গতবছর আজকের দিনে ভাষাবিদ কলিম খান আমাদের ছেড়ে চলে যান। তার কিছুকাল পরে কলিমখান এবং রবি চক্রবর্ত্তীর উদ্ভাবিত ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থবিধি বিষয়ক এই রচনাটি একটি ওয়েবজিনে প্রকাশিত হয়েছিল। রচনাটি সামান্য পরিমার্জ্জিত ক’রে রচনাটি পুনঃপ্রকাশিত হল। সঙ্গের ছবিটি প্রয়াত কলিম খান মহাশয়ের। তাঁকে হারিয়ে আমাদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। আজ তাঁর প্রয়াণ দিবসে তাঁকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করি।
এই রচনার শুরুতে আমি ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থের অভিধান ‘বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ‘ ও ‘সরল শব্দার্থকোষ‘ গ্রন্থের অন্যতম রচয়িতা প্রয়াত ভাষাবিদ কলিম (১৯৫০-২০১৮) খান মহাশয়কে আমার অন্তরের শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করি। সেই সঙ্গে শ্রদ্ধা জানাই তাঁর সহলেখক ভাষাবিদ অধ্যাপক রবি চক্রবর্তী মহাশয়কে। আজ থেকে মাত্র চার বছর আগে, ২০১৪ সালের মাঝামাঝি, কলিম খানের সঙ্গে আমার আলাপ হয়। তখন থেকে তাঁর সঙ্গে আমার অন্তরের আত্মীয়তা গড়ে উঠেছিল যা তাঁর প্রয়াণ পর্যন্ত অটুট ছিল। আমি যেমন বহুবার তাঁর কলকাতার বাড়ীতে গেছি, তেমনি তিনিও একাধিক বার আমার বাড়ীতে এসেছিলেন। সাক্ষাতে ও ফোনে বাংলা বর্ণার্থ ও শব্দার্থের দর্শন নিয়ে তাঁর সঙ্গে আমার বহু আলোচনা হয়েছিল, যে জন্য আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান বলে মনে করি। সেই সুবাদে ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থবিধির ভিত্তি ও উত্তরাধিকার সম্বন্ধে কিছু কথা এখানে বলতে চাই।
আমি পেশায় একজন চিকিৎসক হয়েও কেমন করে ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থবিধির সঙ্গে জড়িয়ে পড়লাম প্রাসঙ্গিক বোধে সেই কথা একটু বলি। সুকুমার রায় আমার প্রিয় কবি এবং তাঁর জীবন ও সাহিত্য আমার অনুসন্ধানের বিষয়। আমি যখন সুকুমার রায়ের কবিতায় রচিত ‘শ্রীশ্রীবর্ণমালাতত্ত্ব‘ নামক অসমাপ্ত রচনাটির নিহিতার্থ নিষ্কাশন করতে গিয়ে বাংলা বর্ণমালার বর্ণগুলির সম্ভাব্য তাৎপর্য্য হন্যে হয়ে খুঁজছি, তেমন এক সময়ে দৈবাৎ কলিম খানের সন্ধান পেয়েছিলাম। তারপর কলিম খান ও রবি চক্রবর্তীর কাছ থেকে আমি পেয়ে যাই বাংলা বর্ণমালার প্রতি বর্ণের অর্থ এবং ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক নিয়মে বাংলা শব্দগুলির বুৎপত্তিগত অর্থ বুঝার কৌশল। এই প্রাপ্তির ফলে আমার সুকুমার গবেষণায় একটা নতুন দিগন্ত খুলে যায়। তখন আমি বুঝতে পারি যে সুকুমারের ‘শ্রীশ্রীবর্ণমালাতত্ত্ব‘ একটি নিছক মজার রচনা নয় (আমার আগে সকলেই এটিকে কেবল মজার লেখা বলেই মনে করেছেন), বরং তাতে ভাষার মূলে বর্ণে গিয়ে ভাষাদর্শন এবং ভাষার আলোয় বিশ্বজগৎকে বুঝার গভীর প্রয়াস আছে। আমার এই উপলব্ধির কথা আমি কলিম খান ও রবি চক্রবর্তী মহাশয়কে জানাই। তারপর প্রায় দুই বছরের (২০১৫-২০১৭) চেষ্টায় আমি ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক পদ্যাভিধান ‘বর্ণসঙ্গীত‘ রচনা ক’রে আমি সেই উপলব্ধি তুলে ধরি, যা ২০১৭ সালের জানুয়ারী মাসে প্রকাশিত হয়। কলিম খান মহাশয় ‘বর্ণসঙ্গীত‘ গ্রন্থটির সমগ্র পাণ্ডুলিপি পড়ে নানা মূল্যবান মতামত দিয়েছিলেন এবং রবিবাবুর সঙ্গে যেৌথভাবে বইটির একটি নান্দীপাঠ লিখে দিয়েছিলেন। এই পদ্যাভিধানে খান-চক্রবর্তীর ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থবিধির সঙ্গে সুকুমার রায়ের ভাষাচিন্তার সম্পর্ক বিষয়ে বিশদ আলোচনা আছে।
