৯৩৭ বার পঠিত
মানব সভ্যতার দুইটি ধারা আছে। একটি বাহ্যিক (বস্তুগত ) এবং অন্যটি আত্মিক (চেতনাগত)। লক্ষ লক্ষ বছর এই পৃথিবীতে বিচরণ করে মানুষ আজ বাহ্যিক বা বস্তুগত সভ্যতার এক প্রকার শিখরে অবস্থান করছে। কিন্তু এই চলতি বর্তমান সময়ে- বস্তুগত সভ্যতার পাশাপাশি আত্মিক সভ্যতার অগ্রগতির গ্রাফটি সমান্তরালতো নয়ই বরং নিম্নমুখী।
এই পৃথিবীতে আমরা বর্তমানে একজন বিলগটস’কে পাই যে কিনা বস্তুগত সভ্যতার সমস্ত সুবিধা ভোগ করতে পারেন। এমন আরো অনেকেই আছেন যারা বিশেষ শিক্ষা, শ্রম, ব্যবসা, সুবিধাজনক অবস্থান, রাষ্ট্রনীতি, ভৌগলিক প্রাচুর্যতার কারনে বস্তুগত সভ্যতার উৎকর্ষতা ভোগ বা সুবিধাগুলোকে ব্যবহার করতে পারেন। এই পৃথিবীতে নানান শিক্ষা ব্যবস্থা এবং নীতিমালা রয়েছে যেসব সঠিক ভাবে প্রয়োগ করলে বর্তমান সভ্যতার সুবিধাগুলিকে আত্মস্থ করা যায়। আমি এই বস্তুবাদিতাকেও সৎ বলছি। কারন এর উদ্দেশ্য ছিল মানুষের সময়কে বাচাঁনো, শ্রম কম খরচ করা, জীবন যাপনকে সহজ ও সহনশীল করা, দুর্গম, দুর্লভকে সহজ ও সুলভ করা।
কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে চেতনাগত বা আত্মিক সভ্যতার দৈনতা নিয়ে। এই পৃথিবী যত বেশি প্রডাক্টিভ ইঞ্জেনিয়ারিং-এ ডেভোলাপ করছে ততখানি হিউমেন বিহেভিয়ারে করেনি। ইমপ্লিমেন্টেশন হয়নি। বিমানে আমরা যাত্রি পৌছে দিতে পারছি পৃথিবীর এক মেরু থেকে অন্য মেরুতে অথচ আমরা এখনো পাশের বাড়ির মানুষটিকে ভালোবাসা পৌছে দিতে শিখিনি। কেন শিখিনি? এত হাজার বছরেও এটা কেন হলো না সেটাই আমি ভাবছি। বিদ্যুৎ যেমন: নারী-পুরুষ, শ্রেনী, জাত, ধর্ম, রঙ নির্বিশেষে সব মানুষকেই অন্ধকারে আলো দিচ্ছে। অথচ কোনও আদর্শ অথবা তত্ত্ব বা শিক্ষা কেন একই ভাবে সবাইকে মানবিকতার, ভালোবাসার আলো চেতনার অন্ধকারে দিতে পারছে না।
এই পৃথিবীতে খাদ্যের চেয়েও ভালোবাসার সংকট বেশি। আমি বিশ্বাস করি যদি এই পৃথিবীতে ভালোবাসার অভাব না হতো তাহলে খাদ্যের অভাবে কাউকেই বোধ করি অমানবিক ভাবে মরতে হতো না। এই সভ্যতা আমাদের যত বেশি সমরাস্ত্র তৈরী ও ব্যবহারের ট্রেনিং দিচ্ছে সেই তুলনায় সেবা সহনশীলতা অথবা মানবিকতার ট্রেনিং কোথায়? ভালোবাসা বোধটাকে আমরা বরাবরি সেন্ট্রালাইজ করে রাখি। যাকে ভালোবাসি তাকেই বাসি। অন্যকে ভালোবাসা যেনো পৈতৃক সম্পত্তিতে ভাগ দেয়ার মতো। ভালোবাসাকে ডিসসেন্ট্রালাইজ করতে না পারলে এবস্ট্রাক্ট মনে শান্তি আসবেনা কখনই।
হয়তো একদিক আসবে যখন পৃথিবীতে কোনও ক্ষুধার্ত মানুষ থাকবে না। বিজ্ঞান হয়তো সেটাও কমপ্লাই করবে। কিন্তু সেইদিনও পৃথিবীর সকল মানুষ সার্বজনীন ভালোবাসা পাবে কিনা আমার সন্দেহ আছে। অর্থাৎ যা মানুষের দৈনন্দিন প্রয়োজন। বস্তুগত সভ্যতা সেটাকে সার্বজনীন করে আনলেও চেতনার দৈনতা, ভালোবাসার অভাব, এবং সহিংসতায়- মানবিকতাবোধ সার্বজনীন হবার আমি তেমন কোন আশা দেখিনা। কারন আমরা ভাষা, জাতি, সংস্কৃতি, রাষ্ট্র, ধর্ম, সামাজ, পারিবার এবং ব্যক্তিগত মূল্যবোধে স্বতন্ত্র ও বিভক্ত।
