সমাপ্তি পর্ব: বাংলাদেশ, ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে একটি সংক্ষিপ্ত তুলনামূলক পর্যালোচনা
ঋগ্বেদ পাঠ এবং তার মূল্যায়ন সম্পর্কে আমাদের দুইজনের (চঞ্চল এবং আমার) প্রায় আটাশ বৎসরের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এখানে তিনটি দেশ সম্পর্কেই খুব সংক্ষেপে হলেও আমার কিছু মূল্যায়ন তুলে ধরব। প্রথমেই বলে রাখা ভাল যে এক ঋগ্বেদ পাঠ দিয়েই একটা সমাজের সবকিছুকে বুঝা যেমন যায় না তেমন বুদ্ধিবৃত্তির সবকিছু সম্পর্কে মূল্যায়ন করাও ঠিক নয়। তবে সত্যের কাছাকাছি যাওয়া যেতে পারে বৈকি। এটা হল হাড়িতে চড়ানো একটা বা দুইটা ভাত টিপে হাড়ির ভাতের অবস্থা বুঝবার চেষ্টার মত। তাতে হয়ত অনেক সময় বুঝতে ভুল হতে পারে। তবে রাঁধতে যে জানে তার ভুলটা যে সচরাচর বেশী একটা হয় না সেটা বলা যায়।
অবশ্য বিশেষত আমার নিজ অভিজ্ঞতার আরও অনেক দিক আছে যেগুলি আমার এই মূল্যায়নে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে। তবে সমগ্রে পৌঁছানোর জন্য এ ক্ষেত্রে আমি একটি খণ্ড দিয়েই শুরু করতে চেয়েছি। সেটা হচ্ছে ঋগ্বেদ পাঠ। বিশেষত ঋগ্বেদের বিষয়টা আমার কাছে পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদী এবং উপনিবেশবাদী জ্ঞানচর্চার স্বরূপ এবং সেই সঙ্গে তার অধীনে গড়ে উঠা উপমহাদেশের জ্ঞানচর্চার অন্তর্গত সমস্যা বুঝবার ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি সূত্র হিসাবে কাজ করেছে। সুতরাং ঋগ্বেদ পাঠের অভিজ্ঞতাকে কেস-স্টাডি হিসাবে ধরে নিয়ে আমি পাশ্চাত্যের উপনিবেশিক আধিপত্যের পটভূমিতে উপমহাদেশের জ্ঞানচর্চা এবং বুদ্ধিবৃত্তির সমস্যার মর্মে পৌঁছাতে চেয়েছি।
একটা মানুষের জীবনে আটাশ বৎসর খুব কম সময় নয়। এই আটাশ বৎসরে নানানভাবে নানান দেশের পণ্ডিতদের সঙ্গে চঞ্চলের এবং আমার যোগাযোগ-মতবিনিময় হয়েছে। অন্যসব বিষয়ের প্রসঙ্গ থাক। শুধু ঋগ্বেদ প্রসঙ্গেই সীমাবদ্ধ থাকা যাক। ঋগ্বেদ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে যেসব অভিজ্ঞতা হয়েছে সেগুলি অনেক সময় শুধু বিস্ময়কর নয়, উপরন্তু অভাবিতও।
প্রথমে আসা যাক পাকিস্তানের ডঃ মোহাম্মদ রফিক মোগলের কথায়। বাংলাদেশের মত পিছিয়ে থাকা দেশের অখ্যাত-অজ্ঞাত লেখক চঞ্চলের লিখা প্রথম প্রবন্ধটাকে তার মত একজন বিশ্ববিখ্যাত পুরাতাত্ত্বিক পণ্ডিতের কি কোনও গুরুত্ব দিবার কথা ছিল? বিশেষত তিনি যখন জানতেন যে চঞ্চল বাংলাদেশের একটি কারখানার সহকারী প্রকৌশলী (যান্ত্রিক) মাত্র। এই আলাচনার শুরুর দিকে বলেছি যে, চঞ্চল তখন চট্টগ্রামের টিএসপি ফ্যাক্টরির সহকারী যান্ত্রিক প্রকৌশলী বা এসিস্ট্যান্ট মেকানিক্যাল ইঞ্জিনীয়ার। এই পরিচয় ডঃ মোগল জেনেছিলেন তার নিকট পাঠানো চঞ্চলের প্রথম চিঠি থেকেই। অর্থাৎ চঞ্চলের পেশাগত এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগত দিকটা জানা থাকা সত্ত্বেও তার নিকট তার গুরুত্বপূর্ণ পুরাতাত্ত্বিক লেখাগুলি পাঠাতে যেমন তার দ্বিধা হয় নাই তেমন পরবর্তী সময়ে চঞ্চলের পাঠানো প্রবন্ধ পাঠের পর সমর্থন জানাতেও তার এতটুকু দ্বিধা কিংবা সমস্যা হয় নাই।
আমরা আশা করেছিলাম ভারত এবং ইউরোপের পণ্ডিতদের কাছ থেকে উৎসাহপূর্ণ সাড়া, যার কোনওটাই প্রকৃতপক্ষে সেই সময় ঘটে নাই। এরপর চঞ্চল এবং আমি উভয়ে যৌথভাবে ইংরাজীতে বই লিখবার পর সেটা সারা পৃথিবীর কিছু সংখ্যক প্রত্নতাত্ত্বিক এবং ইতিহাসবিদ পণ্ডিতের নিকট পাঠাই। এছাড়া আমরা উভয়ে বিভিন্নভাবে বিভিন্ন দেশের পণ্ডিতদের সঙ্গে মতবিনিময়ের চেষ্টা করি। চঞ্চল যেমন দিল্লীতে তেমন আমি নিজে পশ্চিম বঙ্গের পণ্ডিত মহলে কিছু কথা বলেছি।
এই সমগ্র ঘটনাধারায় ডঃ মোগল এক অনন্যসাধারণ ভূমিকা পালনকারী হিসাবে উদ্ভাসিত হয়েছেন। তিনিও তো প্রচলিত ধারার জ্ঞানচর্চার সীমায় আবদ্ধ তথা একজন প্রাতিষ্ঠানিক পণ্ডিত। বিশেষত পণ্ডিতরা দেখেছি নিজ প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রের বাইরে জানলেও সে বিষয়ে সেভাবে কথা বলতে চান না। এটা ভারতীয় জ্ঞানচর্চার একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য বলে আমার ধারণা হয়েছে। জানি না মোগল বেদ অধ্যয়ন করেছিলেন কিনা। কিন্তু তিনি অন্তত প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বেদ-ভাষ্যকার বা বেদ-পণ্ডিত নন। অথচ তিনি সিন্ধু সভ্যতার উপরে তার যে জ্ঞান তা দিয়েই আমাদের বক্তব্যের সারবত্তা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পেরেছিলেন। শুধু তাই নয়, তিনি তার জন্য উচ্ছ্বসিত ভাষায় চঞ্চলকে অভিনন্দনের পাশাপাশি লেখাটিকে প্রকাশের তাগিদও দিয়েছিলেন। সত্যি বলতে কি এই আবেগ, এই সাহস এবং এই ঔদার্যের পরিচয় ভারতীয় কোনও পণ্ডিতের নিকট থেকেই আমরা আজ পর্যন্ত পাই নাই। যদি আমাদের ইতিহাস ব্যাখ্যা কোনও দিন প্রতিষ্ঠা পায়, যেটা পাবে বলে আমি মনে করি, তবে সে ক্ষেত্রে মোগলের এই ভূমিকাও অক্ষয় হয়ে থাকবে।
পাকিস্তানের অনেক সমালোচনা আমার আছে। আমি দ্বি-জাতিতত্ত্বের কঠোর সমালোচনা করি। পাকিস্তান আমলে এ দেশে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার রাজনীতি গড়ায়ও আমার ভূমিকা আছে। সব ধর্মের মত ইসলাম ধর্মেরও সমালোচনা আমার আছে। বিশেষত ইসলামকে আমি সভ্যতা এবং মানবিকতার জন্য খুবই ক্ষতিকর ধর্ম মনে করি। স্বাভাবিকভাবে এই ধর্মের অনুসারী সমাজের ভিতর থেকে মুক্ত মন এবং মানবিক গুণাবলীর উন্মেষ বা বিকাশের সুযোগ খুব কম থাকে। ধর্ম অন্ধবিশ্বাসের বিষয়। ফলে প্রবল ধর্মবিশ্বাসীরা বিচার-বুদ্ধি বা ‘ক্রিটিক্যাল মাইন্ড’-এর অধিকারী হয় না। ইসলাম ধর্ম উগ্র হবার কারণে এ ক্ষেত্রে মুসলমানরা সাধারণত আরও পিছিয়ে থাকে অন্যান্য ধর্মবিশ্বাসীদের তুলনায়। পাকিস্তান উগ্র ইসলামীদের রাষ্ট্র। সুতরাং সেখানে বিচার-বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের অভাব থাকা আরও স্বাভাবিক।
