বিশ্বাস করুন,আমি ওরকম নই!আমি কোনো পাপ করি নি।আমাদের বিয়ে হয়েছে, ও-ই আমার স্বামী।এখন ও আমাকে অস্বীকার করছে -ই….ই এই বেশ্যা,মাগী নাকি আমার বউ! এর কথা একদম বিশ্বাস করবে না। আমার সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই।কাল রাতে বিপদে পড়ে, আমাকে কাল রাত টুকুর জন্য থাকতে দিতে বলেছিল।আমার মনে মায়া হলো,ভাবলাম বিপদে মানুষের উপকারতো করতেই হয়।ওমা!তারপর দেখি এ কেস তো গন্ডগোল
আশেপাশের প্রতিবেশীরা…..
-ছি-ছি এসব কি হচ্ছে আমাদের এখানে? এসব নোংরামি আমরা কিছুতেই সহ্য করবো না
-ঘাড় ধরে মেয়েটাকে বের করে দে
হাত জোড় করে কাঁদতে কাঁদতে চম্পা বলে উঠলো-আপনারা বিশ্বাস করুন,আমি কোনো নোংরামি করি নি।ও আমাকে বিয়ে করে এখানে নিয়ে এসেছে,আমার পেটে ওরই বাচ্চা।ওকে এই কথাটা জানাতেই,ও রেগে গিয়ে এসব করছে
এক প্রতিবেশী জিজ্ঞেস করলেন-বেশ তো,বুঝলাম রতন তোমায় বিয়ে করেছে।তা প্রমাণ দিতে পারবে?মানে যারা সাক্ষী যে, তোমাদের বিয়ে হয়েছে,কিংবা ছবি?
চম্পা কাঁদতে কাঁদতে বলল-প্রমাণ তো কিছু নেই।আমরা তো পালিয়ে গিয়ে,কালীঘাটে বিয়ে করেছি।আমি বলেছিলাম তখন একটা ছবি তুলতে কিন্তু ওর ফোনে নাকি তখন চার্জ ছিল না
রতন-সব মিথ্যে! এ বাচ্চা আমার না।কার না কার সাথে শুয়েছে! এসব মাগীর তো আবার একজনের সাথে শুলে হয় না!
চম্পা-চুপ করো তুমি,এত বাজে কথা বললে, তোমার মুখ খসে পড়বে
রতন-আমার মুখ খোসবে না!দিন রাত কাদের সাথে ফুর্তি করেছে তার নেই ঠিক,এখন আমার ঘাড়ে বাচ্চার নাম চাপাচ্ছে,নষ্টা মেয়ে কোথাকার!
লক্ষ্মীকান্তপুরের খুব ছোট একটা গ্রাম ছাবনপুর।
সেদিন ছাবনপুর গ্রামে কেউ চম্পার সাথে সহানুভূতি দেখায় নি।আর দেখাবেই বা কেন?ওখানের সবাই রতনকে অনেক বছর ধরে চেনে।সে কলকাতায় কাজ করতে যায় সবাই জানে।যদিও কেউ জানে না রতন কলকাতায় কি কাজ করে।তাই বলে কখনো তার চরিত্র নিয়ে কোনো প্রশ্ন ওঠে নি।কখনো গ্রামের কোনো মেয়েদের দিকে সে কু-নজরে দ্যাখে নি।এদিকে সেদিনের সেই পোয়াতি চম্পাকে এর আগে কেউ কখনো দ্যাখে নি।তাছাড়া রতনের বিয়ে হয়েছে কেউ শোনেও নি।বরং গ্রামের যুধিষ্ঠির পালের মেয়ের সাথে রতনের বিয়ের কথা চলছিল,তবে তখনও কিছু ঠিক হয় নি।
সেদিন সবাই নানা রকম ভর্ৎসনা দিয়ে চম্পাকে গ্রাম ছাড়তে বাধ্য করে।চম্পা কোথায় যাবে ভেবে পাচ্ছিল না। কাঁচা রাস্তা পেড়িয়ে, পাকা রাস্তার ধারে বসে চম্পা দিশেহারার মতো আচরণ করছিল, হঠাৎ পিছন থেকে আওয়াজ এলো….
-তোমার ঘর কোথায়?