প্রশ্ন: কলিম খান ও রবি চক্রবর্তী বাংলা ভাষার জন্য নতুন ক’রে কী করেছেন? উত্তরে বলি যে, ওদের প্রণীত ‘বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ’ এবং ‘সরল শব্দার্থকোষ’ বাংলা অভিধান রচনার ক্ষেত্রে এক যুগান্তরের সূচনা করেছে। খান-চক্রবর্তীর অভিধান পড়লে ভাষা আর ‘এলোমেলো নিরাশ্রয় শব্দের কঙ্কাল’ থাকে না; প্রতিটি বর্ণ, শব্দ ও বাক্য যেন জীবন্ত হয়ে উঠে। সুপ্রাচীন কাল থেকে শব্দকে প্রকৃতি-প্রত্যয়ে ভেঙে তার অর্থ নিষ্কাশনের চল থাকলেও সংস্কৃত ও বাংলা বর্ণমালার প্রতিটি বর্ণেরই যে অর্থ আছে, একথা ওদের আগে কেউই বলেননি। প্রতিটি বিশেষ্যপদই যে আসলে ক্রিয়াপদ থেকে জাত হয়, নিরুক্তকার (বৈদিক অভিধানের রচয়িতা) যাস্ক একথা বলে গেলেও বর্ণমালার প্রতিবর্ণের অর্থ তিনি দিতে পারেননি। দেশিকোত্তম হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর অভিধানে মাত্র কয়েকটি বর্ণের অর্থ বলেছেন এবং তাও শব্দের বর্ণভিত্তিক অর্থ নিষ্কাশনের দিকে তিনি খুব একটা অগ্রসর হতে পারেননি। সেখানে খান-চক্রবর্তী শুধু বর্ণমালার প্রতিটি বর্ণের অর্থ বলে দেওয়াই নয়, বর্ণমালায় বর্ণবিন্যাসের ক্রম সম্বন্ধেও মূল্যবান আলোচনা করেছেন, যা এর আগে কখনো হয়নি। ওদের প্রণীত `বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ’-এ ক্রিয়ামূল ধ’রে বাংলার অভিধানের সমস্ত শব্দগুলির বর্গীকরণ করা হয়েছে (সাজানো হয়েছে), যার ফলে খুলে গেছে একসঙ্গে গুচ্ছ গুচ্ছ শব্দের অর্থোপলব্ধির সিংহদুয়ার, কারণ একই ক্রিয়ামূল থেকে জাত শব্দগুলির মধ্যে অর্থের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকে। ওদের বই পডে় জানা যায় বাংলা শব্দগুলির ভিতরের অর্থ এবং তাদের মধ্যেকার লতায়-পাতায় সম্পর্ক। খান-চক্রবর্তীর ‘বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ’ পড়েই আমি শ্রুতকীর্ত্তি হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ গ্রন্থে প্রদত্ত নানা শব্দের ক্রিয়াভিত্তিক অর্থ (যা একটি বাক্যাংশের সাহায্যে প্রকাশ করা হয়) এবং শব্দের বহুঅর্থবাচকতা (এক শব্দের বহুঅর্থের রহস্য, polysemy) বুঝতে পারি, যা আমার চিন্তাচেতনাকে ব্যাপকভাবে নাড়া দেয়।
খান-চক্রবর্তীর গবেষণা সুকুমার রায়ের ভাষাচিন্তার মর্ম্মোদ্ধারে আমাদের প্রভূত সাহায্য করে। উদাহরণ হিসাবে সুকুমার রায়ের `খাই খাই’ ও ‘পাকাপাকি’ ছড়ায় খাই ও পাকা শব্দের বহুঅর্থবাচকতা ফুটে উঠলেও তার ক্রিয়াভিত্তিক রহস্য সুকুমারের কাছে ধরা পড়েনি। পাকা আম, পাকা ঘুঁটি, দড়ি পাকানো — সব ক্ষেত্রেই পাকা শব্দটি আছে কেন? ক্রিয়াভিত্তিক নিয়মে তার কারণটা বুঝা যায়। আসলে সব পাকাই ‘পাকের আধার’। পাকানো দড়ির ভিতরে পাক জমা হয়, খেলার ঘুঁটি সব ঘর ঘুরে এলে পরে সেটি পাকে, জীবনচক্র শেষ হলে পরে আম পাকে — এইভাবে সব পাকার মিল খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়। আবার ডোবা ও খানার উভয়কেই খানা বলে কারণ উভয় ক্ষেত্রেই খনন ক্রিয়াটি আছে (ডোবাকে কোদাল দিয়ে খনন করা হয়, খানাকে দাঁত দিয়ে), এইভাবে খাই শব্দের নানা অর্থ বুঝা সম্ভব হয়। বকুনি খাওয়াও খাওয়া, তবে সে খাওয়া মানসিক খাওয়া। চশমার