কিন্তু মোগল আমাদেরকে ভিন্ন অভিজ্ঞতা দিয়েছেন। একদিকে তিনি প্রত্নতত্ত্ববিদ। সুতরাং যে লেখার আলোচ্য বিষয়ে প্রত্নতত্ত্ব থাকলেও ঋগ্বেদের ব্যাখ্যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে সে লেখা সম্পর্কে তিনি অভিমত নাও দিতে পারতেন। অন্যদিকে, ঋগ্বেদ হিন্দুদের আদি ধর্মগ্রন্থ। সুতরাং মুসলিম সমাজের মানুষ হিসাবে ঋগ্বেদ সংক্রান্ত বক্তব্যকে তিনি অপছন্দ করতে কিংবা এড়াতে চাইতে পারতেন। কারণ হয়ত তিনি মনে করতে পারতেন যে, ঋগ্বেদকে সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীদের সৃষ্টি বলে আমরা ভারতবর্ষের শুধু নয়, হিন্দুদেরও গৌরবকে তুলে ধরতে চেয়েছি।
কিন্তু তিনি আমাদেরকে বলিষ্ঠভাবে সমর্থন জানাতে দ্বিধা করেন নাই। এভাবে তিনি পাকিস্তানের ভিতরে লুক্কায়িত শক্তির এমন একটি জায়গাকে দেখিয়েছেন যা বর্তমান ভারত-রাষ্ট্রের নাই। অর্থাৎ যে পাকিস্তানের আমরা কঠোর সমালোচনা করি যত ক্ষুদ্র হোক তার বাইরেও যে আর একটা পাকিস্তান আছে যার শক্তিমত্তাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না মোগলের ভূমিকা আমাদের নিকট সেই সত্যকে উন্মোচিত করেছে। মোহাম্মদ রফিক মোগল তো পাকিস্তানের জ্ঞানের জগতের ছোটখাটো কোনও মানুষ না যে তাকে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া যাবে। তিনি সেখানকার মূলধারার পাণ্ডিত্যের একজন প্রতিনিধিত্বকারী ব্যক্তি, যিনি সেখানকার প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ পদাধিকারী ছিলেন। অর্থাৎ তার সমর্থন মানে সেখানকার স্ট্যাবলিশমেন্টেরও এক ধরনের সমর্থন। এতখানি সাহস কি ভারতের স্ট্যাবলিশমেন্টে থাকা কেউ দেখাতে পেরেছেন? একই সঙ্গে পুরাতত্ত্বে তার আছে আন্তর্জাতিক খ্যাতি। স্ট্যাবলিশমেন্টে থেকে এমন প্রথা কিংবা প্রতিষ্ঠান বিরোধী ভূমিকা আমার জানামতে কোনও ভারতীয় পণ্ডিতই নিতে পারেন নাই।
ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিকরা বেশ কিছু কাল ধরে আর্য আক্রমণ তত্ত্বকে মানতে পারছেন না। কিন্তু সেটাও তারা সাধারণত সাহস এবং দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে পারেন না। বরং বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে গাঁইগুঁই করে প্রশ্ন তুলতে তারা পছন্দ করেন। এখানে মাইকেল ড্যানিনোর মত ইউরোপীয় প্রত্নতাত্ত্বিক পণ্ডিতদের সঙ্গে তাদের পার্থক্য। প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্যের উপর দাঁড়িয়ে ফরাসী প্রত্নতত্ত্ববিদ ড্যানিনো যে স্পষ্ট এবং ধারালো ভাষায় পাশ্চাত্য এবং ভারতীয় মূলধারার পণ্ডিতদের আর্য আক্রমণ তত্ত্বকে উপনিবেশিক পণ্ডিতদের তত্ত্ব হিসাবে চিহ্নিত করে প্রত্যাখ্যান করেছেন সেটা থেকে ভারতীয় প্রাতিষ্ঠানিক পণ্ডিতদের শিখবার আছে বলে আমি মনে করি।
যাইহোক, ডঃ মোগলের ঘটনা সম্ভবত আর একটা সত্যকে উন্মোচিত করেছে সেটা হচ্ছে মুসলিম সমাজের ভিতরের শক্তি, যেটা অনেক সময় বুঝা যায় না বা সহজে ধরা যায় না। বিষয়টা নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি। বিশেষত উভয় বঙ্গের হিন্দু এবং মুসলিম এই উভয় সমাজ সম্পর্কে আমার অনেক অভিজ্ঞতা থেকে আমার বেশ কিছু উপলব্ধি জন্মেছে যার কিছু সাম্প্রতিক কালে দৃঢ়বদ্ধ হয়েছে।
পশ্চিম বঙ্গ সম্পর্কে আমার কিছু অভিজ্ঞতার কথা বলেছি। সেখানে সাধারণত দুই ধরনের অভিজ্ঞতা হয়েছে। এক হচ্ছে হিন্দু ধর্ম এবং ঐতিহ্যে বিশ্বাসী হিন্দুদের সম্পর্কে অভিজ্ঞতা। এরা এমনই অন্ধ বিশ্বাসী এবং ইতিহাস, সমাজ, ধর্ম সম্পর্কে এদের জ্ঞান এবং উপলব্ধি এতই কম অথবা খণ্ডিত যে এদের সম্পর্কে মন্তব্য না করাই সঙ্গত। আর একটা হচ্ছে কম্যুনিস্ট বা মার্কসবাদী ঘরানার বুদ্ধিজীবী এবং পণ্ডিতদের সম্পর্কে অভিজ্ঞতা। এখনকার কথা বলতে পারব না তবে তেরো-চৌদ্দ বছর আগে পর্যন্ত আমার অভিজ্ঞতার কালটাতে পশ্চিম বঙ্গের বুদ্ধিচর্চার জায়গাটা প্রধানত এদের নিয়ন্ত্রণেই ছিল। এদের অধিকাংশেরই ভয় হচ্ছে আমাদের ব্যাখ্যা দ্বারা ভারতের হিন্দুত্ববাদীরা উৎসাহিত হবে। সত্যকেও তাদের এমনই ভয়! হয়ত এই কারণে অতীত জানতেও তাদের অনেকের এত ভয়। কী জানি তাতে যদি অতীতের গৌরবের কিছু বেরিয়ে আসে! একজন উচ্চশিক্ষিত প্রকাশকের কথা আমার এখনও মাঝে মাঝে কানে বাজে, ‘অতীত জেনে কী হবে?’ বাংলাদেশে কখনই কোনও শিক্ষিত মানুষের কাছ থেকে এমন হতভম্বকর উক্তি শুনেছি বলে আমার মনে হয় না। যাইহোক, পশ্চিম বঙ্গে আমার অভিজ্ঞতা থেকে মনে হয়েছে তারা সাধারণভাবে আমাদের ঋগ্বেদের মূল্যায়ন নিয়ে অখুশী এবং মনে মনে ভীতও। কারণ তাদের ভয় এতে হিন্দুত্ববাদীরা বা বিজেপি শক্তি পাবে।
অথচ ঋগ্বেদ সংক্রান্ত আমাদের বক্তব্য যে হিন্দুত্বকেও নাকচ করে সেই বোধটুকুও তাদের সাধারণত হয় না। আমাদের ব্যাখ্যায় সিন্ধু সভ্যতার পতনের জন্য বৈদিক উত্থানের প্রতিক্রিয়ার দিকটা উঠে আসে, যে কারণে ভারতের হিন্দুত্ববাদী পণ্ডিতদের দিক থেকেও আমরা সেভাবে সমর্থন পাই নাই। আমাদের নিকট এ বিষয় সহজবোধ্য যে, বৈদিক আন্দোলন এবং যুদ্ধ সিন্ধু সভ্যতার পতনোন্মুখ নদী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার ধ্বংসকে ত্বরান্বিত করেছিল। এটা ছিল মূলত নদী নিয়ন্ত্রণ বিরোধী ধর্মীয় আন্দোলন। নদী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার চূড়ান্ত ধ্বংস দ্বারা তা সিন্ধু সভ্যতার খাদ্য উৎপাদনের প্রধান ভিত্তিকে ধ্বংস ক’রে সিন্ধু সভ্যতারও ধ্বংস সাধন করে। সুতরাং সভ্যতার বিচারে বৈদিক আন্দোলনের ভূমিকা ছিল প্রতিক্রিয়াশীল তথা সভ্যতা বিরোধী। বর্তমান হিন্দু ধর্ম বৈদিক ধর্মের উত্তরাধিকারকে ধারণ করেই গড়ে উঠেছে। সুতরাং হিন্দু ধর্মের ভিতরে রয়েছে সভ্যতা বিরোধী চেতনা এবং সংস্কৃতির গভীর প্রভাব। একটু খোলা মন নিয়ে দেখলে হিন্দু ধর্ম এবং সমাজের সভ্যতা বিরোধী প্রতিক্রিয়াশীলতার দিকটাকে বুঝতে ভুল হয় না।
