‘কেস-স্টাডি ঋগ্বেদ এবং পাশ্চাত্য ও ভারতবর্ষের মূলধারার বুদ্ধিবৃত্তির স্বরূপ দর্শন’ নিবন্ধটিতে ৪ টি অংশ রয়েছে। যথা-
১) সূচনা পর্ব: কেস-স্টাডি ঋগ্বেদ এবং কিছু প্রশ্ন
২) পাশ্চাত্য এবং ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক বুদ্ধিবৃত্তির সমস্যা: সাম্রাজ্যবাদ এবং উপনিবেশবাদের ভূমিকা
৩) পাশ্চাত্য পাণ্ডিত্যের মূর্খতা কিংবা বদমায়েশী এবং উপমহাদেশীয় পাণ্ডিত্যের দাসত্ব এবং
৪) সমাপ্তি পর্ব: বাংলাদেশ, ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে একটি সংক্ষিপ্ত তুলনামূলক পর্যালোচনা।
(১) সূচনা পর্ব: কেস-স্টাডি ঋগ্বেদ এবং কিছু প্রশ্ন
মানুষ তার নিজ জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে জীবনের নিয়ম কিংবা সত্যগুলিকে সবচেয়ে ভালভাবে বুঝতে পারে। জীবনের একটা বিরাট দিক সম্পর্কে আমি কীভাবে নূতন উপলব্ধিতে পৌঁছেছি সেই বিষয় তুলে ধরবার জন্য ঋগ্বেদ পাঠ সংক্রান্ত আমার নিম্নোক্ত বিবরণ যাকে একটি কেস-স্টাডি বলা যায়।
সত্য কথা বলতে কী, ঋগ্বেদ পাঠের পূর্ব পর্যন্ত জ্ঞানী এবং পণ্ডিতদের সম্পর্কে আমার খুব উঁচু ধারণা ছিল। মানুষ মাত্র ভুল করতে পারে। সুতরাং পণ্ডিতরাও ভুল করতে পারেন বলে মনে করতাম, যা এখনও মনে করি। তবে আমার ধারণা ছিল জ্ঞানী বা জ্ঞানের সাধকরা সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী সত্যান্বেষী বা সত্য সাধক হন। সুতরাং মনে করতাম তারা যেমন সত্যকে জানবার পর সেটাকে গ্রহণ করবার সৎ সাহস রাখেন তেমন মনে করতাম মিথ্যাকে জেনেশুনে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য তারা কাজ করেন না। কিন্তু ঋগ্বেদ অধ্যয়ন এবং দীর্ঘকাল যাবৎ এ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আমার এ ধারণা পাল্টে যায়। বলা যায় এ সংক্রান্ত অভিজ্ঞতা ক্রমে আমার চিন্তার জগৎকেও অনেকাংশে উল্টেপাল্টে ফেলে। এখন মূল প্রসঙ্গে যাওয়া যাক।
ছেলেবেলা অর্থাৎ বিদ্যালয় জীবন থেকেই আমি ইতিহাসের প্রতি তীব্র আকর্ষণ অনুভব করতাম। সুতরাং ইতিহাসের বই-পত্র যেখানে যা পেতাম পড়ার চেষ্টা করতাম। এ ক্ষেত্রে আরও বেশী আকর্ষণ অনুভব করতাম বঙ্গ এবং ভারতবর্ষের ইতিহাসের প্রতি। ফলে ভারতবর্ষে ‘বহিরাগত আর্যদের আক্রমণ’ সংক্রান্ত সুপ্রসিদ্ধ এবং সুপ্রতিষ্ঠিত তত্ত্ব আমার না জানার কথা ছিল না। তাছাড়া স্কুলের পাঠ্য পুস্তকেও সে সময় এ সম্পর্কে লেখা থাকত। আর সবার মত আমিও মনে করতাম যে, আর্যরা ছিল যাযাবর, পশুপালক, শ্বেতকায়, উন্নতনাসা এবং ভারতবর্ষে বহিরাগত হানাদার। এই ধারণা নিয়ে আমি বড় হই। বহুকাল পর্যন্ত সম্পূর্ণ ঋগ্বেদ গ্রন্থ না পড়লেও তার মন্ত্রের কিছু বাছাই করা অংশ বিভিন্ন গ্রন্থে বা প্রবন্ধে পড়তাম। তা থেকে আর্যদের বর্বর মনে করতে অনেক সময় কষ্ট হলেও মনে হত এরা ছিল ‘বিশেষ ক্ষমতা’ বা ‘গুণের’ অধিকারী মানুষ, যারা বর্বর পশুপালক হলেও উন্নত চিন্তার অধিকারী হওয়ায় এভাবে উন্নত মন্ত্র রচনা করতে পেরেছিল। তবু প্রশ্ন একটা ছিল। কারণ বর্বর পশুপালকরা কীভাবে এত উন্নত সাহিত্য জ্ঞানের অধিকারী হতে পারে সেই প্রশ্ন যে কোনও বিচার-বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের মনে আসা স্বাভাবিক। এই প্রশ্নের একটা উত্তর পেলাম ১৯৭৬-৭৭ সালে যখন আমি ভারতীয় পণ্ডিত দামোদর ধর্মানন্দ কোসাম্বির ইংরাজীতে লেখা বিখ্যাত গ্রন্থ ‘অ্যান ইন্ট্রোডাকশন টু দি স্টাডি অব ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি’ (An Introduction to the Study of Indian History) পড়ি। কোসাম্বির মতে বহিরাগত, যাযাবর, বর্বর, পশুপালক আর্যরা ভারতবর্ষে প্রবেশের পর সিন্ধু সভ্যতাকে ধ্বংস করে এবং সেখানকার পণ্ডিতদেরকে বন্দী করে তাদেরকে দিয়ে আর্য বা বৈদিক ভাষায় মন্ত্র রচনা করায়। অর্থাৎ ঋগ্বেদ মূলত বহিরাগত আর্যদের নির্দেশে সিন্ধু সভ্যতার বন্দী পণ্ডিত বা ঋষিদের রচনা। ফলে এই সব মন্ত্র রচনায় সভ্য মন এবং জীবনের এমন ছাপ পাওয়া যায়। যেন তীব্র আবেদনময় এবং আবেগঘন মন্ত্র বা কাব্য রচনা আর বন্দী কারিগর বা মিস্ত্রীদের দিয়ে দালান বা প্রাসাদ নির্মাণ এক জিনিস! যাইহোক, তবু এমন একটা ব্যাখ্যা দিয়ে আমি আরও অনেক কাল নিজেকে তুষ্ট রাখতে পেরেছিলাম।
