আবুবকর যেদিন ১ম খলিফা নির্বাচিত হন সেদিনই কারবালা যুদ্ধের বীজ পোঁতা হয়ে যায়
বিশ্ব ইতিহাসে যুদ্ধের ইতিহাসটি সব দিক থেকেই বিশাল। কত যুদ্ধ যে সংঘটিত হয়েছে সাড়া বিশ্বে তার ইয়ত্তা নেই। অবশ্য খুব কম যুদ্ধই হয়েছে মানুষের স্বার্থে ও প্রয়োজনে। কিন্তু সব যুদ্ধেই খুন-জখম হয়েছে মানুষই, মানুষ বলতে সাধারণ মানুষ। প্রাক পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় যুদ্ধ হয়েছে, বলা ভালো করা হয়েছে ক্ষমতা বিস্তার, কিংবা ক্ষমতা দখল কিংবা ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের জন্যে। সে সব যুদ্ধ হতো রাজায় রাজায় বা রাজা-বাদশা-সম্রাটদের মধ্যে। পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় বিশ্ব সভ্যতা প্রবেশ করলে যুদ্ধের প্রকৃতি পাল্টে যায়। কারবালা যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে মধ্য যুগে, অর্থাৎ প্রাক-পুঁজিবাদী যুগে মানব সভ্যতা প্রবেশ করার ঢের পূর্বে। স্বভাবতঃই সে যুদ্ধের বৈশিষ্ট আলাদা কিছু ছিল না। কিন্তু আমরা যে ইতিহাস পড়ি সে ইতিহাস এই যুদ্ধটাকে সম্পূর্ণ আলাদা বৈশিষ্ট প্রদান করেছে। কী বৈশিষ্ট প্রদান করা হয়েছে সে প্রসঙ্গে পরে আসবো।
যুদ্ধ বিষয়ে এখানে আর একটা কথা উল্লেখ করা আবশ্যক। ইতিহাসে সত্যি সত্যি ঘটে যাওয়া যুদ্ধ ছাড়া আমরা অনেক যুদ্ধের কথা শুনতে পাই। সে সব যুদ্ধ হলো পৌরাণিক যুদ্ধ। এ সব যুদ্ধের কথা মানুষের মুখে মুখে ঘোরে। অপরদিকে যে যুদ্ধগুলো সত্যি সংঘটিত হয়েছে তার কথা মানুষের মুখে মুখে ঘোরা তো দূরের কথা, মানুষ সে সব যুদ্ধ সম্পর্কে অবহিতই থাকেন না। কিন্তু এক্ষেত্রে একমাত্র ব্যতিক্রম হলো কারবালা যুদ্ধ। এই যুদ্ধটির কথা মুসলিম সমাজের মানুষের মুখে মুখে আজও সমানে ঘোরে। শুধু তাই নয়, প্রতি বছর এই যুদ্ধের দিনটি স্মরণও করা হয়। একটি সত্যিকারের যুদ্ধ পরিণত হয়ে গেছে যেন পৌরাণিক যুদ্ধে। তাই এই যুদ্ধটির একটা আলাদা তাৎপর্য আছে ইতিহাসে। অথচ খুবই দুঃখজনক ব্যাপার হলো এই যুদ্ধটির যে ইতিহাস লেখা হয়েছে এবং প্রকৃতই যা ঘটেছিল তার সঙ্গে পাহাড় সমান পার্থক্য রয়েছে। সত্যি কথা বলতে কি এর আসল ইতিহাসটাই হারিয়ে গেছে এবং তার পরিবর্তে একটা সম্পূর্ণ বিকৃত, অর্ধসত্য ও অসত্য ইতিহাস লেখা হয়েছে যা আমরা যুগ যুগ ধরে বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি।
বলা বাহুল্য যে, যে ইতিহাসের কথা আমি বলছি তা মুসলিম ঐতিহাসিকদের লেখা ইতিহাস। কারবালা যুদ্ধ নিয়ে ইতিহাসের বাইরেও প্রচুর লেখালেখি হয়েছে সাহিত্যের অঙ্গনে। কবিতা, ছড়া, মুর্শিয়া, জারিগান, গল্প, নাটক, থিয়েটার,উপন্যাস প্রভৃতি কত যে লেখা হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই এবং আজও তা সমানে অব্যাহত রয়েছে। এ সব রচনায় ঐ একই ধারা, যে ধারা ইতিহাসে অনুসরণ করা হয়, আজো চালু আছে।