হিন্দু কম্যুনিস্টরাও এর বাইরে নয়। হিন্দু সমাজের সহজাত দুর্বলতা, ভীরুতা, সঙ্কীর্ণতা এগুলিকে কাটিয়ে ঊর্ধ্বে উঠবার ক্ষমতা তাদের মধ্যেও খুব কমেরই হয়। বিশেষত চিন্তার ক্ষেত্রে এদের নিদারুণ দারিদ্র্য আমার কাছে ধরা পড়েছে। পাশ্চাত্য জ্ঞানতত্ত্বকে প্রশ্ন করবার সাহস হওয়া তো দূরের কথা তার বাইরে যাবার সাহসও তাদের মধ্যে আমি খুব কম দেখেছি। কখনও পাশ্চাত্য বুর্জোয়া জ্ঞানতত্ত্বের বিপরীতে দাঁড়াতে চাইলে তারা অন্ধভাবে পাশ্চাত্যের মার্কসবাদী জ্ঞানতত্ত্বকে আঁকড়ে ধরে থাকতে চায়। সেখানেও কাজ করে অন্ধ ভক্তিবাদ। নিজ সমাজ-জমির উপর দাঁড়িয়ে স্বাধীনভাবে এবং বিচারশীল মন নিয়ে দেখবার সাহস বা ক্ষমতা কোনটাই এদের নাই। আসলে অন্য সকল অন্ধবিশ্বাসীর মত এরাও অন্ধবিশ্বাস নিয়ে বাঁচতেই স্বস্তিবোধ করে। পশ্চিম বঙ্গের মূলধারার কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক বুদ্ধিজীবী ও পণ্ডিতদের সম্পর্কে আমার মূল্যায়ন হল এরা খুব বেশী সংখ্যায়ই ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া চাকরবাকরদের অধস্তন পুরুষ। জ্ঞানতত্ত্বে এরা হল পাশ্চাত্যের চাকরবাকর।
যাইহোক, আমি এবার দৃষ্টি দিই বাংলাদেশের দিকে। সত্যি কথা বলতে কি দুই বঙ্গের মধ্যে এ বঙ্গের নিকট আমার প্রত্যাশা প্রথম থেকে অনেক দিন পর্যন্তই কম ছিল। সিন্ধু সভ্যতা সম্পর্কে যারা কিছু ধারণা রাখতেন তাদের অধিকাংশের ধারণা ছিল খুব অস্পষ্ট। বিশেষত ঋগ্বেদ পড়া মানুষ খুঁজে পাওয়া আরও কঠিন ছিল। সম্ভবত আমাদের সঙ্গে আলোচনার কিংবা আমাদের বাংলা গ্রন্থ প্রকাশের পর এখানে ঋগ্বেদ পাঠের প্রতি কিছু সংখ্যক মানুষের মধ্যে আগ্রহ দেখা দেয়।
তবে এখানে সিন্ধু সভ্যতা এবং ঋগ্বেদ সংক্রান্ত বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে আমরা ক্রমশ একটু একটু করে ঢাকাসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, সাংবাদিক, লেখক এবং গবেষকদের মধ্যে অনেকের আগ্রহ এবং কারো কারো সমর্থন পেতে শুরু করি। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা উচিত প্রত্নতত্ত্ববিদ ডঃ নাজিমুদ্দীন আহমেদের নাম। তিনি পাকিস্তান কালে অবিভক্ত পাকিস্তানের প্রত্নতত্ত্ব এবং যাদুঘরের পরিচালক হিসাবে কাজ করেছিলেন। তিনি সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক খননে মাঠ পর্যায়ে কাজ করেছিলেন বলে তিনি আমাকে বলেছিলেন। আমার যতদূর মনে পড়ে তিনি আমাকে জানিয়েছিলেন যে, তিনি ডঃ মোগলের সঙ্গেও মাঠ পর্যায়ে কাজ করেছিলেন। বাংলাদেশ হবার পর তিনি বাংলাদেশের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া তিনি ছিলেন বাংলাদেশে ইউনেস্কোর কালচারাল হেরিটেজ প্রজেক্টের ন্যাশনাল প্রজেক্ট অ্যাডভাইজার। আমাদের সঙ্গে তার যখন পরিচয় হয় তখন তিনি চাকুরী হতে অবসরপ্রাপ্ত। ডঃ নাজিমুদ্দীন আমাদের ইংরাজী বইটা পড়ে খুব খুশী হয়েছিলেন। বাংলা বইটাও (আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা) তিনি পড়েছিলেন। তবে তার পূর্বে ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’র প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ে লিখবার ক্ষেত্রে তার কিছু পরামর্শ আমাদের জন্য ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। বলা যায় সেটা আমাদের জন্য দিকনির্দেশক হিসাবে কাজ করেছিল। মোট কথা তিনি ছিলেন আমাদের বক্তব্যের দৃঢ় এবং উৎসাহী সমর্থক। তিনি চেয়েছিলেন আমরা যাতে একটা সেমিনারের আয়োজন করি যেখানে তিনি আমাদের তত্ত্বের সমর্থনে বক্তব্য দিবেন। আমাদের দুর্ভাগ্য, সে ধরনের কোনও আয়োজন করতে পারার আগে তিনি মৃত্যু বরণ করেন। তার মৃত্যুর পর অনেকগুলি বৎসর কেটে গেছে।
বিশেষত ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’ প্রকাশের পর বাংলাদেশে আমরা যে ধরনের সাড়া পাই তা ছিল আমার নিকট অভাবনীয়। কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় বাংলা এবং ইংরাজী দৈনিক সংবাদপত্রে ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’র উপর রিভিউ বা সমালোচনা প্রকাশিত হয়। এগুলির মধ্যে বাংলা দৈনিক প্রথম আলো এবং ইংরাজী দৈনিক নিউ এজের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ইংরাজী দৈনিক নিউ এজ (The New Age)-এ এটাকে এতই গুরুত্ব দেওয়া হয় যে, এটির উপসম্পাদকীয় পৃষ্ঠায় এই গ্রন্থের উপর ২২ মে, ২০০৪ তারিখে সাংবাদিক ও লেখক Syed Fattahul Alim কর্তৃক লিখিত Rig-Veda reveals secrets of Indus Civilization শিরোনামে একটি কিছু দীর্ঘ নিবন্ধ প্রকাশ করা হয়। বহুল প্রচারিত বাংলা দৈনিক ‘প্রথম আলো’য় ২০ আগস্ট ২০০৪ তারিখে ‘মিথ ও মিথ্যা বনাম ইতিহাস’ শিরোনামে গ্রন্থটির একটি রিভিউ প্রকাশিত হয় যাতে জোরালো এবং প্রাঞ্জল ভাষায় আমাদের বক্তব্যকে তুলে ধরা হয়। রিভিউটি লিখেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুল হাই। বিস্ময়কর ব্যাপার হল তিনি আমাদের কাছ থেকে এ বই পান নাই। কারও কাছে বইটা দেখে চেয়ে নিয়ে পড়ে তিনি এত মুগ্ধ হন যে, নিজ উদ্যোগে প্রথম আলোয় একটি রিভিউ লিখেন। পরবর্তী সময়ে তার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়।
যাইহোক, বাংলা ও ইংরাজী আরও পত্র-পত্রিকায় এটির রিভিউ প্রকাশ করা হয। সব জায়গার রিভিউ প্রকাশে আমার বা চঞ্চলের ভূমিকা ছিল না। অর্থাৎ উদ্যোগ বা উৎসাহ ছিল প্রধানত অন্যদের। এভাবে বাংলাদেশে ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’ সমাদৃত হয়। অবশ্য প্রাতিষ্ঠানিক জায়গাগুলিতে নয়। যেমন বিশ্ববিদ্যালয় বা পাবলিক লাইব্রেরী। যদিও ব্যক্তিগত পর্যায়ে এসব প্রতিষ্ঠানের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বইটি পড়ায় কিংবা নিজেদের সংগ্রহে রাখায় উৎসাহী ছিলেন। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানের সমস্যাটা কোথায় সেটা আমাকে বুঝার চেষ্টা করতে হয়েছে।
যাইহোক, সামান্য কিছু ব্যতিক্রম বাদে সব মিলিয়ে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা আমার জন্য ইতিবাচক। শুধু যে মুসলিম সমাজে উৎসাহী সমর্থন এবং সহযোগিতা পেয়েছি তা-ই নয়, এখানে হিন্দুদের ভিতরেও পশ্চিম বঙ্গের তুলনায় বেশী ইতিবাচক সমর্থন এবং সহযোগিতাও পেয়েছি। এ প্রসঙ্গে প্রয়াত হিন্দু নেতা প্রেমরঞ্চন দেবের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’র প্রচারে তার ছিল উৎসাহী এবং উদ্যাগী ভূমিকা। বাংলা দৈনিক প্রথম আলো এবং ইংরাজী দৈনিক নিউ এজ বাদে অন্যান্য দৈনিকে রিভিউ প্রকাশ হয়েছিল তার উদ্যোগে। প্রসঙ্গক্রমে বলা উচিত হবে যে, বইটি প্রকাশের পর আলোচনা এবং প্রচারের জন্য তিনি কিছুসংখ্যক কপি নিয়ে পশ্চিম বঙ্গে যান। অবশ্য সেখানে তিনি উৎসাহ ব্যঞ্জক সাড়া না পেয়ে ফেরৎ আসেন। কিন্তু বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা ছিল ভিন্ন। সব মিলিয়ে এখানে বইটি অন্তত একটি বোদ্ধা মহলে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।