খাপ চশমাকে খায়, এ হল খাপে খাপে মিলে যাওয়া। এইভাবে চাপকান আর দাঁড়িও খাপ খেতে পারে (matching), যে কথা সুকুমারের ‘খাই খাই’ ছড়াতে আছে (‘খাসা দেখ খাপ খায় চাপকানে দাঁড়িতে’)। এইভাবে বাংলা ক্রিয়াপদগুলি ধ’রে ধ’রে এগিয়ে যেতে থাকলে শব্দের বহুঅর্থবাচকতা তথা শব্দার্থের দর্শন বুঝার খুবই সুবিধা হয়। সুকুমার বিষয়টি নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষার সূচনা করেছেন এবং খান-চক্রবর্তীর রচনায় তার বিকাশ আছে। মৎপ্রণীত ‘বর্ণসঙ্গীত’ গ্রন্থে সুকুমারের ‘খাই খাই’ ও ‘পাকাপাকি’ ছড়াকে অনুকরণ করে এবং খান-চক্রবর্তীর ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধিকে কাজে লাগিয়ে ‘ধরাধরি’, ‘পড়াপড়ি’ ইত্যাদি ছড়াগুলি রচিত হয়েছে যেখানে যথাক্রমে ধরা, পড়া ইত্যাদি শব্দের বহুবিচিত্র অর্থ ও তাদের পারস্পরিক সম্পর্ককে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। নাম ও নামীর সম্পর্ক কী, সুকুমার রায় এই প্রশ্ন তুলেছেন তাঁর ‘ভাষার অত্যাচার’ প্রবন্ধে। খান-চক্রবর্তীকে অবলম্বন ক’রে আমরা বলতে পারি যে, এই সম্পর্ক ক্রিয়াভিত্তিক। কোনো সত্তা যে ক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত তার ভিত্তিতে তার নাম হয়। অবশ্য আজকের দিনে অনেক সময় ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধি বিস্মৃত হয়ে কোনো সত্তার যা খুশী তাই নাম রাখার কিছুটা চলও হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের ‘জীবন ও বর্ণমালা’ রচনায় বাংলা বর্ণগুলির তাৎপর্য্য ও বর্ণগুলির ক্রম সম্বন্ধে তাঁর চিন্তার একটা ঝলক দেখা যায়। তবু কবিগুরু এই বিষয়টি নিয়ে মোটেই এগোতে পারেননি। আধুনিক কালে কবি শঙ্খ ঘোষের ‘শব্দ আর সত্য’ বইয়ে শব্দের অন্তর্নিহিত সত্য নিয়ে কিছু এলোমেলো প্রশ্ন আছে, কিন্তু তা আদৌ আমাদের শব্দের অন্তর্নিহিত সত্যে বা শব্দার্থের দর্শনের মর্ম্মে নিয়ে যায় না। একমাত্র ভাষাবিদ প্রভাতরঞ্জন সরকারকে বাদ দিলে আধুনিক কালে খান-চক্রবর্তী ছাড়া আমার জানা আর কোনো বাঙালি কবি বা ভাষাবিদ বাংলা শব্দগুলির স্বাভাবিক-প্রাকৃতিক অর্থ সম্বন্ধে তেমনভাবে উল্লেখযোগ্য কোনো গবেষণামূলক কাজ করতে পারেননি। এই অবস্থায় খান-চক্রবর্তী শব্দের ভিতরের অর্থ উপলব্ধি করার কাজে যাস্ক, হরিচরণ, রবীন্দ্রনাথ, সুকুমার রায় এবং আধুনিক বাঙালী কবিদের অনেকখানি ছাড়িয়েগেছেন। ওরা শব্দব্রহ্ম মতবাদের প্রচারক প্রাচীন ভারতীয় ঋষিদের যোগ্য উত্তরসূরী।
এখন কিছু উদাহরণ সহযোগে ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থবিধি বিষয়টা একটু ব্যাখ্যা করছি। ক বর্ণের কথা ভাবুন। ক মানে কী? খান-চক্রবর্তী বলেন, ক মানে ‘করে যে’। পালক, চালক, ধারক ইত্যাদি শব্দে ক মানে যে ‘করে যে’ হয়, তা সহজেই বুঝা যায়। ক বর্ণের আরো অর্থ আছে; যথা ক মানে মাথা, দক্ষ, জল, ইত্যাদি। যেমন কবরী মানে যা ক বা মাথাকে আবরণ করে, অর্থাৎ খোঁপা। আবার কপাল মানে যা ক বা মাথাকে পালন করে বা রক্ষা করে। তাহলে ক মানে যে মাথা হতে পারে, তা বুঝা গেল। আবার কলমী মানে যে শাক ক বা জলে লম্বমান হয় (কলম্বী>কলমী), এখানে ক মানে জল (কলমী শব্দের এই ব্যাখ্যা প্রভাতরঞ্জন সরকার মহাশয়ের রচনা থেকে গৃহীত)। এইভাবে ক বর্ণের অর্থকে বুঝা যায়।
ক-এর পর এবার খ বর্ণের অর্থ বলি। আপনারা জানেন খ মানে আকাশ হয়। কেমন ক’রে তা হয়? খ মানে আর কিছু হতে পারে কি? খান-চক্রবর্তীর ‘বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ’ জানাচ্ছে খ্ বর্ণটি তৈরী হয়েছে ক্-এর সঙ্গে হ্ জুডে় (ক্+হ্=খ্)। ওদের মতে তাই খ্-এর অর্থ হল ‘করণ হওয়ন’, অর্থাৎ ‘করা যেখানে থেমে যায়’। মনে করা যাক কেউ একটি বই পড়ে জ্ঞান অর্জন করল। সেই জ্ঞান গিয়ে থামে কোথায়? থামে মনের আকাশে, তাকে আমরা খ বলব। কেউ খক্ খক্ ক’রে কাশলে সে কাশি গিয়ে থামে কোথায়? থামে পার্থিব আকাশে (sky), একেও খ বলা যায়। খান-চক্রবর্তীর কাছে আকাশ মানে শুধু বাহ্য আকাশ নয়, মনের আকাশ অধিক গুরুত্ত্বপূর্ণ। আর এক রকম খ্ আছে, তা হল ক্ষ-এর বিবর্ত্তিত রূপ। ক্ষ থেকে জাত খ-এর অর্থ হল মূল অবয়ব থেকে খনন ক’রে বা কেটে নেওয়া। এই কারণে খ শূন্যকে, আকাশকে, এমনকি মুখগহ্বরের ফাঁকা স্থানকে বুঝাতে পারে। উদাহরণ হিসাবে অশ্বের মুখে যা লীন হয় তাকে খলীন (লাগাম) বলে। এবার খোল ও খোলা শব্দ দু’টিকে বিবেচনা করুন। খোল আর খোলার মধ্যে শূন্যস্থান আছে। সেই সঙ্গে দেখুন উক্ত শব্দ দুটির বানানেও খ রয়েছে।
খ বর্ণের অর্থ বলার সঙ্গে সঙ্গে এখানে ক্ষ বর্ণের অর্থও একটু বিশদে বলছি। তন্ত্রে ক্ষ একটি পৃথক বর্ণের মর্য্যাদা পেয়েছে। ক্ষ বর্ণের অর্থ ‘ক্ষ-করণ’ বা খুবলে নেওয়া। একে ক্ষয় পাওয়াও বলতে পারেন। রক্ষ শব্দটি বিবেচনা করুন। রক্ষ শব্দে র মানে রক্ষণ, ক্ষ মানে ক্ষ-করণ। তাই রক্ষ মানে হল যে ক্ষ-করণ থেকে রক্ষা করে বা বাঁচায়, অর্থাৎ রক্ষক। এবার রক্ষস শব্দটি বিবেচনা করুন। খান-চক্রবর্তীর মতে স বর্ণে শেষাবস্থা বুঝায়। রক্ষস মানে রক্ষ-এর শেষাবস্থা এবং শেষাবস্থায় রক্ষকই ভক্ষক হয় (অতিরক্ষণ ভক্ষণে পরিণত হয়)। রক্ষস মানে তাই রাক্ষস হতে পারে, যে আমাদের আমাদের ভক্ষণ করে। খান-চক্রবর্তী অবশ্য রাক্ষস বলতে প্রথমে সরকারী সংস্থাগুলিকে বুঝেছেন, যারা জনগণের অর্থ রক্ষণের নামে ভক্ষণ করে। রামায়ণে রাবণকে রাক্ষস বলা হয়েছে। খান-চক্রবর্তী এখানে রাবণ বলতে তৎকালীন দুষ্ট শাসকদেরই বুঝেছেন, যাদের রবে ভুবন কাঁপত (রাবণ মানে ‘রব কারয়িতা’)। এবার ক্ষার শব্দটি বিবেচনা করুন। ক্ষার শব্দে ক্ষ বর্ণে ক্ষ-করণ এবং র বর্ণে রহন বুঝুন (র বর্ণে রহন, রক্ষণ দুই হয়)। বর্ণভিত্তিক নিয়মে ক্ষার মানে যাতে ক্ষ-করণ রয়। ক্ষার ময়লার ক্ষরণ ঘটায় এবং আমাদের চামড়ারও ক্ষয় ঘটাতে পারে। সুতরাং তার ক্ষার নাম সার্থক। আবার দু’জন বিবাদমান ব্যক্তি পরস্পরকে ক্ষ-করণ করলে (দৈহিক বা মানসিকভাবে খামচাখামচি করলে) আমরা বলি ওদের মধ্য ক্ষারাক্ষারি আছে। এবার ক্ষমা শব্দের বর্ণভিত্তিক অর্থ বলি। ক্ষ+মা=ক্ষমা। এখানে ক্ষ মানে ক্ষ-করণ, মা মানে না। ক্ষমা মানে যেখানে ক্ষ-করণ নাই। দুই বিবাদকারী পরস্পরকে ক্ষমা করলে ওদের পারস্পরিক ক্ষ-করণ মা বা না হয়ে যায়। এখানে বলে রাখি যে, মা মানে যে না হয় তা `মানা’ শব্দটি থেকে বুঝা যেতে পারে। মানা মানে হল ‘না না’ (‘no no’)।
এবার গ বর্ণের অর্থ নিয়ে কিছু কথা বলি। ‘বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ’-এ গ বর্ণের অর্থ ‘গমন করে যে।’ গঙ্গা (গম্+গ+আ) শব্দের ক্রিয়াভিত্তিক অর্থ হতে পারে ‘গামীর রহস্যময় গমন যাহাতে’ (গ বর্ণে গমন আর ঙ বর্ণে রহস্যময়তা বুঝতে হয়)। ক্রিয়াভিত্তিক নিয়মে এই গঙ্গা অবশ্য শুধু গঙ্গা নদী নয় — অশ্রুগঙ্গা, পণ্যগঙ্গা ইত্যাদিও হতে পারে। এবার গো শব্দটি ধরুন। গো শব্দের ক্রিয়াভিত্তিক অর্থ হল ‘যে যায়’। ক্রিয়াভিত্তিক নিয়মে গো শব্দ টি গরু, পশু, বাক, বজ্র, আলোকরশ্মি ইত্যাদি বহু কিছুকে বুঝাতে পারে যারা গমনশীল। আলোকরশ্মি যায় বলেই তাকে গো বলে। গো এবং অক্ষ জুড়ে গবাক্ষ হয়, যা আসলে গো বা আলোকরশ্মি যাবার অক্ষ বা ছিদ্র। আপনারা জানেন যে, দেওয়ালের মাঝে অবস্থিত যে গোলাকার ছিদ্র দিয়ে ঘরে আলো আসে তাকে গবাক্ষ বলে। আবার পৃথিবীকে গো বলে কারণ পৃথিবীর উপর দিয়ে আমরা যাই। স্বর্গকে গো বলে কারণ সেখানে যাওয়া হয়। গোপাল মানে পৃথিবীর পালক, এখানে গো মানে পৃথিবী বলে বুঝে নিতে হবে। আবার ইংরেজী go মানেও যাওয়া। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ এবং খান-চক্রবর্তীর ‘বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ’ গ্রন্থে গো শব্দের আরো অনেকগুলি অর্থ আছে।অমরকোষে প্রদত্ত গো শব্দের বহু বিচিত্র অর্থে বিস্মিত হয়ে সুকুমার রায় তাঁর ‘খণ্ডিত গোধন মণ্ডল ধরণী’ ছড়াটি লিখেছিলেন, যা তার ‘চলচিত্ত-চঞ্চরী’ নাটিকায় আছে। খান-চক্রবর্তী দেখিয়েছেন যে, ক্রিয়াভিত্তিক নিয়মে গো শব্দের (এবং অন্যান্য শব্দেরও) এত বিচিত্র অর্থ ব্যাখ্যা করা যায়। পাঠক গো শব্দের বহুবিচিত্র অর্থকে উপলব্ধি করলে বাস্তবিকই বিশ্বরূপ দর্শন করবেন। খান-চক্রবর্তী এইভাবে শব্দে-শব্দে, বর্ণে-বর্ণে বিশ্বরূপ দর্শন করিয়েছেন।
স্বরবর্ণের মধ্যে অ এবং আ বর্ণের অর্থ নিয়ে কিছু কথা বলছি। খুব সংক্ষেপে বলতে গেলে অ মানে অস্তিত্বমাত্র এবং আ মানে অস্তিত্বের আধার। অণ্, অণু ইত্যাদি শব্দে অ বর্ণে অস্তিত্বন ক্রিয়াকে বুঝতে চেষ্টা করুন। প্রসঙ্গত, অণ্ শব্দে ণ বর্ণে ‘রহস্যময় টঙ্কারণ’ বা প্রকটিত হওয়াকে বুঝতে হবে। অবশ্য ণ বর্ণের বিস্তারিত বলার অবকাশ এখানে নাই (এজন্য ‘বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ’ দ্রষ্টব্য)। বর্ণভিত্তিক নিয়মে তাই অণ্ মানে অস্তিত্বের প্রকটন বলে বুঝতে পারেন। অণ্ মানে শূলাগ্র, সূচ্যগ্র ইত্যাদি হয় (দ্র. ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’) যেখানে অস্তিত্বের ভাবমাত্র বা তন্মাত্র রূপকে বুঝা যায়। অণ্ শব্দের সঙ্গে উ-কার যোগ করলে অণু হয়। অণ্ শব্দে অস্ত্বিতের যে তন্মাত্র রূপ, অণু শব্দে তার আরো প্রকটন লক্ষ করা যায়। অণু শব্দটি সূক্ষ্ম কণাকে বুঝায়, যা অস্ত্বিত লাভ ক’রে উত্তীর্ণ (উ মানে নবরূপে উত্তরণ) হয়ে যায় এবং তটস্থ লক্ষণ নিয়ে টিকে থাকতে সক্ষম হয়। আপনারা জানেন যে, পদার্থের অণুর মধ্যে তার ধর্ম্ম বিদ্যমান থাকে। এবার আ বর্ণের কথায় আসি। আকাশ শব্দটি বিবেচনা করুন। আকাশ মানে কী? আ+কাশ=আকাশ। আ মানে আধার, কাশ মানে প্রকাশ পাওয়া এবং আকাশ মানে কাশের (প্রকাশিত হবার) আধার — এইভাবে বুঝা চলে। খান-চক্রবর্তী জানাচ্ছেন যে, খক্ খক্ কাশি, বিচ্ছুরিত কাশফুল এবং আরও যা কিছু প্রকাশিত হয় তাদের আধার বলেই আকাশকে আকাশ বলে। চন্দ্রমোহন তর্করত্ন প্রণীত অমরকোষের টীকাকে অবলম্বন করে হরিচরণবাবুর ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ গ্রন্থে আকাশ শব্দের ক্রিয়াভিত্তিক অর্থ করা হয়েছে, ‘যেখানে চারিদিকে সূর্য্যাদি প্রকাশ পায়’। এবার ধরুন আড় শব্দটি। আড় শব্দে আ মানে আধার এবং ড় মানে ‘গড়ান-উড়ান’। জমির আল তার ভিতরে গড়ান–উড়ানকারী জলের আধার, এই কারণেই তাকে আড় বলে। এইভাবে আড় শব্দের বর্ণ দুটি থেকে তার অর্থ পাওয়া গেল। আড় মানে জমির