০
৬২৩ বার পঠিত
১৮৯৬ সালে প্রথম বারের মত নিউইয়র্ক শহরে যখন সিনেমা দেখানো হলো তখনো এর সামাজিক শক্তি ও সক্ষমতা নিয়ে পশ্চিমা তথা ইউরোপ তেমন চিন্তিত ছিল না। রুশ বিপ্লব কালে লেনিন সিনেমার সক্ষমতাকে ব্যবহার করলেন, তার দুই প্রপাগান্ডা সেনাপতি আইজেনস্টাইন ও পুদোভকিন তৈরি করলেন সিনেমা শিল্প-সূত্র। রুশ বিপ্লবের পর রাষ্ট্রীয় নীতিমালার অধীনে আইজেনস্টাইন চুপকরে গেলেন আর পুদোভকিন হলেন মাস্টারমশাই।
খ
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিনীরা সিনেমার সকল শক্তিকেই চিনে গিয়েছিল। গ্রিফিতের শিল্প-সূত্র কিংবা চ্যাপলিনের সমাজ সমালোচনা। তাই চ্যাপলিন হলেন যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া।
গ
১ম ও ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময়ই বোঝা গেছে রেডিওর শক্তি। হিটলার বা গোয়েবলস দেখিয়ে দিলেন কিভাবে জনতার মাথা খেতে হয়।
ঘ
টেলিভিশনের আলোর ঝলক জনতাকে বোকায় পরিণত করবে সেটাই ছিল লক্ষ। সেটা হলোও। তাই তার নাম বোকাবাক্স।
ঙ
ইউরোপের উপনিবেশগুলি যেন ইউরোপের প্রতিদ্বন্দ্বী হতে না পারে বা স্বাধীন হতে না পারে তারই পরিকল্পনায় প্রাচীন সাম্রাজ্যবাদী কৌশলের অংশ হিসেবে সে অঞ্চলের ভাষা ও সংস্কৃতি ধ্বংস করা হয়েছে ৩/৪শ বছর ধরেই। সেটা করতে প্রয়োজনে স্থানীয়দের হত্যা করতেও পিছপা হয়নি পশ্চিম ইউরোপিয়রা। আবার শ্রমিক জোগান দিতে আফ্রিকা থেকে ধরে-বেধে নিয়ে যাওয়া হয়েছে কালো মানুষদের অথবা অর্থ ও সুখের লোভ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে আরব, চিন ও ভারতীয়দের। যে আমেরিকা ছিলো ইউরোপিয়দের প্রমোদ ও ভাগ্য সন্ধানের ভূমি সে আমেরিকা স্বাধীন হলে ইউরোপিয় সমাজ নতুন এক দিশা পেল, তার নাম ‘আধুনিকতা’। সাম্রাজ্য বিস্তারের নতুন কৌশল।
মানুষের চিন্তাশীল-স্বাধীন মাথাই যদি না থাকে সে তবে কেমনে মানুষ? তো উপনিবেশকে ‘শিক্ষিত’ করে তোল। রক্তপাত ছাড়াই তাকে পরিণত কর নিছক প্রাণীতে কিংবা দাসে। বনের সিংহ, বাঘ, হাতী কিংবা বান্দর সকলেই সভ্য-ভব্য হয় শিক্ষায়! অতঃপর তাহারা সার্কাসের সিংহ, বাঘ, হাতী ও বান্দর।
ভারতে চালু হলো ‘ইংরেজি’ শিক্ষা…
চ
আধুনিকতার পাঠপ্রদান সাপেক্ষে ২য় বিশ্বযুদ্ধ শেষে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠা হলে ইউরোপ তার উপনিবেশগুলিকে স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদায় ভূষিত করলো। এরমধ্যে কেউ কেউ সত্যি স্বাধীন হতে জেনেছিল, তারা আধুনিকতার পাঠ আর নিজের ভাষা ও সংস্কৃতির মিশেলে হয়ে উঠেছে ইউরোপের প্রতিদ্বন্দ্বী।
ছ
ভারতবর্ষ’র অবস্থা কী?
পকিস্তানের সামন্ত প্রভুরা প্রকৃত উপনিবেশীক আধুনিক, শিক্ষা পুরোটাই ইংরেজিতে এবং ইংরেজদের লেখা ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক ম্যানুয়াল অনুযায়ী। আর সাধারন মানুষ! তাহারা দুটো রুটির দাস আবহমান কাল ধরে।
ভারত! ১০ বর্গ কিলোমিটার স্বাধীনতার সন্ধানরত তো ১০ বর্গ কিলোমিটার পাকিস্তানের হিন্দুস্তানি চেহারা। ওখানে মসজিদ তো এখানে মন্দির। ওখানে আজান তো এখানে ঘণ্টা।
জ
বাংলাদেশের কী অবস্থা?