কিন্তু এই অবস্থার পরিবর্তন হল তখন যখন আমি ভারতবর্ষের সমাজ বিকাশের গতিধারা এবং সমস্যা বুঝবার জন্য তার শুরুর জায়গায় পৌঁছাতে চাইলাম। এ কথা জানা যে হিন্দুদের আদি ধর্মগ্রন্থ ঋগ্বেদ হচ্ছে ভারতবর্ষের সর্বপ্রাচীন লিখিত দলিল যা রচনার পর হতে আজ অবধি অপরিবর্তিত রূপে আমাদের নিকট পাঠযোগ্য হিসাবে বর্তমান আছে। অবশ্য হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ বেদ মোট চারটি ভাগে বিভক্ত। যথা. ঋক, সাম, যজুঃ এবং অথর্ব। এই চার বেদ মিলেই সমগ্র বৈদিক সাহিত্য। তবে মূল এবং সর্বপ্রাচীন বেদ হিসাবে ঋগ্বেদকেই সর্বাধিক মূল্য দেওয়া হয়। ঋগ্বেদের সামাজিক এবং এতিহাসিক গুরুত্বও অপরিমেয়। সুতরাং ভারতীয় সমাজের উৎসে পৌঁছাতে চেয়ে ঋগ্বেদ পড়তে শুরু করলাম। ১৯৯০ সাল ছিল আমার এক নূতন উপলব্ধির কাল। প্রণালীবদ্ধভাবে ঋগ্বেদ পড়তে গিয়ে সেই সময় বলা যায় আমি হতভম্বকর অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হলাম।
কোসাম্বির তত্ত্ব নিয়ে পড়তে গিয়েও আমি আমার এতকালের বিশ্বাসকে টিকিয়ে রাখতে পারছিলাম না। ঋগ্বেদ দশ মণ্ডলে বিভক্ত। আমি প্রথম মণ্ডল শেষ করলাম এই উপলব্ধি নিয়ে যে, কোসাম্বিও ঋগ্বেদকে বুঝতে ভুল করেছেন। এবং যে সকল পণ্ডিতের আর্য আক্রমণ তত্ত্বকে আমি এতকাল অভ্রান্ত জ্ঞান করতাম তারা যে সবাই ভ্রান্ত এই সিদ্ধান্ত নিয়ে আমি ঋগ্বেদের বাকী নয়টি মণ্ডলও পড়ে শেষ করলাম।
ঋগ্বেদ পড়তে গিয়ে এই বিষয় আমার কাছে স্পষ্ট হল যে, ঋগ্বেদ পশ্চাৎপদ, বর্বর, পশুপালক এবং যাযাবর মানুষদের গ্রন্থ তো নয়ই এমনকি বন্দী পণ্ডিত তথা পরাধীন মানুষদের দ্বারা লিখিত কোনও গ্রন্থও নয়। বরং ঋগ্বেদকে আমার মনে হল বিশেষ সামাজিক পটভূমিতে দাঁড়িয়ে স্বাধীন মানুষদের স্বাধীন কণ্ঠ থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে উচ্চারিত মন্ত্রসমষ্টি। শুধু তা-ই নয়, আমি এটির পিছনে দেখতে পেলাম ঋগ্বেদে সপ্তসিন্ধু হিসাবে বহুবার কথিত উত্তর-পশ্চিম ভারতবর্ষে অবস্থিত একটি সুউন্নত সভ্যতার ভিত্তিভূমিকে। সিন্ধু সভ্যতা আবিষ্কারের পর সেই ভিত্তিভূমিকে চিনতে অন্তত আমার কোনই কষ্ট হয় নাই।
সবচেয়ে বড় কথা ঋগ্বেদের কোনও মন্ত্র থেকেই আমি ঋগ্বেদ রচয়িতা ঋষি তথা আর্যদেরকে বহিরাগত মনে করবার কোনও কারণই খুঁজে পেলাম না। কারণ ঋগ্বেদের ঋষিরা ভুলেও কখনও নিজেদেরকে তথা তাদের জনগোষ্ঠীকে সপ্তসিন্ধু অঞ্চলে বহিরাগত বলেন নাই। বরং সপ্তসিন্ধু অঞ্চল যে তাদের মূল বাসভূমি সেটা তাদের মন্ত্রগুলি থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হল। অবশ্য সপ্তসিন্ধু বলতে যে ঋষিরা সিন্ধু, সরস্বতীসহ শুধু সাতটি নদী অথবা সাত নদীবিধৌত অঞ্চলকে বুঝাতেন তা নয়। সেখানে আরও অনেক কয়টি ছোটখাটো নদী ছিল। তবে কুভা বা কাবুল নদী কিংবা উত্তর ভারতের বৃহৎ নদী গঙ্গার উন্নত কূলের উল্লেখ (ঋগ্বেদ : ৬/৪৫/৩১ – ‘গঙ্গার উন্নত কূলের ন্যায় পণিগণের মধ্যে উচ্চস্থানে বৃবু অধিষ্ঠান করছিলেন।’) থেকে বুঝা যায় যে ঋগ্বেদের ঋষিদের বা বৈদিক জনগোষ্ঠীর আবাস সিন্ধু-পাঞ্জাবের বাইরেও প্রায় চতুর্পার্শ্বে আরও বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বিস্তৃত ছিল। এই সমগ্র অঞ্চল ছিল সিন্ধু সভ্যতার অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং ঋগ্বেদ পাঠে আমি নিশ্চিত হলাম যে ঋগ্বেদ রচয়িতা ঋষি বা আর্যরা সিন্ধু সভ্যতার অন্তর্ভুক্ত ভূভাগের অধিবাসী।
আমার কাছে এ বিষয়টাও প্রায় প্রথম থেকেই ধরা পড়ল যে, আর দশটি ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনের মত ঋগ্বেদও একটি ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের ফসল, যা সিন্ধু সভ্যতার পতনের সময় সেই সভ্যতার অধিবাসীদের দ্বারা সংগঠিত হয়। এর সঙ্গে বহিরাগত যাযাবর, পশুপালক, শ্বেতাঙ্গ আক্রমণকারীদের আক্রমণের এবং ভারতবর্ষে বহিরাগতদের সভ্যতা এবং প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠার কোনও সম্পর্কই নাই। সমগ্র ঋগ্বেদ পাঠে আমি বহিরাগত আর্য এবং স্থানীয় অনার্যদের মধ্যকার যুদ্ধের কোনও চিহ্নই খুঁজে পেলাম না। বরং এটা আমার কাছে স্পষ্ট হল যে, সিন্ধু সভ্যতার সঙ্কট কালে সামাজিক পরিবর্তনের প্রয়োজনে সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীদের একাংশ সমাজের বিদ্যমান ধর্মের সংস্কারের প্রয়োজন অনুভব করে। ধর্ম সংস্কার করতে গিয়ে ঋগ্বেদের ঋষিরা মন্ত্র রচনা করে। এভাবে তারা পুরাতন ধর্মের পরিবর্তে একটি নূতন ধর্মের জন্ম দেয়। এটা পরিণামে একটা গৃহযুদ্ধের দিকে সমাজকে নিয়ে যায়। ধর্মের আবরণে ঋগ্বেদ মূলত সেই গৃহযুদ্ধেরই দলিল।