আল ছাড়াও পুকুরের পাড়, নদীর তীর, পর্দা, প্রস্থ ইত্যাদিও হতে পারে যাদের মধ্যে কোনো সত্তা আধারিত হয়ে গড়ান-উড়ান করে। আবার আড় শব্দের মানে বুঝে নিলে আড়াল, আড়া, আড়ি ইত্যাদি শব্দগুলির অর্থ বুঝে নিতে বেশী সময় লাগে না। জমির আড় যেন দু’টি পাশাপাশি জমির মধ্যে ব্যবধান বা আড়ি করিয়ে দেয়। আড়ালকোলা হল সেই গ্রাম যা বনের আড়ালে এবং তার কোলে আছে। বাঁকুড়ার এই ছোটো গ্রামটি বর্ত্তমান লেখকের জন্মভূমি পাঁচাল গ্রামের পাশে বনের কোলেই আছে। খান-চক্রবর্তীর দেখানো পথে আমাদের প্রতিবেশী এই গ্রামটির আড়ালকোলা নামের এই ক্রিয়াভিত্তিক অর্থ আমি নিষ্কাশন করেছি। খান-চক্রবর্তীর অভিধানগুলি থেকে এইভাবে শত শত শব্দের ক্রিয়াভিত্তিক–বর্ণভিত্তিক অর্থ, একসঙ্গে গুচ্ছ গুচ্ছ শব্দের অর্থ এবং বর্ণে-বর্ণে ও শব্দে-শব্দে এক বিরাট জাল (সঙ্গীতের সুরজালের মতো) অনায়াসে উপলব্ধি করা যায়। ‘বর্ণসঙ্গীত’ গ্রন্থেও এই বিষয়টি আছে। মেধাবী পাঠক এইসব অভিধান পড়ে অখণ্ড শব্দকল্পদ্রুমকে দেখতে পাবেন, যা মনশ্চক্ষে দেখতে হয়।
এবার ড় বর্ণের অর্থ নিয়ে কিছু কথা বলি। নীড় শব্দটি ধরুণ। নীড় শব্দে ন বর্ণে ‘নাকরণ-অনকরণ’ (on-off করা) এবং ড় বর্ণে উড়ান ক্রিয়াকে বুঝা যায়। নীড় মানে যেখান থেকে পাখীর উড়ান (ড়) অনকৃত ও নাকৃত (ন) হয়। পাখীর বাসা বা নীড় থেকে পাখীর উড়ান শুরু (অনকরণ, on-করণ) এবং শেষ (নাকরণ, off) হয়, তাই উহা নীড়। পাখীর বাসাকে বাসা বলে কারণ পাখী সেখানে বসে, বাস করে। আবার বাসাকে কুলায় বলে কারণ সেখানে তার কুলের আয় বা বংশবৃদ্ধি হয়। বাসা শব্দটিকে শুধু ক্রিয়াভিত্তিক নয়, বর্ণভিত্তিক উপায়ে ব্যাখ্যা করা যায়; কিন্তু এখন সে অবকাশ নাই।
এখন বর্ণমালার শষ বর্ণ বিসর্গ বর্ণের অর্থ বলছি। সংস্কৃতে বর্ণমালা বিন্দু দিয়ে শুরু আর বিসর্গ দিয়ে শেষ হয়। এর থেকে ‘বিন্দুবিসর্গ’ শব্দটি এসেছে। বিন্দুবিসর্গ শব্দে বিন্দু মানে শুরু আর বিসর্গ মানে শেষ ধরুন। কোনো বিষয়ের বিন্দুবিসর্গ না জানা মানে পুরা বিষয়টাই না জানা (শুরু থেকে শেষ কিছুই না জানা)। সর্গ মানে সৃষ্টি, বিসর্গ মানে তার বিপরীত বা বিসর্জ্জন। যখন আমরা ডাক্তার বুঝাতে ‘ডাঃ’ লিখি তখন তার ঃ বর্ণে এই বুঝতে হবে যে উক্ত শব্দটি থেকে শেষের কিছু বর্ণকে (‘ক্তার’-কে) বিসর্জ্জন দেওয়া হয়েছে। আবার যখন ‘অত্যন্তঃ’ বানানের শেষে আমার বিসর্গ দিই তখন তার মানে এই যে আমরা অতিশয় অন্তে বা শেষাবস্থায় পৌঁছেছি (এখানে বিসর্গ বর্ণে শেষাবস্থা বুঝায়)। বর্ণমালার সব বর্ণের অর্থ এই প্রবন্ধে বলা সম্ভব নয়। যারা বর্ণমালার প্রতি বর্ণের ক্রিয়াভিত্তিক অর্থ এবং বর্ণগুলির ক্রমের ব্যাখ্যা চান, তারা ‘বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ’ পাঠ করুন।
শব্দের ভিতরের ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক অর্থ বুঝতে গেলে গভীর চর্চ্চার প্রয়োজন এবং সেজন্য ইতিবাচক মন নিয়ে এগোতে হয়। এক একটি বর্ণের অর্থ বহুদূর বিস্তৃত এবং খান-চক্রবর্তী অনেক সময় এক একটি বর্ণের অর্থ প্রকাশ করতে অনেকগুলি বাক্যের সাহায্য নিয়েছেন। তবু বিষয়টি নিয়ে চর্চ্চা করলে পাঠকের কাছে বর্ণগুলির অর্থ ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়ে যায় এবং তা উপযুক্ত পাঠকের কাছে এক বিরাট পাওনা হয়। এছাড়া আরো বলে রাখি যে, বাংলা শব্দগুলির ভিতরের মানে বুঝতে গিয়ে সর্বদা সব শব্দেরই বর্ণভিত্তিক অর্থ খুঁজতে হবে তা কিন্তু নয়। যেখানে কোনো শব্দকে ভেঙে একটি ক্রিয়ামূল পাওয়া যায়, সেখানে সেই ক্রিয়া ধরেই শব্দের অর্থ ব্যাখ্যা করা যাবে, বর্ণভিত্তিক অর্থের প্রয়োজন হবে না। যেমন সুকুমার রায় তাঁর ‘দাঁড়ের কবিতা’ ছড়ায় দাঁড়া, দাঁড়ি ও দাঁড়কাকে মিল কোথায় সেই প্রশ্ন করেছেন। উত্তরে বলব যে, এই সব শব্দগুলিই দাঁড়ানো ক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত এবং সেখানেই তাদের ক্রিয়াভিত্তিক মিল। দাঁড়কাক হল সেই কাক যে কাক নির্ভয়ে দাঁড়াতে পারে। দাঁড় মানে পাখী বসার দণ্ড হতে পারে, যেখানে পাখী খাড়া হয়ে দাঁড়ায়। আবার দাঁড় মানে নৌকার দাঁড়ও হত পারে যা নৌকাকে দাঁড় করায়। দাঁড়ি মানে পূর্ণচ্ছেদ, যা বাক্যকে দাঁড় করিয়ে দেয়। এইভাবে দাঁড়া, দাঁড়ি ও দাঁড়কাকের সম্পর্ক বুঝা যায় এবং সুকুমারকথিত সমস্যাটির সমাধান পাওয়া যায়। এরপর কেউ চাইলে তিনি দাঁড় শব্দটিকে দ ও ড় ইত্যাদি বর্ণে ভেঙে তার অর্থ নিষ্কাশনের চেষ্টা করতে পারেন, তবে সর্বদা তার দরকার হয় না। কিন্তু যেখানে ক্রিয়ামূল পাওয়া যায় না সেখানে বর্ণার্থ থেকে এবং অন্যান্য শব্দের সঙ্গে তুলনা ক’রে শব্দার্থ নিষ্কাশন করার দরকার হয়। এইভাবে তথাকথিত অবুৎপন্ন (যাদের প্রচলিত প্রকৃতি-প্রত্যয়ে ভাঙা যায় না) শব্দগুলিরও অর্থ পাওয়া যেতে পারে।
এবার আসি খান-চক্রবর্তী পুরাণাদির যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন সেই প্রসঙ্গে। পুরাণাদির মধ্যে অনেক ইতিহাস লুকিয়ে আছে এবং বহুকাল ধরে বহু গবেষক তা নিয়ে গবেষণা করেছেন। কিন্তু খান-চক্রবর্তী তাঁদের ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থবিধির সাহায্যে পুরাণাদির অর্থের ব্যাপারে যে গভীর আলোকপাত করেছেন তেমনটা আগে হয়নি। আমি এইসব বিষয়ে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ডিডি কোসাম্বী, গিরীন্দ্রশেখর বসু, সুকুমারী ভট্টাচার্য্য, নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী প্রভৃতির রচনার সঙ্গে অল্পবিস্তর পরিচিত আছি। পুরাণাদি যে আমাদের ইতিহাস সে বিষয়ে সংশয় নাই। খান-চক্রবর্তীর অভিধানে পৌরাণিক শব্দর অর্থের আলোয় পুরাণব্যাখ্যা পড়ে পুরাণাদির প্রতি আমার শ্রদ্ধা অনেক বেড়ে গেছে। এখানে বলে রাখি যে, ওরা পুরাণাদির যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা অনেকটা জোর ক’রে মেলানো বলে অনেকে মনে করেন। সবাই ওদের পুরাণব্যাখ্যার সঙ্গে সম্পূর্ণ সহমত না হলেও তা যে প্রাচীন ভারতের ইতিহাস উন্মোচনের একটা নতুন পথ দেখিয়েছে এই নিয়ে কিন্তু সংশয় নাই। পুরাণাদির অর্থ বিষয়ে এর চেয়ে ভাল ব্যাখ্যা আমি এখনো পাইনি। সেই সঙ্গে এই কথাও বলা দরকার যে, এতদিন রামায়ণমহাভারতপুরাণাদির ভুল ব্যাখ্যা ক’রে এক শ্রেণীর মানুষ আর এক শ্রেণীর মানুষকে শোষণ ক’রে আসছে। খান-চক্রবর্তীর অভিধানগুলি হিন্দু মৌলবাদের এবং সাধারণভাবে সব রকমের মৌলবাদের স্বরূপ উন্মোচন ক’রে সেই শোষণের অবসান ঘটাতে প্রভূত সাহায্য করতে পারে। সম্প্রতি শ্রীদেবতোষ দাস ‘বিন্দুবিসর্গ’ নামে একটি উপন্যাসে এই বিষয়টি উপস্থাপন ক’রে আমাদের কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছেন।
কেউ কেউ হয়ত ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থবিধি সম্বন্ধে সংশয়ী হতে পারেন। তাদের জন্য বলি যে, খান-চক্রবর্তীর অভিধানগুলি খুঁটিয়ে দেখে বহু হাজার শব্দের ক্রিয়াভিত্তিক ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট হয়ে পরে আমি ওদের তত্ত্বকে মেনেছি। এছাড়া সুকুমার রায় ভাষাদর্শন সম্বন্ধে এবং আমাদের কিম্ভূতকিমাকার জগৎ সম্বন্ধে যেসব প্রশ্ন তুলেছেন খান-চক্রবর্তীর তত্ত্বের সাহায্যে সেগুলির উত্তর দিয়ে আমি এই তত্ত্বের ফলিত প্রয়োগ দেখিয়েছি, যা আমার পদ্যাভিধান ‘বর্ণসঙ্গীত’ এবং ‘সুকুমার সাহিত্যে অটিজম্’ গদ্যগ্রন্থে লিপিবদ্ধ হয়েছে। এই বইগুলি ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থবিধির সাহায্যে অটিজমে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ভাষাসমস্যার সমাধানেরও একটি পথ দেখায়। দুঃখের বিষয় শেষোক্ত বইটির ছাপা কপি আমি কলিম খান মহাশয়ের হাতে তুলে দিতে পারলাম না। আর এটা প্রশ্ন হল, বিদেশী শব্দে এই নীতি কতটা প্রযোজ্য? এই ব্যাপারে বলি যে, ভাষায়-ভাষায় গভীর সম্পর্ক থাকে এবং বাংলা মূল ধরে ইংরেজী ও অন্যান্য বিদেশী ভাষার বহু শব্দকেও ব্যাখ্যা করা যায়, যার বহু উদাহরণ খান-চক্রবর্তী দেখিয়েছেন। পণ্ডিতেরা সেই উনবিংশ শতাব্দী থেকেই ইন্দোইউরোপীয় ভাষাপরিবারের নানা ভাষার শব্দগুলির মধ্যে গভীর মিলের কথা বলে আসছেন। খান-চক্রবর্তী দেখাতে চেষ্টা করেছেন যে, পৃথিবীর সব ভাষাই একই আদি ভাষা থেকে জাত হয়েছে এবং সব ভাষার সব শব্দই ক্রিয়াভিত্তিক নিয়মে বোধগম্য হয়। ভাষাবিদ নোয়াম চমস্কির সার্ব্বজনীন পদবিন্যাসের নীতির (universal syntax) মত তাঁরা বলেছেন সার্ব্বজনীন নিরুক্তের (universal semantics) কথা। এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা বর্ত্তমান নিবন্ধে সম্ভব নয়। সারা পৃথিবীর যোগ্য ব্যক্তিরা বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করলে একটা দারুণ কাজ হবে।
খান-চক্রবর্তীর অভিধানগুলি এখনো বাংলার সারস্বত সমাজে যথাযোগ্য মর্য্যাদা লাভ করেনি। কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিয়ে বাংলার প্রথিতযশা কবি কবিসাহিত্যিকদের কেউ ওদের নাম শোনেননি, কেউ বা ওদের রচনার সঙ্গে পরিচিত নন, কেউ হয়ত সব জেনেও বিষয়টি নিয়ে এখনো ঘুমিয়ে আছেন। এমনটা হল কেন? এর একটা কারণ ওদের বক্তব্য নতুন এবং নতুন কথা গৃহীত হতে সময় লাগে। উপযুক্ত স্বীকৃতি না পেয়ে, অর্থকষ্টে ভুগে এবং অবশেষে দুরারোগ্য রক্তের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে কলিম খান আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। তাঁর মৃত্যুসংবাদও কোনো খবরের কাগজে প্রকাশিত হয়নি, এ বড় লজ্জার কথা। এরই মধ্যে একটু আশার কথা এই যে, দুই বাংলার বহু বাংলাপ্রেমী মানুষ ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থবিধির মধ্যে বঙ্গ ও ভারতীয় সংস্কৃতির মূলের সন্ধান পেয়ে এর চর্চ্চায় এগিয়ে এসেছেন। আপনারা বাংলা ভাষা ও বিশ্বের স্বার্থে বাংলা বর্ণগুলির অর্থ দিকে দিকে ছড়িয়ে দিন এবং কলিম খান ও রবি চক্রবর্তীর উত্তরাধিকার বহন করুন, এই অনুরোধ রইল। সেটাই হবে ওদের শ্রদ্ধা জানানোর ঠিক পথ। জয় হোক ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থবিধির। জয় হোক বাংলা ভাষার।
মার্চ ১২, ২০২২; ১:৩৫ পূর্বাহ্ন
খুবই ভালো। তবে ভাষা যেখানে থেমে যায়, সেখানে কাদের বোঝাবেন?
মে ৩, ২০২২; ৯:০২ পূর্বাহ্ন
খুব প্রয়োজনীয় আলোচনা।
নভেম্বর ২৮, ২০২২; ১০:৪৯ অপরাহ্ন
অভিনব।