আলী ও মুহাম্মদ দুহিতা ফাতেমা আবু বকরকে খলিফা হিসেবে মেনে নেন নি
খলিফা পদ তথা ক্ষমতা না পেয়ে আলী নিজে যতোটা হতাশ ও ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন তার থেকে অনেক বেশী ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন আলীর পত্নী এবং মুহাম্মদ-দুহিতা বিবি ফাতেমা। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ফাতেমা ছিলেন মুহাম্মদের অতি আদরের কন্যা। ফাতেমা কতো ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন তা ভাষায় প্রকাশ সাধ্যেরও অতীত। আলী ও ফাতেমার ক্ষোভ অবহিত হওয়ামাত্র আবু বকর কাল বিলম্ব না করে তাঁদের গৃহে গিয়েছিলেন তাঁদের ক্ষোভ প্রশমিত করার জন্যে। সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন মুহাম্মদের আর একজন অতি ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত সাহাবী (অনুগামী ও অনুচর) ওমর ফারুককে।
তাঁরা আলীর গৃহের ভিতর প্রবেশ করার পূর্বেই দরজার মুখে দাঁড়িয়েই বিবি ফাতেমাকে সালাম জানান। ফাতেমা মুসলমানদের চোখে অতি আদরণীয় ও আদর্শস্থানীয় রমণী। তিনি ‘খাতুনে জান্নাত’ উপাধিতে ভূষিত হওয়ার দুর্লভ সম্মানের অধিকারী হয়েছিলেন এবং এখনও তাঁকে সেই উপাধিতে সম্মান প্রদর্শন করা হয়। ‘খাতুনে জান্নাত’ অর্থ স্বর্গীয় রমণী বা জান্নাতের (স্বর্গ ) নারীদের নেত্রী। সেই ফাতেমা আবু বকর ও ওমরকে তাঁদের গৃহের অভ্যন্তরে আমন্ত্রণ করার সৌজন্যটুকু প্রদর্শন করেন নি। এ প্রসঙ্গে যে কথাটি খেয়াল রাখা দরকার তা হলো তখন আবু বকর একজন ব্যক্তিমাত্র শুধু নন, তিনি একধারে একটি দূর্দণ্ডপ্রতাপশালী রাষ্ট্রের প্রধান এবং আর একাধারে তাঁরই (ফাতেমা) পিতার সবচেয়ে প্রিয়, ঘনিষ্ঠ ও সর্বাধিক বিশ্বস্থ সাহাবি। ওমরও ছিলেন মুহাম্মদের অতি প্রিয় ও বিশ্বস্ত সাহাবী।
তবুও তাঁদের প্রতি তিলপরিমাণ সৌজন্য ও সম্মান প্রদর্শন করেননি বিবি ফাতেমা। উল্টো অপমান করে গৃহের দরজা থেকেই অনেক কটু কথা বলে তাঁদের তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। ফাতেমা তাঁদের অনেক রূঢ়স্বরে বলেন,
“আপনারা খলিফা নির্বাচনে পক্ষপাতিত্ব করেছেন। তারপরেও আপনারা কোন মুখে জনগণের নিকট হতে বয়াত গ্রহণ করেছেন।“
(দ্রঃ হযরত আবু বকর (রাঃ), ড. ওসমান গণি, পৃষ্ঠা- ৬৪)
সেসময় সেখানে মদিনার অনেক মানুষ জড়ো হয়েছিলেন, তাঁদের উদ্দেশে তিনি নালিশের সুরে বলেন,
“আপনারা রসুলের উম্মত, আপনারাই বলুন, খলিফা নির্বাচনে কী ন্যায়-নীতির অনুসরণ হয়েছে? শের-ই খোদা হযরত আলী কী মহানবীর অতি ঘনিষ্ঠতম নন! তাছাড়া তাঁর গুনাগুণ কী সকলের অপেক্ষা কোন অংশে কম? তাঁর যোগ্যতা, দক্ষতা, জ্ঞান-গরিমার কথা, বীরত্বের কাহিনী কে না জানেন। বিদায় হজ্বে আব্বাজান (মহানবী) তাঁর সম্পর্কে জনগণকে কী বলে গেছেন?”
(দ্রঃ হযরত আবু বকর (রাঃ), ড. ওসমান গণি, পৃষ্ঠা- ৬৪)
ফাতেমা কোনোভাবেই তাঁর জীবদ্দশায় আবু বকরকে খলিফা বলে স্বীকার করেন নি এবং মেনেও নেন নি। আলীও তাঁর কাছে বয়াত নেন নি (অর্থাৎ খলিফা বলে স্বীকার করেন নি)।
অনেক পরে অবশ্য আলী আবু বকরের কাছে বয়াত নেন। সেটাও কমপক্ষে ছ’মাস পর। ফাতেমা মারা যান মুহাম্মদের মৃত্যুর ছ’মাস পর, ফাতেমার জীবদ্দশায় আলী আবু বকরের কাছে বয়াত নেন নি। পরে বয়াত নিলেও শেষ পর্যন্ত তাঁর মনের ক্ষোভ মুছে যায় নি। পরিস্থিতি তাঁকে বয়াত নিতে বাধ্য করেছিল এবং বয়াত নেওয়ার পশ্চাতে কোন বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল বলে মনে করা হয়। তিনি যে মন থেকে আদৌ বয়াত গ্রহণ করেন নি, তার অনেক প্রমাণ ইতিহাসে পাওয়া যায়। সে বিষয়ে একটু পরে আলোচনা করবো। এখন দেখা যাক কেন এবং কোন পরিস্থিতিতে তিনি খলিফা আবু বকরের কাছে বয়াত নেন।
আবু বকর মুহাম্মদের মৃত্যুর পর প্রথম খলিফা হওয়ার পর ইসলামি সাম্রাজ্য কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে নিমজ্জিত হয়। সেসব নিয়ে আলোচনা করার অবকাশ এখানে নেই। আবু বকর কিন্তু অত্যন্ত দৃঢ় হস্তে পরিস্থিতি সামাল দেন এবং ইসলামি সাম্রাজ্যকে ‘বিপদমুক্ত’ করে অনেকখানি শক্তভিতের ওপর দাঁড় করিয়ে দিতে সক্ষম হন। মুহাম্মদের মৃত্যুপরবর্তীকালের সঙ্কট যখন কেটে গেল তখন আবু বকর মন দিলেন ইসলামি সাম্রাজ্য বিস্তারের দিকে এবং এক্ষেত্রেও একের পর এক সাফল্য অর্জন করতে তিনি সক্ষম হলেন।
এসময় আলীর ভূমিকা ছিল হতাশাব্যঞ্জক। ফলে একদিকে মুহাম্মদের সাহাবী ও সাধারণ উম্মতদের ওপর আবু বকরের নের্তৃত্ব ক্রমে দৃঢ় হতে থাকলো, অপরদিকে আলীর প্রতি মুহাম্মদের জামাই ও বংশধর বলে যে আবেগ ও সহানুভূতি ছিল তা ফিকে হতে শুরু করলো। এই সুযোগকে কাজে লাগালেন আবু বকর ও ওমর। তাঁরা প্রভূত ক্ষমতার মালিক এখন, সেই ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে আলীর অনুগামীদের তাঁদের পক্ষে টানার কাজ শুরু করলেন। আলীর অনুগামীরাও ক্ষমতার প্রসাদ লাভের জন্যে ধীরে ধীরে তাঁদের প্রিয় মহানবীর প্রিয় জামাই ও বংশধরের সঙ্গ ত্যাগ করে আবু বকরের দিকে ঝুঁকতে শুরু করলেন।
আলী একসময় আবিষ্কার করলেন তিনি নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ছেন, কেউ আর তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতে চাইছে না এবং সবাই তাঁকে এড়িয়ে চলছেন। এদিকে আবু বকর থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্যে তাঁর উপার্জনও (গণিমতের মালের অংশ পাওয়া) বন্ধ, ফলে শুরু হয়েছে আর্থিক সঙ্কট। আলীকে আরেকটা বিষয় ভাবিয়ে তুলেছিল, তাহলো ইসলামি সাম্রাজ্যের পরবর্তী খলিফা পদটি হাসিল করার ভাবনা। আবু বকর থেকে দূরে থাকলে তো সেই পদটি তথা ক্ষমতা কব্জা করা সম্ভব হবে না। তাই শেষ অবধি তিনি সিদ্ধান্ত নেন আবু বকরের আনুগত্য মেনে নেওয়া তথা বয়াত নেওয়াটাই শ্রেয়। এরূপ বিবেচনা করেই পরবর্তী খলিফা হওয়ার লোভের বশবর্তী হয়ে তিনি খলিফা আবু বকরের নিকট আত্মসমর্পণ করেন ও বয়াত নেন।
আলীর পক্ষে কিন্তু খুবই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটেছিল, প্রধানতঃ যে উদ্দেশ্যে আবু বকরের নিকট আত্মসমর্পণ করেছিলেন সেটা পূরণ হয় নি। আবু বকর খলিফা হওয়ার পর মাত্র দু’বছর বেঁচে ছিলেন। তিনি মারা যান ৬৩৪ খ্রিস্টাব্দে। তিনি যখন বুঝতে পারলেন তাঁর মৃত্যু ঘনিয়ে এসেছে তখন সবাইকে ডেকে জানিয়ে দিলেন যে পরবর্তী খলিফা পদে তিনি ওমর ফারুককে মনোনীত করছেন। উপস্থিত সকলেই তাঁর সিদ্ধান্তকে স্বাগত ও সমর্থন জানালেন। একমাত্র আলীই আশা করেছিলেন মুহাম্মদের সবচেয়ে প্রিয় ও বিশ্বস্ত বন্ধু ও সাহাবি (অনুচর) আবু বকর মুহাম্মদের হাতে গড়া সাম্রাজ্য তাঁর জামাই ও বংশধর আলীর হাতে অর্পণ করে মুহাম্মদের প্রতি শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা নিবেদন করবেন। কিন্তু আলী গভীর হতাশা নিয়ে শুনলেন যে ইসলামি সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় খলিফা মনোনীত হলেন ওমর ফারুক। এই ঘোষণা তাঁর কাছে আশাতীত ও অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল, তবু তা তাঁকে নীরবেই শুনতে হলো ও মেনে নিতেও হলো, কারণ তিনি নিজের চোখেই দেখলেন যে উপস্থিত সকলেই সহর্ষে ওমরকে খলিফা মেনে নিয়েছেন। আলীকে পরবর্তী খলিফা মনোনীত না করার জন্যে কোনোদিক থেকেই কোনো প্রশ্ন ওঠে নি। এর কারণ হলো মুহাম্মদের মৃত্যুর পরের দু’বছর যে সীমাহীন সংকট ও দুর্যোগ মোকাবিলা করতে হয়েছে মুহাম্মদের সাহাবী ও উম্মতদের সেক্ষেত্রে আলীর ভূমিকা ছিল খুবই হতাশাব্যঞ্জক ও নৈরাশ্যজনক, ফলে আলীর প্রতি যে আবেগ ও সহানুভূতি ছিল তা ক্রমশঃ বিরক্তিতে রূপান্তরিত হয়েছিল। ফলে সবকিছুই আলীকে মুখ বন্ধ করে মেনে নেওয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। তাই আবু বকরের মৃত্যুর পর বিনা বাক্য ব্যয়ে ওমরের নিকট গিয়ে বয়াত নিতে আর বিলম্ব করেন নি।
ওমরের প্রতি আলীর আনুগত্য ছিল নিতান্তই মুখোশমাত্র, অন্তর থেকে তাঁকে তিনি খলিফা মেনে নিতে পারেন নি। ওমরের দশ বছরের খেলাফতকালে এর অজস্র প্রমাণ রয়েছে। এখানে তারই একটা দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা যাক। ওমরকে প্রকৃতপক্ষে ইসলামি সাম্রাজ্যের নির্মাতারূপে ইতিহাস আখ্যায়িত করেছে। কারণ আবু বকর যে সাম্রাজ্যটিকে চারিদিকের আক্রমণ থেকে রক্ষা করে একটা শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন, ওমর সেখান থেকে ইসলামি সাম্রাজ্যের ব্যাপক বিস্তার ঘটিয়েছিলেন এবং প্রকৃত অর্থেই শিশু ইসলামি রাষ্ট্রটিকে একটি সাম্রাজ্যের চেহারা দিয়েছিলেন। রোম ও পারস্য সাম্রাজ্যটি জয় করে সেই কাজটি সম্পন্ন করেছিলেন। সেই কারণে তাঁকে ইসলামি সাম্রাজ্যের নির্মাতা বলে অভিহিত করা হয়।
যে ঘটনাটি উল্লেখ করতে চাইছি সেটা পারস্য সাম্রাজ্যকে আক্রমণের পূর্বেকার ঘটনা। ৬৩৮ থেকে ৬৪২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যেকার ঘটনা। ইসলামের ইতিহাসে কাদিসিয়ার যুদ্ধের একটি বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। এই যুদ্ধটির উদ্দেশ্য ছিল পারস্য সাম্রাজ্য আক্রমণ করা। কাদিসিয়ার যুদ্ধকে মুসলিম ঐতিহাসিকগণ ইতিহাসের একটি সন্ধিক্ষণ বলে বর্ণনা করেছেন। কারণ এই যুদ্ধে ওমরের বাহিনীর পরাজয় হলে ইসলামি সাম্রাজ্যের ধ্বংস অনিবার্য ছিল। আর তা যদি হতো তবে ইসলাম ধর্মটাই ইতিহাসের পাতা থেকে চিরদিনের জন্যে হারিয়ে যেতো। যুদ্ধের এমন গুরুত্বের কথা বিচার করে ওমর কয়েকটি নতুন রণকৌশল ও রণনীতি রচনা করেছিলেন। তারমধ্যে একটি হলো তিনি সর্বাধিনায়কের পদ ও গুরুদায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। আর একটি হলো তিনি ক্ষমতাসম্পন্ন একটি সামরিক পরিষদ গঠন করেছিলেন। এই সামরিক পরিষদই ওমরের রণকৌশল পরিবর্তন করার প্রস্তাব দিয়েছিল, যা ছিল অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণ ও বাস্তবসম্পন্ন। ওমর তা মেনে নিয়েছিলেন। প্রস্তাবটি ছিল এরকম-
‘যদি যুদ্ধে পরাজয় ঘটে তবে শত্রুরা চারদিক থেকে মদিনা (ইসলামি রাষ্ট্রের রাজধানী) আক্রমণ করবে। তাই খলিফার মদিনা ছেড়ে যাওয়া সমীচীন হবে না, শত্রুর আক্রমণ থেকে মদিনাকে রক্ষা করার জন্যে কিছু সৈন্য নিয়ে তাঁর মদিনায় থাকা বাঞ্ছনীয় হবে এবং সেক্ষেত্রে সর্বাধিনায়কের গুরুদায়িত্বটি পালনের সব থেকে উপযুক্ত মানুষটি হলেন আলী। তাই আলীকেই এই যুদ্ধের সর্বাধিনায়ক করা হোক।’
ওমরের সম্মতিতে ও সর্বসম্মতিতে যখন এই সিদ্ধান্তটি সামরিক পরিষদে গৃহীত হলো তখন আলী বেঁকে বসলেন। সবাইকে বিস্মিত করে তিনি জানিয়ে দিলেন তাঁর অসম্মতি ও অক্ষমতার কথা। আলী কেন খলিফা ও সামরিক পরিষদের সিদ্ধান্ত প্রত্যাখান করলেন তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। ওমরকে খলিফা হিসাবে মনের ভিতর থেকে গ্রহণ করতে না পারার জন্যেই এই যুদ্ধে তিনি ইসলামের জয়ের জন্যে ব্যাকুলতাবোধও করেন নি কিংবা ইসলামের পরাজয় ও মুছে যাওয়ার আশঙ্কাতেও বিচলিত হন নি। খলিফা ওমর শেষ পর্যন্ত মুহাম্মদের খালাতো (মাসতুতো) ভাই ও বিশিষ্ট সাহাবি সাদ বিন আক্কাসকে সর্বাধিনায়ক করে যুদ্ধাভিযানের নির্দেশ দেন। এইরূপ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা অবশ্যই ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। এই যুদ্ধে ওমর বিজয়ীর হাসি হেসেছিলেন তা বলা বাহুল্য এবং তখন আলীর মনের কী অবস্থা হয়েছিল তা সহজেই অনুমেয়।
ওমর ফারুকের রাজত্বকালের সময়সীমা ছিল ১০ বছর। এই সময়কালে স্বাভাবিকভাবেই ওমর ও আলীর মধ্যে মানসিক দুরত্ব আরও অধিক বৃদ্ধি পেয়েছিল এবং এর জন্যে যে আলীই দায়ী ছিলেন তা বলা বাহুল্য। ওমর ছিলেন ভীষণ ধর্মনিষ্ঠ ও কড়া ধাতের মানুষ। মুহাম্মদের নির্দেশ ও কোরানের বাণী অনুসারে তিনি শাসনকার্য পরিচালনা করতেন, কোনো রকম আপস-রফা করতেন না। মুহাম্মদের নির্দেশ ছিল সমগ্র আরবকে মোশরেকমুক্ত (অমুসলমানদের থেকে মুক্ত) করা। মুহাম্মদ যেহেতু মক্কা বিজয়ের মাত্র দু’বছর পর আকস্মিকভাবে মারা যান, তাই এই কাজটি নিজে সম্পূর্ণ সম্পন্ন করে যেতে পারেন নি। মৃত্যুর প্রাক-মূহুর্তে এই কাজটি সম্পাদন করার নির্দেশ দিয়ে যান তাঁর সাহাবীদের ওপর। আবু বকরও সময় পান নি। ওমর এটা একশোভাগ সম্পন্ন করেন। এর ফলে যারা নিরুপায় হয়ে প্রাণে বাঁচার তাগিদে স্বধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে মুসলমান হয়েছিলেন তাঁরা খুব স্বাভাবিকভাবেই ওমরের বিরুদ্ধে ক্ষুদ্ধ ও ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন। তাঁদেরই কেউ ওমরকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে ছুরিকাহত করেন এবং সেই আঘাতের কারণেই তাঁর জীবনাবসান হয়।
মৃত্যুর পূর্বে ওমর আবু বকরের পথ অনুসরণ করে একজন বিশিষ্ট সাহাবিকে খলিফা মনোনীত করে যেতে চেয়েছিলেন। এ ব্যাপারে তাঁর পছন্দ ছিল আব্দুর রহমান নামের একজন বিশিষ্ট সাহাবি। খলিফা পদের দাবিদার ছিলেন অনেকেই, যাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী আকাঙ্ক্ষা ও আশা ছিল যাঁর, তিনি হলেন আলী। যাঁরা দাবিদার ছিলেন তাঁদের কারও প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস ছিল না ওমরের, এদিকে আব্দুর রহমানও খেলাফতের দায়িত্ব নিতে অসম্মত হলেন। ওমর তখন একটি কমিটি গঠন করে পরবর্তী খলিফা নির্বাচনের দায়িত্ব সেই কমিটির হাতে তুলে দিলেন। এই কমিটির পক্ষে খলিফা নির্বাচনের কাজ দুরুহ হয়ে উঠেছিল। কারণ খলিফা পদের দাবিদার যাঁরা ছিলেন তাঁদের মধ্যে আলী ও ওসমান গণি দু’জনেই শেষ অবধি নিজের নিজের দাবিতে অটল ছিলেন। খলিফা তখন কমিটির সম্প্রসারণ করেন। এই কমিটিকে খলিফা পদে একজনকে নির্বাচিত করার জন্যে শেষ অবধি ভোটাভুটি করতে হয়। ভোটে আলী পরাস্ত হন এবং ওসমান সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে পরবর্তী খলিফা তথা ইসলামি সাম্রাজ্যের তৃতীয় খলিফা নির্বাচিত হন। আলীর তখনও যাঁরা অতি অল্প কয়েকজন অনুগামী ছিলেন তাঁরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন এবং ওসমানকে তাঁরা মানবেন না বলে জানিয়ে দিয়ে সভাস্থল ত্যাগ করেন।
খলিফা ওমর কিন্তু কমিটির সিদ্ধান্তকে চূড়ান্ত বলে জানিয়ে দিলেন এবং খেলাফতের দায়িত্ব ওসমান গণির হাতে সঁপে দিলেন। তৃতীয় খলিফা এই ওসমান গণিও ছিলেন মুহাম্মদের আর এক জামাই। তৃতীয় খলিফা হিসেবে ওসমান গণিকে আলী একেবারেই মেনে নিতে পারেন নি। ওসমান গণির খেলাফতকালে নানাভাবে ওসমানকে সমস্যায় ফেলার চেষ্টায় আলী নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। এরই ফলশ্রুতিতে ওসমানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ দানা বাঁধে এবং শেষঅবধি বিদ্রোহীদের হাতেই তাঁর মৃত্যু হয়।
তৃতীয় খলিফা ওসমানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং সেই বিদ্রোহে খলিফার মৃত্যুর ঘটনাই কারবালার ঘটনাকে অবধারিত করে তুলেছিল। কীভাবে পরিস্থিতি দ্রুত কারবালা প্রান্তরের যুদ্ধের দিকে এগুচ্ছিল তা নিয়ে আলোচনার পূর্বে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় এখানে আলোচনা করে নিতে চাই, যা এই আলোচনার জন্য খুবই প্রাসঙ্গিক।
মুহাম্মদের মৃত্যুর পর খলিফা নির্বাচন কোনবারই সুষ্ঠু, সুন্দর ও সাবলীলভাবে যে সম্পন্ন হয় নি তা ইতোপূর্বের আলোচনায় স্পষ্ট। প্রতিবারই বেশ কঠিন সমস্যা তৈরি হয়েছে। প্রথম খলিফা আবু বকর তাঁর নিজের খলিফা হওয়ার তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা চিন্তা করে পরবর্তী খলিফা নির্বাচনের জন্যে আলোচনার পথে হাঁটেন নি, বরং খেলাফতের ক্ষমতাবলে মুসলিম উম্মার ওপর দ্বিতীয় খলিফা হিসেবে ওমর ফারুককে চাপিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি যেহেতু খলিফা তাই তাঁর বিরোধিতা করার সাহস কারও হয় নি। খলিফা ওমরও সেইপথ ধরে তৃতীয় খলিফা নির্বাচনপর্ব সম্পন্ন করে যেতে চেয়েছিলেন তাঁর মৃত্যুর পূর্বে। কেন পারেননি, তা উপরের আলোচনায় বর্ণনা করা হয়েছে।
চতুর্থ খলিফা নির্বাচনে সংকট হয়েছিল আরও তীব্র যা কারবালা কাণ্ডের পরিস্থিতিকে অনিবার্য ও অধিক নিকটবর্তী করে তুলেছিল। কেন এরূপ সমস্যাগুলির উদ্ভব হয়েছিল তার কারণগুলি বুঝতে খুব অসুবিধা হয় না। প্রধান দু’টি কারণ হলো-
১) খলিফা নির্বাচনে মুহাম্মদ কোনো নীতি ঠিক করে যান নি। এটা তাঁর অদূরদর্শিতার জন্যে হয়ে থাকতে পারে। তিনি ভাবতেই পারেন নি যে তাঁর মৃত্যু খুবই সন্নিকটে।
২) মুহাম্মদের সাহাবীরা ছিলেন প্রচণ্ড ক্ষমতালোভী। প্রধানতঃ এই দু’টি কারণেই খলিফা নির্বাচনের সময় সংকট সৃষ্টি হয়েছে।
এই সত্যটি কোনো মুসলিম ঐতিহাসিক স্বীকার করেন নি এবং সযত্নে তা গোপন করে গেছেন। অথচ তাঁরাই পঞ্চম খলিফা মাবিয়ার বিরুদ্ধে একটা গুরুতর অভিযোগ করেছেন যে, তিনি তাঁর পরবর্তী খলিফা নির্বাচনে ইসলামের গণতান্ত্রিক পদ্ধতি লঙ্ঘন করেছেন। এবং এটাকে কারবালা যুদ্ধের একটা বড় কারণ বলে তাঁরা চিহ্নিত করেছেন। কারবালা যুদ্ধের প্রধান হোতা হিসাবে আসামীর কাঠগড়ায় মুসলিম ঐতিহাসিকগণ মাবিয়াকেই দাঁড় করিয়েছেন এবং তার সপক্ষে তাঁর বিরুদ্ধে আরও বহু অভিযোগ উত্থাপন করেছেন যা অতিশয় পক্ষপাতদুষ্ট। সেসব বিষয় আলোচনা হবে আগামী পর্বে। আগামী পর্বে আমরা আসবো ওসমান গণির খলিফা নির্বাচনোত্তর কালের ঘটনায়।
মে ৩১, ২০১৭; ২:৫৭ অপরাহ্ন
ধারাবাহিক সিরিজটি মনোযোগসহ পড়ছি। পরের পর্বের অপেক্ষায়…
মে ৩১, ২০১৭; ৩:০১ অপরাহ্ন
জেনে প্রীত হলাম। পড়ার জন্য আপনাকেও ধন্যবাদ।
মে ৩১, ২০১৭; ৬:৩২ অপরাহ্ন
পড়ছি। অনেক গোছালো লেখা
জুন ১, ২০১৭; ৬:২৫ অপরাহ্ন
খুব ভালো লাগল লেখাটা। লেখক ও ব্লগ কর্তৃপক্ষকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই এরকম একটি ইতিহাসমূলক নিবন্ধের জন্য। আমি সত্যিই আনন্দিত এই কারণে যে, সত্য ইতিহাসটা জানতে চাই। আশাকরি লেখক নিরাশ করবেন না।
জুন ১, ২০১৭; ৬:২৮ অপরাহ্ন
সাগ্রহে পড়ছি। সিরিজটা শেষ হবার পরে কিছু আলোচনা করার ইচ্ছে আছে।
জুন ১, ২০১৭; ৬:৩৫ অপরাহ্ন
বাংলা ভাষায় ইতিহাস গবেষণামূলক লেখার বড়ই অভাব। বিশেষ করে ইসলামি ইতিহাস আমরা যা পাঠ করি সেসব পক্ষপাতদুষ্টতায় ভরা। যে কারণে আমরা অনেককিছুই জানতে পারি না। এই সিরিজটা অত্যন্ত নিবিড়ভাবে পাঠ করছি সে তৃষ্ণা থেকেই। ভালো লেগেছে।
জুন ১০, ২০১৭; ৮:০৪ পূর্বাহ্ন
লেখাটি মনোযোগ দিয়ে পড়ছি। ভালো লাগছে। আপনার প্রোফাইলে হিন্দু মেয়ের ছবি কেন?