কান নিয়েছে চিলে…
বাংলার কেন্দ্রীয় অভিজাত ও আঞ্চলিক অভিজাতের দন্দ্ব সেই বৈদিককাল থেকেই বিরাজমান। মুঘল বা ব্রিটিশ সে দ্বন্দ্বকে কাজে লাগিয়েই বাংলা থেকে নিয়ে গ্যাছে তাহাদের সম্পদের কাঁচামাল। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্রিটিশদের মস্তিস্কপ্রসূত নয়, ব্রিটিশরা শুধু এটা আবিস্কার করেছে। বৈদিক যুগেও এ পদ্ধতিতে বাংলার শাসনের হাত বদল হয়েছে, ব্রিটিশরা শুধু এর নামকরণ বা ব্র্যান্ডিং করেছে।
যেহেতু এই বাংলায় চিলে কান সকাল বিকাল নিয়ে যায় তাই এখানে এটাই সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি। ভারত বা পাকিস্তানে দুটো রুটির সন্ধানে ব্যস্ত সাধারণ আর বাংলার সাধারণ ব্যস্ত কান নিয়ে যাওয়া চিলের খোজে…
বাংলার ভাষা আন্দোলন যতটা জেগে ওঠা ততটাই কান নেয়া চিলের সন্ধান।
তাই কেন্দ্রীয় অভিজাত বা এলিটদের নেতৃত্ব ছাড়াই বাংলা হলো স্বাধীন। কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব না থাকলেও রুশ বিপ্লবের পর একমাত্র বিপ্লব যেখানে আঞ্চলিক বা গ্রাম্য নেতৃত্ব বা মধ্যবিত্তই নেতৃত্ব বা চালকের আসনে।
যে কোন কিছু পরিচালনা করতে লাগে সঠিক পরিকল্পনা ও অর্থ। অধিকাংশ বিপ্লব বা উদ্যোগ ব্যর্থ হয় এ দু’টোর অভাবে। ১৯৭১ এবং ১৯৭২-এর বাংলাদেশ সরকারের এটাই ব্যর্থতা, কীভাবে অর্থ সংগ্রহ হবে তা পূর্ব পরিকল্পনায় ছিলনা। অর্থ যাদের হাতে (অভিজাত বা এলিট) তারা মনে ও মগজে বাংলাদেশী নয়…
ঝ
মুজিব সরকার চলচ্চিত্রের সকল শক্তিকে জানতো, জানতো টেলিভিশনের শক্তিকেও। তাই সিনেমা ও টিলিভিশন দুটোকেই দাড় করানোর ইচ্ছে আমরা দেখতে পাই তাদের কর্মকাণ্ডে।
ঙ
১৯৭৫ পরবর্তী সামরিক সরকারও চলচ্চিত্রের সকল শক্তিকে জানতো, জানতো টেলিভিশনের শক্তিকেও। টেলিভিশন রঙিন করা হলো দ্রুতই, সেটার অনুষ্ঠান নির্মাণ প্রচার করবার দায়িত্বে অনুগত আমলারাই। যদি কিছু মনে না করেন ইহাই আমাদের ‘সকাল সন্ধ্যা’, ইহাই আমাদের ‘এইসব দিন রাত্রি’। আর চলচ্চিত্রে বিনিয়োগ করলেন তারা, যারা মনে ও মগজে বাংলাদেশী নয়। সকল বিনিয়োগ পকেটে অর্থ ফেরাবার জন্য নয়; কখোনো টাকা ওড়াবার জন্যও, ‘ঢাকা শহর আইসা আমার পরান জুড়াইছে…’* কারণ এখানে ‘টাকা উইড়া বেড়ায় রে…’ আর যদি ‘টাকা দেন’ তয় ‘দুবাই যামু’ নাইলে কিন্তু ‘বদনাম’ হয়ে যাবে, জানেন তো ‘মিন্টু আমার নাম’।
চ
চ্যাপলিনকে তো যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া করা হলো, কিন্তু কতো চ্যাপলিনকে ফেরৎ পাঠানো হবে আটলান্টিকের ওপারে? নীতিমালা দিয়ে আটকাতে গেলে বিক্ষোভ হতে পারে, তাই ‘রোমান হলিডে’ কিংবা ‘বেনহার’ কিংবা ‘ক্লিওপেট্রা’ আর হিটলারকে সালাম জানিয়ে ‘টু ওমেন’ এর রঙিন দুনিয়া! টেলিভিশন প্রথমথেকেই বোকাবাক্স। চলুন এন বি এল দেখি। আর তথ্যই অধিকার, তথ্য ক্ষুদার্থরাই বিজ্ঞাপন দেখে। ও হ্যাঁ, ‘টারজান‘, ‘সিক্স মিলিয়ন ডলারম্যান‘, ‘সুপারম্যান‘, ‘ম্যাকগাইভার‘ আমরা বাংলাদেশীরাও দেখেছি…
ধন্যবাদ জেনারেল জিয়া, আপনি আমাদের এতো এতো উন্নতমানের অনুষ্ঠান দেখিয়েছেন যে আজো আমরা সে আশায় আমাদের চ্যানেলগুলো না দেখে বিদেশি চ্যানেলে সে মান খুজি। আর দুঃখিত হাজার হাজার সেনা, বিমান ও নৌ কর্মকর্তা; টেলিভিশনের বিস্ফোরণের শব্দে আমরা আপনাদের বুকে চালানো বুলেটের শব্দকে আলাদা করতে পারিনি!
ছ
আমরা তখন নতুন কুড়ির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, তাই নাচ গান ছবি আঁকা সবই হয়ে গেল জাতীয় প্রতিযোগিতা। ওই মেধার সন্ধান আর কী! খেলাঘর, কচি কাঁচার মেলা বা চাঁদের হাটের আনন্দ আশ্রমে থাকলে আমাকে আর মা’কে টিভিতে কীভাবে দেখা যাবে? যে করেই হোক ফার্স্ট হতে হবে…
ঞ
দূরদর্শনের সিগনাল শক্তিশালী হলে বাংলাদেশ টিলিভিশন ঝিরঝির হয়ে যায়, এটা ভারতীয় আগ্রাসন। তাই ১৯৯৩ এ আমরা বৈশ্বিক হয়ে গেলাম, আকাশ জুড়ে জি… সিনেমা ও সিরিয়াল। আগেই ভিসিআরের চোরাই পথে আমাদের স্বপ্নের দুনিয়ায় অমিতাভ, রেখা, হেমা… বাবা’রা-মা’রা পড়ে আছেন সুচিত্রা উত্তমে। ৬৭-৭৭ আমাদের ঘরে এসেছিলেন রহমান, সুচন্দা, রাজ্জাক, কবরী, ফারুখ, ববিতা তারপর শুধুই শাবানার কান্না…
ট
শাবানার কান্নার চেয়ে সুবর্ণা আফজালের প্রেম অধিক সুন্দর। আর মধ্যবয়সী জমিদারের সাথে কিশোরী শ্যালিকার প্রেম ঐতিহাসিক সত্য। ভুলকরে মুনির চৌধুরী লিখেছিলেন ‘শংসপ্তক’, ক্লাসিক তো ক্লাসিকসই। বাপুরাম সাপুড়ে, কোথা যাস বাপুরে…
ঠ
আমাদের ‘কান নিয়েছে চিলে’; তাই যদি কিছু মনে না করেন, কিছু কথা বলতে চাই- বিটিভির স্বর্নযুগ আমাদের রাজাকারদের টুপি-দাড়ির লেবাস পড়িয়েছে, শিখিয়েছে টাকার জন্য দুবাই যেতে, শিখিয়েছে প্রতিযোগিতা ও তাতে জয়ী হওয়ার আশায় দৌড়াতে। আমরা ভুলেছি সিনেমা হলে যেতে। একাত্তর মানে কিছু প্রেম ও শরণার্থী যাত্রা, ১৯৫২ থেকে ১৯৭১ কিছু ও অজস্র মৃত মানুষের নাম ও অথবা নামহীনতা। দেশ মানে ইতিহাস ও নেতৃত্ব নায়কবিহীন এক যাত্রা অথবা কিছু সামরিক অ্যাকশন বা গুলির আওয়াজ…। (একালেই বিশ্ববিদ্যালয় হলগুলি যেন তাই কিছুদিন বিরতিতে সে আওয়াজেরই প্রতিধ্বনি তোলে…)
সিনেমা, সেখানেই কিছু চ্যাপলিনের আশা আজো আছে, আজো মাইকেল মুরেরা সেখানে জন্ম নেয়। জহির রায়হান মরে গিয়ে বেঁচে গ্যাছেন, না হলে হয়তো তিনিও বিটিভির স্বর্ণযুগের স্বর্ণকার হয়ে যেতেন…
বাঙালির কান যে চিলে নিয়ে যায়…
* প্রতিদিন ঢাকা শহরে বাড়ছে ১৬০০০ মানুষ
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন