সম্পাদক থেকে কারখানার ম্যানেজারও মনে করে ধমক দিয়েই শেখাতে হয়। এই যে আদিম ধমক দেয়া এটা নাট্য নির্দেশক থেকে সংস্কৃতি মামাদেরও শেখানোর কৌশল।
আর ভুলটা হয় সেখানেই। মানুষকে শেখাতে হয় ভালবেসে; পরম মমতায়। মানুষকে শৃংখলা-সততা ও দায়িত্ববোধ সম্পর্কে যতক্ষণ পর্যন্ত বুঝিয়ে উপলব্ধি না করানো যাচ্ছে যে শৃংখলা-সততা আর দায়িত্ববোধ সভ্য হবার অপরিহার্য শর্ত; ততক্ষণ পর্যন্ত সে অসভ্যই থেকে যাবে। বিশৃংখলা-অসততা-দায়িত্ব জ্ঞানহীনতা মানুষকে একটি বানরের পর্যায়ে রেখে দেয়; এই ব্যাপারটা যতক্ষণ পর্যন্ত জনমনে প্রতিষ্ঠিত না করা যাচ্ছে না; ততক্ষণ পর্যন্ত সে বানরের মতোই আচরণ করবে।
যে বিশৃংখল-দুর্নীতিবাজ-দায়িত্ব জ্ঞানহীন; সে কিন্তু এগুলোকে অপরাধ মনে করে না। মাশরাফির মনে প্রশ্ন জেগেছে, আমি তো খেলার মাঠে শৃংখলা-সততা-দায়িত্ববোধের পরিচয় দিয়েছি; তাহলে দায়িত্বহীন ডাক্তারকে কেন বকাঝকা করা যাবে না। এই মাশরাফি নিজেই কিন্তু ভোটারহীন নির্বাচনে সাংসদ হওয়াকে অসততা মনে করছেন না। তার মানে সততার বোধ তার নিজের কাছেও স্পষ্ট নয়।
আমরা রাজনীতিক ওবায়দুল কাদেরকেও দেখেছিলাম, ইঞ্জিনিয়ারকে
অসততার শাস্তি দিতে ফোয়ারার পানিতে চুবাতে। অথচ ভোটারবিহীন নির্বাচনে জিতে মন্ত্রী হওয়াকে তিনি নিজে কোন অসততা মনে করছেন না। বরং দেশপ্রেম বলে ভাবছেন।
দায়িত্বজ্ঞানহীন ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়ার ভাবছেন, পরিবার প্রেমের কারণেই তাদের সরকারি দায়িত্বে অবহেলা করে বাড়তি উপার্জন খুঁজতে মগ্ন থাকতে হচ্ছে।
এই যে শৃংখলা-সততা-দায়িত্ববোধকে আউটডেটেড ব্যাপার ভেবে দক্ষিণ এশীয় সমাজ যেন তেন প্রকারে সম্পদ অর্জন করা লোকেদের তোয়াজ করছে; এটা কিন্তু চিন্তার জগতে একটা জঙ্গলের বেশি কিছু নয়।
অর্থমন্ত্রী লোটাস কামাল যেমন মনে করছেন, শেয়ার বাজারে সিংহ আর ছাগল থাকে। সিংহরা কয়েকবছর পর পর ছাগলদের টাকা লুটে নিয়ে যায়। দক্ষিণ এশিয়ায় লাখপতি হলেই বাড়িতে লক্ষ বাতি জ্বেলে জানান দেবার চল রয়েছে। ফলে লোটাস কামালের মতো লোকেরা মনে করেন, কিছু টাকা-পয়সা হলেই জঙ্গল-দর্শনের কথা বড় মুখ করে বলা যায় শেয়ার বাজার ধসের কোন দায়িত্ব না নিয়ে। “ঋণ খেলাপি হলেই যদি সব ব্যবসায়ীকে জেলে পাঠানো হয়, তাহলে দেশ চলবে না,” বলেছেন তিনি।
কিংবা তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার, মন্ত্রীর পদে বসে শিক্ষকদের অনুষ্ঠানে গিয়ে ‘শিক্ষা ব্যবস্থাকে বঙ্গোপসাগরে’ ফেলে দিতে বলতে পারেন। তার মানে দক্ষিণ এশীয় সমাজ কেবলই ক্ষমতা নির্ভর; এতোটুকু জ্ঞান নির্ভর হয়ে ওঠেনি। মোস্তফা জব্বার বাংলা সাহিত্যের ছাত্র; ছাত্র জীবনে মাইকেল মধুসূদনের লেখা “বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ” সিলেবাসে পড়েছেন। অথচ তার নিজের ‘সারাবিশ্বের মন্ত্রীরা এখন বাংলাদেশের মন্ত্রীদের খুঁজে বেড়ায় ’-এর মতো অযৌক্তিক কথা-বার্তার প্রেক্ষিতে অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন ভাষায় লেখা স্যাটায়ার পড়ে বিক্ষুব্ধ হন। যেহেতু ক্ষমতা আছে তাই সান্ত্রী সেপাইকে ‘এ লেখা ব্লক করে দেবার নির্দেশ দেন’। এই যে জবাবদিহিতাহীন ক্ষমতার দম্ভ; যে শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে উনি এরকম অযৌক্তিক আচরণ শিখেছেন; সে শিক্ষা ব্যবস্থাকে বঙ্গোপসাগর নয়; কৃষ্ণ সাগরে ফেলে দিয়ে আসা উচিত।
দক্ষিণ এশীয় সমাজের এই যে ক্ষমতা ও টাকা-পয়সা নির্ভরতা; যুক্তি ও জ্ঞান নির্ভরতার অভাব; এটা আজো এ অঞ্চলকে কঙ্গোর গহীন অরণ্য করে রেখেছে।
একবার দেখেছিলাম, সৌদি আরবে শ্রম দিয়ে ফেরা এক নব্য ধনী টাকার গরমে তার গৃহ নির্মাণে নিয়োজিত শ্রমিকদের আঙ্গুল উঁচিয়ে জ্ঞান দিচ্ছে।
সমাজে বিশৃংখলা- অসততা-দায়িত্বহীনতা তৈরি হয়েছে টাকা ও ক্ষমতার গরমে আঙ্গুল উঁচানোর বদ-অভ্যাস থেকে। আর এতে করে দক্ষিণ এশিয়াটি হয়ে উঠেছে একটি স্বয়ং সম্পূর্ণ পা্তকুয়া। এখানে একটু টাকা বা ক্ষমতা হলেই; ঘাড় গুঁজ করে নিজে যা বুঝি ঐটাই ঠিক বলে পাতকুয়ায় লেজ উঁচিয়ে সাঁতরে বেড়ানো ডানকিনে মাছের জীবন এখানে প্রতিদিন।
প্রত্যেকটি ব্যক্তি-সমাজ-রাষ্ট্র কেবল একচুয়ালাইজেশান আর আত্মসমালোচনার মাধ্যমে শৃংখলা-সততা-দায়িত্ববোধের মতো গুণগুলো অর্জন করতে পারে। আচার-আচরণের পার্থক্যই বানর থেকে মানুষকে পৃথক করে, সমাজ-রাষ্ট্রকে জঙ্গল থেকে উন্নততর করে।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন
মে ৩, ২০১৯; ৩:২৫ পূর্বাহ্ন
অসংখ্য ধন্যবাদ সত্যিই অনেক অনেক সুন্দর লিখেছেন। সত্যি টা একদম শিকড় থেকে তুলে আনছেন। শুভকামনা