কারবালা যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল অধুনা ইরাকে অবস্থিত ইউফ্রেটাস (ফোরাত) নদীর ধারে কারবালা নামক একটি প্রান্তরে। সেজন্যে ইতিহাসে এটা কারবালা যুদ্ধে নামে খ্যাত। এটা আবার মহরম নামেও পরিচিত। কারণ যেদিন যুদ্ধটি হয় সেদিন ছিল আরবী বছরের মহরম মাসের ১০ তারিখ। তাই প্রতি বছর ১০ই মহরম এই দিনটি উদপযাপিত হয় গোটা দুনিয়ায় মুসলমান সমাজে। এটা উদযাপন করা হয় অবশ্য শোক দিবস হিসাবে, কারণ এই যুদ্ধে নিহত হয়েছিলেন ইমাম হোসেন যিনি ছিলেন মুহাম্মদের নাতি এবং ইসলামের চতুর্থ খলিফা আলীর পুত্র। বলা বাহুল্য একমাত্র সে কারণেই এই যুদ্ধটি পৌরাণিক যুদ্ধের মতো মুসলমানদের মুখে মুখে ঘোরে। এবং এই কারণেই মুসলমান ঐতিহাসিকগণ এই যুদ্ধের ইতিহাস লিখতে গিয়ে ইতিহাসের প্রতি দায়বদ্ধতার পরিবর্তে দায়বদ্ধতা প্রদর্শন করেছেন মুহাম্মদ ও তাঁর বংশধরদের প্রতি। একই অবস্থা হয়েছে যাঁরা কারবালা নিয়ে সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন তাঁদের ক্ষেত্রেও। যুদ্ধটি হয় হোসেন ও ইসলামি সাম্রাজ্যের ষষ্ঠ খলিফা এজিদ (ইয়াজিদ)–এর সৈন্যবাহিনীর সাথে। মুসলিম ঐতিহাসিক ও সাহিত্যিকদের কলমের আক্রমণের অভিমুখ থেকেছে তাই এজিদ ও তাঁর পিতা ইসলামের পঞ্চম খলিফা মাবিয়া (মুয়াবিয়া)–র দিকে। অপরদিকে সমস্ত প্রশংসা উজার করে দুহাতে ঢেলে দেওয়া হয়েছে হোসেন ও নবীর (মুহাম্মদ) বংশধরদের প্রতি। দেখানো হয়েছে হোসেনকে দুগ্ধপোষ্য শিশুর মতো নিষ্পাপ এবং আল্লাহ্, ইসলাম, আদর্শ ও মানুষের জন্যে আত্মবিসর্জনকারী এক বিশ্বশ্রেষ্ঠ মহান ত্যাগী পুরুষ হিসাবে।
যুদ্ধটি সংঘটিত হয়েছে ৬৮০ খ্রিস্টাব্দের ১০ই অক্টোবর। তার আগের বছর মাবিয়া পরবর্তী খলিফা হিসাবে মনোনীত করেন তাঁর পুত্র এজিদকে। মুসলিম ঐতিহাসিকগণ বলেছেন সেটাই হলো কারবালা যুদ্ধের মূল সূত্রপাত। অর্থাৎ তাঁদের মতে কারবালা যুদ্ধের সময়কাল সীমাবদ্ধ মাত্র দুবছর বয়সকালের মধ্যে। এই যুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে কিন্তু জড়িয়ে আছে অনেকটা দীর্ঘ সময়। এর সূত্রপাত মূলতঃ ঘটে মুহাম্মদের মৃত্যুর অব্যবহতি পরেই তাঁর উত্তরসূরী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। মুসলিম ঐতিহাসিকগণ যেহেতু ইতিহাস লিখেছেন এটা প্রমাণ করার জন্যে যে, হোসেন ইসলামি সাম্রাজ্য ও ইসলাম ধর্মকে রক্ষা করার জন্যেই কারবালা প্রান্তরে আত্মবলিদান করেছেন। সেজন্যে তাঁরা কারবালার সময়কালকে সীমায়িত করেছেন মাত্র দুবছরের অতি স্বল্প সময়কাল ও ততোধিক ক্ষুদ্র পরিসরের সময়সীমার মধ্যে।
যে যে কারণগুলিকে কারবালা যুদ্ধের জন্যে দায়ী করা হয়েছে সেগুলি হলো এ রকম – মাবিয়া যখন খলিফা পদে অধিষ্ঠিত হন তখন কথা ছিল তাঁর পরে খলিফা পদে মনোনীত করতে হবে ইমাম হোসেনকে। কারণ, এরকম একটা চুক্তি হয়েছিল মাবিয়া ও ইমাম হাসান (মুহাম্মদের জ্যেষ্ঠ নাতি ও আলীর জ্যেষ্ঠ পুত্র)– এর সঙ্গে। মাবিয়া সেই চুক্তি লঙ্ঘন করে তাঁর পুত্র এজিদকে খলিফা মনোনীত করেন। এর মধ্যে দিয়ে শুধু যে হোসেনের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেন মাবিয়া তা নয়, আসলে বিশ্বাসঘাতকতা করেন ইসলাম, মুহাম্মদ ও গোটা মুসলমান সমাজের সঙ্গে। এভাবেই বিষয়টিকে চিত্রিত করা হয়েছে। হোসেনের পক্ষে এজিদের খেলাফত মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না আরো একটা কারণে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সেটা হলো, এজিদ ছিল স্বৈরাচারী, উচ্ছৃঙ্খল, মদ্যপ ও লম্পট প্রকৃতির যুবক, সুতরাং তার হাতে খেলাফত হস্তান্তর মানেই ইসলামের অপমৃত্যু। তাই ইসলামকে বাঁচাতে এজিদকে ক্ষমতা থেকে সরানো ব্যতীত অন্য বিকল্প ছিল না। তারজন্যে হোসেনকে এজিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতেই হয়েছিল।
কেন মাবিয়া বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন? সে কি অন্ধ পুত্রস্নেহের বশেই কেবল? ঐতিহাসিকগণ বলেছেন,না তা নয়। তাঁরা এর জন্যে দায়ী করেছেন মাবিয়ার বংশপরম্পরাকেও। মক্কায় হাসেমি ও উমাইয়া এই দুটি বংশের মধ্যে প্রবল বিরোধ ছিল প্রাক-ইসলাম যুগে। মুহাম্মদ ছিলেন হাসেমি বংশের প্রতিনিধি। তিনি যখন ধর্ম প্রচার শুরু করেন তখন সব থেকে বেশী বাধা পেয়েছিলেন উমাইয়া বংশের নিকট থেকে। মুহাম্মদের যাঁরা প্রধান প্রতিপক্ষ ছিলেন তাঁদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন উমাইয়া বংশের প্রতিনিধি আবু সুফিয়ান। এই আবু সুফিয়ান একেবারে বাধ্য হয়েই মুহাম্মদের কাছে আত্মসমর্পণ করে মুসলমান হয়েছিলেন মুহাম্মদ মক্কা জয় করার পর। সেই আবু সুফিয়ানের পুত্র ছিলেন মাবিয়া। মুসলিম ঐতিহাসিকগণ তাই বলেছেন যে পিতার পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতেই মাবিয়া ইসলামি সাম্রাজ্যের ক্ষমতা মুহাম্মদের বংশধরদের হাতে না দিয়ে নিজের বংশ ও বংশধরদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। তাঁরা তাই এজিদকে নয়, মাবিয়াকেই কারবালার ঘটনার প্রধান ষড়যন্ত্রী ও প্রধান হোতা বলে চিহ্নিত করেছেন।
কেউ কেউ মাবিয়াকে নয়, প্রধান হোতা বলেছেন এজিদকেই। তাঁরা বলেছেন জয়নব নামে একজন বিধবা কিন্তু অসাধারণ সুন্দরীও এই যুদ্ধের পেছনে বড় কারণ হিসাবে কাজ করেছে। ইমাম হাসান জয়নবের রূপ-লাবণ্যে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে বিয়ে করার প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন। একই প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন এজিদও। জয়নব সম্মতি জানিয়েছিলেন হাসানের পক্ষেই। কিন্তু নাছোড় বান্দা ছিলেন এজিদ। যে কোনো মূল্যে তিনি জয়নবকে পেতে চেয়েছিলেন। আর এটা সম্ভব করার জন্যে ইসলামি সাম্রাজ্যের ক্ষমতা হাসিল করা তাঁর কাছে অনিবার্য হয়ে পড়েছিল। সেজন্যে তিনি পিতার উপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করে তাঁকে বাধ্য করেছিলেন তাঁকে খলিফা মনোনীত করার জন্যে। মাবিয়া সেই চাপের কাছে নতি স্বীকার করেছিলেন বাধ্য হয়েই। এদিকে জয়নবের প্রশ্নে শেষ হাসি হেসেছিলেন হাসানই। তারপরে হাসানকে বিষ খাইয়ে হত্যা করিয়েছিলেন এজিদ একজন মহিলার সাহায্য নিয়ে। এজিদ এখানেই ক্ষান্ত হন নি, পরবর্তী পর্যায়ে হাসানের ভাই হোসেনকে হত্যা করে চূড়ান্ত প্রতিশোধ নিয়েছিলেন।
খোলা মনে ও নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে বিচার করলে অবশ্য কারবালার ঘটনার জন্যে মাবিয়াকে কোনো প্রকারেই দায়ী করা যায় না এবং এজিদকেও খুব একটা দায়ী করা যায় না। মাবিয়া যেদিন তাঁর উত্তরসূরী হিসাবে তার পুত্রকে নির্বাচিত করেন সেদিনই কারবালা যুদ্ধের ক্ষেত্র তৈরী হয় বলে মুসলিম ঐতিহাসিকরা যে কথা লিখেছেন সেটা ইতিহাসের অতি সরলিকরণ বৈ নয়। পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে এই যুদ্ধের ক্ষেত্র তৈরী হয়েছিল মুহাম্মদের মৃত্যুর পরপরই। হ্যাঁ, ঠিক তাই। কারণ মুহাম্মদের মৃত্যুর পর পরবর্তী খলিফা নির্বাচনে প্রচন্ড কলহপূর্ণ পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল। ইসলামি সাম্রাজ্যের খলিফা হতে তথা অসীম ক্ষমতার পদটি পেতে লালসা হয়েছিল অনেকেরই। ঐ প্রশ্নে সিদ্ধান্তে আসা যাচ্ছিল না।
অবস্থা এমন হয়েছিল যে মুহাম্মদের দাফন-কাফনের কাজ তথা অন্তিম সৎকারের কাজ একদিন (অন্য মতে তিন দিন) স্থগিত রাখতে হয়েছিল। অবশেষে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছানো গিয়েছিল বটে, কিন্তু সেই সমাধানে সকলের সম্মতি ছিল না। অনেক হৈ-হট্টগোলের পর আবু বকর মুহাম্মদের উত্তরসূরী নির্বাচিত হয়েছিলেন। এই নির্বাচনে সব চেয়ে বেশী ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন আলী (মুহাম্মদের জামাই)। আলী মুহাম্মদের আপন খুড়তুতো ভাইও ছিলেন, অর্থাৎ সে সময় তিনি ছিলেন মুহাম্মদের একমাত্র উপযুক্ত জীবিত বংশধর। তিনি মুহাম্মদের জীবনের ছায়াসঙ্গীও ছিলেন। পুরুষের মধ্যে তিনিই প্রথম ইসলামকে কবুল (স্বীকার) করেছিলেন, অর্থাৎ তিনিই প্রথম মুসলমান মুহাম্মদের পর। আলী যখন ইসলাম কবুল করে মুসলমান হন তখনও তিনি নাবালক ছিলেন। তাই তাঁর মতে তিনিই ছিলেন একমাত্র মুহাম্মদের সঠিক উত্তরসূরী এবং সব দিক থেকেই খলিফা পদের সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তি। তাই তিনি একদিকে আবু বকরের খলিফা নির্বাচনে যেমন অবাক হয়েছিলেন অপরদিকে তেমনই প্রচন্ড ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। এবং বলা বাহুল্য যে, আলীর অনুগামীরাও অবাক ও ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। আর ঠিক তখনই কারবালার ইতিহাসের সূচনা হয়ে গিয়েছিল সবার অলক্ষ্যে। এভাবেও বলা যায় যে আবু বকরের খলিফা নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে সেদিনই কারবালা যুদ্ধের বীজটি পোঁতা হয়ে গিয়েছিল। সেই বীজটি অঙ্কুরিত হয়ে ক্রমে ক্রমে সবার অলক্ষ্যে কারবালা যুদ্ধ নামক বিষবৃক্ষে পরিণত হয়েছিল।
(নোট: এই ব্লগপোস্টটি আমার ‘কারবালা যুদ্ধঃ মিথ ও মিথ্যা’ বইয়ের অংশ। নবযুগ ব্লগের পাঠকদের জন্য পুরো বইটি ধাপে ধাপে পোস্ট করার ইচ্ছে আছে।)