চম্পা পিছন ফিরে,তাকিয়ে বলল-কলকাতায়
-ও!ফিরে যাও কলকাতায়
-আমি ওখানে ফিরতে পারবো না।আমি ওর সাথে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে, কলকাতায় একটা বাড়িতে দুজনে লুকিয়ে ছিলাম।কিন্তু আমার বাড়ির লোকেরা আমাদের খুঁজে পেয়ে গিয়েছিল।তবে আমি তখন ওকে ছেড়ে যাই নি। বাড়ির লোকেরা আমায় আর মুখ দেখাতে বারণ করেছে।এখন আমি এই শরীরে কি করে মুখ দেখাবো ওদের
-তাহলে রতন তোমায় অস্বীকার করছে কেন?
-ও যে এত নোংরা লোক আমি আগে বুঝতেই পারিনি।এতদিন শুধু অভিনয় করেছে যে,আমায় ও ভালোবাসে,আসলে উদ্দেশ্য অন্য ছিল
-কি উদ্দেশ্য?
-আপনি বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ,আপনাকে কি করে বলবো…
-বলো ওর কি উদ্দেশ্যে ছিল?
-বিয়ের কদিন পর থেকেই ও আমাকে….
-কি!মার ধোর করতো?
-না! আমাকে অনেক লোকের সাথে আলাপ করাতো।বলতো ওর বন্ধু,কেউ ওর অফিসের পরিচিত।ও অনেকদিন ধরেই আমাকে গ্রামে আনতে চাইছিল।আমাকে বলেছিল, যখন আমরা গ্রামে থাকবো ,তখন ও যখন কাজের জন্য কলকাতায় থাকবে,সেই সময় মাঝে মধ্যে ওই লোকগুলো আসতে পারে তাঁদের ভালো করে যত্ন করতে আর…..আমি মুখে বলতে পারছি না।ও আসলে মেয়েদের দালাল।(কাঁদতে কাঁদতে) আমি ওকে ভালোবেসে সব ছেড়ে ছিলাম আর ও আমাকে এভাবে ঠকালো।আমি ওর সাথে খুব ঝগড়া করতাম এসব কথা নিয়ে।তারপর ও এসব নিয়ে আর কিছু বলতো না।আমি ভেবেছিলাম,হয়তো সব ঠিক হয়ে গেছে।ওখানে আমার শরীর খারাপ হওয়ায় এর আগে গ্রামে আসা সম্ভব হয় নি।পরশু আমরা এই গ্রামের বাড়িতে এসেছি।এদিকে রোজ রাতে জানোয়ারের মতো আমায় ছিড়ে খায় আর সকালে বলবে কোনো মতেই যেন আমার পেটে বাচ্চা না আসে।
আমি যেন আমার নিজের ইচ্ছায় বাচ্চা তৈরি করতে পারবো। আমার পোয়াতি হওয়ার খবরটা এক সপ্তাহ আগেই আমি জেনেছি,কিন্তু ভয়ে ওকে বলিনি।কাল যখন ও আমায় বলেছিল যে ওর অফিসের,অফিস না ছাই…. সব মিথ্যে বলেছে আমায়।যেটা বলছিলাম,বলেছিল একজন স্যার আসবে,তাঁকে আমি খুশি করতে পারলে,ওর নাকি অনেক উন্নতি হবে,মোটা টাকা পাবে। আমিও তখন ওকে অনেক খারাপ খারাপ কথা বলেছিলাম।তখনও যখন ও আমার কথা মানছিল ,না তখন আমি সত্যি কথাটা বলে দিয়েছিলাম,যে আমি মা হতে চলেছি। সঙ্গে সঙ্গে বলেছিল,আজই আমায় ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে বাচ্চাটা নষ্ট করার জন্য,কিন্তু আমি বলেছিলাম ও যদি আমার বাচ্চা নষ্ট করার চেষ্টা করে,তাহলে আমি সবার সামনে ওর মুখোশ খুলে দেবো।সেই শুনে বলেছিল,আমার শরীর বেঁচবে বলেই ও নাকি আমায় বিয়ে করেছিল,এখন আর যখন তা হবে না,তাই ওর আমাকে আর কোনো দরকার নেই,আর তাই ও নাকি সবার সামনে আমায় নোংরা মেয়ে বলে,আমি নাকি বেশ্যা বৃত্তি করি বলে আমাকে এখান থেকে তাড়াবে, আর ঠিক সেটাই করলো।(অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে) আমি আমার সত্যিটা প্রমাণ করতে পারলাম না।ঠাকুর নেই,তাইতো ঠাকুর ওর মতো ঠকবাজের সাথ দিলো।আমার শরীরে আরেকটা প্রাণ না থাকলে,আজ আমি ট্রেনের তলায় শুয়ে পড়তাম
-এসব আজে বাজে কথা বলবে না।তা এখন কোথায় যাবে তুমি?
-জানি না
-শোনো, এখান থেকে আমি তোমাকে বাসে তুলে দিচ্ছি।বাসের শেষ স্টপেজের আগের স্টপেজ পদ্মপুকুর বলে একটা জায়গা আছে।তোমার কাছে টাকা আছে?
-না!আমার কাছে আড়াইশো টাকা ছিল,ও সব নিয়ে নিয়েছে
-দাড়াও(কোমরে, লুঙ্গির ভাঁজ থেকে টাকা বের করে)এই নাও চল্লিশ টাকা।সাত টাকা লাগবে বাসে, ওখানে নেমে দেখবে অনেক ভ্যান রিক্সা দাঁড়িয়ে থাকে।ওখানে পাঁচ টাকা নেবে।বলবে তাঁতী পাড়া যাবো।ওখানে নেমে কাউকে জিজ্ঞেস করবে বাসনাদের বাড়ি কোনটা,কেউ না কেউ দেখিয়ে দেবে।ওখানে গিয়ে বলবে,আমি তোমায় পাঠিয়েছি।আমি মানে শ্রীপতি মান্না।বলবে তোমায় ছাবনপুর থেকে শ্রীপতি মান্না কাজের জন্য পাঠিয়েছে।ওরা তোমায় থাকতে দেবে
চম্পা নিজের খুব ছোট্ট একজোড়া রুপোর কানেরদুল বের করে,শ্রীপতির দিকে বাড়িয়ে ….
-আপনি আমায় চেনেন না,তবুও আপনি আমার সব কথা ধৈর্য ধরে শুনে,আমায় বিশ্বাস করে,আমায় টাকা দিয়ে,থাকার ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন,এটা রাখুন।এটা ছাড়া আমার কাছে আর কিছু নেই
-ওটা তোমার কাছেই রাখো,পরে তোমার কাজে লাগবে।সবাই তোমায় অবিশ্বাস করেছে,কিন্তু কেনো জানি….যাক,আমি পরে ওখানে গিয়ে তোমায় দেখে আসবো।ওখানে আমার আত্মীয়রা থাকে,ওঁদের ওখানে অনেক পুরোনো তাঁতের ব্যবসা।ওঁরা তোমায় একবেলা খেতে দেবে,তারপর কিন্তু তোমার খাবার তোমায় নিজেই জোগাড় করে নিতে হবে।ওঁদের তাঁতের কাজে, তুমিও কাজ করতে পারো।যাওয়ার সময় যাওয়ার খরচ বাদে বাকিটা দিয়ে ডাল চাল অল্প করে কিনে নিয়ে যেও
চম্পা গিয়ে ওনাকে প্রণাম করলে….
-আরে আরে ,এ কি করছো? আমি নিঃস্বার্থ ভাবে কিছু করছি না।ওখানে তাঁতের কাজের জন্য লোক লাগবে ওরা আমাকে বলেছিল।তাই তোমায় পাঠাচ্ছি।ওঁদের ও উপকার হবে আর তোমারও
বেশ কিছুক্ষণ পর বাস এলো।দূর থেকে বাস আসতে দেখেই শ্রীপতি কিভাবে যেতে হবে তা আবার চম্পাকে বলে দিলো।চম্পা যেই বাসে উঠবে বলে এগিয়ে গেলো,শ্রীপতি পিছন থেকে বলে উঠলো….
-একটা কথা মনে রাখবে,ভগবানের বিচারে শাস্তির জন্য সব সময় লাঠির আওয়াজ হয় না।ঠিক পথে থেকো,একদিন তুমি তার ফল পাবেই
এরপর দেখতে দেখতে অনেক গুলো বছর কেটে গেছে।চম্পা পদ্মপুকুরে একটা বেড়ার ঘরে থেকে তাঁতের কাজ করতো।বসে বসে কাজ,তাই দিন রাত কাজ করে চম্পা টাকা জমাতো।ওখানের আসে পাশের সবার সাথে চম্পার বেশ চেনা পরিচিত হয়ে গিয়েছিল।চম্পা ওখানেই একটি পুত্র সন্তান জন্ম দিয়েছিল।শ্রীপতি খুব কম হলেও মাঝে মাঝে ওখানে যেত।চম্পা কোনোদিনও বুঝতে পারে নি,যে শ্রীপতি একজন অচেনা মানুষ হয়েও তাদের জন্য নিঃস্বার্থ ভাবে কেন এত করতো।চম্পা অনেকবার শ্রীপতির জন্য বিশেষ কিছু করতে চেয়েছে,কিন্তু শ্রীপতি বলতো একদিন সে নিজেই ঠিক চেয়ে নেবে চম্পার কাছে,তখন কিন্তু চম্পাকে তা করতেই হবে।একবার শ্রীপতির কাছেই চম্পা শুনেছিল,রতন আবার বিয়ে করেছে।চম্পার ছেলেও ধীরে ধীরে বড়ো হচ্ছিল।চম্পা খুব কষ্টের মধ্যে ছেলেকে বড় করছিল।তবে চম্পার পাশের ঘরের মলিনারা না থাকলে,চম্পা অনেকক্ষণ তাঁতের কাজে বাড়ির বাইরে থাকতে পারতো না।মলিনার মেয়ে চম্পার ছেলের থেকে একটু বড়।ওখানেই চম্পার ছেলে সারাদিন থাকে।
মলিনাকে চম্পার ছেলে বড়মা ডাকে।মলিনা চম্পার জীবনের সব কষ্টের কথা শুনেছিল।সেই চম্পা আর রতনের আলাপ হওয়া,আলাপের পরেই দুজন দুজনের প্রেমে পাগল হওয়া,রতন বিয়ের আগেই চম্পার সাথে শারীরিক সম্পর্ক করতে চেয়েছিল কিন্তু চম্পা বলেই দিয়েছিল, বিয়ে না হলে রতন চম্পাকে পুরোপুরি পাবে না,তারপরে তাঁদের পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করা,এক রুমের একটা বাড়ি ভাড়া করে তখন তাঁরা স্বপ্নের জগতে ভাসছিল।তবে প্রথম থেকেই চম্পা খেয়াল করেছিল,বিয়েটা যেন রতনের কাছে চম্পার শরীর ভোগ করা।দিন নেই,রাত নেই তার সারাক্ষণ শুধু ওই এক ক্ষুধা।নিজের ভালোভাবে ভোগ করার পরই তাঁর শুরু হয়ে যায় চম্পাকে কিভাবে শরীরের ব্যবসায় নামিয়ে,টাকা রোজগার করবে।আর যখনই তাঁর সেই চেষ্টা সফল হয় নি তখনই চম্পাকে সবার সামনে বেশ্যা বদনাম দিয়ে গ্রাম থেকে তাড়িয়েছে।মলিনা বলেই দিয়েছিল,না খেতে পেয়ে মরে গেলেও আর কখনো যেন চম্পা রতনের কাছে ফিরে না যায়।মলিনা সেদ্ধ ভাত,ফ্যানা ভাত যা খাবে,চম্পা দেরও খাওয়াতে পারবে।চম্পার কাছেও মলিনাদির কথাই সব সময় বেদবাক্য ছিল।ধীরে ধীরে শ্রীপতির বয়স বাড়ছিল।
একবার শ্রীপতি চম্পাকে বলে গেল,আর সে চম্পাদের দেখতে আসতে পারবে না।বাসে উঠতে,নামতে তার কষ্ট হয়।তবে বলেছিল,শ্রীপতির শেষ সময়ে চম্পা যেন একবার শ্রীপতিকে দেখতে যায়।চম্পা শুনে না করে দিয়েছিল,যে সে ওই গ্রামে আর কখনো যাবে না।কিন্তু তবুও শ্রীপতি বলেছিল সে সব জেনেই বলছে,চম্পা যেন তাঁর এই কথাটা রাখে।
রাগের মাথায় না করে দিলেও,চম্পা জানতো ওই বুড়ো মানুষটার জন্যই আজ চম্পা আর তাঁর ছেলে বেঁচে আছে।রক্তের কোনো সম্পর্ক না থাকলেও ওই বুড়ো মানুষটা মাঝে মাঝে চম্পাদের দেখতে আসতো।কিন্তু তাই বলে ওই পাড়ায় গেলে যে চম্পা কে আবার অপমানিত হতে হবে।
ছাবনপুর গ্রাম থেকে লাঞ্ছিত হয়ে পদ্মপুকুরে চলে যাওয়ার,সাত বছর পর…..
শ্রীপতির মনের ইচ্ছা পূর্ণ করতে পারে নি চম্পা।আসলে শ্রীপতি যখন মৃত্যু শয্যায় ছিল,তখন কোনো খবর পায় নি চম্পা।একদিন মাঝরাতে শ্রীপতির যে আত্মীয়দের ওখানে চম্পা কাজ করতো,সেখানে খবর এলো শ্রীপতি আর নেই।কথাটা শুনেই চম্পা মান অপমান সব ভুলে গেল, ভোর রাতে ছেলেকে নিয়ে, মলিনাদি আর ওর মেয়ের সাথে প্রথম বাসে পৌছালো ছাবনপুর গ্রামে।
শ্রীপতি মান্না কোন বাড়িতে থাকতো,তাও জানতোনা চম্পা।একে তাকে জিজ্ঞেস করে যখন শ্রীপতি মান্নার বাড়ির কাছে পৌছাল,তখন চম্পা দেখলো রতনের ঘরের ঠিক উল্টো দিকের ঘরটাই ছিল শ্রীপতির।দুই বাড়ির মধ্যে একটা বড় মাটির উঠোন আর সেখানে খাটিয়ার ওপর রাখা শ্রীপতির দেহটা।চম্পা কাঁদতে কাঁদতে ছুটে গেল, শ্রীপতির দেহের কাছে।পায়ের কাছে বসে চম্পার পুরোনো দিনগুলো মনে পড়ছিল।সেদিন চম্পার সেই বিপদে এই মানুষটা হঠাৎ করে চম্পার জীবনে না আসলে,চম্পা বাচঁতো কিনা কে জানে।মলিনা চম্পাকে শান্তনা দিচ্ছিল। হঠাৎ মলিনার মেয়ে এসে চম্পাকে বললো….
-মাসি চলো একটা জিনিস দেখবে
তখন চম্পা ওর সাথে কোথাও যাওয়ার পরিস্থিতিতে ছিল না।তাই মলিনা বলে উঠলো….
-আহ! চুমকি,কি হচ্ছে কি! তুই ভাইয়ের সাথে খেল
-আমি তো ভাইয়ের সাথেই খেলছিলাম,দেখলাম পুরো ভাইয়ের মতো দেখতে একটা কাকু
-কী!
-হ্যা গো মা,তুমি দেখবে চলো,পুরো ভাইয়ের মতো
মলিনা চম্পাকে কিছু না বলে চুমকির সাথে দেখতে গেল।গিয়ে দ্যাখে একটা বারান্দার ওপর চেয়ারের ওপর বসে থাকা এক ব্যক্তি ,যার ডান পায়ের হাঁটুর কাছে ঘা হয়েছে,যার কিছুটা ব্যান্ডেজ দিয়ে বাঁধা আর কিছুটা খোলা,তার ওপর মাছি বসছে আর সেই ব্যক্তি বিরক্ত সহকারে একটা ছেঁড়া কাপড় দিয়ে মাছি তাড়াচ্ছে।সেই ব্যক্তির মুখের চেহারা আর চম্পার ছেলের মুখের চেহারা হুবহু এক।মলিনা দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো।আর না এগিয়ে চুমকি কে বলল,”শিগগির মাসিকে ডাক”
চুমকি গিয়ে মাসিকে যেই বললো তার মা ডাকছে,চম্পা মলিনাদির সব কথার খুব প্রাধান্য দিতো তাই চুমকির সাথে যেতে গিয়ে বুঝলো,চুমকি তাঁর ই স্বামীর ঘরের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।মলিনার পাশে গিয়ে কি হয়েছে জিজ্ঞেস করায়,মলিনা আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে সামান্য দূরে বারান্দায় বসে যে মানুষটা নিজের ঘা এ বসা মাছি তাড়াচ্ছিলো তাঁর দিকে দেখালো।চম্পা ওদিকে তাকিয়েই মাথা নিচু করে বললো “ও-ই রতন”।একথা বলে যেই চম্পা আবার ফিরে যেতে গেল,মলিনা চম্পার হাতটা ধরে,ওকে দাঁড় করিয়ে আরেক হাতে ধরে থাকা চম্পার ছেলেকে দেখিয়ে বলল…..
-ভালো করে দ্যাখ চম্পা!যে রতন তোর বাচ্চাকে নোংরা গালি গিয়েছিল,যে বাচ্চাকে নিজে অস্বীকার করেছিল,যে বাচ্চাকে অন্যের পাপ বলেছিল।তুই তার কোনো প্রমাণ দিতে পারিস নি,কিন্তু আজ ভগবান প্রমাণ করে দিয়েছেন।দ্যাখ ছোটনের মুখটা হুবহু রতনের মুখ।তুই তো আগে আমাকে বলিসনি কখনো
চম্পাও খুব অবাক হয়ে বলল-আমি এভাবে কখনো ভেবেই দেখি নি
-চল তুই আমার সাথে
-না দিদি তুমি কিছু বলো না
-কেন বলবো না,শ্রীপতি কাকুর জন্য আজ এখানে অনেক লোক আছে।তোকে এরা সবাই অপমান করেছিল,আজ সেই অপমানের শোধ আমি নেবো
-আমি চাই না শোধ নিতে,আজ কি আমরা এই করতে এসেছি?
-তুই এখনো বুঝতে পারছিস না?
-কি?
-শ্রীপতি কাকু কেন তোকে আর তোর ছেলেকে আবার এই গ্রামে আনিয়েছে,বুঝতে পারছিস?চল আমার সাথে
মলিনা, চম্পা আর ছোটনের হাত ধরে আরো এগিয়ে গিয়ে,রতনের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো….
-কি রতন বাবু কেমন আছো? চিনতে পারছো একে?
মাছি তাড়াতে তাড়াতে রতন মলিনা আর চম্পার দিকে তাকিয়ে….
-কে?চম্পা?
-হ্যা চম্পা।সেই চম্পা যে সাতবছর আগে এখান থেকে অপমানিত হয়ে চলে গিয়েছিল
-কেমন আছো চম্পা? আমি তো খুব অসুস্থ।আমি তোমাকে অনেক খুঁজেছিলাম, কিন্তু পাই নি
মলিনা চিৎকার করে বলল- কেন ,খুঁজেছিলেন কেন?ও তো নাকি নষ্টা মেয়ে(আস্তে আস্তে লোকের ভিড় বাড়তে থাকলো)।ও তোমার স্ত্রী না,তাহলে ওকে খুঁজেছিলে কেন?(ছোটনকে সামনে দাঁড় করিয়ে) এই দেখো রতন বাবু,এ হলো চম্পার ছেলে,যাকে তুমি অস্বীকার করেছিলে, বলেছিলে কার না কার পাপ।তাহলে এই বাচ্চা হুবহু তোমার মতো দেখতে হলো কি করে?
-চম্পা ঘরে এসে কথা বলো,তোমার সাথে আমার অনেক কথা আছে
মলিনা-না! চম্পা যাবে না! ঘরে কেন কথা হবে? সেদিন সবার সামনে তুমি ওকে নষ্টা বলেছিলে,তখন তোমার প্রতিবেশীরা কি জানতো যে তুমি একটা মেয়েদের দালাল?
-আপনি চুপ করুণ! আমি চম্পার সাথে আলাদা কথা বলতে চাই
চম্পা মলিনার হাতটা ছাড়িয়ে ছোটনের হাত ধরে রতনের বারান্দায় উঠবে বলে যেই এগোলো,মলিনা পিছন থেকে বলে উঠলো…..
-চম্পা যাস না।ও তোকে আবার ফাঁসাবে।ও অসুস্থ তাই এখন ওর সেবা করানোর জন্য আবার ভালো ভালো কথা বলছে
-না চম্পা,আমি সত্যিই তোমাকে অনেক খুঁজেছিলাম,আমি ভুল করেছি।তুমি আমায় ক্ষমা করে দাও
চম্পা মলিনাদির কথা না শুনে বারান্দায় রতনের কাছে গিয়ে দেখলো, রতনের পায়ের ঘা টা একদম কাঁচা,অপরিস্কার,তাতে মাছি বসছে।রতন আকুতি করে বললো….
-চম্পা,আমার ক্যান্সার হয়েছে।আমি আর বেশিদিন বাঁচবো না।তুমি আমায় ক্ষমা করে দাও।চলো আমরা তিনজন আবার এক সাথে থাকি।তুমি আমায় ছেড়ে যাবে না তো?
চম্পা-না যাবো না,কিন্ত কি পরিচয়ে আমি এখানে থাকবো?
-কেন,তুমি তো আমার স্ত্রী
-এখানে সবাইকে বলতে পারবে আমি তোমার স্ত্রী আর এ তোমার ছেলে?তাহলে আমি থাকবো
একটু দূর থেকে সবাই দেখছে রতন আর চম্পা কথা বলছে,কিন্তু কি বলছে তা আন্দাজ করলেও ঠিকমতো শুনতে পারছে না।তাও আন্দাজে মলিনা চিৎকার করে বলে উঠলো…..
-চম্পা,আর ভুল করিস না কিন্তু,এবার ফাঁসলে আর বেরোতে পারবি না
রতন সবার দিকে তাকিয়ে বলল….
আমাদের মধ্যে একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল।যাক এখন থেকে আবার আমরা তিনজন একসাথে থাকবো।ও চম্পা,আমার বৌ আর এই আমার ছেলে
এসব শোনার পর প্রতিবেশীদের মধ্যে কানাঘুষো শুরু হয়ে যায়।চম্পা আর কিছু না বলে চলে যাচ্ছে দেখে রতন বিচলিত হয়ে বলে উঠলো….
-চম্পা কোথায় যাচ্ছ?
পিছন ফিরে চম্পা বলল-আমার কাজ শেষ
-মানে?
-সাতটা বছর ধরে শুধু আফসোস করেছি নিজের অসহতায়।দোষারোপ করেছি ঠাকুরকে,যে কেন আমি সত্যিটা প্রমাণ করতে পারলাম না।(দূরে উঠোনে খাটিয়ার ওপর শুয়ে থাকা শ্রীপতির দেহর দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলল)আজ ওই বুড়ো মানুষটা আমার সব মিটিয়ে দিয়ে গেল।তুমি ভাবলে কি করে যে তুমি, যখন ইচ্ছা আমায় নোংরা কথা বলে তাড়িয়ে দেবে আর যখন ইচ্ছা স্বীকার করবে আর আমি মাথা পেতে মেনে নেবো, কেন? কারণ আমি তোমার স্ত্রী তাই?নিকুচি করেছে, একজন মেয়ে দালালের স্ত্রী হয়ে থাকতে
-চম্পা যেও না,আমায় ক্ষমা করে দাও
বারান্দা থেকে নিচে নেমে চম্পা বলে উঠলো…
-ক্ষমা? ঠাকুরই তোমায় ক্ষমা করলো না আর আমি কি করে করি।আবার বিয়ে করলে,সেই বৌ ছেড়ে চলে গেছে,ক্যানসার হয়েছে।এবার পচেগলে মরো।অনেক মেয়ের সর্বনাশ করেছো, এবার তোমার সর্বনাশ শুরু।চলো মলিনাদি
পিছন থেকে রতন চম্পাকে অনেক বার ডেকেছে,কিন্তু চম্পা আর ফিরে তাকায় নি।শ্রীপতির শুয়ে থাকা দেহের পায়ের কাছে গিয়ে ধপাস করে বসে পড়লো চম্পা।শ্রীপতির চাদরে ঢাকা শরীরের দিকে তাকিয়ে চম্পা কাঁদতে কাঁদতে,শ্রীপতির দুটো পায়ে হাত দিয়ে মনে মনে বলল….
-সব লড়াই শেষ।সেদিন আমি আমার সত্যিটা প্রমাণ করতে পারি নি।তুমি বলেছিলে, যে ঠাকুরের শাস্তির সব সময় লাঠির আওয়াজ হয় না।আজ তাই দেখলাম।তুমি জানতে ছোটন দেখতে পুরো ওর বাবার মতো হয়েছে,জানতাম তো আমিও,কিন্তু আমি এরকম ভাবে কখনো কিছু ভাবি নি।তুমি এ ও জানতে আমি জীবনেও এখানে আসতাম না,তাই তুমি তোমার দোহাই দিয়ে আনিয়েছো।সেদিনের সেই অপমান থেকে আজকের এই অপমান শোধ করা অবধি,সব সময় তুমি আমার পাশে ছিলে।তুমি আমার জন্য এত কেন করলে,কে তুমি?তুমি কি আমার ঠাকুর ছিলে? যে নাকি নিঃশব্দে আমায় আমার সব ফিরিয়ে দিয়ে গেলে। কে তুমি?….