স্বাভাবিকভাবে প্রসঙ্গক্রমে পুনরায় পশ্চিম বঙ্গের অভিজ্ঞতা চলে আসে। ২০০৩ সালে ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’ প্রকাশের বেশ কিছু দিন পর(২০০৪ সালের অক্টোবর-নভেম্বর) আমি নিজে সেটার কয়েকটা কপি নিয়ে কলকাতায় যাই। উদ্দেশ্য এর ভিত্তিতে আরও কিছু মত বিনিময় করা এবং সম্ভব হলে সেখানে রিভিউ করানো। যারা পড়েছিলেন এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে মত দিয়েছিলেন এমন ২/১ জন ব্যক্তির মতের অবশ্য বিশেষ কোনও গুরুত্ব নাই। কোনও সংবাদপত্র রিভিউ করার গুরুত্ব বোধ করে নাই। তবে একজন গবেষক আমার কাছ থেকে একটা বই নিয়ে ‘বারোমাস’ নামে কলকাতার একটা নামী লিট্ল ম্যাগাজিনে রিভিউ করার জন্য দেন। ২০০৫ সালের শারদীয় সংখ্যায় গ্রন্থ সমালোচক বা লেখক বিষ্ণুপ্রিয়া বসাক মনে হয় বইটা ভালভাবে না পড়ে শুধু গালাগালি করার জন্য মনের ঝাল মিটিয়ে একটা রিভিউ লিখেন। শুধু বুঝলাম যে সিন্ধু সভ্যতা তথা ভারতের গৌরবময় অতীত তুলে ধরবার জন্য লেখকের এত আক্রোশ। হয়ত তাকে বইটাকে গালাগালি দেওয়ার জন্য লিখতে বলা হয়েছিল। তবে বিষ্ণুপ্রিয়ার সমালোচনা পড়ে আমার মনে হয়েছিল বইটা ভালভাবে পড়বার প্রয়োজনও তিনি বোধ করেন নাই। ফলে আমাদের যুক্তি খণ্ডন করবার চেষ্টা না করে নিরর্থকভাবে আমাদেরকে আক্রমণ করেছিলেন। সমালোচক হয়ত মনে করেছিলেন যে বইটা বিজেপি বা হিন্দুত্ববাদীদের পক্ষে যায়। হয়ত তার কাছে হিন্দুত্ব এবং অতীত ভারতবর্ষের ইতিহাস এক জিনিস। সুতরাং অতীতের যদি কিছু গৌরবময় কিংবা ইতিবাচক দিক থাকে তবে সেটাকেও নাকচ ক’রে পারলে তার ইতিহাস-ঐতিহ্যের সবকিছুকে ঘৃণা এবং তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতে হবে এবং যা কিছু বিদেশী তাকে নিয়ে গৌরবে বুক ফুলিয়ে বেড়াতে হবে।
আমি ভুল হতে পারি। তবে আমার অনুমান লেখক নিজে কিংবা যারা তাকে দিয়ে ‘বারোমাসে’ রিভিউ বা সমালোচনা লিখিয়েছিল তারা কম্যুনিস্ট বা মার্কসবাদী হবে। কারণ দুই বঙ্গের মূলধারার কম্যুনিস্টরা যাদেরকে দেশদ্রোহী বুর্জোয়া হিসাবে ঘৃণা এবং গালিগালাজ করে বেড়ায় তাদের কারও চেয়ে যে দেশপ্রেমহীনতায় তারা নিজেরা এতটুকু কম নয় সেটা আমার খুব ভালভাবে জানা আছে। পাকিস্তান আমলে আমি কম্যুনিস্ট রাজনীতির সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত ছিলাম। ওটাকে আমি খুব কাছে থেকে দেখেছি বললেও কম বলা হয়, বরং খুব গভীরে থেকে দেখেছি বলাই সঙ্গত। এ থেকে এ দেশে কম্যুনিস্ট রাজনীতির নেতৃত্ব এবং মূলধারায় যারা থাকেন তাদের মানসিক গড়নটা আমার খুব ভালভাবে জানা আছে। সমস্যাটা হয়ত শুধু মার্কসবাদ কিংবা কম্যুনিস্ট আদর্শের নয়, সমাজেরও। কারণ আরও তো দেশ আছে যেগুলিতে মার্কসবাদী বা কম্যুনিস্টরা রাষ্ট্র ও সমাজ বিপ্লব ঘটিয়ে এবং সাম্রাজ্যবাদ-উপনিবেশবাদের শৃঙ্খল চূর্ণ করে দেশকে মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগে এবং পরাধীনতা থেকে উপনিবেশিকতার শৃঙ্খলমুক্ত স্বাধীনতায় নিয়ে এসেছে। সুতরাং আমাদের সমাজের অন্তর্গত সমস্যাকেও আমাদের বুঝতে চেষ্টা করা উচিত।
এই সমাজের প্রভাবটা মার্কসবাদীদেরও কীভাবে প্রভাবিত করে সেটা বুঝা যায় তাদের মানসিক গড়নের উপর সমাজের প্রভাব দেখলে। আর সেখানে চলে আসে ধর্মের বিষয়টা। বঙ্গ এবং উপমহাদেশের প্রেক্ষিতে ইসলাম এবং হিন্দু এই দুই ধর্ম। এই দুই ধর্ম দ্বারা এই উপমহাদেশের মুসলমান এবং হিন্দু সমাজ এবং জনমানস গভীরভাবে প্রভাবিত। সুতরাং এই দুই সমাজ এবং জনমানসের অনেক সমস্যাকে বুঝতে হলে এ্ই দুই ধর্মের বৈশিষ্ট্য এবং সমস্যাগুলিকে বুঝতে হবে বলে আমি মনে করি। প্রসঙ্গক্রমে এখানে সে বিষয়ে সামান্য কিছু ইঙ্গিত দিলেও এটা ভিন্ন আলোচনার বিষয়। সুতরাং এই আলোচনায় খুব প্রয়োজন না হলে সে দিকটাতে যাবার চেষ্টা করব না।
এবার পশ্চিম বঙ্গের বুদ্ধিবৃত্তির একটা সমস্যা তুলে ধরে আমি বর্তমান আলোচনাকে সমাপ্তির দিকে নিব। পশ্চিম বঙ্গে আমি যখনই পণ্ডিত কিংবা উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত মহলে ইতিহাস বা এই ধরনের কোনও বিষয়ে আলোচনা করতে গেছি তখন প্রায়শ আমাকে একটা প্রশ্ন শুনতে হত, ‘আপনি কোন “ডিসিপ্লিনের” মানুষ?’ বিশেষত সিন্ধু সভ্যতা কিংবা বেদ প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গেলে প্রায় ক্ষেত্রেই এ ধরনের প্রশ্ন শুনতে হত। আমি কোন প্রতিষ্ঠানে আছি এটা জানবার পরও তাদের এই প্রশ্ন শুনতে হত। আমি কয়েক বৎসর গবেষণা প্রতিষ্ঠানে থাকায় তারা অনেকে হয়ত সেটা জানতেন। তা জানুন বা না জানুন এই প্রশ্ন প্রায়শই আসত। তার মানে প্রশ্নকর্তা জানতে চাইতেন আমি কোন বিষয়ে উচ্চশিক্ষা লাভ করেছি। কিংবা আমার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বা বিদ্যাচর্চা কোন বিষয়ের উপর। আমি নিজে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র ছিলাম। সুতরাং সেটাই বলতাম। তারপর তারা আমার সঙ্গে আলোচনায় আসতেন।
বাংলাদেশে আমি কখনও এ ধরনের প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছি বলে মনে পড়ে না। সেটা যে পর্যায়ে যাদের সঙ্গেই আলোচনা করি না কেন। প্রসঙ্গক্রমে যদি কখনও অনেক আলাপের মধ্যে সে বিষয় উঠত তবে ভিন্ন কথা। কিন্তু প্রত্নতত্ত্বের ছাত্র না হয়ে কিংবা প্রাচীন ভারতের ইতিহাস অথবা বেদ-উপনিষদের ছাত্র না হয়েও আমার সীমা অতিক্রম করেছি কিনা সেটা নিয়ে কারও মাথা ব্যথা দেখি নাই। সুতরাং কেউ আমার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বিষয় নিয়ে সেভাবে জানতে আগ্রহী হতেন না। বরং তাদের আগ্রহের বিষয় হত আমার বা আমাদের বক্তব্য। সেটাই তারা নানানভাবে বুঝতে বা জানতে চাইতেন। অথচ পশ্চিম বঙ্গে এটা একটা সাধারণ প্রশ্ন বিশেষত পণ্ডিত মহলে। সেটা হচ্ছে আমি কোন ‘ডিসিপ্লিনের’ অথবা কোন ‘ডিসিপ্লিন’ থেকে আসা মানুষ। বারবার এই প্রশ্ন আমাকে প্রথম দিকে অবাক করলেও পরে এর কারণটা স্পষ্ট হয়। এই কারণে যাবার জন্য গল্পের মত শুনাবে এমন একটা ঘটনার কথা বলি। মানুষের তত্ত্বজ্ঞানের উৎস বাস্তব। আমি সেই বাস্তব থেকে এখন এমন একটা তত্ত্বজ্ঞানে যেতে চেষ্টা করি।
ঘটনাটা ১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময়কার। সেই সময় আমি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তৎকালীন পূর্ব বঙ্গের জাতীয় মুক্তি যুদ্ধ সংগঠিত করবার জন্য দুই বঙ্গের বিস্তীর্ণ অঞ্চল ভ্রমণ করি। এমনই একটা ভ্রমণে আমি তৎকালের এপার বঙ্গ থেকে পশ্চিম বঙ্গে প্রবেশ করি। পায়ে হেঁটেই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হচ্ছিল। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্ত পাড়ি দিয়ে পশ্চিম বঙ্গে পা দিবার অল্প পর সীমান্তবর্তী এলাকার স্থানীয় গ্রাম্য একজন লোক আমার সঙ্গী হন। চেহারা দেখে সব বুঝবার কথা নয়। তবে তাকে দেখে এবং তার কথা শুনে তাকে আমার একজন নিতান্ত সাধারণ গ্রামবাসী মনে হয়েছিল। যাইহোক, তার উদ্দেশ্য ছিল গল্প করতে করতে হাঁটা। কথা তিনিই বলছিলেন। আমি মাঝে মধ্যে হুঁ হাঁ করছিলাম। অল্পক্ষণ পরই তিনি মুসলমানদের তীব্র সমালোচনা করে কথা বলতে থাকলেন। এবং পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দুরা যে বোকার মত লোভ করে পূর্ব পাকিস্তানে পড়ে ছিল সে কথা বললেন। ‘এখন বোকা এবং লোভী হিন্দুরা ঠেলা বুঝছে। কতবার বলেছি তোরা মুসলমানদের সঙ্গে থাকতে পারবি না। মুসলমানের দেশ পাকিস্তান ছেড়ে তোরা ভারতে চলে আয়। মুসলমানদের সঙ্গে কি থাকা যায়? যায় না। এখন বুঝ্ ঠ্যালা!’ ইত্যাদি, ইত্যাদি। বেশ কিছুক্ষণ তার কথা চলল। প্রায় সবটা জুড়ে থাকল মুসলমানদের বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা এবং নিন্দা।
আমার তাতে কোনও সমস্যা ছিল না। তার অনেক অভিযোগ যে সত্য সেটা আমি জানতাম। সব সত্য না হলেই বা কী? আমার কী যায় আসে তাতে? কিন্তু বিপদ বাধল তখন যখন তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘অনেক ক্ষণ তো আলাপ করলাম। কিন্তু দাদা, আপনার নামটাই তো জানা হল না।’ আমি একটা বাংলা নাম বললাম। শুনে খুব একটা তৃপ্ত হলেন না। এবার জানতে চাইলেন, ‘আপনার জাত কী?’ এবার আমি প্রমাদ গুনলাম। কারণ এতক্ষণ ধরে মুসলমানদের গুষ্টি উদ্ধার করে যে সব কথা বলেছেন তাতে আমি যদি আমার মুসলমান পরিচয় বলি তবে তিনি লজ্জা পেতে পারেন। আর আমি যদি বলি ‘আমি কোনও জাত মানি না’ তাহলে তিনি মানবেন না। আর যদি বলি আমার কোনও ধর্ম বিশ্বাস কিংবা ধর্ম নাই সেটাও আসলে হাস্যকর হবে। ধর্মীয় পরিচয়ে আমার ভয় পাবার কারণ ছিল না। কিন্তু এতটা পথ একত্রে চলার পর তাকে লজ্জায় ফেলতে চাইলাম না। একটা নির্দোষ মিথ্যার আশ্রয় নিলাম। সুতরাং বললাম, ‘হিন্দু।’ উত্তরে তিনি বললেন, ‘তা তো আমি জানি। কিন্তু শুধু হিন্দু বললে তো হবে না। হিন্দু হলেও একটা জাত আছে না?’ এইবার বুঝলাম আমাকে বর্ণজাতির কাঠামোতে ফেলে স্বস্তি পেতে চাইছেন। বেশী বড়ও না, আবার বেশী ছোটও না, মাঝামাঝি এমন একটা জাত বুঝাতে তখন আমি বললাম, ‘আমি কায়স্থ।’ যতদূর মনে পড়ে আমার বাংলা নামের শেষে ‘রায়’ পদবী উল্লেখ করে তাকে নিশ্চিন্ত করলাম। এবার তিনি স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন, ‘হ্যাঁ, তাই বলেন।’ এরপর বেশীক্ষণ আর আমরা একত্রে হাঁটি নাই। তার গন্তব্য আসাতে তিনি চলে গেলেন। আমি আমার পথে গেলাম আমার গন্তব্যের দিকে। সেটা আরও দূরে।
আমার মনে হয় উপরে বর্ণিত ঘটনার মধ্য থেকে হিন্দু মানসের একটা চমৎকার চিত্র বেরিয়ে আসে। পবিত্রতা-অপবিত্রতার ধারণা ভিত্তিক এবং অপরিবর্তনীয় পেশা ও মর্যাদা ভিত্তিক বর্ণজাতির কাঠামোতে না ফেললে হিন্দু সমাজকে যেমন সঠিকভাবে বুঝা যাবে না তেমন তার মানস অবতলের গভীরেও প্রবেশ করা যাবে না। সভ্যতার বিশেষায়ন বা স্পেশিয়ালাইজেশনের বাস্তবতার সঙ্গে তার বর্ণজাতিভেদ ভিত্তিক চেতনার সংমিশ্রণে এমন এক বুদ্ধিবৃত্তিক অচলায়তন সৃষ্টি হয় যেখানে জ্ঞানের এক শাখা থেকে আর এক শাখায় সাহসী এবং স্বচ্ছন্দ বিচরণ অসম্ভব অথবা অসম্ভবপ্রায় হয়ে থাকে। বাস্তবে অপরিবর্তনীয় বর্ণজাতি কাঠামোর অনেক কিছুকে এখন আর না মানলেও হিন্দু মন অজস্র বিভাজনের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত বর্ণজাতির কাঠামোকে আজ অবধি অতিক্রম করতে কিংবা ভাঙ্গতে পারে নাই। সুতরাং হিন্দুদের এত প্রচণ্ড রক্ষণশীলতা। এই রক্ষণশীলতার কারণেও একবার জোর করে তাদের উপর প্রতিষ্ঠান হোক, আর যা-ই হোক একটা কিছু চাপিয়ে দিতে পারলে তারা আর সেটা থেকে বের হতে চায় না। বরং সেটাকেই আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকতে চায়।
সুতরাং পশ্চিম বঙ্গে আমি কেন এত ডিসিপ্লিনের প্রশ্ন শুনতাম সেটা বোধহয় এখন বুঝা যায়। একটা অনড়, অপরিবর্তনীয় কাঠামোতে রেখে হিন্দু মন সবকিছুকে বুঝতে চায়। কম্যুনিস্ট বা মার্কসবাদী হলেও তাতে বিশেষ কিছু হেরফের হয় না। তার মানস জগতে কাজ করে হিন্দু ধর্ম তথা সমাজের এই কাঠামোগত চেতনা। এটাকে হয়ত প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোও বলা চলে। এই কাঠামো আবার অপরিবর্তনীয় পেশা এবং অলঙ্ঘনীয় পবিত্রতা-অপবিত্রতা তথা অলঙ্ঘনীয় শ্রেষ্ঠত্ব এবং নীচতার ধারণার ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। একটা অনমনীয়, অপরিবর্তনীয় এবং অলঙ্ঘনীয় ছকে সে যেমন আবদ্ধ থাকতে পছন্দ করে তেমন সবকিছুকে এমন একটা ছকে ফেলে দেখতেই তার পছন্দ। যে কথা বললাম, সেখানে আবার থাকতে হবে উচ্চতা-নীচতা, মর্যাদা-অমর্যাদা বা বেশী মর্যাদা, কম মর্যাদা এবং শ্রেষ্ঠত্ব-হীনতার স্থায়ী এবং অপরিবর্তনীয় স্তরবিন্যাস। আমি তো প্রাচীন ইতিহাসের ছাত্র নই, তার উপর নই প্রতিষ্ঠিত বেদ পণ্ডিত। সবচেয়ে বড় কথা, প্রথমত আমি পরিচয়ে মুসলমান, দ্বিতীয়ত কোনও পাশ্চাত্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীন ভারতের ইতিহাস বিষয়ক নামী অধ্যাপকও আমি নই, সুতরাং আমাকে বা আমাদের বক্তব্যকে তারা গুরুত্ব দিবে কেন?
এ প্রসঙ্গে আর একটা প্রশ্ন জাগে সেটা হচ্ছে পাশ্চাত্য দ্বারা উদ্ভাবিত আর্য আক্রমণ তত্ত্বের প্রতি হিন্দু চেতনার কোনও ধরনের অনুমোদন আছে কিনা। প্রশ্নটা আসা স্বাভাবিক। কারণ যে কথা একটু আগেই বলেছি হিন্দু ধর্ম এবং সমাজ বর্ণজাতিভেদমূলক এমন এক স্তরবিন্যস্ত বিভাজনের উপর প্রতিষ্ঠিত যেখানে এক বর্ণজাতি থেকে অপর বর্ণজাতির ব্যবধান অলঙ্ঘনীয়। এই ধরনের সমাজ বিন্যাসের শীর্ষে থাকে সবচেয়ে পবিত্র এবং সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ বর্ণজাতি হিসাবে ব্রাহ্মণ, ধর্ম চর্চার একচ্ছত্র অধিকার এবং সেই সঙ্গে জ্ঞান চর্চারও মূল দায়িত্ব যার হাতে। পবিত্রতা এবং শ্রেষ্ঠত্বের বিচারে তার নীচে অবস্থান করে ক্ষত্রিয়, যার হাতে থাকে রাষ্ট্রশাসন এবং যুদ্ধের দায়িত্ব। তত্ত্বগতভাবে তার নীচে আছে বৈশ্য। বাকীরা শূদ্র। তারা সবার নীচে।
প্রকৃতপক্ষে সমগ্র শ্রমজীবীই শূদ্র, সুতরাং অপবিত্র, নীচ এবং ঘৃণিত। আসলে ব্রাহ্মণসহ সমগ্র উচ্চবর্ণের নিকট সমগ্র সাধারণ ভারতবাসী অপবিত্র এবং ঘৃণিত শূদ্র ছাড়া আর কিছু নয়। অবশ্য আর একদল আছে, তারা হল অস্পৃশ্য। তারা সর্বাপেক্ষা অপবিত্র, সুতরাং সর্বাপেক্ষা ঘৃণিত। তাদের ছোঁয়া বা স্পর্শ এমনকি ছায়া পর্যন্ত অপবিত্র। এরা মূলধারার হিন্দু সমাজেরও বাইরে অবস্থান করে। এখন এদের দলিতও বলা হয়।
সুতরাং এটা বলা ভুল হবে না যে, হিন্দু উচ্চবর্ণের সংখ্যাল্প মানুষরা পাশ্চাত্য কর্তৃক উদ্ভাবিত বহিরাগত এবং শ্বেতাঙ্গ আর্য আক্রমণ তত্ত্বকে সংখ্যাগুরুর উপর নিজেদের বর্ণজাতিগত শ্রেষ্ঠত্ব এবং আধিপত্য রক্ষায় সহায়ক হিসাবে দেখতে পায়। কাজেই নিজেদেরকে ‘বহিরাগত, শ্বেতাঙ্গ এবং বিজয়ী আর্যদের’ বিশুদ্ধ বংশধর ভেবে নিলে লাভ ছাড়া ক্ষতি কী? বহুকাল ধরে অবশ্য আর্যদের সম্পর্কে শ্বেতকায়, উন্নত নাসা ইত্যাদি রেসিয়াল বা জাতিবাদী পরিচয় আর দেওয়া হয় না। বিশেষত দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর থেকে ইউরোপীয়রা আর্যদের উপর এ ধরনের গুণ বা বৈশিষ্ট্য আরোপ করার ব্যাপারে সতর্ক হয়ে গেছে। এখন তারা ভাষাতত্ত্বের উপর জোর দেয়। এখন আর্যদের সম্পর্কে বলা হয় যে তারা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর মানুষ, যারা ইউরোপ কিংবা মধ্য-এশিয়ার কোনও অজ্ঞাত স্থান থেকে বিজয়ীর বেশে ভারতবর্ষে প্রবেশ করেছিল। তাতে অবশ্য বর্ণহিন্দুদের সমস্যা নাই। বৈদিক কিংবা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাভাষীদের শ্রেষ্ঠত্ব কিংবা বিজয়ের ব্যাপারটা তো ঠিক রইল! আর পশ্চিম বঙ্গ বলা যাক কিংবা ভারত বলা যাক সেখানকার জ্ঞানের জগতকেও প্রধানত উচ্চবর্ণের হিন্দুরাই নিয়ন্ত্রণ করে।
এখন আর একটু ভাবা যাক। হিন্দুরা সাড়ম্বরে ঋগ্বেদকে তাদের মূল বা আদি ধর্মগ্রন্থ হিসাবে ঘোষণা করে। সেক্ষেত্রে ধর্মীয়ভাবেই বেদ চর্চার অধিকারী উচ্চবর্ণের হিন্দু, বিশেষত ব্রাহ্মণদের ঋগ্বেদের অর্থ একেবারে না বুঝবার কারণ ছিল না বা নাইও। সুতরাং এটাই প্রত্যাশিত যে অন্তত বেদ-পণ্ডিত এবং যারা বেদ পাঠ করেছেন তারা প্রথম থেকেই পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের ঋগ্বেদের কদর্থ করার বিরুদ্ধে সোচ্চার হবেন। এটা ঠিক, সবাই যে পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের ব্যাখ্যা মেনে নিয়েছিলেন তা নয়। তবে তাদের সংখ্যা এমনই নগণ্য এবং সর্বোপরি তাদের কণ্ঠস্বর আর্য আক্রমণ তত্ত্ববাদীদের ঢক্কা নিনাদে এমনইভাবে চাপা পড়ে থেকেছে যে সাধারণ ইতিহাস পাঠকরা কখনই সে সম্পর্কে জানতে পারেন নাই।
বরং উপমহাদেশের বহু সংখ্যক বেদ-পণ্ডিতসহ বিপুল সংখ্যক সমাজ এবং ইতিহাস বিষয়ক পণ্ডিত এবং লেখক ঊনবিংশ শতাব্দীর পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের প্রবর্তিত তত্ত্বের সুরে সুর মিলিয়ে আর্য আক্রমণ তত্ত্বের অভ্রান্ততা প্রচার করে বেড়িয়েছেন। পরিতাপের বিষয় যে, আজও তাদের সংখ্যা কম নয়। ঠিক আছে, অন্যদের ভুল না হয় মেনে নেওয়া গেল। যাদের ধর্মগ্রন্থ ঋগ্বেদ নয়, ফলে এটার চর্চা যাদের করবার কথা নয় তারা না হয় পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের ভ্রান্ত ব্যাখ্যা দ্বারা বিভ্রান্ত হতে পারেন। কিন্তু যারা ঋগ্বেদকে তাদের ধর্মগ্রন্থ হিসাবে দাবী করেন এবং তা পাঠ বা চর্চা করেন তাদের কেন ঋদ্বেদের অর্থ এবং তাৎপর্য নিয়ে এতকাল ধরে এত বিভ্রান্তি? ঋগ্বেদে স্পষ্ট ভাষায় বলা কথাগুলির অর্থ বুঝতেও কি এতই কষ্ট হয়?
কী অবলীলায় স্থিতিশীল সভ্য জীবনের মানুষদেরকে পশুপালক, যাযাবর এবং বহিরাগত বলে দেওয়া হল! ঋগ্বেদের বর্ণনা অনুযায়ীই যারা ছিল গঙ্গাসহ বৃহত্তর সপ্তসিন্ধু ভূভাগের নগর ও গ্রামের অধিবাসী, কৃষি ও বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত, যারা একটা সভ্য সমাজের সকল গুরুত্বপূর্ণ বৃত্তির সঙ্গে সংযুক্ত এবং এমনকি যারা ‘শতদাঁড়যুক্ত’ জাহাজে (ঋগ্বেদ – ১/১১৬/৫) সাগর পাড়ি দিয়ে বাণিজ্য করত, ইউরোপীয় পণ্ডিতদের কলমের খোঁচায় তারা সেসব কিছুই বাদ দিয়ে পশুপালক এবং যাযাবর অশ্বারোহী হয়ে ভারতবর্ষ আক্রমণ অভিযানে নামল! সমগ্র ঋগ্বেদে যারা একটি বারও নিজেদেরকে বহিরাগত বলেন নাই, বরং নিজেদের আবাস ভূমি হিসাবে সপ্তসিন্ধুকে তুলে ধরেছেন কলমের খোঁচায় সেই ঋষিদের আবাস ভূমি কেড়ে নিয়ে তাদেরকে বানানো হল বহিরাগত ভবঘুরে! আর হিন্দু পণ্ডিতরাও প্রায় সবাই এতকাল ঋগ্বেদ ও তার রচয়িতাদের সম্পর্কে সেসব হাস্যকর, উদ্ভট এবং হতভম্বকর মিথ্যাচারকে নির্বিবাদে মেনে নিলেন! কিন্তু কেন?
যারা ঋগ্বেদকে তাদের ধর্মগ্রন্থ হিসাবে দাবী করেন তাদের কেন ঋগ্বেদের অর্থ এবং তাৎপর্য নিয়ে এতকাল ধরে এত বিভ্রান্তি? এ কি শুধু বুদ্ধির দোষ কিংবা জ্ঞানতাত্ত্বিক ভ্রান্তি, নাকি একটু আগেই যে দিকে ইঙ্গিত করেছি তার পুনরুক্তি করে বলব পাশ্চাত্যের মত তাদেরও নিজস্ব কিছু স্বার্থগত প্রেরণা কাজ করেছে এত বড় এক মিথ্যার বিরুদ্ধে না দাঁড়াবার পিছনে?
এই আলোচনা শেষ করার পূর্বে বৈদিক এবং হিন্দু ধর্মের পার্থক্য সম্পর্কে যারা তেমন একটা ধারণা রাখেন না তাদের সুবিধার জন্য এখানে এ কথা বলে রাখা উচিত হবে যে, আমরা যেন বৈদিক ধর্ম এবং হিন্দু ধর্মকে এক করে না দেখি। যদিও হিন্দুরা বেদ বা ঋগ্বেদকে তাদের আদি ধর্মগ্রন্থ বলেন এবং বেদের উত্তরাধিকারকে স্বীকার করেন বাস্তবে তারা কিন্তু বহু বিষয়েই বৈদিক ধর্ম থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। যেমন হিন্দু ধর্মে প্রতিমা পূজা থাকলেও ঋগ্বেদ বা বৈদিক ধর্মে প্রতিমা পূজার জায়গা নাই। হিন্দু ধর্মের প্রধান দেব-দেবীরাও বৈদিক ধর্ম বা ঋগ্বেদের দেবতা থেকে ভিন্ন। শুধু তা-ই নয়, বর্ণাশ্রম ভিত্তিক তথা ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র এই চার বর্ণ ভিত্তিক জাতিভেদ প্রথা বর্তমান হিন্দু ধর্ম এবং সমাজের মূলভিত্তি হলেও বৈদিক ধর্মে এর কোনও স্থান ছিল না। ঋগ্বেদ পড়লে যেমন সেটা বুঝা যায় তেমন ঋগ্বেদের এক ঋষিও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানাচ্ছেন, ‘দেখো, আমি স্তোত্রকার, পুত্র চিকিৎসক, কন্যা প্রস্তরের উপর যব-ভর্জন-কারিণী। আমরা সকলে ভিন্ন ভিন্ন কর্ম করছি।’ (৯/১১২/৩)।
বৈদিক আন্দোলনের অনেক পরবর্তী কালে বৈদিক সমাজ বর্ণজাতিভেদ ভিত্তিক হিন্দু সমাজে পরিণত হলে বর্ণজাতিভেদ প্রথাকে ধর্মের অঙ্গীভূত করে নেওয়া হয়। যেহেতু ঋগ্বেদকে ব্রাহ্মণ বা বর্ণ হিন্দুরা বাস্তবে সাধারণভাবে না মানলেও মৌখিকভাবে এবং তত্ত্বগতভাবে কিংবা নৈতিকভাবে তাদের মূল ধর্মগ্রন্থ হিসাবে ঘোষণা করে সেহেতু বেদ রচনার পরবর্তী কালে বর্ণাশ্রম প্রথার সমর্থনে ‘পুরুষ দেবতা’ নামে রচিত একটি সূক্তকে ঋগ্বেদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এটি ঋগ্বেদের শেষ অর্থাৎ দশম মণ্ডলের নব্বই নম্বর সূক্ত। বর্তমান কালের ভাষাতাত্ত্বিক পণ্ডিতরা সকলে এটিকে সংস্কৃত ভাষায় অর্থাৎ অবৈদিক ভাষায় রচিত মন্ত্র বলেন। সংস্কৃত ভাষা বৈদিক ভাষা থেকে আগত হলেও এটি বৈদিক ভাষার পরবর্তী এবং রূপান্তরিত রূপ। অর্থাৎ ‘পুরুষ দেবতা’ নামে মন্ত্রটি প্রকৃতপক্ষে অবৈদিক এবং পরবর্তী কালের রচনাকার কর্তৃক ঋগ্বেদে প্রক্ষিপ্ত একটি মন্ত্র মাত্র, যার সঙ্গে বৈদিক সমাজ কিংবা ধর্মের কোনও সম্পর্ক নাই।
বর্ণাশ্রম ভিত্তিক জাতিভেদ প্রথাকে ধর্মীয় বৈধতা দানের উদ্দেশ্যে পরবর্তী কালে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতরা যে এ কাজ করেছিলেন সেটা স্পষ্ট। সুতরাং এ কথা বলাই যুক্তি সঙ্গত যে ধর্মীয় বিধানের অলঙ্ঘনীয়তার কারণে পরবর্তী কালে বেদের মন্ত্র পরিবর্তন করতে না পারলেও উচ্চবর্ণের হিন্দু বিশেষত ব্রাহ্মণরা তাদের শ্রেণী স্বার্থে ইচ্ছামত ঋগ্বেদ তথা বেদের অর্থ কিংবা ব্যাখ্যা দান করেছে। ধর্মীয় বা শাস্ত্রীয় বিধানে অন্য ধর্মাবলম্বীদের তো প্রশ্নই উঠে না এমনকি শূদ্রদের জন্যও বেদ পাঠ নিষিদ্ধ। তবে ধর্মীয় বিধানে ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্যের জন্য বেদ পাঠ নিষিদ্ধ না হলেও বাস্তবে ব্রাহ্মণরা সুদীর্ঘ কাল তাদের জন্যও বেদ পাঠ নিষিদ্ধ করে রেখেছিল। সবচেয়ে বড় কথা দেব-দেবীর পূজা তথা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পরিচালনার অধিকারী ব্রাহ্মণ হওয়ায় এবং পূজায় বেদের মন্ত্রপাঠ অপরিহার্য হওয়ায় ধর্মগ্রন্থ হিসাবে বেদ পাঠ বা চর্চার অধিকার বা সুযোগও ব্রাহ্মণের একচেটিয়া অধিকারে চলে গিয়েছিল। সুতরাং বেদের যা খুশী অর্থ করতে কিংবা যেভাবে সুবিধা সেভাবে ব্যাখ্যা করতে ব্রাহ্মণদের সমস্যা কী? উচ্চবর্ণের অন্য বর্ণজাতিগুলিও নিম্নবর্ণের উপর নিজেদের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক আধিপত্য রক্ষায় সহায়ক হিসাবে ব্রাহ্মণদেরকে দেখেছে। ফলে এরা সবাই মিলে বর্ণজাতিভেদমূলক ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে ব্রাহ্মণদের নেতৃত্বে নিজেরা যেমন ঐক্যবদ্ধ হয়েছে তেমন ঘৃণিত অবস্থানে রেখে দিয়ে নিম্নবর্ণের বিপুল সংখ্যাগুরু শ্রমজীবী জনগোষ্ঠী অর্থাৎ বাকী সমাজকেও ঐক্যবদ্ধ করেছে। জন্মগতভাবে পাওয়া হীন এবং ঘৃণিত অবস্থান পরিবর্তনের লড়াই না করে নিম্নবর্ণের মানুষরাও ভাগ্যলিপি বা পূর্বজন্মের কৃত পাপের ফল বলে নির্বিবাদে সেটাকে মেনে নিয়েছে হাজার হাজার বছর ধরে। ধর্মের এমনই গুণ! এই বাস্তবতায় বর্ণজাতিবাদের সুবিধা ভোগকারী একটা শ্রেণীর স্বার্থ ব্রিটিশ এবং পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদী-উপনিবেশবাদী স্বার্থের সঙ্গে মিলে গেলে তারা কোন্ দুঃখে ঐ স্বার্থের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ তত্ত্বের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে?
আসলে ব্রাহ্মণকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা হিন্দু ধর্মের জাত-পাতের বিভাজন তথা চতুর্বর্ণ (ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্র) ভিত্তিক জাতিভেদ প্রথা নিকৃষ্টতায় শ্বেতবর্ণজাতিবাদ কিংবা ইউরোপীয় রেসিজমের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। ফলে বহিরাগত আর্য আক্রমণ তত্ত্ব ব্রাহ্মণকেন্দ্রিক উচ্চ বর্ণজাতিসমূহের অন্তর্গত বর্ণজাতিগত দম্ভকে যে তৃপ্ত করবে সেটা স্বাভাবিক। সম্ভবত এটাও একটা কারণ যার জন্য ঋগ্বেদ এবং প্রত্নতত্ত্বের সব সাক্ষ্য-প্রমাণ বহিরাগত আর্য আক্রমণ তত্ত্বকে নাকচ করলেও পশ্চিম বঙ্গ কিংবা ভারত আজ অবধি এই হাস্যকর তত্ত্বের বিরুদ্ধে বৃহদায়তনে কোনও সামাজিক জাগরণ ঘটাতে অক্ষম হচ্ছে। হিন্দু বর্ণজাতিবাদ বা জাত-পাতের বিভাজন যে তত্ত্বের মধ্যে নিজের ছায়া দেখতে পায় সেই তত্ত্ব যতই মিথ্যা এবং ভারতবর্ষের প্রতি অমর্যাদাসূচক হোক তার বিরুদ্ধে ঘৃণার জাগরণ ঘটানোও কঠিন নয় কি?
এই রকম একটা সমাজ থেকে বড় কী হতে পারে? মাঝে মাঝে চিন্তা করে অবাক হই বিরাট ও প্রবল পুরুষ সুভাষচন্দ্র বসু ঐ সমাজের গর্ভ থেকে কী করে জন্ম নিয়েছিলেন! বুঝা যায় জন্ম নিতে পারলেও এই কারণে তিনি সফল হতে পারেন নাই। কারণ স্বদেশে পায়ের নীচে কোনও শক্ত জমি পান নাই। শুধু বিদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে কতটুকু কী করা যায়?
যাইহোক, পশ্চিম বঙ্গ থেকে অন্তত এই মুহূর্তে আমি তেমন কিছু আশা করি না। এখন পর্যন্ত ভারতের দিক থেকেও আশা করবার মত তেমন কিছু দেখি না। আপাত দৃষ্টিতে ভারতে জ্ঞানচর্চার ব্যাপকতা থাকলেও সাধারণভাবে সেগুলি পাশ্চাত্য জ্ঞানতত্ত্বের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখার টীকাভাষ্য ছাড়া আর কিছু না। স্বাধীনভাবে চিন্তার অক্ষমতা এবং মৌলিক চিন্তার অভাব ভারতের জ্ঞানচর্চায় প্রকটভাবে দৃশ্যমান। স্বাধীন এবং মৌলিক চিন্তাগুলি সেখানে দাঁড়াবার মত সুযোগ খুব সামান্যই পায় অথবা সেগুলি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রচলিত ধারার জ্ঞানচর্চার জঙ্গলে পথ হারায়।
উপমহাদেশ তথা ভারতবর্ষে আর্য আক্রমণ তত্ত্বের বিরুদ্ধে আমাদের দীর্ঘ লড়াই যে বিষয়টিকে আমার নিকট স্পষ্ট করেছে সেটা হচ্ছে সাধারণভাবে ভারতীয়দের নিস্তেজতা এবং আত্মমর্যাদা বোধের অভাব। একই সঙ্গে স্পষ্ট হয়েছে ইতিহাসের সত্যকে গ্রহণে ইউরোপ বা পাশ্চাত্যের অনীহা। প্রত্নতত্ত্ব দ্বারা ভারতবর্ষে আর্য আক্রমণ তত্ত্ব নাকচ হবার এত কাল পরেও সেটাকে রক্ষা করতে চেয়ে এবং ঋগ্বেদ যে ভাষায় লেখা হয়েছিল সেই ভাষাভাষী মানুষদের যদি আর্য বলা যায় তবে সেই আর্যরা যে ভারতবর্ষ থেকে ইউরোপ যায় নাই সেটা প্রমাণের জন্য এখনও ইউরোপীয় পণ্ডিতদের চেষ্টার অন্ত নাই। সুতরাং সিন্ধু সভ্যতার বাইরে তথা ভারতবর্ষের বাইরে আর্য তথা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর উৎস খুঁজবার নানান হাস্যকর চেষ্টা আজ অবধি অব্যাহত রয়েছে।
এমনই এক হাস্যকর তত্ত্ব নিয়ে অল্প কিছুদিন আগেও তারা খুব মাতামাতি করলেন। তারা প্রাচীন আনাতোলিয়া বা তুরস্কের কুরগানের এক ক্ষুদ্র পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীকে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর আদি পুরুষ তথা আদি আর্য হিসাবে চিহ্নিত করে কিছুদিন খুব শোরগোল তুললেন। কম্পিউটারে অঙ্ক কষে তার নিখুঁত (!) প্রমাণও হাজির করলেন! কিছুদিনের মধ্যে কুরগান তত্ত্বের এই ধাপ্পা ফুটো বেলুনের মত চুপসেও গেছে। তবু তারা সত্যটাকে স্বীকার করবে না। অর্থাৎ এত কিছুর পরেও ইউরোপের মূলধারা ভারতবর্ষের কাছে বর্তমান ইউরোপীয়দের ভাষা, সভ্যতা ও সংস্কৃতির জন্মগত উত্তরাধিকারের ঋণ স্বীকার করতে রাজী নয়। কারণ তাদের রয়েছে সাম্রাজ্যবাদী-উপনিবেশবাদী দম্ভ।
এদের পাশে রাখা যাক চাকরবৃত্তিধারী ভারতীয় পণ্ডিতদের ধারাকে। চরম মিথ্যাচারপূর্ণ এবং উপমহাদেশের জন্য চরম অগৌরবের একটা হাস্যকর এবং উদ্ভট তত্ত্বকে স্পর্ধার সাথে এবং চরম ঘৃণাভরে ছুঁড়ে ফেলবার মত সাহসও আজ অবধি ভারতের এই চাকরবাকরদের হল না। কারণ এরা যে রাজনীতি করেন না, বরং বিশুদ্ধ (!) জ্ঞান চর্চা করেন! সুতরাং জ্ঞানতত্ত্বের আড়ালে পাশ্চাত্যের অপরাজনীতিও এদের কাছে বিশুদ্ধ জ্ঞানের সাধনা! এরা যে আজও এদের ব্রিটিশ এবং পাশ্চাত্য প্রভুদের আত্মমর্যাদা বোধহীন খাঁটি চাকরবাকর এবং তাদের ‘রেসিস্ট’ রাজনীতির তল্পিবাহক রয়ে গেছে এই একটা ঘটনা থেকেই সেটা প্রমাণ হয়।
পাকিস্তান সম্পর্কে এক ডঃ মোগলকে দিয়ে মূল্যায়ন করা ঠিক নয়। তবু তার সম্ভাবনা এবং শক্তির জায়গাটাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ধর্মের কারণে দাসত্ব (বান্দাত্ব) এবং বর্বরতার চেতনা দ্বারা মুসলিম সমাজ খুব বেশী প্রভাবিত হলেও মুসলমানের থাকে প্রবল সাহস এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষা, কিছু ক্ষেত্রে তীব্র আত্মমর্যাদা বোধ। সেগুলির ধাক্কায় হঠাৎ কখন সে গাঝাড়া দিয়ে জেগে উঠে বিদ্যমান সব ধারণা কিংবা ব্যবস্থাকে লণ্ডভণ্ড করে ফেলে সেটাকে অনেক সময় আগে থেকে বুঝা যায় না। দৃষ্টান্ত তো আছেই তুরস্কের কামাল পাশা কর্তৃক খেলাফত উচ্ছেদের ইতিহাস। একাত্তরে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতার কথাও বলা যায়। তবে পাকিস্তান এখনও খুব বেশী ধর্মাচ্ছন্ন। এটা তাকে চিন্তার ক্ষেত্রে খুব বেশী পিছিয়ে রেখেছে। চিন্তায় অগ্রগমন না হলে বাস্তবে অগ্রগমন ঘটবে কী করে?
আমার অভিজ্ঞতা থেকেই আমি শেষ পর্যন্ত যে উপলব্ধিতে পৌঁছেছি তা হল চিন্তার জগতে ভারতবর্ষে বাংলাদেশই সবচেয়ে এগিয়ে আছে। এখানে অনেক সমস্যা আছে। সেটা সামাজিক ক্ষেত্রে এবং চিন্তার জগতেও। সেসব সমস্যার অনেকগুলিই পর্বত প্রমাণ। যেমন ধর্মের সমস্যা। তা সত্ত্বেও চিন্তার জগতে সেগুলিকে অতিক্রম করবার আকাঙ্ক্ষা এবং স্পর্ধাও যত সামান্যই হোক উপমহাদেশে এখানেই সর্বাপেক্ষা দৃশ্যমান। আর এ কথাও তো সত্যি, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি থেকে এবং যুক্তি ও প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ সহকারে ইতিহাসের নামে পাশ্চাত্যের প্রতিষ্ঠিত ভুয়া তত্ত্বকে এখানেই আমরা সাহসের সঙ্গে নস্যাৎ করেছি এবং দিয়েছি ঋগ্বেদের যৌক্তিক ব্যাখ্যা। এবং সেটার সমর্থনে এখানে শিক্ষিত মহলের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ নানানভাবে আমাদেরকে সমর্থন যুগিয়েছে, উৎসাহ দিয়েছে। যাইহোক, সামগ্রিক বিচারে সমগ্র বঙ্গ এবং উপমহাদেশের মধ্যে এখন আমি বাংলাদেশ থেকেই নবজাগরণের সূচনার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশী দেখতে পাই। বিশেষ করে ঋগ্বেদ অধ্যয়ন এবং তার প্রকৃত মর্মার্থ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টাকে কেন্দ্র করে আমার যে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা সেটা আমাকে এই উপলব্ধিতে পৌঁছাতে প্রভূত পরিমাণে সাহায্য করেছে।