০
১৩৯০ বার পঠিত
কাকন রেজা :
অ্যাক্টিভিজম কী, বুদ্ধিবৃত্তি বিষয়টি কেন, কারা বুদ্ধিজীবী, এসব নিয়ে দেখি সামাজিকমাধ্যমে অনেকে ক্লাশ খুলে বসেছেন। শুধু ক্লাশ নয়, তিনি বা তারা যে অন্যের চেয়ে সেরা এবং বেশি জানেন তা বোঝাতে অন্যকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতেও ছাড়ছেন না। বুদ্ধিজীবীতা যে অন্যায়ের প্রতিবাদ নয়, তাও বোঝানোর অদ্ভুত কসরত দেখলাম। বুদ্ধিজীবীতা হলো সত্য খোঁজার রাস্তা। আর সত্য বরাবরই মিথ্যা তথা অন্যায়ের বিপরীতে, এ কথাটা এই স্বঘোষিতদের কে বোঝাবে।
এমনি একজনকে অ্যাক্টিভিজমের সাথে বুদ্ধিজীবীতার পার্থক্য বোঝাতে দেখলাম। আর তা বোঝাতে গিয়ে আরেকজনের স্তুতিবাক্যও চোখে পড়লো। সেই স্তুতিতে সেই আরেকজনকে নানা অভিধায় অভিষিক্ত করলেন তিনি। বর্ষার প্রথম কদমফুলের মতন রীতিমত ভেজা অভিষেক।
আমাকে একজন বলেছিলেন, ফেসবুক তথা সামাজিকমাধ্যমে টিকে থাকার এবং আলোচিত হবার কিছু কৌশল রয়েছে। তারমধ্যে একটা হলো পরস্পরের পিঠ চুলকানি। সাম্প্রতিক কয়েকজন মাঝারি টাইপ এবং স্বঘোষিত বুদ্ধিজীবী’র ক্যাচালে মিলে গেলো সেই একজনের বর্ণিত কৌশল। বুদ্ধিজীবীতা আর অ্যাক্টিভিজমের সংজ্ঞা নির্ধারণের অদ্ভুত বয়ানেও সেই টিকে থাকার আরেক উপসর্গ পরিলক্ষিত হলো।
ইনারা আসলে মাঝে-মধ্যে বিরোধীতার অভিনয় করেন, যার লক্ষ্য অডিয়েন্স ক্রিয়েট করা। আবার অনেকে উল্টোপাল্টা লজিকের সাথে গালি-গালাজের মিশেল দিয়েও অডিয়েন্স জুটিয়ে নেন। স্ল্যাঙ অনেকের কাছে অভব্য হলেও, কারো কাছে আনন্দের। বিকৃতিতেও আনন্দ খোঁজেন অনেকে। তারাই আবার অনেক কিছু শুদ্ধ করে ফেলতে চান। নিজেদের ভেতর গড়ে ওঠা এই ভয়াবহ কন্ট্রাস্ট তাদের মস্তিষ্কের অ্যান্টেনায় ধরা খায় না। গোত্তা খেয়ে সুতোকাটা ঘুড়ির মতন বেরিয়ে যায়। এমন সুতোকাটা ঘুড়ি দেশ-বিদেশ মিলে অনেকেই আছেন, যাদের কাজই কোনো না কোনো ভাবে স্বঘোষিতদের আলোচনায় থাকা।
আচ্ছা, যে শ্রেণিটা ফেসবুকে ক্যাচাল করে অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন, তাদের সংখ্যা কত? যারা এই ক্যাচালে দৃষ্টি দেন ধরেন আমরা, সেই আমরাই বা কতজন? আমজনতার শতাংশের হিসেবে ধরলে প্রায় শূন্য ভাগ। দেশের সিংহভাগ মানুষ যে ক্যাচাল বোঝে না, তা সৃষ্টি করে ফায়দাটা কী? এই যে নানা ‘বাদ’, ‘ইজম’, মানুষ কি বোঝে? বোঝে না তো। বোঝে না বলেই, সেই স্বঘোষিত বুদ্ধিজীবীরা তাদের গাধা ভাবেন। আসলে গাধাটা কারা, যারা বোঝাতে পারেন না, না যারা বোঝেন না তারা?
কলকাতার বাবুর কথা বারবার বলি আমি। তেমনি আমাদের এই স্বঘোষিত বাবু’দের জীবনের ষোলআনাই মিছে। আর বলি না, স্বয়ং সুকুমার রায়কে উদ্ধৃত করি।
আবার ভেবে কহেন বাবু, ” বলতো ওরে বুড়ো,
কেন এমন নীল দেখা যায় আকাশের ঐ চুড়ো?
বলতো দেখি সূর্য চাঁদে গ্রহণ লাগে কেন?”
বৃদ্ধ বলে, ”আমায় কেন লজ্জা দেছেন হেন?”
বাবু বলেন, ”বলব কি আর বলব তোরে কি তা,-
দেখছি এখন জীবনটা তোর বারো আনাই বৃথা।”
খানিক বাদে ঝড় উঠেছে, ঢেউ উঠেছে ফুলে,
বাবু দেখেন, নৌকাখানি ডুবলো বুঝি দুলে!
মাঝিরে কন, ” একি আপদ! ওরে ও ভাই মাঝি,
ডুবলো নাকি নৌকা এবার? মরব নাকি আজি?”
মাঝি শুধায়, ”সাঁতার জানো?”- মাথা নাড়েন বাবু,
মূর্খ মাঝি বলে, ”মশাই, এখন কেন কাবু?
বাঁচলে শেষে আমার কথা হিসেব করো পিছে,
তোমার দেখি জীবন খানা ষোল আনাই মিছে!”
একটা রাষ্ট্র নির্মিত হয় নাগরিকদের জন্য। সেই নাগরিকরা যেখানে অত্যাচারিত, অবহেলিত, সেখানে সুখে-সৌষ্ঠবে থাকা একটি ক্ষুদ্র শ্রেণি অযথা তর্কের সৃষ্টি করে। যে তর্ক মানুষের বেঁচে থাকার প্রশ্নে অর্থহীন। যাদের পেটে ভাত নেই, তাদের কোনো ইজম নেই। ইজমের চেয়ে ভাত জোগানোটা বেশি প্রয়োজন, বেঁচে থাকার নিশ্চয়তার বেশি প্রয়োজন, এটা ‘কলকাতার বাবু’দের বোঝাবে কে? অবশ্য অন্য ভাবেও বলা যায়, যাদের জীবনের ষোলআনাই মিছে তাদের বোঝানোর প্রয়োজনটাই বা কী!
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন