কারবালা যুদ্ধের কথিত কারণ
কারবালা যুদ্ধ কেন সংঘটিত হয়েছিল, এর পশ্চাতে কী কী কারণ রয়েছে এবং এই যুদ্ধের জন্য কে বা কারা দায়ী এই প্রশ্নগুলি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যাঁরা এই যুদ্ধের ইতিহাস কীছুটা পড়েছি বা শুনেছি তাঁরা প্রায় সকলেই বোধ হয় কম বেশী এটাই জানি যে, এই যুদ্ধের জন্য দায়ী ছিলেন শুধু দুজন ব্যক্তি – পঞ্চম খলিফা মাবিয়া ও তাঁর পুত্র ষষ্ঠ খলিফা এজিদ। মুসলিম ঐতিহাসিকগণ অবশ্য প্রধান হোতা হিসাবে চিহ্নিত করেছেন মাবিয়াকেই। আর অপরদিকে তাঁদের মতে হোসেন ছিলেন সম্পূর্ণ নির্দোষ, তিনি এজিদ নামধারী মুসলমান সমাজের একজন কলঙ্ক, মদ্যপ ও লম্পট ব্যক্তির হাত থেকে ইসলাম, ইসলামি সাম্রাজ্য ও প্রকৃত ইসলামি খেলাফতকে বাঁচাতে চেষ্টা করেছিলেন। এজিদের চোখে এটাই ছিল তাঁর অপরাধ এবং সেই কারণেই তিনি হোসেনকে নিষ্ঠুর ও নৃশংসভাবে কারবালা প্রান্তরে হত্যা করেছিলেন একটি চরম অন্যায় ও অসম যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে।
মাবিয়ার বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগগুলি সাজানো হয়েছে এই রকম-
এক) সৎ ও ধর্মনিষ্ঠ খলিফা আলির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন খলিফা হওয়ার লালসায়
দুই) আলিকে সরাসরি যুদ্ধে পরাস্ত করতে না পেরে গুপ্তঘাতক লাগিয়ে তাঁকে হত্যা করে অসৎ এবং অনৈতিক পথে খেলাফত দখল করেছিলেন
তিন) পরবর্তী খলিফা মনোনয়নে নবীর জ্যেষ্ঠ দৌহিত্র ইমাম হাসানেরর সঙ্গে করা কৃত চুক্তির খেলাপ ও অবমাননা করেছিলেন
চার) ইসলামি নীতি এবং আল্লাহর নবী প্রদর্শিত পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে আপন অযোগ্য পুত্রকে খলিফা পদে মনোনীত ও অধিষ্ঠিত করেছিলেন
পাঁচ) খলিফা হয়েই নিজের ক্ষমতাকে শক্তশালী ও সংহত করতে ইসলামের সমস্ত নীতি ও আদর্শকে জলাঞ্জলী দিয়ে যে খেলাফত তিনি প্রতিষ্ঠিত করে ছিলেন তা যথার্থ ইসলামি খেলাফত নয়। আলির খেলাফতের পর ইসলামের সত্যিকারের খেলাফতি যুগের যে অবসান হয়েছিল তার সূচনা হয়েছিল মাবিয়ার হাত ধরেই।
এজিদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত ও সাজানো অভিযোগগুলি হলো-
এক) এজিদ ছিলেন একেবারেই অযোগ্য
দুই) তিনি ছিলেন মদ্যপ, লম্পট, উচ্ছৃঙ্খল ও স্বেচ্ছাচারী
তিন) নিজের সিংহাসনকে নিষ্কন্টক রাখার জন্যে ইমাম হোসেনকে হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। অর্থাৎ তাঁর নির্দেশেই হোসেনকে হত্যা করা হয়েছিল
চার) বিদ্রোহ দমন করার উদ্দেশ্যে সেনাবাহিনী পাঠিয়ে মদিনা লুঠ এবং মসজিদে নববী-সহ মুহাম্মদ এবং বিশিষ্ট সাহাবীদের কবরগুলির চরম অসম্মান ও অবমাননা করেছিলেন
পাঁচ) মক্কা আক্রমণ করে কাবাগৃহে তথা আল্লাহর গৃহে আগুন লাগিয়ে এক নজিরবিহীন জঘন্য অপরাধ সংঘটিত করেছিলেন।
মানুষ মাবিয়া ও প্রশাসক মাবিয়া
মাবিয়া ও এজিদের বিরুদ্ধে তোলা অভিযোগগুলি নিয়ে আলোচনা করার পূর্বে দুটি বিশেষ বিষয়ের প্রতি আলোকপাত করা আবশ্যক। যে দুটি বিষয়ের প্রতি আলোকপাত করা আবশ্যক তা হলো,
এক) সাধারণভাবে মুসলিম ঐতিহাসিক এবং বুদ্ধিজীবীগণ মাবিয়াকে কোন চোখে দেখে থাকেন এবং
দুই) মাবিয়া মানুষ হিসেবে এবং প্রশাসক হিসেবেইবা কেমন ছিলেন?
মাবিয়ার সম্পর্কে আধুনিক যুগের উচ্চ শিক্ষিত মুসলিমরা কী মনোভাব পোষণ করেন তা বোঝার জন্যে মুসলিম সমাজের কিছু বিশিষ্ট স্বনামধন্য ব্যক্তিত্বের মন্তব্যের প্রতি চোখ রাখা যেতে পারে। সৈয়দ আমির আলি বলেছেন,
‘ইমাম হাসেনের পদত্যাগের পর, মুয়াবিয়া ইসলামের একজন স্বঘোষিত শাসক হলেন, হীন কদর্য ষড়যন্ত্রের সাহায্যে ইমাম হাসেনের জীবনাবসান ঘটিয়ে অবিসংবাদী, অপ্রতিদ্বন্দ্বী ও একচ্ছত্র নৃপতি হলেন।’
তিনি আরও বলেছেন,
‘তিনি ছিলেন ধূর্ত, অসৎ, তীক্ষ্ণ মেধা সম্পন্ন কৃপণ অথচ আপন স্বার্থসিদ্ধিতে অস্বাভাবিক উদার।’
(উদ্ধৃতি দুটি আমির আলির ‘দ্য স্পিরিট অব ইসলাম’ গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ থেকে নেওয়া)।
মাওলানা আবুল কালাম আজাদ বলেছেন,
‘আমার বিশ্বাস কেয়ামতের দিন যদি জালেমদের ফাছেক দল থেকে পৃথক করে দাঁড় করানো হয়, তাঁদের পয়লা কাতারে বানু উমাইয়ারা থাকবে। সে জালেমরাই ইসলামের এ আজাদীর (গণতন্ত্রের) মন্ত্রটিকে জুলুমে পরিণত করল। …ব্যক্তিগত স্বার্থে এ আদর্শটিকে পদদলিত করল। …তারা যে শুধু ইসলামের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে রাজতন্ত্রে পরিণত করে ছেড়েছে তাই নয়, অবশ্য এটাও কোরানের দৃষ্টিতে কুফরী বৈ নয়। কিন্তু সব চাইতে বড় জুলুম হল, ইসলামের প্রাণশক্তি সত্য প্রকাশ ও প্রতিষ্ঠার আদর্শটিকে তরবারির জোরে দাবিয়ে দিতে চাইল। মুসলমানদের সত্য বলার প্রেরণাকে নষ্ট করে দিল ’
(দ্রঃ মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, যে সত্যের মৃত্যু নাই)
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, মাবিয়া ছিলেন উমাইয়া বংশের একজন প্রতিনিধি এবং ইসলামি সাম্রাজ্যে উমাইয়া খেলাফতের যুগ তথা উমাইয়া যুগের সূচনা তাঁর হাত ধরেই হয়েছিল।
ড.ওসমান গণি লিখেছেন,
“৬৬১ খ্রিস্টাব্দে মহানবীর (দঃ) ব্যক্তিগত সচিব ও আবু সুফিয়ানের পুত্র প্রথম মুয়াবিয়া ইসলামের গণতন্ত্রের গতিরোধ করেন। প্রথম মুয়াবিয়া উমাইয়া রাজবংশের জন্ম দিয়ে উমাইয়া সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। মুয়াবিয়া স্বয়ং মহানবী(দঃ) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্রকে সমাধিস্থ করে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করত যে পরিমাণ পাপ সঞ্চয় করেছেন, সমগ্র মুসলিম জাহানের সমূহ রাজনৈতিক পাপও তার সমান হবে কীনা সন্দেহ। …এই রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে তাঁর নিকট ন্যায়-অন্যায়ের কোন ভেদ ছিল না। আপন স্বার্থসিদ্ধির জন্য, পথের কাঁটাকে (তিনি যত মহানই হোন না কেন) সরিয়ে দেওয়ার জন্য জগতের এমন কোন জঘন্য কাজ ছিল না, মুয়াবিয়া তাকে ধীরভাবে বরণ করতে দ্বিধা বোধ করেছিলেন। এখানে তিনি ছিলেন কামনা ও ইচ্ছার দাস মাত্র। এই পরিপ্রেক্ষিতে মুয়াবিয়াকে মুসলিম জাহানের একজন চির কুখ্যাত মুসলমান ও একজন অনৈসলামিক প্রথার প্রবর্তক ও রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা গণতন্ত্রের হত্যাকারী এবং ইসলাম জগতের মহাক্ষতিকারক ব্যতীত আর কীছু বলা যাবে না।”
(দ্রঃ উমাইয়া যুগ, পূর্বাভাষ)
এই হলো মাবিয়া সম্পর্কে মুসলিম জগতের সাধারণ মনোভাব, একেবারে ক্রোধ ও ঘৃণায় কানায় কানায় পরিপূর্ণ। মাবিয়া তাঁদের চোখে একজন রাজা বা নৃপতি মাত্র, খলিফা মোটেই নন। মাবিয়া সম্পর্কে এইরূপ প্রচার চলে আসছে শত শত বছর ধরে, ফলে এর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন, হচ্ছেন অমুসলিম ঐতিহাসিক ও লেখকরাও। ঐতিহাসিক আরনল্ড ‘Caesar of the Arabs‘ গ্রন্থে লিখেছেন,
“মুয়াবিয়া উমাইয়া সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করলে, প্রাচীন পৌত্তলিক আরবের ভাবধারার পুনর্জাগরণ হয়। ধর্মের স্থান গ্রহণ করল – অধর্ম, সত্যের স্থান গ্রহণ করল – মিথ্যা, সাধতার স্থান নিল অসাধুতা। নিরপেক্ষতার স্থান নিল স্বজনপ্রীতি; ‘মজলিস-উস-শুরার’ স্থান দখল করল রাজতন্ত্র। তাই সেদিনে মুয়াবিয়ার উপাধি ছিল-আরবদের সীজার।”
মাবিয়া সম্পর্কে মুসলিমরা যে ধারণা ও মনোভাব পোষণ করেন ও নিরন্তর প্রচার করেন তা কীন্তু কী ব্যক্তি মাবিয়া, কী প্রশাসক মাবিয়া, কোনও ক্ষেত্রেই ইতিহাসের পাতায় যে স্বাক্ষর তিনি রেখে গেছেন তার সঙ্গে একদম মেলে না। মাবিয়ার দীর্ঘ জীবনে তিনি কখনও ছিলেন নবী মুহাম্মদের সহকর্মী তথা সাহাবি, কখনও ছিলেন মুহাম্মদের সর্বাধিক ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত তিন সাহাবা তথা প্রথম তিন খলিফার অধস্তন উচ্চপদস্থ কর্মচারি বা আমলা, আবার কখনও ছিলেন ইসলামি সাম্রাজ্যের প্রধান কর্ণধার তথা খলিফা। তাঁর এই বর্ণময় জীবনের যে পরিচয় পাওয়া যায় ইতিহাসের পাতায় তা এক কথায় অনবদ্য, অতুলনীয়, শিক্ষণীয়, ঈর্ষণীয় এবং অবশ্যই আদর্শ স্থানীয়। সেই বর্ণময় জীবনের ওপর একটু আলো ফেলা যাক।
আবু সুফিয়ান ছিলেন প্রথম দিকে মুহাম্মদের প্রধান শত্রুদের অন্যতম একজন। মুহাম্মদের মক্কা বিজয়লাভের পূর্বের আগের দিন পর্যন্ত তিনি ছিলেন মুহাম্মদ ও ইসলামকে ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে দেওয়ার লক্ষ্যে এবং সঙ্কল্পে অনড় ও অটল। মুহাম্মদ মক্কা জয় ও দখল করার পর তিনি (আবু সুফিয়ান) তাঁর (মুহাম্মদ) কাছে অগত্যা আত্মসমর্পণ করেন এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে মুসলমান হন। সেজন্য আবু সুফিয়ানকে আজও অগত্যা মুসলমান বলে কটাক্ষ করে থাকেন মুসলিমরা। মাবিয়া ছিলেন সেই আবু সুফিয়ানের পুত্র। মানুষ চেনার ব্যাপারে মুহাম্মদের সুখ্যাতি সর্বজন সুবিদিত। মক্কা বিজয়ের পর তিনি কৌশলগত কারণে আবু সুফিয়ানের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিশোধ নেন নি, ঘুরিয়ে তাঁর সঙ্গে নানাভাবে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টাও করেছিলেন, কিন্তু তাঁকে মন থেকে কোনদিনই বিশ্বাস করেন নি। অথচ আবু সুফিয়ানের পুত্র মাবিয়া হয়ে উঠেছিলেন মুহাম্মদের অতি বিশ্বস্ত ও স্নেহধন্য একজন সহযোদ্ধা (সাহাবী)। মুহাম্মদ মাবিয়াকে তাঁর ব্যক্তিগত সচিব নিযুক্ত করেন। শুধু তাই নয়, মাবিয়া উপরেই কোরান লিখে রাখার সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও দায়িত্বপূর্ণ কাজটিও অর্পণ করেন।
মুসলিমরা দাবী করেন যে মুহাম্মদ নিরক্ষর ছিলেন, একজন নিরক্ষর ব্যক্তি তাঁর মুখনিসৃত বাণী একমাত্র তাঁকেই লিপিবদ্ধ করার দায়িত্ব অর্পণ করতে পারেন যাঁকে তিনি সবার চেয়ে অধিক বিশ্বাস করেন। আবু বকর, ওমর ফারুক, আলি প্রমুখ প্রবীণ সাহাবীগণ থাকতে মাবিয়ার উপরে এত আস্থা ও ভরসা রাখাটা নিঃসন্দেহে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। পরে মাবিয়াও কীন্তু এটা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন যে মুহাম্মদ তাঁর উপর গভীর আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপন করে বিন্দুমাত্র ভুল করেন নি। মাবিয়ার সততা, বিশ্বাসযোগ্যতা, নিষ্ঠা, দায়িত্ববোধ ও পারদর্শিতা সকলের মনেই গভীর রেখাপাত করেছিল। তাই মুহাম্মদ পরবর্তী যুগে যাঁরা খলিফা হয়েছিলেন তাঁরাও তাঁর প্রতি গভীর আস্থা রাখতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেন নি। তাঁরা সকলেই তাঁকে প্রাশাসনে উচ্চপদে নিয়োগ করেছিলেন। মুহাম্মদ থেকে শুরু করে তৃতীয় খলিফা ওসমান গণির খেলাফত পর্যন্ত ইসলামি সাম্রাজ্যের প্রশাসনে মাবিয়া কত বড় বড় ও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন তা শোনা যাক মাবিয়াকে যাঁরা পৃথিবীর সব থেকে কুখ্যাত মুসলমান বলে গালাগাল দিয়েছেন তাঁদের অন্যতম একজন ড.ওসমান গণির মুখ থেকেই। তিনি ‘উমাইয়া খেলাফত’ গ্রন্থে লিখেছেন,
‘৬৩০ খ্রিস্টাব্দে মক্কা বিজয়ের পর নিরুপায় আবু সুফিয়ান বাধ্য হয়েই ইসলাম ধর্মে দীক্ষা নিলেন, সঙ্গে পুত্র মুয়াবিয়া। এরপর থেকে মহানবীর সাথে তাঁদের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হতে থাকে। মুয়াবিয়া রসুলে আকরমের (সাঃ) ব্যক্তিগত সচিবের পদও লাভ করেন, এবং ‘ওহী’ প্রত্যাদেশ লেখার কাজে নিযুক্ত হন। …পরবর্তীকালে মুয়াবিয়ার ভ্রাতা ইয়াজিদ সিরিয়ার শাসনকর্তা নিযুক্ত হন এবং মুয়াবিয়া জেলা শাসকের পদ লাভ করেন। তখন খলিফা ওমরের যুগ। সিরিয়ায় শাসনকর্তা ইয়াজিদ ইয়ারমুকের শহীদ হলে খলিফা ওয়মর মুয়াবিয়াকে সিরিয়ার শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। খলিফা ওমরের পর খলিফা ওসমান মুয়াবিয়াকে এই পদে স্থায়ী করেন। মুয়াবিয়া আপন প্রতিভা বলে, কর্মগুণে সিরিয়াতে সুশাসন কায়েম করেন। খলিফা থেকে আরম্ভ করে সকল মানুষের নিকট হতেই তিনি সুশাসনের সুনাম অর্জন করতে সক্ষম হন। একদিন তাঁর চরম নির্ভিকতা ও সামরিক দক্ষতার জন্যই সিরিয়া, বাইজান্টাইন আক্রমণ থেকে রক্ষা পেয়েছিল।”
(পৃ: ১০ )।
প্রথমে মুহাম্মদের ব্যক্তিগত সচিব, তারপর প্রথম খলিফা আবু বকরের আমলে জেলা শাসক, তারপর দ্বিতীয় খলিফা ওমর ফারুকের আমলে সিরিয়ার অস্থায়ী গভর্ণর, তারপর তৃতীয় খলিফা ওসমান গণির খেলাফত কালে ঐ প্রদেশেরই স্থায়ী গভর্ণর – এইভাবে পর্যায়ক্রমে একের পর এক গুরুদায়িত্বে অধিষ্ঠিত থাকার ও সুচারুরূপে সেই সব দায়িত্ব পালন করার গৌরবোজ্জ্বল মুকুট ছিল মাবিয়ার ঝুলিতে। এটা নিশ্চয় একটা প্রামান্য মাপকাঠি যে, কত সততা ও বিশ্বাসযোগ্যতা ছিল তাঁর এবং কত আনুগত্যশীল ছিলেন তিনি মুহাম্মদ এবং তাঁর অগ্রজ খলিফাদের প্রতি। সেই মাবিয়ার উপর বিশ্বাসঘাতকতা, অসততা ও প্রতারণার অভিযোগ উত্থাপন করা হলে সেই অভিযোগের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। নিজ কর্ত্যবের প্রতি সততা, বিশ্বাসযোগ্যতা এবং খলিফার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের ধারাবাহিকতা বজায় ছিল খলিফা ওসমানের শাসন কালেও।
ওসমানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু হওয়ার পূর্বে মাবিয়ার বিরুদ্ধে অসততা, বিশ্বাসযোগ্যতা ও প্রতারণার বিন্দু মাত্র অভিযোগ কেউ কখনো তোলেনি। খলিফা ওসমানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সময়ে তাঁর (মাবিয়ার) বিরুদ্ধে নানা রকম অভিযোগ উঠতে শুরু করে। এই পর্যায়ে খলিফার সঙ্গে আলির দ্বন্দ ক্রমশঃ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। মাবিয়া যথারীতি খলিফার পাশে দৃঢভাবে অবস্থান করেন। তিনি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে খলিফাকে প্রথমে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করার পরামর্শ দেন এবং পরিস্থিতি নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে খলিফাকে রাজধানী মদিনা থেকে দামেস্কে স্থানান্তরিত করার অথবা দেহরক্ষী নেওয়ার পরামর্শ দেন। নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে বিচার করলে সিরিয়ার গভর্ণর মাবিয়ার ভূমিকা নিয়ে কোনও প্রশ্ন ওঠার কথা নয়। একজন সৎ, দায়িত্বশীল এবং নির্ভিক গভর্ণরের পক্ষে খলিফা এবং সাম্রাজ্যের এহেন দুঃসময়ে ও গভীর সঙ্কট কালে যা করা উচিত মাবিয়া ঠিক সেই কাজই করেছিলেন। তবুও যাঁরা মাবিয়ার সততা ও বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে তাঁকে প্রবলভাবে বিদ্ধ করেন তাঁরা কতোটা নিরপেক্ষ ও ইতিহাসের প্রতি কতোটা দায়বদ্ধ সে প্রশ্নের জবাবদিহি করতেই হবে। একজন সৎ গভর্ণর যদি তাঁর সততা ও বিশ্বাসযোগ্যতার প্রতি দায়বদ্ধ থেকে তাঁর নিয়োগকর্তা খলিফার গভীর বিপদে তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে তাঁকে সর্বতোভাবে সাহায্য করেন এমন পরিস্থিতিতে যাঁরা তাঁকে খলিফার কুপরামর্শদাতা ও ক্ষমতালোভী বলে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চান তাঁরা যে কোনও বিশেষ উদ্দেশ্য সিদ্ধ করার জন্য তাঁর সমালোচনায় মত্ত তা বুঝতে অসুবিধা হয় না।
মাবিয়ার আসল পরিক্ষা শুরু হয় প্রকৃতপক্ষে তাঁর খলিফা পদে আসীন হওয়ার পর। তখন তিনি মুহাম্মদ কিংবা তাঁর প্রতিনিধিবৃন্দ তথা খলিফাদের অধীনস্থ উচ্চপদস্থ আমলা নয় যে তাঁকে শুধু নিয়োগকর্তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা ও আস্থা অর্জনের জন্যে কাজ করলেই চলবে। তখন তাঁর মাথার উপর কেউ নেয় যাঁদের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। তদুপরি সাম্রাজ্য তখন দীর্ঘ গৃহযুদ্ধের কবলে পড়ে ধ্বংসের কীনারায় দাঁড়িয়ে। এ রকম সংকট কালে যে কোনো শাসকের পক্ষে ভুল হওয়া খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। এ রকম এক দুঃসময়ে অভূতপূর্ব এক কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি তাঁকে দাঁড়াতে হয়েছিল। সে পরীক্ষায় তিনি যে চরম ও পরম সাফল্য অর্জন করেছিলেন তা আজ সর্বজন সুবিদিত। এই ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করতে তাঁকে সবচেয়ে বেশী সাহায্য করেছিল তাঁর প্রশাসনিক দক্ষতা ও যোগ্যতা এবং সাম্রাজ্য পরিচালনায় যে নীতিগুলি অবলম্বন করেছিলেন সেই নীতিগুলি। ভিতর ও বাইরের বিদ্রোহ দমন করে সাম্রাজ্যের আরও বিশাল বিস্তৃতি ঘটিয়ে সুবিশাল সাম্রাজ্যে অতি নিপুণভাবে তিনি এত সুন্দর শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন যা প্রায় রূপকথা হয়ে উঠেছিল। এ কথা তাঁর শত্রুদের পক্ষেও অস্বীকার করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। সেই শান্তি ও শৃঙ্খলা সম্পর্কে তাঁর সব চেয়ে বড় ও কড়া সমালোচক ঐতিহাসিক ড.ওসমান গণি কী বর্ণণা করেছেন তার উপর চোখ বোলানো যাক। তিনি লিখেছেন,
“সারা দেশে বেজে উঠলো সুশাসনের দামামা, ঘোষিত হলো সুনীতির জয় গান। সঙ্গে সঙ্গে বেশ কীছু মানুষ স্থান পেল কারাগারে। ফলে দেশের অসংখ্য নর-নারী শান্তি ও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। সমগ্র দেশের এক প্রান্ত হতে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত চুরি নাই-চাপটা নাই। খুন নাই খারাবি নাই। দেশে যেন নিস্তব্ধ পারাবার। মুয়াবিয়া যেন সেখানে সরোবরে ফুটন্ত পদ্ম। গভীর রাত্রিতেও কোন পরমা সুন্দরী, কোন উর্বশী, কোন তিলোত্তমা একাকী দীর্ঘ পথ অতিক্রম করলেও, কোন দুর্ধষ দুরাচারেরও শক্তি বা সাধ্য ছিল না একটি আঙ্গুল হেলানোর। এমনি শাসন ব্যবস্থা তিনি প্রণয়ন ও প্রবর্তন করেছিলেন। যার ফলে মুয়াবিয়া জনগণের নিকট যেন ফেরেস্তার সম্মান লাভ করলেন। সমগ্র আরব সমাজে এরূপ কঠোর শাসন আর কখনও লক্ষ্য করা যায় না। সাগরের উত্তাল তরঙ্গরাশিকে তিনি শান্ত পারাবারে পরিণত করেছিলেন। বৈশাখির ভয়ালরূপকে বসন্তের স্নিগ্ধ বাতাসে রূপান্তরিত করতে পেরেছিলেন, মহাবর্ষার প্রচন্ড প্লাবনকে সুনির্দিষ্ট খালে পরিচালিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। হযরত ওসমান হত্যার পর হতে হযরত আলী পর্যন্ত সমগ্র দেশে যে অরাজকতা ও উচ্ছৃঙ্খলতা দেখা দিয়েছিল, তা শুধু চিরতরে প্রশমিত ও প্রদমিতই হলো না, সেখানে দেখা দিল শাসনে প্রশাসনে শান্তির সমীরণ ও সবুজ শালবন। দূরীভূত হলো যত আগাছা, যত অরাজকতা।”
(দ্রঃ প্রাগুক্ত গ্রন্থ, পৃ- ৩৩,৩৪)
একটা সাম্রাজ্যের যাবতীয় আগাছা, অরাজকতা ও অত্যাচার-অনাচার নির্মূল করার বিরলতম নজির স্থাপন করার জন্য ইতিহাসে চিরকালের শ্রেষ্ঠ আরব-নৃপতির অভিধার পালক আজও মাবিয়ার মাথার মুকুটে শোভা পাচ্ছে। এই অভিধায় তাঁকে অভিহিত করেছেন ধর্ম-বর্ণ-জাতি নির্বিশেষে সকল ঐতিহাসিকগণ। এই যে প্রায় অবিশ্বাস্য ও অকল্পনীয় নজির ও সাফল্যের কীর্তি স্থাপন – তার পশ্চাতে যে যাদু ছিল তা হলো তাঁর (মাবিয়ার) অনুসৃত নীতিমালা। তিনি সাম্রাজ্য পরিচালনায় ইসলামের কট্টর ধর্মীয় সংকীর্ণতা এবং কোরানের নির্দেশিত পথের প্রতি অন্ধ আনুগত্য পরিহার করে একটি সময়োপযোগী, উদারনৈতিক, বিকাশশীল ও যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গী করেছিলেন। যে নীতিগুলি তাঁকে সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছে দিয়েছিল সেগুলির মধ্যে অন্যতম হলো ধর্মনিরপেক্ষতা, গোষ্ঠী-বংশের সংকীর্ণতা পরিহার করা এবং কোরানের বাইরে বেরিয়ে সমস্যার সমাধান এবং উন্নতির পথের সন্ধান করা। তিনি যে ধর্ম নিরপেক্ষ নীতি অবলম্বন করেছিলেন তা সর্বজন স্বীকৃত। এ প্রসঙ্গে একজন ঈমানদার মুসলমান তথা ঐতিহাসিক আল মাসউদী লিখেছেন,
“…পরধর্মের প্রতি সহিষ্ণুতা মুয়াবিয়া চরিত্রের ভূষণ বলে পরিগণিত ছিল। তিনি যেমন নিষ্ঠুর ও কঠোর ছিলেন, তেমনি আবার উদার ও দয়ালুও ছিলেন। তিনি তাঁর জীবনের সর্বত্র বিনয় ও সংযমের পরিচয় রেখে গেছেন। জাতিধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষকে তিনি সমান চোখে দেখতেন। তাঁর রাজত্বে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা সুখে ও শান্তিতে বসবাস করত। একবার ভূমিকম্পে খ্রিস্টানদের ‘এডেসার’ গীর্জা ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে তিনি তা আপন ব্যয়ে পূননির্মাণ করেছেন। যে কোন ধর্মের যোগ্য ব্যক্তিকে যে কোন উচ্চ পদে নিয়োগ করতে কোনদিনই কুন্ঠা বোধ করতেন না। তিনি গোঁড়া ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের পরিবর্তে একটি ধর্মনিরপেক্ষ (Secular) রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে মুসলমান ও অমুসলমানদের মধ্যে একটা মধুর সম্পর্ক গড়ে তুলেন।”
(দ্রঃ ঐ,পৃ -২৫)
মাবিয়া কত বড় মাপের ধর্ম নিরপেক্ষ খলিফা ছিলেন তার কয়েকটা দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। তিনি সর্ব প্রথম ইসলামি সাম্রাজ্যে একটি ধর্মনিরপেক্ষ সেনাবাহিনী গড়ে তোলেন। তিনি একজন বিখ্যাত খ্রিস্টান কবি আল-আখতালকে তাঁর দরবারে সভাকবির মর্যাদায় ভূষিত করেন। বিখ্যাত খ্রিস্টান চিকিৎসক ইবন আসলকে তিনি নিযুক্ত করেছিলেন হিমস প্রদেশের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা হিসাবে। বংশ-গোষ্ঠীর সংকীর্ণ চিন্তা এবং বিভিন্ন বংশ ও গোষ্ঠীর মধ্যে কলহ ও রক্তপাত করা ছিল আরবের কোরেশদের পরম্পরা ও মজ্জাগত। সেই ভয়ংকর কু-অভ্যাস ও ঐতিহ্য থেকে নিজেকে মুক্ত করে এমন এক নিরপেক্ষ প্রশাসক হিসাবে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন যে তাঁর শত্রুরাও তা স্বীকার না করে পারেন না। এ প্রসঙ্গে ড.গণি লিখেছেন তাঁর উক্ত গ্রন্থের ৩৮ পৃষ্ঠায় লিখেছেন,
“… তিনি নিজে মুদারীয় গোত্রের মানুষ হয়েও প্রতিদ্বন্দী হিমারীয় গোত্রের সঙ্গে সদ্ভাব বজায় রাখেন। এ ক্ষেত্রে তিনি নিরপেক্ষ নীতি অবলম্বন করে শ্রেষ্ঠ শাসক বা ন্যায়পরায়ণ বিচারকের পরিচয় দেন। …মুয়াবিয়া আপন বংশ বা গোত্র-ভিত্তিক রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন কীন্তু প্রশাসনকে নিরপেক্ষ রাখার জন্য একমাত্র খলিফা ওসমানের জামাতা মারওয়ানকে হেজাজের গভর্ণর করা ব্যতীত তিনি তাঁর স্বগোত্রীয় কোন ব্যক্তিকেই প্রশাসনিক বা সামাজিক কোন উচ্চপদে অধিষ্ঠিত করেন নি।”
মাবিয়ার ব্যক্তি জীবনে কোন দোষ-ত্রুটি ছিল এমন অভিযোগও কেউ কোনদিন তুলতে পারেন নি। এক্ষেত্রেও মুসলিম ঐতিহাসিকদের কলমেও ছত্রে ছত্রে মাবিয়ার চরিত্রের প্রশংসা আমরা দেখতে পাই। ঐতিহাসিক আল মাসউদী খলিফা মাবিয়ার দৈনন্দিন অনাড়ম্বর ও সরল জীবন-যাপনের বর্ণণা প্রসঙ্গে বলেছেন,
“প্রভাতে ফযরের নামাযের পর তিনি নগরপালের নিকট হতে নগরের খবরা-খবর শুনতেন। অতঃপর কোরআন শরীফ তেলায়াত (পড়তেন)। পড়ে সামান্য প্রাতরাশ গ্রহণ করতেন। …পরে মসজিদে মাকসুরার (একটি বেষ্টনীর) মধ্যে বসে সর্বসাধারণের অভিযোগ শ্রবণ করতেন। এই সময় আবার একটু প্রাতরাশ গ্রহণ করতেন, এবং ঐ সময় সচিব তাঁকে বিভিন্ন চিঠিপত্র পড়ে শুনাতেন। তারপর দরিদ্র ব্যক্তিদের খাওয়ানো হত। অতঃপর জোহরের (মধ্যাহ্ন) নামায পড়ে বিশেষ বিশেষ মানুষদের প্রবেশের অনুমতি দিতেন, যাঁরা বহু মুল্যবান উপঢৌকন সহ আসতেন। …আসরের (বিকাল) নামাযের পর তিনি সর্বসাধারণের জন্য আবার দরবারে বসতেন। এরপর সান্ধ্যভোজ হতো, এবং মগরেবের (সন্ধ্যা) নামায পড়তেন। …এশার (রাত্রির) নামাযের পর তিনি আবার একবার দরবারে যেতেন। পরে রাত্রির ১/৩ অংশ পর্যন্ত বিভিন্ন রাজা বাদশার কাহিনী শুনতেন ও অধ্যয়নে মনোনিবেশ করতেন। এবং সামান্য মিষ্টি খেয়ে শুয়ে পড়তেন। তাঁর দৈনন্দিন জীবনযাত্রার প্রণালী দেখে মনে হয়, তিনি খুবই নিয়ম চলতেন, যার জন্য সমগ্র সাম্রাজ্যেও আইন শৃঙ্খলার সুষ্ঠু রূপায়ণ দেখতে পাওয়া যায়।”
(সুত্র: ঐ, পৃঃ ২৪, ২৫)
মাবিয়ার চরিত্রের আর একটি অতীব উজ্জ্বল দিক রয়েছে। তারও স্বীকৃতি দেখা যায় মুসলিম ঐতিহাসিকদের লেখায়। ড.গণির ইতিহাসে এ প্রসঙ্গে যা লেখা হয়েছে তা হলো এরূপঃ
“খলিফা আলির সময় ছিলেন খলিফা পদের জন্য উচ্চাভিলাষী কুচক্রী মুয়াবিয়া। শাসক হিসাবে ছিলেন কঠোর, রাজনীতিবিদ হিসাবে ছিলেন দূরদর্শী, ধূর্ত, কপট, প্রতিজ্ঞা ভঙ্গকারী এমন কী খুনি ও বিশ্বাসঘাতক। তবে তাঁর জীবনে কোথাও কোনদিন মদ-ভাঙ, জুয়া ও অবৈধ মেয়েছেলের সমাবেশ দেখা যায় না। এই দিক দিয়ে তাঁর ব্যক্তিজীবন কলুষিত ছিল না। তিনি অতি উচ্চাকাঙ্ক্ষার বশবর্তী হয়ে অনেক কীছু করেছেন, তাঁর অদম্য চেষ্টায় সে বাসনা-কামনা সফলতা লাভ করেছে। এ বিষয়ে মদ ও মেয়েছেলে বিহীন চরিত্র তাঁকে অনেকখানি সাহায্য করেছিল।
(সুত্র: ঐ, পৃ -২৬)
পঞ্চম খলিফা মুয়াবিয়ার তথা মাবিয়ার কী ব্যক্তি জীবন কী খলিফা-জীবনের যে পরিচয় পাওয়া যায় তা এক কথায় অতুলনীয়। তিনি যে সততা, উদারতা, ধর্ম- বংশ-গোত্র নিরপেক্ষতা, পরধর্ম সহিষ্ণুতা,কর্মদক্ষতা, পারদর্শিতা, দূরদর্শিতা, নৈতিকতা, নিষ্ঠা এবং অধস্তন উচ্চ পদস্থ আমলা বা প্রশাসক হিসাবে নিয়োগকর্তাদের (মুহাম্মদ এবং প্রথম তিন খলিফা আবু বকর, ওমর ফারুক ও ওসমান গণি) প্রতি বিশ্বাসযোগ্যতা, দায়িত্বশীলতা, কর্তব্যপরায়ণতা এবং আনুগত্যের নজির স্থাপন করে গেছেন সে সব গুণ একত্রে আর কোনোও খলিফার মধ্যে লক্ষ্য করা যায় না। এই সকল গুণাবলী যেমন তাঁকে একটা পৃথক স্বকীয়তা এনে দিয়েছে, তেমনি তাঁকে এনে দিয়েছে আরব-শ্রেষ্ঠ নৃপতির (খলিফা) বিরল সম্মান। মুসলিম ঐতিহাসিক ও ধর্মগুরুরা কীন্তু তাঁর ব্যক্তি জীবনের এবং প্রশাসক জীবনের এই সব ইতিবাচক ও ভালো গুণাবলিগুলিকে স্বীকার করেও তাঁকে একজন ভালো খলিফার স্বীকৃতি তো দেন নি, অধিকন্তু তাঁকে বিশ্বাসঘাতক, প্রতারক, খুনী, কুচক্রী, নিকৃষ্ট মুসলমান বলে অকথ্য-কুকথ্য ভাষায় নিন্দা-মন্দ এবং তাঁর উপর দিনরাত অভিশাপ বর্ষণ করে চলেছেন। মাবিয়া সম্পর্কে মুসলিম ঐতিহাসিকদের এই মূল্যায়নে এত নগ্ন বৈপরীত্য বা স্ববিরোধিতা বিদ্যমান যা আমাদের বিবমিষার উদ্রেক করে। এই মূল্যায়ণ যে এক নজিরবিহীন দ্বিচারিতার নিকৃষ্ট দৃষ্টান্ত তা বলা বাহুল্য। সমগ্র মুসলিম দুনিয়া একযোগে কেন তাঁদেরই একজন খলিফার বিরুদ্ধে দ্বিচারিতায় মত্ত তা যেমন ভীষণ বিস্ময়কর তেমনই কৌতুহলোদ্দীপকও বটে। এই দ্বিচারিতার পশ্চাতে নিশ্চয় কীছু রহস্য রয়েছে। কী সেই রহস্য তার প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করবো এই বইয়ের শেষাংশে। এই পর্যায়ে আমরা দৃষ্টি নিবদ্ধ করবো এই অধ্যায়ের প্রধান আলোচনায় অর্থাৎ কারবালার যুদ্ধের জন্য দায়ী শুধু মাবিয়া ও এজিদকে দায়ী ও দোষী বলে তাঁদের উপর যে দায় চাপানো হয়েছে সেগুলি কতখানি যথার্থ বা আদৌ যথার্থ কী না সে আলোচনায়।