২১২৯ বার পঠিত
হোসেনের আপত্তি সত্ত্বেও ৬ষ্ঠ খলিফা পদে ইয়াজিদের আরোহণপর্ব ছিলো মসৃণ
মাবিয়ার মৃত্যুর পর এজিদ ৬৮০ খ্রিস্টাব্দে ইসলামি সাম্রাজ্যের ৬ষ্ঠ খলিফা নিযুক্ত হন। বলা বাহুল্য যে, যেহেতু তিনি পূর্ব থেকেই ওই পদে মনোনীত ছিলেন, তাই একদম নির্বিঘ্নে ও মসৃণভাবেই খলিফার সিংহাসনে তাঁর আরোহণ প্রক্রিয়াটি সুসম্পন্ন হয়। এমনকী মদিনার মুসলমানরাও এজিদকে খলিফা পদে স্বীকার করে নিতে বিলম্ব করেন নি। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিলেন কেবল ইমাম হোসেন এবং তাঁর মুষ্টিমেয় হাতেগোনা কয়েকজন সঙ্গী-সাথী। তাঁরা এজিদকে খলিফা মানতে অস্বীকার করেন।
প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে এজিদের হাতে সমগ্র মুসলিম জাহানে যখন বয়াত (আনুগত্যের শপথ) নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে তখন হোসেন মদিনাতেই অবস্থান করছিলেন। মাবিয়া যখন এজিদের মনোনয়নের প্রস্তাব নিয়ে মদিনা এসে মদিনাবাসীর সঙ্গে মত বিনিময় করছিলেন তখন মাবিয়া আহুত সভাস্থল থেকে উঠে হোসেন একেবারে মদিনা ত্যাগ করে মক্কা চলে গিয়েছিলেন। এটা নিয়ে অবশ্য দুরকম মত রয়েছে। একটা মত হলো, মক্কা থেকে পুনরায় মদিনায় ফিরে এসেছিলেন মাবিয়ার মৃত্যুর ঢের পূর্বেই, আরেকটা মত হলো মাবিয়ার মৃত্যুর খবর পেয়ে তিনি মদিনা এসেছিলেন মাবিয়ার মৃত্যু-পরবর্তী পরিস্থিতিতে মদিনার প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করার জন্য।
বলা বাহুল্য, তিনি যে পরিস্থিতি নিজের চোখে দেখলেন (মক্কার প্রায় সকলেই এজিদকে খলিফা হিসেবে মেনে নিচ্ছেন স্বতস্ফূর্তভাবে) তা তাঁকে আরও একবার ভীষণ হতাশ করলো। এদিকে দামেস্কে (ইসলামি সাম্রাজ্যের তৎকালীন রাজধানী) এজিদের কাছে যথারীতি খবর পৌঁছে গেল যে, হোসেন ও তাঁর মুষ্টিমেয় কয়েকজন সঙ্গী বা অনুচর তাঁকে খলিফা হিসাবে মেনে নিতে অসম্মতি জ্ঞাপন করেছেন। এজিদ মানসিকভাবে এ খবর শোনার জন্য প্রস্তুতই ছিলেন। তিনি শুধু খবরটি কখন এসে পৌঁছায় তারজন্য অপেক্ষা করছিলেন। খবর পৌঁছানোমাত্রই মদিনার গভর্নর ওয়ালিদকে একটি জরুরী বার্তা পাঠান, যে বার্তায় ওয়ালিদকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যাঁরা খলিফার বয়াত নিতে অস্বীকার করেছেন তাঁদেরকে যেন অবিলম্বে বয়াত নেওয়ানোর ব্যবস্থা করা হয়। মদিনার গভর্নর স্বাভাবিকভাবেই হোসেনের নিকট খলিফার বার্তা পৌঁছে দেন এবং তাঁকে খলিফার আনুগত্য স্বীকার করে নেওয়ার অনুরোধ করেন এবং অনুরূপভাবে তাঁর অনুচরদেরও (ওমরের পুত্র, আবু বকরের পুত্র, যুবায়েরের পুত্র এবং আর একজন বিশিষ্ট সাহাবীসহ আব্বাসের দুই পুত্রকেও) একই অনুরোধ করেন।
খলিফার নির্দেশ পাওয়ার সাথে সাথে ওমরের পুত্র, আবু বকরের পুত্র এবং আব্বাসের দুই পুত্র ইমাম হোসেনকে উপেক্ষা করে ষষ্ঠ খলিফা এজিদের প্রতি আনুগত্যের শপথ নিয়ে নেন। শুধু বাকি থাকলেন হোসেন এবং যুবায়ের পুত্র আব্দুল্লাহ। হোসেন যখন নিজের চোখে দেখলেন তিনি একেবারেই নিঃসঙ্গ, এমনকী এক বছর আগেও যে কয়েকজন তাঁর সাথে ছিল তাঁরাও তাঁকে পরিত্যাগ করে চলে গিয়ে এজিদকে খলিফা হিসাবে স্বীকার করে নিয়েছেন, তখন মদিনায় আর এক মূহুর্তও অবস্থান করা অসমিচীন ভেবে কাল বিলম্ব না করে তিনি মদিনা ত্যাগ করেন। স্বাভাবিকভাবেই একমাত্র আব্দুল্লাহ ইবন যুবায়েরকেই তিনি সঙ্গী হিসাবে পেলেন। গভর্নর সে খবরও যথারীতি খলিফা এজিদের দরবারে পৌঁছে দিলেন। ওদিকে খলিফার নিকট থেকে হোসেনের ওপর বলপ্রয়োগ করে আনুগত্য আদায়ের জন্য কোনও নির্দেশ না আসায় তিনিও এবিষয়ে নীরব থাকায় শ্রেয় ও সমীচীন মনে করলেন। এর কারণে হোসেন এবং আব্দুল্লাহ ইবন যুবায়ের বিনা বাধায় মক্কায় গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করলেন।
মক্কায় গিয়ে হোসেন এজিদের খেলাফতের বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় তা নিয়ে তিনি তাঁর আত্মীয়স্বজন ও শুভাকাঙ্খীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা শুরু করলেন। তাঁরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে ইসলামি সাম্রাজ্যের খেলাফতের একমাত্র ন্যায়সঙ্গত উত্তরাধিকার হলেন মুহাম্মদের নাতি ও বংশধর ইমাম হোসেন, এবং মাবিয়া যেহেতু সম্পূর্ণ অন্যায় ও অনৈতিকভাবে এবং ইসলামি নীতিবিরুদ্ধ পথে নিজ পূত্রকে খলিফা মনোনীত করে গেছেন, তাই এজিদ কোনোভাবেই বৈধ খলিফা নয়। এবং শেষ পর্যন্ত তাঁরা এরূপ সিদ্ধান্তও গ্রহণ করেন যে শুধু এজিদের হাতে বয়াত নেওয়া থেকে বিরত থাকলেই হবে না, তাঁর (এজিদের) খেলাফতের বিরুদ্ধে সরব হয়ে জনমত গঠন করতে হবে যার লক্ষ্য হবে এজিদকে ক্ষমতাচ্যুত করে হোসেনের হাতে ইসলামি সাম্রাজ্যের খেলাফত তুলে দেওয়া। এমনটা শোনা যায় যে, এরূপ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত বা প্ররোচিত করেছিলেন নাকী যুবায়ের পুত্র আব্দুল্লাহ। এই কথাটার কতোটা ভিত্তি আছে তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। তবে বিশাল একটি সাম্রাজ্যের একজন খলিফাকে ক্ষমতাচ্যুত করার দুরুহ ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করার ভাবনা কীভাবে হোসেন ও তাঁর আত্মীয়-স্বজনদের মাথায় ঠাঁই পেয়েছিল সেটাই সবচেয়ে বেশি বিস্ময়কর। তাঁরা বোধহয় এরূপ আশা করে ছিলেন যে মুহাম্মদের বংশধর বলে হোসেনের পক্ষেই মুসলমানরা রাস্তায় নেমে সমর্থন জ্ঞাপন করবেন। কিন্তু এতট আশা করার কোনো উপাদানই যে তখন অবশিষ্ট ছিল না তা তাঁরা কেউ বুঝতে সক্ষম হন নি। সে যাই হোক, তাঁরা স্থির করলেন যে, এজিদকে বৈধ খলিফা বলে তাঁরা যে স্বীকার করছেন না সে কথা লিখিতভাবে তাঁকে জানিয়ে দিতে হবে। সেই সিদ্ধান্ত মতো হোসেনের নেতৃত্বে কিছু মানুষ একজন দূত মারফত এজিদকে একটি চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিলেন যে, মাবিয়া আপনাকে খলিফা পদে মনোনীত করে চরম অন্যায় ও পাপ কাজ করেছেন, তাই আপনি একজন অবৈধ খলিফা বৈ নয়। ইসলামি সাম্রাজ্যের একমাত্র ন্যায্য ও ন্যায়সঙ্গত উত্তরাধিকার হলেন ইমাম হোসেন। আমরা তাই আপনাকে খলিফা হিসাবে স্বীকার করছি না।
এজিদকে সেই চিঠি পাঠিয়ে হোসেন তাঁর পক্ষে জনমত গঠনের কাজে নেমে পড়লেন। প্রথমে তিনি কুফা প্রদেশে নিজে গিয়ে জনমত গড়ার পরিকল্পনা করলেন। এই প্রদেশে তাঁর পিতা আলির অনুরাগীর সংখ্যা ছিলো তুলনায় বেশী। কুফাবাসীর প্রতি বেশী ভরসা রেখেছিলেন তাঁর পিতা স্বয়ং আলিও। তিনি (আলি) যখন খলিফার সিংহাসনে আরোহণ করেন ওসমানের হত্যাকারীদের হাত ধরে তখন মদিনাবাসী তাঁর প্রতি ভীষণ বিরূপ ও বিক্ষুব্ধ হয়ে তাঁর পাশ থেকে সরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাই তিনি খলিফা হওয়ার কিছুদিন পরেই ইসলামি সাম্রাজ্যের রাজধানী মদিনা থেকে কুফায় সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন।
অথচ আলির বংশধর ও অনুগামীরা প্রবলভাবে দাবি করে এসেছেন যে, আলি যেহেতু আল্লাহর শেষ নবী তথা মুহাম্মদের বংশধর তাই ইসলামি সাম্রাজ্যের খেলাফতের ন্যায়সঙ্গত উত্তরাধিকার একমাত্র আলিই, আর অন্য কেউই হতে পারেন না। আলিও বারবার সেই একই দাবী করেছেন। আলির পত্নী ফতেমাও সেই একই দাবি করেছিলেন এবং আবু বকরকে (মুহাম্মদের মৃত্যুর পর প্রথম খলিফা) খলিফা পদে কিছুতেই মেনে নেন নি। অথচ সেই আলিই মুহাম্মদ যে মাটিতে চির নিদ্রায় শুয়ে রয়েছেন সেই মদিনা থেকে রাজধানী কুফা শহরে সরিয়ে নিয়ে যেতে দ্বিধা করেন নি। আলির এমনই ছিল আল্লাহর শেষ নবী তথা আপন শ্বশুর তথা আপন চাচাতো দাদার প্রতি শ্রদ্ধা,আবেগ ও ভালবাসা!
ওসমান কিন্তু নিজের জীবন বিপন্ন জেনেও মদিনা ছেড়ে যান নি বা মদিনা থেকে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন নি। তিনি বলেছিলেন, আমার প্রিয় নবি যে মাটিতে শায়িত রয়েছেন চির ঘুমে সেই মাটির তুলনায় আমার আমার জীবন ও খলিফার সিংহাসন অতিশয় তুচ্ছ, আমি কোনো কিছুর বিনিময়েই মদিনা পরিত্যাগ করে যেতে পারব না। শেষ নবির প্রতি প্রেম-প্রীতি-ভালবাসা এবং শ্রদ্ধা কত গভীর ও কত আন্তরিক ছিল ওসমানের হৃদয়ে তার প্রমাণ নিজের জীবন দিয়ে তিনি দেখিয়ে দিয়ে গেছেন। ওসমান কিন্তু নবির উত্তরাধিকার বা বংশধর ছিলেন না, এমনকী তাঁর গোত্রের লোকও ছিলেন না। অপরদিকে আলি ছিলেন নবির অতি আদরের চাচাতো ভাই। নবি আলিকে এত ভালবাসতেন ও স্নেহ করতেন যে তাঁর নিজের প্রাণাধিক কন্যা ফতেমার সঙ্গে তাঁর(আলি) বিয়ে দিয়েছিলেন, যদিও ইতিমধ্যেই আবু বকর ও ওমর দুজনেই নবির কাছে ফতেমাকে বিয়ে করার প্রস্তাব প্রদান করেছিলেন। মুহাম্মদ আলিকে ‘আল্লাহর তরবারি’ (সাইফুল্লাহ) এবং ‘জ্ঞানের দরজা’ এই দুটি অসামান্য উপাধিতে ভুষিত করেছিলেন। সেই আলিই নিজের স্বার্থ রক্ষার্থে মুহাম্মদের প্রাণাধিক প্রিয় শহর মদিনাকে ত্যাগ করে চলে গিয়েছিলেন কুফা শহরে। হোসেন সেই কুফা শহরকেই সব আগে তাঁর পক্ষে জনমত গঠনের জন্য বেছে নিলেন। কুফা যাওয়ার আগে সেখানকার পরিস্থিতি সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়ার জন্য তাঁর চাচাতো ভাই মুসলিমকে আগে সেখানে প্রেরণ করলেন।
সর্ব প্রথম হোসেন কুফা শহরেই কেন যেতে মনস্থির করেছিলেন তা নিয়ে ভিন্ন মতও শোনা যায়। সে মতটি এ রকমঃ এজিদের খলিফা হওয়াটা কুফাবাসী একেবারেই মেনে নিতে পারেন নি। তাঁরা হোসেনকেই খলিফা পদে দেখতে আগ্রহী ছিলেন। তাঁরা মনে করতেন যে এজিদ একজন স্বেচ্ছাচারী, লম্পট ও মদ্যপ যুবক, এবং খলিফা পদের সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত। তাঁরা এজিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে প্রস্তুত, এবং তাঁরা চান যে সেই বিদ্রোহে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বীর আলির সুযোগ্য পুত্র হোসেন যেন নেতৃত্ব করেন। সে জন্যে তাঁরা হোসেনকে কুফা শহরে আসতে আহবান করছেন। কুফাবাসীগণ তাঁদের এই অভিমত, আহবান ও সঙ্কল্পের কথা লিখে অসংখ্য পত্র হোসেনের কাছে প্রেরণ করেন । কুফাবাসীদের এ সব পত্র পেয়ে হোসেন এজিদের বিরুদ্ধে এবং তাঁর নিজের পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে প্রবল উৎসাহ বোধ করেন এবং সে জন্যেই সর্ব প্রথম তাঁর অভীষ্ট লক্ষ্য পূরণের জন্যে কুফা যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
হোসেন খুব শীঘ্রই কুফা যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেন এবং সেখানে যাওয়ার জন্য তাঁর আর তর সইছিলনা। কিন্তু তাঁর আত্মীয়স্বজন ও শুভাকাঙ্খীরা তাঁকে সরাসরি কুফা যেতে নিষেধ করেন। তাঁরা বলেন কুফাবাসীদের কিছু মানুষের কথায় বিশ্বাস করে হোসেনের সেখানে যাওয়া সমীচীন হবে না। কারণ, তাঁরা সিফফিনের যুদ্ধে আলির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন। তাই হোসেনের নিজে যাওয়ার আগে কাউকে সেখানে প্রেরণ করে সরেজমিন তদন্ত করে সেখানকার পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত হওয়া আবশ্যক বলে তাঁরা হোসেনকে পরামর্শ দেন। তাঁরা বলেন যে পরিস্থিতি অনুকূল এমন নিশ্চিত খবর পেলে তবেই হোসেনের যাওয়া উচিত হবে। শেষ পর্যন্ত হোসেন সকলের পরামর্শ মেনে নেন এবং হোসেন তাঁর চাচাতো ভাই মুসলিমকে গোপনে কুফায় পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন।
মুসলিম অতি গোপনীয়তার সাথে কুফা যাত্রা করলেন এবং সেখানে গিয়ে জনৈক হানি নামের আলির অতি বিশ্বস্ত একজন ব্যক্তির বাড়িতে ওঠেন এবং তাঁর কাছ থেকে কুফার মানুষদের মনোভাব সম্পর্কে খোঁজ-খবর সংগ্রহ করেন। হানি যে আলির অতি ভক্ত তা কুফায় সর্বজন বিদিত ছিল এবং সেই কারণে যাঁরা আলি ও আলির পরিবারের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন কিন্তু প্রকাশ্যে মাবিয়ার বিরোধিতা বা সমালোচনা করা সমীচিন মনে করতেন না তাঁরা এজিদের খলিফা হওয়ায় খুশী ছিলেন না। সেই মানুষগুলো গোপনে সুযোগ পেলেই তাঁদের মনের কথা হানির কাছে ব্যক্ত করতেন। এই মানুষগুলোর সংখ্যা ঠিক কত বা এঁরা কুফার জনসংখ্যার কত অংশ তার সঠিক হিসাব হানির কাছে ছিল না। কিন্তু কিছু লোকের কাছ থেকে তাঁদের উক্ত মনোভাবের কথা শুনেই তাঁর বিশ্বাস জন্মেছিল যে ওটাই কুফাবাসীর মনের কথা। মুসলিমকে অতি সোৎসাহে সে কথাটাই হানি জানালেন, তিনি জানালেন যে কুফার মানুষ কেউ এজিদকে চায় না, তাঁরা সবাই হোসেনকেই খলিফা পদে দেখতে চান। এই কথায় বিশ্বাস করে মুসলিম কাল বিলম্ব না করে হোসেনকে পত্র মারফত জানিয়ে দিলেন যে কুফার মানুষ তাঁকেই খলিফা হিসাবে পেতে চায়, তাঁরা এজিদের প্রতি ভীষণ ক্ষুব্ধ ও রুষ্ট, সুতরাং তিনি যেন পত্র প্রাপ্তির সাথে সাথে কুফার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। হোসেন ভীষণ উদগ্রীব ছিলেন মুসলিমের ঠিক এই চিঠির জন্যেই, তাই চিঠি পাওয়া মাত্র কুফার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। বলা বাহুল্য যে সঙ্গে নিলেন পরিবারের লোকজনসহ অনুগত কিছু লোক-লস্কর।
এদিকে এজিদের নিকট এই খবর পৌঁছে গেল যে হোসেন তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার পরিকল্পনা নিয়ে কুফা যাওয়ার সিদ্ধান্ত করেছেন। মুসলিমকে কুফায় পাঠানো হয়েছে সেখানকার পরিস্থিতি বুঝবার জন্যে- এ খবরও যথারীতি এজিদের নিকট পৌঁছে গিয়েছিল। এ সব খবর পেয়ে তিনি অতি তৎপরতার সাথে হোসেনের বিদ্রোহের পরিকল্পনা ব্যর্থ করার জন্যে উদ্যোগ গ্রহণ করলেন। আর এ কাজে তিনি কুফার তৎকালীন গভর্ণরের প্রতি আস্থা রাখা ও নির্ভর করা সমীচীন হবেনা মনে করে তাঁকে সরিয়ে ওবাইদুল্লাহ ইবন জিয়াদকে গভর্ণর করে পাঠালেন। জিয়াদপুত্র ওবাইদুল্লাহকে এই নির্দেশ দিয়ে পাঠালেন যে হোসেনকে যেন কুফা প্রবেশ করার পূর্বেই আটকে দেওয়া হয়। জিয়াদ ছিলেন মাবিয়ার খুবই বিশ্বস্ত এবং অত্যন্ত যোগ্য, দক্ষ ও বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ প্রশাসক ও যোদ্ধা। ওবাইদুল্লাহও ছিলেন পিতার যোগ্য উত্তরসূরী এবং এজিদের অত্যন্ত বিশ্বস্ত ও অনুগত। ওবাইদুল্লাহ দ্রুত কুফায় পৌঁছে গিয়ে সেখানকার গভর্ণরের দায়িত্বভার বুঝে নিলেন।
তারপর কুফায় কী ঘটলো তা বর্ণণা করার পূর্বে জিয়াদ সম্পর্কে এখানে কয়েকটি কথা বলা নেওয়া জরুরী। কারণ, কারবালা যুদ্ধের ইতিহাস আলোচনায় এর যেমন প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে তেমনই জিয়াদ সম্পর্কে খুব বিশ্রী ভাষায় অনেক মুসলিম ঐতিহাসিক এমন কিছু আলোচনা করেছেন যা খুবই অনৈতিক ও কুৎসায় পরিপূর্ণ যার জবাব দেওয়াও একান্ত আবশ্যক। জিয়াদ ইতিহাসে জিয়াদ-ইবন-আবিহ নামে খ্যাত। পঞ্চম খলিফা মাবিয়া জিয়াদকে এই নামে ডাকতেন, তারপর থেকে ইতিহাসে তিনি এই নামেই পরিচিত হতে থাকলেন। মাবিয়ার জিয়াদকে ওই নামে ডাকার একটি মহৎ প্রেক্ষাপট রয়েছে। সেটা এ রকম- জিয়াদ জন্ম পরিচয়ের দিক থেকে ছিলেন অত্যন্ত অসম্মান, অগৌরব এবং উপেক্ষা, অবজ্ঞা ও অনুগ্রহের পাত্র। এটা যেমন তৎকালীন সমাজের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল তেমনি এই সময়ের আধুনিক ও তথাকথিত সভ্য সমাজের ক্ষেত্রেও সমান প্রযোজ্য। কারণ, জিয়াদের মা ছিলেন জন্মসূত্রে তায়েফের অধিবাসী এবং আবু সুফিয়ানের একজন উপপত্নী। আবু সুফিয়ান ছিলেন মক্কার একটি অভিজাত পরিবারের সন্তান এবং স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন একজন ধনী বণিকও।
তখন ধনী ব্যক্তিরা বহু উপপত্নী রাখতেন, সে যুগের সেটাই ছিল রীতি। আল্লাহর স্বঘোষিত শেষ নবি তথা মুহাম্মদেরও অনেক উপপত্নী ছিল। তাঁর উপপত্নীদের মধ্যে মারিয়ার নাম খুবই পরিচিত। একদিন মুহাম্মদের সঙ্গে তাঁর পত্নী হাফসার প্রবল ঝগড়া হয়েছিল ওই মারিয়াকে নিয়েই। সে কথা থাক। নবী মুহাম্মদেরও অনেক উপপত্নী ছিল- এটা উল্লেখ করা আবশ্যক হলো এ কথা বলার জন্য যে উপপত্নী রাখাটা সে সময় দোষের কিছু ছিল না। আর যে মেয়েরা উপপত্নী রূপে কোনো পুরুষের হারেমে থাকতেন তাঁরা খারাপ মেয়ে বা দুশ্চরিত্রা মেয়ে – তা মোটেই নয়। হয় তাঁরা ক্রীতদাসী, না হয় হত-দরিদ্র পিতা-মাতার সন্তান। নিজের ইচ্ছায় কোনো নারীই ওই জীবন বেছে নিতেন না।
সে যুগে উপপত্নীদের গর্ভে সন্তান জন্ম নিলে সেই সন্তান সে সমাজেই বড় হতো, কিন্তু যার ঔরসে তার জন্ম সে তার পিতৃ পরিচয়ের দায় নিতো না এবং তাকে তার উত্তরাধিকার বলে গণ্য করতো না। এই নীতি বা প্রথা যতোই অন্যায়, অনৈতিক ও অমানবিক হোক না কেন, তবু আল্লাহর স্বঘোষিত নবি তথা মুহাম্মদ সেই নীতিকেই বহাল রেখে যান। শুধু তাই-ই নয়, তিনি এও বলে যান যে, একজন পুরুষ যতোখুশী উপপত্নী রাখতে পারবে- এটা আল্লার বিধান। যাঁরা উপপত্নী হিসাবে কোনো পুরুষের যৌনসঙ্গী হয়ে থাকতে বাধ্য হতেন তাঁদের এই অভিশপ্ত জীবনের ওপর তাঁদের যেমন কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিলনা, তেমনই তাঁদের গর্ভজাত সন্তানদেরও তাঁদের নিজেদের অনাকাঙ্খিত জীবনের ওপর কোনো হাত ছিল না।
তবুও তাঁদের ওই অবাঞ্ছিত জীবনের জন্য তাঁদেরকেই মাশুল গুণতে হতো। সমাজে তাঁরা আর পাঁচটা মানুষের মত স্বীকৃতি পেতেন না। উপপত্নীগণ পেতেন না পতির পরিচয় ও স্বীকৃতি এবং তাঁদের সন্তানগণ পেতেন না পিতৃ-পরিচয়। এ যুগেও কোনো নারী যদি কোনো পুরুষের দ্বারা প্রতারিত হয়ে বিবাহের পূর্বে সন্তানের জন্ম দেয় তবে তথাকথিত এই সভ্য সমাজের মানুষ সেই নারী ও তাঁর সদ্যজাত সন্তানকে অসভ্য, নোংরা ও কুৎসিত ভাষায় গালাগাল দেয় এবং সমাজ থেকে নির্বাসিত করে।
আলোচনা হচ্ছে জিয়াদ প্রসঙ্গে। তিনি ছিলেন যেহেতু আবু সুফিয়ানের একজন উপপত্নীর গর্ভজাত সন্তান, তাই তিনি ছিলেন পিতৃ পরিচয় থেকে বঞ্চিত এবং সমাজের কাছে অবজ্ঞা, উপেক্ষা ও করুণার পাত্র। সে যুগের ক্ষেত্রে সেটাই ছিল সামাজিক রীতি, কিন্তু এ যুগের ঐতিহাসিকগণ যদি তাঁদেরকে কুৎসিত ভাষায় আক্রমণ করেন তবে তা নিশ্চিতভাবেই হবে ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। হ্যাঁ, বহু মুসলিম ঐতিহাসিক সেই অপরাধে অপরাধী। তাঁরা জিয়াদের নির্দোষ মা’কে অসতী ও দুশ্চরিত্রা রমণী এবং নির্দোষ জিয়াদকে জারজ সন্তান ও তাঁর পুত্র ওবাইদুল্লাহকে জারজের পুত্র বলে অকারণে আক্রমণ করেছেন। মানুষ পুঁথিগত বিদ্যায় যতোই উচ্চশিক্ষিত হোক না কেন, তিনি যদি প্রকৃত শিক্ষা অর্জন করতে সফল না হোন, তবে তাঁর মন যে কুসংস্কার, কুপ্রথা ও ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক অফুরন্ত গরল ভাণ্ডারের বিরাট আধার হয়ে বিরাজ করবেই; তার প্রমাণ হলো এইসব ঐতিহাসিকগণ।
জিয়াদ জন্মসূত্রে অখ্যাত ও অবজ্ঞার পাত্র হলে কী হবে, তিনি তাঁর তীব্র মেধা ও তীক্ষ্ণ বুদ্ধি এবং কঠোর পরিশ্রম, অতুলনীয় সততা ও দায়িত্ববোধের দ্বারা সকলের কাছ থেকে সমীহ ও সম্মান অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর এই গুণের জন্য মাবিয়া তাঁকে অত্যন্ত কদর করতেন এবং তাঁকে প্রশাসনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিয়েছিলেন। তাঁর দায়িত্ব পালনের যোগ্যতায় এবং বিচক্ষণতায় মুগ্ধ হয়ে মাবিয়া তাঁকে প্রথমে বসরার শাসনকর্তা এবং পরে তাঁর একার হাতেই বসরার শাসনভারসহ কুফার শাসনকর্তার দায়িত্বও অর্পণ করেছিলেন। ধীরে ধীরে তিনি হয়ে উঠেছিলেন মাবিয়ার দক্ষিণ হাত। মাবিয়া তাঁকে শুধু প্রশাসনের উচ্চপদে নিযুক্ত করেই সম্মানিত ও পুরস্কৃত করেন নি, তাঁকে এইসব বিরাট সম্মান অপেক্ষাও অনেক বড় সম্মান প্রদান করেছিলেন যে সম্মানের কোনো তুলনাই হয় না।
মাবিয়ার পিতা আবু সুফিয়ান জিয়াদকে নিজের সন্তানের স্বীকৃতি প্রদান করেন নি, মাবিয়া কিন্তু জিয়াদকে তাঁর পিতার সন্তানের স্বীকৃতি প্রদান করে এক অমর কীর্তি স্থাপন করে গেছেন। তিনি জিয়াদকে ‘আমার ভাই’ বলে বুকে টেনে নিয়েছিলেন একজন খলিফা হয়েও। তিনি জিয়াদকে ডাকতেন ‘জিয়াদ আমার ভাই’ এই নামে। ‘জিয়াদ আমার ভাই’ – এই কথাটাই আরবিতে হলো ‘জিয়াদ-ইবন-আবিহ’।
মুসলিম ঐতিহাসিকদের চোখে মাবিয়া একজন মুসলমানের শত্রু এবং অতি জঘন্য ব্যক্তি। কারণ, মাবিয়া আলির কাছে বয়াত নেন নি এবং ওসমানের হত্যাকারীদের শাস্তির দাবীতে অনড় থেকে আলির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন। আর জিয়াদ যেহেতু তাঁর ওপর ন্যাস্ত দায়িত্ব পালন করে মাবিয়ার অত্যন্ত বিশ্বস্ত ও স্নেহভাজন হয়ে উঠেছিলেন তাই তাঁদের চোখে তিনিও মুসলমানদের শত্রু। তাই তাঁর জন্ম পরিচয় তুলে জিয়াদ এবং তাঁর পুত্রকে এইসব ঐতিহাসিকগণ কুৎসিত ভাষায় আক্রমণ করে নিজেদের অন্তরের জ্বালা প্রাণভরে মিটিয়ে নিয়েছেন। থাক সে কথা। ওবাইদুল্লাহ কুফায় যাওয়ার পরে সেখানকার পরিস্থিতি কী হল তা এবার দেখা যাক।
ওবাইদুল্লাহ কুফায় গিয়েই মুসলিমের খবর জানতে পারলেন। এটা জানতে পারা খুব স্বাভাবিকই ছিল। কারণ মুসলিম সেখানে গিয়ে এজিদের বিরুদ্ধে এবং হোসেনের পক্ষে জনমত গঠনের কাজ গোপনে চালালেও তা গোপন থাকেনি, এজিদের পক্ষের মানুষজন তা জেনে যায় এবং তাঁরা ওবাইদুল্লাহকে জানিয়ে দেন। তিনি তখন কালবিলম্ব না করে মুসলিম ও হানিকে ডেকে পাঠিয়ে তাঁদের কাছ থেকেই তাঁদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছে সে সম্পর্কে জানতে চান। মুসলিম স্পষ্ট জানিয়ে দেন যে তিনি যা শুনেছেন তা সবই সত্যি। তিনি ঔদ্ধত্যের সঙ্গে বলেন যে, মাবিয়া এজিদকে ইসলামি সাম্রাজ্যের খলিফা মনোনীত করে ইসলামি নীতির লঙ্ঘন ও অবমাননা করেছেন। তাছাড়া এজিদ খলিফা পদের উপযুক্ত ব্যক্তিও নয়। তাই তাঁকে আমরা খলিফা বলে মানি না। ইসলামি সাম্রাজ্যের খেলাফতের উত্তরাধিকার হলেন একমাত্র হোসেন, কারণ তিনি ইসলামের শেষ নবি মুহাম্মদের দৌহিত্র ও বংশধর এবং খলিফা পদের উপযুক্ত ব্যক্তিও।
এ কথা শোনার পর কুফার গভর্নর ওবাইদুল্লাহ তাঁকে এবং তাঁর আশ্রয়দাতা ও মদতদাতা হানিকে খলিফার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার ষড়যন্ত্রের অভিযোগে প্রাণদণ্ড দেন। হোসেন সদলবলে কুফার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছেন সে খবর এজিদ ও ওবাইদুল্লাহর কাছে আগেই পৌঁছে গিয়েছিল, সে খবর যে সত্যি তা মুসলিমের মুখ থেকে শোনার পর যে সংশয়টুকু ছিল, তাও দূরীভূত হলো। মুসলিম ও হাসির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার পর হোসেনের গতিরোধ করার জন্যে ওবাইদুল্লাহ ওমর ইবন সাদের নেতৃত্বে বড় একদল সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করলেন কুফা শহরের বাইরেই। পরে ওবাইদুল্লাহ স্বয়ং সেই বাহিনীর সঙ্গে যোগ দেন।
এদিকে হোসেন যখন মহানন্দে কুফার পথে এগিয়ে চলেছেন তখন পথিমধ্যেই বিনামেঘে বজ্রপাতের মতো সংবাদটি তাঁর কাছে পৌঁছে গেল, কুফার গভর্নর মুসলিমকে হত্যা করেছে। খুব স্বাভাবিকভাবেই হোসেনের শিবিরে নেমে এল গভীর শোকের ছায়া এবং তাঁরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লেন। এই পরিস্থিতিতে কুফা যাত্রা বাতিল করার দাবি উঠলো শিবিরে। সবাই তাকিয়ে আছে হোসেনের দিকে তিনি কী বলেন তা শোনার জন্যে। হোসেন কিছুক্ষণ ভেবে জানিয়ে দিলেন যে তিনি কুফা যাত্রা বাতিল করবেন না। হোসেনের এই ঘোষণায় সবাই মুষড়ে পড়লেন। কারণ এই পরিস্থিতিতে কুফা যাওয়ার অর্থ কী তা সবাই স্পষ্ট বুঝতে পারছিলেন। এমনকী যাঁরা হোসেনের নিজের বংশধর এবং নিকট আত্মীয়স্বজন তাঁরাও অকারণে এবং অযথা আত্মাহুতি দিতে কুফা যাওয়ার কোন অর্থই খঁজে পাচ্ছেন না। কিন্তু হোসেনের মুখের ওপর তাঁদের পক্ষে সে কথা তাঁরা বলতে পারলেন না। আবার হোসেনের সহযাত্রীরা সবাই যে জেনেশুনে হোসেনের জন্য মরণকূপে ঝঁপ দিতে তাঁর সঙ্গী হয়েছেন তা নয়, অনেকেই আশা করেছিলেন কুফা শহরের মানুষ হোসেনের সাথে নিশ্চয় থাকবেন। তাঁরা মুসলিমের নিহত হওয়ার খবরে অসম্ভব বিচলিত হয়ে হোসেনকে বারংবার কুফা যাত্রা বাতিল করার জন্য অনুরোধ করতে লাগলেন। কিন্তু হোসেন তাঁর সিদ্ধান্তে অটল ও অনড়ই থাকলেন।
এই অবস্থায় যাঁরা কুফা যাত্রা বাতিল করার বিষয়ে হোসেনকে পীড়াপীড়ি করছিলেন তাঁরা মক্কা ফিরে গেলেন। হোসেন তখন অবশিষ্ট সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে পূনরায় কুফা অভিমুখে রওনা দিলেন। সেইসময় তাঁর সাথে খুব সামান্যই সৈন্য-সাথী ছিল। ঠিক কতোজন সৈন্য ছিল তা সঠিক করে বলা সম্ভব নয়। সেই সংখ্যা নিয়ে নানা মত রয়েছে। তবে সংখ্যাটা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই যে নগণ্য, তা সংশয়াতীত। বিভিন্ন যে মত রয়েছে তাতে এটা স্পষ্ট যে সেই সংখ্যাটা ৭০ (সত্তর) থেকে ১১০ (একশত দশ) এর মধ্যে। সত্তরের মধ্যে ৩০ (ত্রিশ) জন মাত্র অশ্বারোহী এবং ৪০ (চল্লিশ) জন পদাতিক সৈন্য ছিলেন। অপরদিকে ওবাইদুল্লাহ ওমরের নেতৃত্বে যে সৈন্যদল পাঠিয়ে ছিলেন তাতে অশ্বারোহী সেনাই ছিল ৪০০ (চারশত) জন।
হোসেনের বাহিনীকে প্রথমে আটকে দেয় কুফা শহর থেকে প্রায় ৪০ (চল্লিশ) কিলোমিটার দূরে একটি জায়গায়, সেখানকার অধিবাসী তামিম গোত্রের লোকেরা। জায়গাটির নাম হলো ইতিহাস প্রসিদ্ধ সেই ‘কারবালা’। কারবালা প্রান্তরেই তাই বাধ্য হয়ে হোসেন তাঁবু খাটিয়ে শিবির স্থাপন করেন। ইউফ্রেটস বা ফোরাত নদী থেকে অতি সামান্য দূরে এই কারবালা প্রান্তর অবস্থিত। তার কিছু পরে সেখানে ওমরের সৈন্যবাহিনী এসে পৌঁছায়। তাঁরা যে খলিফা এজিদের বাহিনী তা প্রথমে হোসেন বুঝতে পারেন নি। তিনি ভেবেছিলেন তাঁরা কুফা থেকে এসেছেন তাঁর সমর্থনে। ওমর সৈন্যবাহিনী নিয়ে সেখানে পৌঁছালে হোসেন মনে মনে অনেকটাই উৎসাহবোধ করলেন এবং উৎসাহভরে ওমরকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা কারা? তোমরা কী আমার সাথে যোগদান করতে এগিয়ে এসেছ? ওমর তাঁর পরিচয় দিলেন এবং তাঁর সেখানে যাওয়ার উদ্দেশ্য ব্যক্ত করলেন। মূহুর্তেই হোসেনের মুখমণ্ডলে যে আশা ও ভরসার হর্ষভাব ছিল তা মিলিয়ে গেল, এবং এক অনিশ্চয়তা ও আশঙ্কার দুঃশ্চিন্তায় তাঁর মুখমণ্ডল কালো হয়ে গেল। সেই হতাশা ও আশঙ্কার মেঘ মূহুর্তের মধ্যে হোসেনের শিবিরকে ছেয়ে ফেললো।
ফোরাত নদীর তীরে হোসেনের শিবির থেকে কিছুটা দূরে ওমরও তাঁর সৈন্যবাহিনী নিয়ে শিবির স্থাপন করেন। ওবাইদুল্লাহ তাঁর সঙ্গে পরে যোগদান করেন আর একদল বড় সৈন্যবাহিনী নিয়ে। হোসেনের সঙ্গে শুরু হয় তাঁদের আলাপ-আলোচনা। ঠিক কী কী আলোচনা হয়েছিল তাঁদের মধ্যে, কে কী প্রস্তাব বা শর্ত রেখেছিল, হোসেন ঠিক কবে সেখানে পৌঁছান, ওবাইদুল্লাহর বাহিনীতে কতোজন সৈন্য ছিল, এবং আলোচনা ভেঙে যাওয়ার পরে কবে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল, কতোদিন যুদ্ধ চলেছিল, উভয়পক্ষের কতোজন হতাহত হয়েছিল ইত্যাদি বিষয়ের সম্পূর্ণ নির্ভুল তথ্য কোথাওই পাওয়া যায় না।
সেসময় ইতিহাস লেখার প্রচলন ছিল না। ইতিহাস লেখার কাজ শুরু হয় তার অনেক পর থেকে। কয়েকশতাব্দী ধরে মানুষের মুখে মুখে কারবালা যুদ্ধের কথা ঘুরতে ঘুরতে যখন ইতিহাস লেখার কাজ শুরু হয় ততোদিনে কারবালার ইতিহাস যে বহুলাংশে বিকৃত হয়ে গেছে তা বলাই বাহুল্য। আর এর ইতিহাস বা এটা নিয়ে অজস্র যে গল্প-উপন্যাস-কবিতা রচিত হয়েছে তার রচয়িতাদের সিংহভাগই মুসলমান। তাঁরা লিখেছেন এটা প্রমাণ করার জন্য যে এজিদ অনৈতিকপথে খলিফা হয়ে ইসলামের পতাকাকে ধুলায় লুটিয়ে দিচ্ছিল, হোসেন ইসলামের সেই পতাকা ঊর্দ্ধে তুলে ধরতে গিয়ে শাহাদাতবরণকরেছেন।
স্বভাবতই সেসব লেখায় লেখকদের নিজেদের মনের কল্পনার রঙ লেগেছে যথেষ্টই। তাই এসব লেখার মধ্যেও দেখা যায় তথ্যগত, পরিসংখ্যানগত এবং আরও নানা বিষয়ে নানা মত। সে কথা মুসলিম ঐতিহাসিক ও ধর্মগুরুরাও মানেন। এ প্রসঙ্গে মাদ্রাজের (চেন্নাই) গভর্নমেন্ট কলেজের অধ্যাপক হাজী মাওলানা মির্জা গোলা আব্বাস লিখেছেন,
“Several authors have attempted to give vivid pictures of stories, whose chronology is not yet traceable and whose antiquity has led many to doubt the reality and genuineness of the stories themselves and to suspect them as of the production of intelligent heads for the inculcation of high moral and ethical principles of the common folk in the most appealing and dramatic fashion.”
(Source: Wikipedia)
স্বভাবতই কারবালা যুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে লিখতে হলে মূলত নির্ভর করতে হয় মুসলিম লেখকদের লেখা ইতিহাস বা গল্প-উপন্যাসের ওপরেই। তাঁদের অনেকের মতে হোসেন যুদ্ধ এড়ানোর জন্য তিনটি গ্রহণযোগ্য প্রস্তাব প্রদান করেছিলেন, কিন্তু ওবাইদুল্লাহ সে প্রস্তাবগুলি প্রত্যাখান করেছিলেন।
হোসেনের প্রস্তাব তিনটি হলো-
১) তাঁকে মক্কা কিংবা মদিনা ফিরে যেতে দেওয়া হোক, অথবা
২) এজিদের সঙ্গে আলোচনার জন্য দামেস্কে যেতে দেওয়া হোক, অথবা
৩) তুর্কি সীমান্তে মুসলমানদের শত্রুদের সাথে যুদ্ধ করবার অনুমতি দেওয়া হোক।
কুফার গভর্নর ওই তিনটি প্রস্তাবই খারিজ করে দিয়ে তাঁকে তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করতে বলেন। হোসেন আত্মসমর্পণ করতে অস্বীকার করায় যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে। মুসলিম ঐতিহাসিকদের দাবী মতে, হোসেনের দেওয়া উক্ত তিনটি প্রস্তাব কতোটা যথার্থ তা নিয়েও সংশয়ের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। বিশেষ করে তিন নম্বর প্রস্তাবটি যে অবাস্তব ও মনগড়া তা সহজেই অনুমেয়। কারণ মাবিয়ার দীর্ঘ কুড়ি বছরের শাসনে হোসেন মুসলমানদের শত্রুদের বিরুদ্ধে কোনও অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন এর প্রমাণ পাওয়া যায় না। এমনকী খলিফা মাবিয়াকে অন্য কোনভাবেও যে তিনি সহযোগিতা করেছেন এমন কথারও কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না।
সুতরাং তুর্কি প্রান্তে মুসলমানদের শত্রুদের সাথে যুদ্ধ করার অনুমতি চাওয়ার প্রশ্নটি অবান্তর। আর হোসেনের সঙ্গে আলোচনা করার নিমিত্তে এজিদের কাছে যেতে দেওয়ার প্রস্তাবটিও যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। কারণ ইসলামি সাম্রাজ্যের খলিফা কে হবেন সে প্রশ্নে আলোচনা করার কোন সুযোগ বা অবকাশই তখন আর ছিল না। এজিদের সঙ্গে হোসেনের মধ্যে আলোচনা করার প্রশ্ন তখনই উঠতো যদি হোসেন এজিদকে খলিফা পদে মেনে নিতে সম্মত হতেন। এজিদকে খলিফা মেনে নিয়ে অন্য বিষয়ে কিছু দাবি বা শর্ত থাকলে তা নিয়েই শুধু আলোচনা করার প্রশ্ন উঠতে পারতো। কিন্তু হোসেন যেহেতু এজিদকে কোনভাবেই খলিফা হিসেবে মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলেন না, তাই দ্বিতীয় প্রস্তাব মুসলিম ঐতিহাসিকদের নিজেদের মস্তিষ্ক প্রসূত বৈ অন্য কিছু নয়। সুতরাং সত্যি হলে হতে পারে প্রথম প্রস্তাবটি। কিন্তু ওই প্রস্তাবটি যে কোনো খলিফার পক্ষে মানা সম্ভব নয় তাও বলা বাহুল্য।
স্বভাবতই কারবালা প্রান্তরে পরিস্থিতি ক্রমশঃ জটিল হতে থাকল। ওবাইদুল্লাহ হোসেনের ওপর চাপ দিতে থাকলেন এজিদকে খলিফা মেনে নিয়ে তাঁর হাতে বয়াত নেওয়ার জন্যে, অপরদিকে হোসেন সে প্রস্তাবকে তাচ্ছিল্যের সাথে প্রত্যাখান করে তাঁকে মক্কা বা মদিনা ফিরে যেতে দেওয়ার দাবী জানাতে থাকলেন। এই অবস্থায় ওবাইদুল্লাহ হোসেনের ওপর মানসিক চাপ সৃষ্টি করার কৌশল অবলম্বন করলেন। ওমরকে নির্দেশ দিলেন হোসেনের লোকজনের জন্য ফোরাত নদীর জল বন্ধ করে দিতে এবং তার জন্যে নদীর ধারে সেনা মোতায়েন করার নির্দেশ দিলেন।
ওমর তখন নদীর তীর বরাবর কয়েকহাজার সেনাকে দাঁড় করিয়ে দিলেন। ওবাইদুল্লাহ হয়তো আশা করেছিলেন যে, জলকষ্টে যখন সকলের প্রাণ যাওয়ার উপক্রম হবে, তখন হোসেন নিজের প্রণের জন্যে না হলেও অন্যদের জন্যে; বিশেষ করে তাঁর সাথে আসা শিশুদের প্রাণরক্ষার জন্যেও এজিদকে খলিফা মেনে নিতে সম্মত হবেন। কিন্তু ওবাইদুল্লাহর আশা বা ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছিল। হোসেন জলের জন্য বারবার নদীর ধারে নিজে ছুটে গেছেন, সেনাদের কাছে বহু অনুরোধ করেছেন, অনুরোধ করেছেন ওমরের কাছে, ওবাইদুল্লাহর কাছেও বারবার গিয়ে কাতর আবেদন করেছেন, তবুও একফোঁটা জলের ব্যবস্থা করতে পারেন নি। এ অবস্থাতেও তিনি আপস করেন নি, এজিদকে খলিফা মেনে নিতেও সম্মত হন নি। হোসেন তখন এরকম ভাবলেন যে, যদি মরতেই হয় তাহলে জলতেষ্টার অসহ্য কষ্ট ভোগ করে তিলে তিলে মরা অপেক্ষা জলের জন্যে জিহাদ করে মরা অনেক উত্তম। তিনি এজিদের বাহিনীর সঙ্গে জিহাদ (যুদ্ধ) করাই স্থির করলেন। শুরু হয়ে গেল যুদ্ধ।
জুলাই ১, ২০১৭; ৪:০৪ পূর্বাহ্ন
লাখে একজন ও মুসলিম কারবালার ঘটনা সঠিকভাবে জানে না ! উসমান হত্যা ,উষ্টির যুদ্ধ , সিফফিনের যুদ্ধ সম্পর্কে মুসলিম আলেমরা কেন খোলাখুলিভাবে আলোচনা করে না ? রহস্যটি কি তাহা জাতি জানতে চায়।