ঋগ্বেদ আমার কাছে কোনও গালগল্পের সমষ্টি ছিল না। কারণ তাহলে এটাকে এভাবে হাজার হাজার বৎসর ধরে টিকিয়ে রাখবার কোনও তাড়নাই একটা সুবৃহৎ সমাজ বা জনগোষ্ঠী অনুভব করত না। যে বিরাট সামাজিক সংঘাতের অভিঘাতের ফলে ঋগ্বেদের সৃষ্টি সেটাই তাকে এভাবে কালজয়ী করেছে। সুতরাং ঋগ্বেদ ধর্মগ্রন্থ হলেও তা পাঠের সময় তার পিছনের সামাজিক সংঘাতের স্বরূপ বুঝবার উপরই আমি সর্বাধিক গুরুত্ব দিলাম।
ঋগ্বেদ পড়তে গিয়ে এই সত্যও আমার নিকট স্পষ্ট হল যে, সিন্ধু সভ্যতা দাঁড়িয়েছিল বিশেষ ধরনের এবং জটিল নদী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার উপর। আজ অবিশ্বাস্য মনে হলেও ঋগ্বেদের সাক্ষ্য অনুযায়ী জলকপাট বা স্লুইস গেট যুক্ত বাঁধ দিয়ে সিন্ধু সভ্যতার নদীগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করা হত। সভ্যতার শেষ পর্যায়ে নদী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়তে থাকলে ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠী নদী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার অবসান দাবী করে। কিন্তু জনগোষ্ঠীর অপর অংশ এই ব্যবস্থার পক্ষে থাকায় সভ্যতা বা সমাজ বিভক্ত হয়ে পড়ে। নদী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ছিল বিদ্যমান ধর্মের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং এর অবসান যারা চাইছিল তাদের জন্য বিদ্যমান ধর্মের সংস্কার ছিল অপরিহার্য। এই ধর্ম সংস্কারের ফসল হচ্ছে ঋগ্বেদ।
অনেকের নিকট সিন্ধু সভ্যতার কালে, যেটার নগর বা পরিণত পর্যায় শুরু হয়েছিল আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বৎসর পূর্বে, আজকের মত জলকপাট সংযুক্ত বাঁধ দ্বারা নদী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার অস্তিত্বকে অবিশ্বাস্য মনে হলেও আমি মোটেই অবিশ্বাস করি নাই। কারণ ধর্মগ্রন্থ হলেও ঋগ্বেদকে আমি যেমন গাল-গল্পের সমষ্টি মনে করি নাই তেমন আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর কিংবা তারও আগের মানুষের প্রযুক্তিগত সামর্থ্যকে অবিশ্বাস করি নাই। দৃষ্টান্ত হিসাবে তো আছেই পাঁচ হাজার বৎসর পূর্বে মিসরের পিরামিডের বিস্ময়কর এবং আপাত দৃষ্টিতে অবিশ্বাস্য মহানির্মাণ। ঐ কালে তামা ও ব্রোঞ্জের হাতিয়ার দিয়ে যদি বহুদূরবর্তী স্থানের পাহাড় থেকে পাথরের বিশাল সব চাঁই কেটে এনে মিসরের পিরামিডগুলি নির্মাণ করা সম্ভব হয়ে থাকে তবে সিন্ধু উপত্যকার নদীগুলিতেও জলকপাট সংযুক্ত বাঁধ দিয়ে সেগুলির জল প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ দ্বারা সিন্ধু সভ্যতায় উন্নত জলসেচ ব্যবস্থা গড়ে তুলা সম্ভব হবে না কেন? না, আমি ঋগ্বেদের ঋষিদের বর্ণিত নদী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে যেমন বিস্ময়কর মনে হলেও অবিশ্বাস করি নাই তেমন সিন্ধু সভ্যতার কাল প্রেক্ষিতে সুউন্নত প্রযুক্তিগত সক্ষমতাকেও খাটো করে দেখি নাই।
যাইহোক, ঋগ্বেদ পাঠে আমার নিকট এটি স্পষ্ট হল যে, নদী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে সিন্ধু সভ্যতায় যে বিবাদ ঘটে তা গৃহযুদ্ধে পরিণত হয় এবং এই গৃহযুদ্ধের প্রক্রিয়ায় বৈদিক পক্ষের ঋষিদের রচিত মন্ত্রের সংকলন হচ্ছে ঋগ্বেদ।
সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারসমূহের উপর আমার ধারণা তখনও পর্যন্ত ছিল খুব প্রাথমিক পর্যায়ের। তখনও পর্যন্ত সিন্ধু সভ্যতার যেটুকু প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার হয়েছিল সে সংক্রান্ত বইপত্র বা তথ্যাদি বাংলাদেশে ছিল না বলাই সঙ্গত। বড় জোর ১৯৭০-এর দশকের কিছু আবিষ্কার পর্যন্ত আমার জানা বা পড়া ছিল। ইতিমধ্যে যে আরও অনেক আবিষ্কার হয়েছে যেগুলি আমার ধারণাকে অনেক বেশী শক্ত ভিত্তি দান করতে পারে তা আমার জানা ছিল না। তবু আমি আমার নূতন উপলব্ধির ভিত্তিতে একটা আলোচনার সূত্রপাত ঘটাতে চাইলাম। সুতরাং ঋগ্বেদ এবং সিন্ধু সভ্যতার যোগসূত্র সম্পর্কে আমি আমার প্রাথমিক উপলব্ধি এবং সিন্ধু সভ্যতার উপর পঠিত এবং লভ্য কিছু সংখ্যক বইয়ের উপর নির্ভর করে ১৯৯০ সালে লিখলাম ‘ভারত-ইতিহাসের সূত্র সন্ধান’। অর্থাৎ ঋগ্বেদ পাঠ সম্পূর্ণ করার পর আর বেশী দেরী না করে প্রত্নতত্ত্ব সংক্রান্ত যেটুকু তথ্য হাতের কাছে ছিল তাই নিয়ে লিখতে শুরু করি। আমার লেখাটি হল তাই মূলত ঋগ্বেদের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ভিত্তিক। সেই সঙ্গে সিন্ধু সভ্যতার বৃহৎ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সঙ্গে মহাভারতের বীজ কাহিনীর সঙ্গতি দেখতে পাওয়ায় মহাকাব্য মহাভারতের প্রসঙ্গকেও এই লেখায় আনলাম।
এর পর দুই বঙ্গের পণ্ডিত মহলে বইটির পাণ্ডুলিপির ফটোকপি নিয়ে কিছু ঘোরাঘুরি করে বুঝলাম যে লাভ হবে না। ভেবেছিলাম যে আর কিছু না হোক একটা আলোচনার সূত্রপাত ঘটাতে পারব। ভাবলাম বাংলাদেশে না হোক পশ্চিম বঙ্গে অন্তত কিছু সাড়া বা উৎসাহ পাব আমার যুক্তির অভিনবত্ব এবং শক্তির কারণে। কিন্তু বুঝলাম সেখানকার অবস্থা বাংলাদেশের চেয়ে সুবিধার নয়, বরং আরও অনেক করুণ। পাশ্চাত্যের পণ্ডিতবর্গ যা বলেছে তার বাইরে চিন্তার ক্ষমতা তাদের নাই, ফলে তার বাইরে কোনও জিজ্ঞাসাও নাই।
বুঝলাম যে বাংলা ভাষায় হবে না। উভয় বঙ্গের শিক্ষিত পণ্ডিতবর্গ যাদেরকে কর্তা বা গুরু বলে ভজনা করে সেই ইংরেজ প্রভুদের ভাষায় না লিখলে হবে না। তাছাড়া ভারতবর্ষে বহিরাগত আর্য আক্রমণ তত্ত্ব যারা প্রতিষ্ঠা করেছেন কিংবা আজও প্রচার করে চলেছেন সেই পাশ্চাত্য পণ্ডিতরাও হয়ত সত্যান্বেষী জ্ঞান সাধক হিসাবে ঋগ্বেদের সঠিক ব্যাখ্যায় অনুপ্রাণিত হবেন।
এখানে উল্লেখ করা উচিত হবে যে, আমার নূতন উপলব্ধির সঙ্গে প্রথম থেকেই একমত হয়েছিলেন শামসুল আলম চঞ্চল। ঋগ্বেদ পাঠের পরই এ সংক্রান্ত প্রচুর আলোচনা তার সঙ্গে হয়। পেশায় প্রকৌশলী (যান্ত্রিক) হলেও তার ছিল বিভিন্ন বিষয়ের উপর ব্যাপক অধ্যয়ন এবং সেই সঙ্গে সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতত্ত্বের উপর কিছু পড়াশুনা। এবং ছিল উন্মুক্ত মন। সুতরাং তার সঙ্গে আলোচনা আমাকে খুব সাহায্য করে।
যাইহোক, ‘ভারত-ইতিহাসের সূত্র সন্ধান’ অপ্রকাশিত রয়ে গেল। এই গ্রন্থ লিখবার চাপে যেমন আমি অবসন্ন ছিলাম তেমন দুই বঙ্গ বিশেষত পশ্চিম বঙ্গে বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনার ফলাফলে আমি যথেষ্ট হতাশ এবং তিক্তও হয়েছিলাম। আর একটা লেখা লিখবার উৎসাহ, ধৈর্য এবং শক্তি আমার ছিল না। সুতরাং চঞ্চলকে ইংরাজীতে একটা প্রবন্ধ লিখবার দায়িত্ব নিতে বললাম। ভাবলাম যে ইংরাজীতে লিখে বাইরের পৃথিবীর পণ্ডিত মহলে মতামতের জন্য পাঠানো যাবে। চঞ্চল রাজী হলেন।
ইতিমধ্যে তিনি বিভিন্নভাবে সিন্ধু সভ্যতার সাম্প্রতিক কিংবা সর্বশেষ আবিষ্কার সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু করেন। সেই সময় তিনি চট্টগ্রামে টিএসপি কমপ্লেক্স লিমিটেড নামে রাষ্ট্রায়ত্ত সার কারখানায় অ্যাসিস্ট্যান্ট মেকানিক্যাল ইঞ্জিনীয়ার হিসাবে কর্মরত ছিলেন। ১৯৯২ সালে তিনি পাকিস্তান আর্কিওলজি এন্ড মিউজিয়াম্স (Pakistan Archaeology and Museums)–এর বর্তমানে সাবেক মহাপরিচালক ডঃ মোহাম্মদ রফিক মোগলের নিকট পাকিস্তান প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত তথ্য এবং বইপত্র কীভাবে পাওয়া যাবে তা জানতে চেয়ে চিঠি পাঠান। তার পেশাগত পরিচয় দিয়ে তিনি যে এ ব্যাপারে কাজ করতে ইচ্ছুক সেটাও জানান। ১৯৯৩ সালের জানুয়ারীতে ডঃ মোগল সিন্ধু সভ্যতার উপর তার নিজের লিখা ১৩টি প্রবন্ধ চঞ্চলের নিকট পাঠান যেগুলি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জার্নাল এবং সংকলন গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছিল। এগুলি ছিল সিন্ধু সভ্যতার উপর অমূল্য প্রত্নতাত্ত্বিক রিপোর্ট এবং মূল্যায়ন। বাংলাদেশের মত একটা পিছিয়ে থাকা দেশের এক অজ্ঞাত-অখ্যাত এবং ইঞ্জিনীয়ারিংয়ের মত ভিন্ন পেশার গবেষকের জন্য তার এই আগ্রহ এবং উৎসাহকে চঞ্চল বা আমার পক্ষে কখনই ভুলা সম্ভব না।
যাইহোক, সিন্ধু সভ্যতার সেই সময়ের বিচারে সর্বশেষ কিংবা সাম্প্রতিক বহু পরিমাণে তথ্য দ্বারা সমৃদ্ধ হয়ে এবং আমার সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে শামসুল আলম চঞ্চল ইংরাজীতে ১৯৯৪ সালে ‘দি ইন্ডাস সিভিলাইজেশন অ্যান্ড দি এরিয়ান্স’ (The Indus Civilization and the Aryans) নামে একটি প্রবন্ধ লিখে ভারত, পাকিস্তান, ব্রিটেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাঁচজন পণ্ডিতের নিকট মতামতের জন্য পাঠালেন। এরা হলেন, ভারতের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতির অধ্যাপক বি এন মুখার্জী, ভারতের গোয়ায় অবস্থিত মেরিন আর্কিওলজি সেন্টারের পরামর্শক ডঃ এস আর রাও, পাকিস্তানের প্রত্নতত্ত্ব ও যাদুঘরের মহাপরিচালক ডঃ মোহাম্মদ রফিক মোগল, যুক্তরাজ্যের সেন্টার ফর সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ, কেমব্রিজের অধ্যাপক এফ আর অলচিন এবং যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ এশিয়া রিজিওনাল স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক গ্রেগরি এল পোশেল।
এটা ছিল প্রকৃতপক্ষে আমাদের নূতন পথে যাত্রা শুরুর ঘটনা। চঞ্চলের লেখাটি পড়ে ১৯৯৪ সালের সেপ্টেম্বরে ডঃ মোগল চঞ্চলের কাজটিকে একটি সফল প্রয়াস হিসাবে উল্লেখ করে তার অফিসিয়াল প্যাডে একটি চিঠি লিখে পাঠান। তিনি যে শুধু কাজটিকে সফল প্রয়াস বললেন তা-ই নয়, অধিকন্তু তিনি তার পত্রে এটিকে যত শীঘ্র সম্ভব প্রকাশেরও তাগিদ দেন।[1] এটি ছিল আমাদের জন্য বিশাল ঘটনা। কারণ সেই সময়ে ডঃ মোগল শুধু যে পাকিস্তানের প্রত্নতত্ত্ব ও যাদুঘর বিভাগের প্রধান বা মহাপরিচালক ছিলেন তা-ই নয়, উপরন্তু তিনি সিন্ধু সভ্যতার উপর একজন শ্রেষ্ঠ বিশেষজ্ঞ পণ্ডিত বা অথরিটি হিসাবে বর্তমান বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত। যারা সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতত্ত্ব বা পুরাতত্ত্ব সম্পর্কে একটু ভাল রকম খোঁজখবর রাখেন তারা সবাই রফিক মোগলের মর্যাদা সম্পর্কে জানেন। তিনি যে শুধু মাঠ পর্যায়ে প্রচুর খনন কাজ তথা আবিষ্কার করেছেন তা-ই নয়, উপরন্তু সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতত্ত্বের ক্ষেত্রে নূতন ধারণাগত কাঠামো নির্মাণেও মৌলিক ভূমিকা রেখেছেন।
স্বাভাবিকভাবে মোগলের সমর্থনসূচক পত্র আমাদের জন্য বিরাট প্রেরণাদায়ী ঘটনা ছিল। তবে চঞ্চলের প্রবন্ধ এবং চিঠির প্রেক্ষিতে অন্য পণ্ডিতদের ক্ষেত্রে আমাদের আরও কিছু অভিজ্ঞতা ঘটেছিল যেগুলির আলোচনা এখানে আপাতত অনুল্লিখিত রইল।
যাইহোক, মোগলের চিঠি যে আমাদেরকে বিরাটভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল সে কথা বলেছি। এই চিঠি পাবার পর চঞ্চল এবং আমি যৌথভাবে একটি বই লিখবার প্রয়োজন অনুভব করি। অতঃপর ‘দি ইন্ডাস সিভিলাইজেশন অ্যান্ড দি এরিয়ান্স’-কে (The Indus Civilization and the Aryans) ভিত্তি করে আমরা যৌথভাবে ‘দি এরিয়ান্স অ্যান্ড দি ইন্ডাস সিভিলাইজেশন’ (The Aryans and the Indus Civilization) নামে ইংরাজীতে একটি বই লিখি। এটি ১৯৯৫ সালে ঢাকার ‘দিন-রাত্রি প্রকাশনী’ থেকে প্রকাশিত হয়। এবার আমরা পৃথিবীর জ্ঞানের জগতের দরজায় কড়া নাড়বার মত শক্তি পেলাম। অনেক কষ্ট করে নাম-ঠিকানা যোগাড় করে পাকিস্তান, ভারত, ব্রিটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ফ্রান্স, জার্মানী, ইটালী এবং ফিনল্যান্ড এই ৯টি দেশের বেশ কিছু সংখ্যক প্রত্নতত্ত্ববিদ এবং ঐতিহাসিক বা পণ্ডিতের কাছে আমরা আমাদের বইটি পাঠালাম।
এরপরের অভিজ্ঞতা কিছু ব্যতিক্রম বাদে নূতন করে তেমন ইতিবাচক যে ছিল না সে কথা বলা যায়। তবে একটা লক্ষ্যণীয় বিষয় হল সাধারণভাবে পাশ্চাত্য পণ্ডিতবর্গের আমাদের বক্তব্যকে গুরুত্ব না দিবার প্রবণতা। প্রাপ্তি স্বীকারের পর কেউ কেউ চিঠির উত্তর দিয়ে বই পড়ার পর মতামত জানাতে চাইলেও সেই মতামত আর কোনও কালেই আসে নাই। তবে বেশীর ভাগ পণ্ডিত বইটা পেয়েছেন কিনা সেটাও জানান নাই। জানি না তারা বই পেয়েছিলেন কিনা। বাংলাদেশের ডাক বিভাগের উপর আস্থা রাখাও তো কঠিন। তবে বই পাবার আগে চিঠিপত্র আদান-প্রদানে যে ২/১ জন পণ্ডিত উৎসাহ দেখিয়েছিলেন এবং এমনকি জিম জি শেফার (Jim G. Shaffer)-এর মত আমেরিকান পণ্ডিত তাদের মূল্যবান লেখা পাঠিয়ে আমাদেরকে সাহায্য করেছিলেন The Aryans and the Indus Civilization পাঠাবার পর তাদের কাছ থেকেও আর কোনও চিঠি কিংবা মতামত পাওয়া যায় নাই। অবশ্য বইটা পড়বার পর আমেরিকান পণ্ডিত গ্রেগরি এল পোশেল একটা চিঠি লিখে আমাদের বই থেকে যে অনেক কিছু জেনেছেন সেটা জানিয়ে আমাদেরকে একটা সৌজন্যমূলক চিঠি দেন। কোনও মতামত না দিলেও আমাদের মত অজ্ঞাত, অখ্যাত এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক গবেষকদের প্রচলিত ধারণা-বিরুদ্ধ বই পাঠের পর তার মাপের একজন প্রাতিষ্ঠানিক পণ্ডিত কর্তৃক এটুকু জানিয়ে একটা চিঠি লিখা আমাদের বক্তব্যের জন্য ইতিবাচক না হলেও আমাদের জন্য সম্মানের ছিল। আমাদেরকে কোনও মতামত না দিলেও আন্তরিকতার সঙ্গে একটা চিঠি লিখবার কষ্টটুকু তিনি করেছিলেন।
যাইহোক, ইউরোপীয় বা পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের দিক থেকে ইতিবাচক সাড়া না পেলেও ভারতীয় পণ্ডিতদের দিক থেকে সাড়া পাবার আশা করেছিলাম। সে দিক থেকেও যে তেমন ইতিবাচক কিছু ছিল না সে কথা বলা যায়। আমার আলোচনাকে এ প্রসঙ্গে আর দীর্ঘায়িত করতে না চেয়ে আমি এ কথা বলি যে, ইংরাজী বইটার প্রকাশ এবং কিছু প্রচারের পর এবার আমরা বাংলায় এই বিষয়ের উপর একটা বই লিখবার প্রয়োজন অনুভব করি। এরপর চঞ্চল বইপত্র সংগ্রহ এবং পন্ডিতদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলবার জন্য ২০০০ সালে ভারতের রাজধানী দিল্লীতে যান। সেখানে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ব্রজদুলাল বা (সংক্ষেপে) বি ডি চট্টোপাধ্যায়ের পরামর্শে ভারতের বিখ্যাত বেদ পণ্ডিত এবং ‘ভেদিক হরপ্পান্স’ (Vedic Harappans) নামে সুবৃহৎ এবং সমৃদ্ধ গ্রন্থের লেখক ভগবান সিং এবং ভারতের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের তৎকালীন মহাপরিচালক আর এস বিশ্ট্-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। আর্য আক্রমণ তত্ত্ব বিরোধিতার প্রশ্নে তারা চঞ্চলের সঙ্গে মতৈক্য প্রকাশ করেন।
অবশ্য পরবর্তী সমযে আমাদের লিখা The Aryans and the Indus Civilization পড়বার পর ভগবান সিং তার লিখিত পত্রে বইটির উপর মতামত জানাতে গিয়ে আর্যরা যে সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসী আমাদের এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত হলেও আমরা যেভাবে ধর্মসংস্কার আন্দোলনের ফসল হিসাবে ঋগ্বেদকে দেখেছি তার প্রতি তার আপত্তি জানিয়েছিলেন। তার অভিযোগ ছিল যে আমরা সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংসের জন্য বৈদিক আন্দোলনকে দায়ী করেছি। আসলে আমাদের ব্যাখ্যা বা বক্তব্য অনুযায়ী নদী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার ক্রমবর্ধমান ব্যর্থতার ফলে এমনিতে সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংসের দিকে এগিয়ে চলেছিল। তবে নদী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার ধ্বংস সাধন দ্বারা সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংস ত্বরান্বিত করবার ক্ষেত্রে বৈদিক আন্দোলনের ভূমিকা চলে আসে। কিন্তু তার মতো পণ্ডিতদের মতে সিন্ধু সভ্যতার শুরু থেকেই বৈদিক ঋষিরা তার প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্বমূলক বা উদ্যোগী ভূমিকা রাখবার অংশ হিসাবে মন্ত্র রচনা করেছিলেন। Vedic Harappans-এ তিনি এই ব্যাখ্যা বা অভিমতই দিয়েছেন। সুতরাং তিনি সভ্যতার ধ্বংসে বৈদিক ঋষিদের কোন ভূমিকা দেখতে পান নাই। বরং এর জন্য তিনি জলবায়ু পরিবর্তনকেই দায়ী হিসাবে দেখেছেন।
আমার জানা মতে ভগবান সিং একজন মার্কসবাদী। সুতরাং তাকে হিন্দুত্ববাদী বলা কঠিন। কিন্তু ভারতের হিন্দুত্ববাদীরা যারা বর্তমানে পাশ্চাত্যের ঋগ্বেদ ব্যাখ্যার বিপরীতে আর্যদেরকে সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসী বলছেন তারা ঋগ্বেদের যে ব্যাখ্যা দিচ্ছেন সেটা মূলত এই ব্যাখ্যার অনুরূপ কিংবা কাছাকাছি। ঋগ্বেদ ব্যাখ্যার এই দৃষ্টিভঙ্গীকে আমরা হিন্দুত্ববাদী বলতে পারি। এই দৃষ্টিভঙ্গীর নিকট ঋগ্বেদের মন্ত্র রচনার পিছনে নির্দিষ্ট কাল প্রেক্ষিত এবং সামাজিক তাড়না কিংবা সামাজিক সংঘাতের স্বরূপ খুঁজবার গুরুত্ব নাই। একইভাবে এই দৃষ্টিভঙ্গীর অধিকারী পণ্ডিতরা সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংসে বৈদিক আন্দোলন তথা বৈদিক ঋষিদের দায়কেও মানতে রাজী নন। একই কারণে তারা নদী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কিংবা জলকপাট এবং বাঁধ ধ্বংসের উদ্দেশ্যে দেবতাদের নিকট প্রার্থনার জন্য রচিত কিংবা এগুলির ধ্বংসের বর্ণনায় রচিত মন্ত্রগুলির সহজ অর্থ কিংবা ব্যাখ্যাকেও এড়িয়ে যেতে কিংবা অস্বীকার করতে চান। এভাবে তারা ঋগ্বেদের মূল তাৎপর্যকেই গুলিয়ে ফেলেন।
পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের দ্বারা উদ্ভাবিত আর্য আক্রমণ তত্ত্বকে গ্রহণ না করলেও হিন্দুত্ববাদীরা ঋগ্বেদের তেমন কোনও যুক্তিসঙ্গত বা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিতে পারেন না তাদের এই দৃষ্টিভঙ্গীর কারণে। যাইহোক, এটি একটি দৃষ্টিভঙ্গী যা ক্রমবর্ধমান প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারের ফলে বিশেষত প্রত্নতাত্ত্বিকদের দ্বারা ভারতবর্ষে বহিরাগত আর্য আক্রমণ তত্ত্ব যত বেশী প্রত্যাখ্যাত কিংবা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে তত বেশী জায়গা করবার চেষ্টা করছে। তবে এই দৃষ্টিভঙ্গীর ত্রুটি এবং অবৈজ্ঞানিকতার কারণে ঋগ্বেদের বহু ধাঁধার উত্তর এই ধারার পণ্ডিতদের পক্ষে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ফলে তাদেরকে ঋগ্বেদের ব্যাখ্যায় প্রভূত পরিমাণে গোঁজামিল দিতে কিংবা অস্পষ্টতা রাখতে হচ্ছে। এটা একটা কারণ যার ফলে তারা আজ অবধি আর্য আক্রমণবাদীদেরকে সফলভাবে মোকাবিলা করতে পারছেন না।
এটা ঠিক যে, একটি সামাজিক সংঘাতের কালে ঋগ্বেদের মূল অংশ রচিত হলেও তাতে তার পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী কালেরও কিছু মন্ত্রের স্থান পাওয়া অস্বাভাবিক নয়। যেহেতু বৈদিক আন্দোলন প্রচলিত বা বিদ্যমান ধর্মের সংস্কারের লক্ষ্য নিয়ে সংগঠিত হয়েছিল সেহেতু এখানে প্রচলিত ধর্মের অনেক প্রথা বা নিয়মকে যে মেনে নিতে হয়েছিল সেটা বোধগম্য। কারণ সাধারণত পুরাতন ধর্মের সংস্কারের মাধ্যমে নূতন ধর্ম প্রতিষ্ঠার সময় আদি ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব এবং তার প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেই কাজটা করা হয়। আদি ধর্মের মূল জায়গা থেকে বিদ্যমানরা সরে গেছে এমন অভিযোগ করে কিংবা এ ধরনের অজুহাত দিয়েই সচরাচর ধর্মসংস্কারকরা কাজটা করেন। স্বাভাবিকভাবে এই প্রক্রিয়ায় পুরাতন বা সনাতন ধর্মের কিছু উপাদান, উপাখ্যান এবং এমনকি কিছু সংখ্যক মন্ত্রও সংস্কারের মাধ্যমে সৃষ্ট নূতন ধর্মে জায়গা করে নিতে পারে। কিন্তু তা দিয়ে একটা সংস্কারের মধ্য দিয়ে নূতন ধর্ম প্রতিষ্ঠার বিশেষ সামাজিক এবং কাল প্রেক্ষিতকে বুঝতে ভুল করলে বুঝবার ক্ষেত্রে মারাত্মক বিচ্যুতি ঘটে। হিন্দুত্ববাদীদের ঋগ্বেদ ব্যাখ্যার ক্ষেত্রেও এই বিচ্যুতি ঘটেছে বলে আমি মনে করি। যে কারণে তারা প্রতিপক্ষের, বিশেষত আর্য আক্রমণ তত্ত্ববাদীদের, অনেক প্রশ্নের উত্তর দিতে সক্ষম নন। বস্তুত একটি সমাজের ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের ফসল হিসাবে ঋগ্বেদকে না দেখে পাশ্চাত্যের পণ্ডিতরা যেমন ঋগ্বেদের অপব্যাখ্যা দিয়েছেন তেমন হিন্দুত্ববাদীরাও সেভাবে না দেখায় ঋগ্বেদের সঠিক ব্যাখ্যা দিতে অক্ষম হয়েছেন।
যাইহোক, দীর্ঘদিন ধরে এবং দীর্ঘ প্রস্তুতি নিয়ে চঞ্চল এবং আমি যৌথভাবে লিখলাম ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’। এতদিনে পাণ্ডুলিপি হিসাবে রয়ে যাওয়া ১৯৯০-এ লিখা ‘ভারত-ইতিহাসের সূত্র সন্ধান’ও বহুল পরিমাণে কাজে লাগল। ততদিনে আমাদের হাতে সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারের সমৃদ্ধ তথ্য ভাণ্ডার। একদিকে আমাদের তথ্য ভাণ্ডারের সমৃদ্ধি এবং অপর দিকে আমাদের মাতৃভাষা বাংলায় লিখিত হওয়ায় ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’ নামক গ্রন্থটি নিয়ে আমরা মোটামুটি সন্তুষ্ট হলাম।
এখানে প্রসঙ্গক্রমে বলা যায় যে, বাংলাদেশ থেকে ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’ প্রকাশের পূর্বে পশ্চিম বঙ্গ থেকে প্রকাশের চেষ্টা করে আমি ব্যর্থ হয়েছিলাম। গ্রন্থটি প্রকাশের জন্য সেখানে আগ্রহী প্রকাশক না পাবার পর এটি বাংলাদেশ থেকে প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিই। ততদিনে (২০০২ সালে) মূলত আমার উদ্যোগে প্রতিষ্ঠা করেছি প্রকাশনী সংস্থা ‘ব-দ্বীপ প্রকাশন’। গ্রন্থটি ঢাকা থেকে ব-দ্বীপ প্রকাশন কর্তৃক প্রকাশিত হল ২০০৩ সালের জানুয়ারীতে।
আমরা এইটুকুতে থেমে থাকি নাই। ২০০৬ সালে ওয়েবসাইট ‘বঙ্গরাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠা করলে সেখানে ইংরাজী গ্রন্থ The Aryans and the Indus Civilization এবং বাংলা গ্রন্থ ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’ প্রকাশিত হয়। এভাবে আগ্রহী অনলাইন পাঠকদের গ্রন্থ দুইটি পাঠের সুযোগ হয়। এছাড়া চঞ্চল এবং আমার যৌথভাবে লিখা ইংরাজী প্রবন্ধ Rediscovering Indus Civilization and Aryans: Journey to Our Renaissance ওয়েবসাইট বঙ্গরাষ্ট্রে ২০১২ সালের ৯ সেপ্টেম্বর তারিখে প্রকাশিত হয় এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পণ্ডিত, অধ্যাপক এবং গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন ব্যক্তির নিকট তার কপি অথবা লিঙ্ক দেওয়া হয়। এটির বংলা ‘নূতন দৃষ্টিতে সিন্ধু সভ্যতা ও আর্যজন : আমাদের নবজাগৃতির উদ্বোধন’ বঙ্গরাষ্ট্রে ২০১৫ সালের ১৯ জুলাইতে প্রথম প্রকাশিত হয়। মোট কথা আমরা থেমে থাকি নাই। দেশে এবং দেশের বাইরে বিভিন্ন সময়ে আমরা ইতিহাসের নামে এক বিরাট মিথ্যাকে নাকচ করে ইতিহাসের সত্যকে তুলে ধরবার কাজ করে আসছি। যদি ১৯৯০ থেকে ধরা যায় তবে আমরা ২০১৮ পর্যন্ত ২৭ বৎসরের অধিকাল কিংবা প্রায় ২৮ বৎসর ধরে একটা সত্যকে প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করে আসছি।
এই সমগ্র সংগ্রামে অনেক ঘটনা আছে। বিশেষত কিছু সংখ্যক ভারতীয় পণ্ডিতের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংলাপ যেমন হয়েছে তেমন কিছু সংখ্যক পণ্ডিতের সঙ্গে পত্রালাপও হয়েছে। অনেক বিরোধিতার ইতিহাস যেমন আছে তেমন বিভিন্ন ধরনের সমর্থন এবং উৎসাহের ইতিহাসও আছে। কিন্তু যেখান থেকে যতটুকু সমর্থন পাওয়া যাক বাস্তব হচ্ছে ভারতবর্ষ তথা ভারতীয় উপমহাদেশে আর্য আক্রমণ তত্ত্বের মত একটা হাস্যকর, উদ্ভট এবং মিথ্যা তত্ত্ব আজও সমগ্র উপমহাদেশের জ্ঞানের জগৎকে অধিকার করে আছে। শুধু তা-ই নয়, এটা এখনও পৃথিবী ব্যাপী আর্য সংক্রান্ত যাবতীয় তত্ত্বের মূল ভিত্তি হয়ে আছে। অথচ বিগত প্রায় শতাব্দী কালের সমস্ত প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার ভারতবর্ষে বহিরাগত আর্য আক্রমণ তত্ত্বকে নাকচ করে দিয়েছে। বস্তুত এখন প্রত্নতত্ত্বে আর্য আক্রমণ তত্ত্বের কোনও গুরুত্বই নাই। কারণ প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারগুলি দ্বারা বেশ কিছুকাল যাবত নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, এ ধরনের কোনও বহিরাক্রমণ বা বহিরাগমনই যে সময়টাতে আর্য অভিগমন ঘটবার কথা বলা হয় (খ্রীষ্টপূর্ব ১২০০ থেকে খ্রীষ্টপূর্ব ১৫০০ সাল পর্যন্ত সময় সীমার মধ্যে) সে সময়টাতে ঘটে নাই। শুধু তা-ই নয় বহিরাগমন ঘটলে ভারতবর্ষের উত্তর এবং পশ্চিম অঞ্চলে যে ধরনের নৃতাত্ত্বিক ছেদের প্রত্নতাত্ত্বিক চিহ্ন পাওয়া যেত সেটা সাড়ে ছয় হাজার বছর পূর্বকাল থেকে শুরু করে খ্রীষ্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দী কাল পর্যন্ত পাওয়া যায় না। এই কারণে অনেক প্রত্নতত্ত্ববিদ ইদানীং ভারতবর্ষে আর্য বা যে নামই দেওয়া যাক এ ধরনের কোনও বহিরাগমন তত্ত্বকেও আর মেনে নিতে পারছেন না। তবু তাকে প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান ও শিক্ষার জগৎ থেকে ছুঁড়ে ফেলা যাচ্ছে না। শুধু তা-ই নয়, আজ অবধি এটাই ভারতবর্ষ তথা ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস ব্যাখ্যার ভিত্তি হয়ে আছে। কিন্তু কেন? এখন সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজা যাক।
চলবে…
টীকা:
[1] এই কেস-স্টাডির জন্য ডঃ মোগলের চিঠিটির বিশেষ গুরুত্ব আছে। সুতরাং আগ্রহী পাঠকদের জন্য এখানে সেটা পুরোটা স্ক্যান করে দেওয়া হয়েছে।