আমরা অন্য সম্প্রদায়কে আপন ভাবতে শিখিনা। সম্মান করতে শিখি না। বরং হেয় করি, অসম্মান করি, কখনো’বা ঘৃনা করতেও ছাড়িনা। অথচ আমাদের এই অঞ্চলের প্রাচীন কালে যখন মানুষের কাছে এত সভ্যতার উপকরনের সহজলভ্যতা ছিলনা তখনো তারা মানুষকে ভালোবাসার কথা চিন্তা করেছেন। মানুষের মধ্যে আজ যত বিভক্তি তখন অতটা ছিল না তবুও তারা ঘৃনার থেকে সংঘাতের থেকে মুক্তির কথা ভাবতেন। আজকের প্রেক্ষাপটে তাদের কিছু উদাহরণ দেই।
কবিরের দোহার কথা অনেকেই জানেন। কিন্তু রামসিংহকে জানেন কী? রামসিংহের দোহা সন্ত কবিরের মতো লাগলেও উনি কবিরের অনেক অনেক আগের মানুষ। তাঁর আবির্ভাব কাল ছিল খ্রীস্টিয় সহস্র শতক।
এত আগে তিনি বলেছিলেন :
কলহ কেন সম্মানউঁ
জহিঁ জহিঁ জোবউঁ তহিঁ আপপাণউঁ ** দোহা ১৩৯
(বিরোধ হবে কার সঙ্গে- কার সঙ্গে হবে ঝগড়া? যেখানেই তাকাই, সেখানেই দেখি আপন আত্মাকে।) চিন্তাই করা যায় না! কী অসাধারণ মানবিক চেতনার প্রকাশ ওনার দোহায় উনি প্রচার করেছিলেন। এই মানবিক চেতনা যার আছে সে কি পারবে মানুষ হত্যা করতে? যুদ্ধে যেতে? প্রশ্নই ওঠেনা।
আরো একটা উদাহরণ দেই বিনয়ের আত্মিক ত্যাগের চেতনার।
সপ্তম শতকের মহাযানী বৌদ্ধ সাধক আচার্য শান্তিদেব তার বোধিচর্যাবতারে বলেন,
অভ্যাসাদন্যদীয়েসু শুক্র-শোণিত বিন্দুষু।
পরত্বং তু স্বকায়স্য স্থিতমেব ন দুষ্ক্রং** (৮:১১১)
(অর্থাৎ অভ্যাসবশে শুক্র-শোণিত বিন্দু ইত্যাদি পরকীয় বস্তুতে আত্মা না থাকিলেও আমার অহং-জ্ঞান উৎপন্ন হয়। এদেরকে ‘আমি’ বা ‘আমার’ বলে স্বীকার করি। এ যদি সম্ভব হয়, তবে অন্যের দেহকে কেন ‘আমি’ বা ‘আমার’ বলে স্বীকার করিনা। যাকে নিজ বা আপন বলি তাতো আসলে পর। সুতরাং যাকে পর মনে করি, তাকে আপন মনে করাটা দুষ্কর নয়। ) অকল্পনীয় এই বোধ। এই চেতনার ডিসসেন্ট্রালাইজেশন যদি হতো তাহলে সবার আগে বোধকরি সকল সাম্রাজ্যবাদ বন্ধ হতো।
বাউল ফকির লালন শাই কি বলছেন। তিনি বলছেন –
কার বা আমি কে বা আমার,
আসল বস্তু ঠিক নাহি তার,
বৈদিক মেঘে ঘোর অন্ধকার,
উদয় হয়না দিনমণি।।
মানুষে মানুষে সম্পর্কটা আসলেতো আলোর মতো। সেখানে কেবলই প্রথাগত প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান বা ধর্মিয় আনুষ্ঠানিকতায় সেই আলো মানুষ হারিয়ে ফেলে অন্ধকারে নিমজ্জত হতে থাকে।
লালন তার এক গানে বলছেন-
মন বিভ্রান্ত হলেই কেবল কেউ ঘরের ধন বাইরে খুঁজে বেড়ায়, আর তার হাতড়ে বেড়ানো শেষ হয় না যদি না সে নিজের ভেতরে দৃষ্টি ফেরায়। ‘আমি’ ‘তুমি’র আলাদা নামের অধীনে বয়ে চলেছে একই অনন্তের ধারা।
রবীন্দ্রনাথ গাইছেন –
অন্ধকারের উৎস হতে উৎাসারিত আলো
সেইতো তোমার আলো!
সকল দ্বন্দ্ববিরোধ-মাঝে জাগ্রত যে ভালো
সেই তো তোমার ভালো!!
…
সবায় নিয়ে সবার মাঝে লুকিয়ে আছো তুমি
সেইতো আমার তুমি..
আহ! ইতিবাচক চেতনার কি অপূর্ব ক্ষমতা! এমন করে কবে ভাববে এই পৃথিবীর ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবোধ খোঁজা অসুখি মানুষেরা?
আমাদের এই বাংলার গ্রামের কোনও গায়ক হয়তো গাইছেন-
” মনরে আমার মনের সাথে মিলবি যদি আয়
দুই মনেতে এক মন হয়ে আজব শহর চলে যাই”
আমি শুধু এই ভারতীয় উপমহাদেশীয় আত্মিক চেতনার প্রাচীন সভ্যতার কিছু অতি সামান্য নমুনা দেখালাম। আমি জানি এবং পাঠকরাও জানেন, সমগ্র পৃথিবীতে এমন সার্বজনীন প্রেমের, মানবিক চেতনাবোধের – হাজার, হাজার উদাহরণ ছড়িয়ে আছে। অথচ তা সত্যেও আমরা অসুখি, অতৃপ্ত, ভালোবাসাহীন, বিষাদ জীবন যাপন করি। সামাজিক এন্ট্রপি দ্রুত বাড়ছে। অথচ আমি জানি যদি আমরা আমাদের এইসব অমূল্য মানবিক বোধগুলি আত্মস্থ করতে পারতাম, চর্চার পরিবেশ তৈরী করতে পারতাম, তাহলে এই দক্ষিণ এশিয়া হতো-পৃথিবীর সবচেয়ে মানবিক অঞ্চল। এবং এই আত্মিক চেতনার উন্নতি দেখে- নিশ্চয় পৃথিবীর বাকী অঞ্চল তাদের নিজ নিজ উদার এবং মানবিক মতাদর্শ গ্রহন করে চর্চা ও আত্মস্থকরণ এর ব্যবস্থা নিতো।
এই বাহ্যিক সভ্যতার শরীর আছে কিন্তু এর অন্তর কই? যেই দেহে মন নেই সেটা মৃতদেহের সমান। যতই তাকে জাঁকজমক করে সাজাই আর মমি করে রাখি সেখানও গন্ধ ছড়াবেই। আমার ধারনা সভ্যতার গায়ে গন্ধ ছড়াতে শুরু করছে। তাই এর দেহে আত্মার অনুসন্ধান জরুরী হয়ে পড়েছে। তাই যে যার মতো এই সভ্যতার দেহে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করবেন। এটাই আমার চাওয়া। আমার মানবিক দাবী। যেই প্রাণের চেতনায়, মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা প্রকাশ পাবে। এই পৃথিবী যেনো ঘৃনামুক্ত এবং ক্ষুধামুক্ত পৃথিবী হয়।
কোন মানুষ যেনো ক্ষুধার অভাবে ভালোবাসার অভাবে না কাঁদে। এটা আমাদের সবার পৃথিবী। আপনি আর আমি চাইলেই এটা সম্ভব। আমাদের মধ্যে একজন না চাইলেই এটা সম্ভব না।
আমি চাইছি, – আপনি?
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন