প্রথম দফার আন্দোলন শেষ হয়েছিল অকস্মাৎ প্রধানমন্ত্রীর কোটা বাতিলের ঘোষণায়। তার আগে কেন কিভাবে এই আন্দোলন শুরু হয়েছে সে কথার পুনরাবৃত্তি করছি না সঙ্গত কারণে। মোটা দাগে কোটাবিরোধী শিক্ষার্থীদের দাবী দেশে প্রায় ৫৬% কোটা বহাল থাকায় মেধাবী শিক্ষার্থীরাও শিক্ষা শেষে চাকরি পাচ্ছেন না, তাই কোটা সংস্কার করতে হবে। সেই সংস্কারগুলো হচ্ছে-
১. কোটাব্যবস্থা সংস্কার করে ৫৬ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশে আনতে হবে,
২. কোটায় কোনো ধরনের বিশেষ নিয়োগ দেওয়া যাবে না,
৩. চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় কোটাসুবিধা বারবার ব্যবহার করা যাবে না,
৪. সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে সবার জন্য অভিন্ন কাট মার্কস ও বয়সসীমা নির্ধারণ করতে হবে এবং
৫. কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া গেলে শূন্য পদগুলোয় মেধায় নিয়োগ দিতে হবে।
এই দাবীসমূহ নিয়ে আন্দোলন করছে ‘বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ’, এদের সাথে কখনো কয়েকটি বাম ছাত্র সংগঠন সমর্থন জানিয়েছে। কখনো কয়েকটি বাম দলও সমর্থন জানিয়েছে। তাদের ভেতর কেউ কেউ আন্দোলনে সম্পৃক্ত থেকেছে, কেউ কেউ পৃথকভাবে সমর্থন জানিয়েছে। আন্দোলনকারীদের সাথে মিলিমিশে আন্দোলন করছেন না, সে কারণে এই আন্দোলনের কোনো রাজনৈতিক চরিত্র নেই।
এপ্রিলে আন্দোলন জোরালো হলে প্রধানমন্ত্রী কোটা বাতিলের ঘোষণা দেন। কোটাবিরোধীরা ‘বাতিল’ নয় ‘সংস্কার’ চায় জানিয়ে সেই ঘোষণা বাস্তবায়নের জন্য দ্রুত গেজেট প্রকাশের দাবী জানিয়ে সে যাত্রায় আন্দোলন স্থগিত করে। সে সময় আন্দোলনে এক ধরণের ‘যৌথ অংশগ্রহণ’ ছিল।
এপ্রিল পেরিয়ে জুলাই। গেজেট প্রকাশ হয়নি। কোটাবিরোধীরা ফের মাঠে নামেন। এবার তারা আর বিনা বাধায় কর্মসসূচী পালন করতে পারেননি। সংবাদ সম্মেলনেই ছাত্রলীগ হামলা করেছে। ছাত্র সংগঠনের আক্রমণ-প্রতিআক্রমণ, হামলা-মামলা, হল দখল, ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়ন এসব নতুন কিছু নয়, দেশের প্রায় সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পুরোনো ‘ঐতিহ্য’। পার্থক্য- আগে এইসব হামলাগুলোতে ব্লাডশেড কম হত, এখন ডাইরেক্ট ব্লাডশেড। আগে চড়-থাপ্পড়েই থেমে যেত, এখন সমবেত হামলা, রক্ত ঝরানো, হাতুড়ি দিয়ে হাড় ভেঙ্গে পঙ্গু করা যোগ হয়েছে (ডেভেলপমেন্ট!)।
আন্দোলনকারী নেতা নূরুকে পেটানোর দৃশ্য এবং রাজশাহী বিশ্বদ্যালয়ে শিক্ষার্থী তরিকুলের হাতুড়ি দিয়ে পা ভাঙ্গার চিত্র সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। তরিকুলের পায় যেভাবে ভাঙ্গা হয়েছে তাতে তাকে কমপক্ষে ১ মাস হাসপাতালে থাকতে হবে প্লাস্টাররত অবস্থায়, অথচ রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে তাকে বের করে দেয়া হয়েছে এই বলে যে ‘এধরণের রুগিকে এক-দুদিন পরই রিলিজ করার নিয়ম’! নূরুদেরকেও ঢামেক থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। এই ব্যাপারগুলো এই সময়ের রাজনৈতিক ভ্রষ্টচার এবং নির্লজ্জ দালালির ‘ডেভেলপমেন্ট’। এর পর যে মেয়েগুলোকে শহীদ মিনারে অপদস্থ করা হয়েছে তাও এক প্রস্থ ‘ডেভেলপমেন্ট’। এই নিপীড়নকারী ছাত্র সমাজ যখন দেশের প্রশাসকের চেয়ারে বসবেন তখনকার ‘ডেভেলপমেন্ট’ কী হবে ভাবতে গায়ে কাটা দিচ্ছে!
এর পরে যা হয়- বিভিন্ন রাজনৈতিক দল মৌসুমী মেলার দোকানদারির মত বিবৃতি দিয়েছে। কেউ কেউ সমর্থন জানিয়েছে, কেউ কেউ ছাত্রলীগের ‘বাড়াবাড়ি’ নিয়ে অভিমান করেছে। পক্ষে-বিপক্ষে টকশো হয়েছে, এবং প্রবল চাপান-উতোর-এর পর সরকারের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায়, কড়ে-বর্গায়, ক্ষমতার বিভিন্ন রেঞ্জে এই মর্মে সাব্যস্ত হয়েছে ‘এই কোটাবিরোধীরা আসলে বিএনপি এবং জামাত-শিবির। এরা কোটাবিরোধী আন্দোলনের ছলে সরকার পতনের অপচেষ্টা করছে। এই তথাকথিত আন্দোলন সরকার বিরোধীতা তো বটেই, এই রাষ্ট্রেরও অমঙ্গলচিন্তা। এরা মুক্তিযুদ্ধেরও বিরোধীতাকারী।’
নৌমন্ত্রী শাহাজাহান খান বলেছেন ‘এইসব হামলা ছাত্রলীগ করেনি, করেছে ছাত্র শিবির’। ছাত্রলীগের অনেকেই বলেছেন ‘ওরা ভ্রষ্ট, ওরা ছাত্র নামধারী জামাত-শিবির’।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে সরকারের হাতে জামাত-শিবির নিষিদ্ধ করার ‘১০১ টা উপায়’ থাকার পরও, ডজন ডজন সংগঠন এবং বিভিন্ন নীতিনির্ধারকদের তথা হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধার দাবী স্বত্তেও জামাত-শিবির নিষিদ্ধ হয়নি কেন? তাদেরকে নিষিদ্ধ করলে তো আর তারা এ ধরনের ‘স্যাবোটাজ’ করতে পারত না। কেন নিষিদ্ধ করা হয়নি সেটি যেমন রাজনৈতিক টুলস, তেমনি তারা কখন কোথায় ‘পুশইন’ হয়ে স্যাবোটাজ করতে চাচ্ছে সেটাও রাজনৈতিক টুলস। এইসব টুলস সরকার হাতছাড়া করতে চায় না। জামাত-শিবির এখন তাদের কাছে ‘এন্টিবায়োটিক’! বিবিধ ‘রোগে’ ব্যবহার্য! কোটাবিরোধী আন্দোলনে এই ‘এন্টিবায়োটিক’ ব্যবহারের লাভ হল রাতারাতি সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছে… ‘কি? মুক্তিযোদ্ধা কোটা তুলে দিতে বলছে জামাত-শিবির?’ ‘কি? উপজাতি কোটা তুলে দিতে বলছে আন্দোলনকারীরা? ওরা তো তাহলে পাহাড়েরও শত্রু!’ ‘কি? পিছিয়ে পড়া অঞ্চলের লোকজনকে চাকরি করতে দেবে না ওরা? এ তো রীতিমত রাষ্ট্রদ্রোহীতা! গুরুতর অপরাধ!’
এইসব ‘সুনিয়ন্ত্রিত’ প্রপাগান্ডায় বিভ্রান্ত হয়েছে বিপুল সংখ্যক আদিবাসী, বিভিন্ন নৃগোষ্ঠির লোকজন। এইসব অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হয়েছে মুক্তিযোদ্ধারা।
এ তো গেল এই আন্দোলনের ব্যবহারিক দিক। এর মতাদর্শীক দিক নিয়েও সমস্যা আছে। বামপন্থী, প্রগতিশীল, কমিউনিস্ট নামধারীদের কারো কারো মতে এই আন্দোলন সরকারের জুলুম-নিপীড়নের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের বিদ্রোহ। তাই একে এগিয়ে নিতে হবে। সেই লক্ষে কোনো কোনো অতিউৎসাহী পণ্ডিত কোটা আন্দোলনকারীদের ‘এই সময়ের মুক্তিযোদ্ধা’ বলেও আপ্লুত হতে চেয়েছেন!
এদের এই পুকুরকে সমুদ্র ভাবার বালখিল্যতাকেই আমলে নিয়ে পুলিশ এই আন্দোলনের কোন ভাঁজে কোনোভাবে সরকার পতনের বীজ লুক্কায়ীত কিনা, কিংবা কোনো মহল থেকে তাদের কাছে টাকা-পয়সা এসেছে কিনা তা ‘খতিয়ে’ দেখতে শুরু করেছে। সে জন্য ব্যাংক একাউন্ট থেকে ফেসবুক পেজ-গ্রুপ চষে ফেলা হচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত করিৎকর্মা পুলিশ কোনো আমলযোগ্য ক্লু খুঁজে পায়নি। তার মানে এটা নয় যে তারা খুঁজে পাবে না! যে কোনো সময় যে কাউকে, যে কোনো গোষ্ঠিকে ‘ভয়াবহ সন্ত্রাসী’ বা ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ কিংবা ‘রাজাকার’ আখ্যায়িত করে এ্যাক্টিভ হয়ে উঠতে পারে।
“কোটা সংস্কার আন্দোলনের পেছনে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা আছে কি না, তা নিয়ে কাজ করছে পুলিশ। গ্রেপ্তার হওয়া ছাত্রনেতাদের জিজ্ঞাসাবাদ, বিভিন্নজনের সঙ্গে তাঁদের মুঠোফোনে যোগাযোগ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন অ্যাপ ও গ্রুপের কথোপকথন (চ্যাট), অর্থের উৎস ইত্যাদির তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। এই আন্দোলনে বিএনপি-জামায়াত বা তাদের ছাত্রসংগঠনগুলোর উসকানি রয়েছে বলে ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন মহল থেকে অভিযোগ করা হচ্ছে। সম্প্রতি বিভিন্ন মামলায় কোটা আন্দোলনের অন্তত ১০ জন নেতাকে গ্রেপ্তারের পর পুলিশের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, তারাও মামলার তদন্তে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার দিকটি গুরুত্ব দিয়েই খতিয়ে দেখছে। তবে এখন পর্যন্ত জোরালো কোনো রাজনৈতিক যোগসাজশের তথ্য তাদের হাতে আসেনি (প্রথম আলো, ০৭.০৭.২০১৮)।“
“তথ্যপ্রযুক্তি আইনে গ্রেপ্তার হওয়া রাশেদ খানের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্ত করছে সাইবার ক্রাইম ইউনিট। পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়ে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। সাইবার ক্রাইম ইউনিটের দুজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা রাশেদ খানের দেওয়া তথ্য খতিয়ে দেখছেন। ক্যাম্পাসের বিভিন্ন বামপন্থী ছাত্রসংগঠন ও ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের বিভিন্ন সময়ে কথাবার্তা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে রাশেদও এমন তথ্য দিয়ে বলেছেন, যৌক্তিক আন্দোলনে সব শিক্ষার্থীর সহায়তাই তাঁরা চেয়েছেন। তবে আন্দোলনের সব সিদ্ধান্ত ছাত্র অধিকার সংরক্ষণের নেতারা বসে নিয়েছেন। রাশেদের মুঠোফোন যোগাযোগ, বিভিন্ন অ্যাপ ও গ্রুপের কথোপকথন, অর্থের উৎসও খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানা গেছে। তবে এখন পর্যন্ত বলার মতো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি।“
(প্রাগুক্ত)
এই আন্দোলনটি মোটেই সরকারবিরোধী আন্দোলন নয়। প্রথম দিকে আন্দোলনকারীরা বঙ্গবন্ধুর ছবিসহ ব্যানার-ফেস্টুন ব্যবহার করেছেন। ‘আমরা সরকারবিরোধী নই’ বলে আশ্বস্ত করেছেন। সরকারের কাছে ‘সুবিচার’ পাবে ভেবে আবেগাক্রান্তও হয়েছে। সে সময় প্রধানমন্ত্রীর ‘কোটা বাতিল’ ঘোষণাটিকে ‘অভিমানজনিত’ ভেবে মর্মাহত হয়েছেন। সেই আন্দোলনকারীরাই বেদম মার খাওয়ার পর এখন তাদের সুর পাল্টেছেন। কেউ কেউ কাতর মিনতি করছেন, কেউ কেউ রাজনৈতিক বক্তব্য দিচ্ছেন।
দেশে গণতন্ত্র থাকলে এটা কেন, যে কোনো আন্দোলন করার অধিকার যে কোনো নাগরিকের থাকে। সরকারের বিরোধীতা করা, সরকার প্রধানের বিরোধীতা করার অধিকার থাকে। থাকতে হয়, তা না হলে তাকে গণতন্ত্র বলা চলে না। কিন্তু এখানে হয়েছে কি? এখানে গণতন্ত্রের ধারণাটিই সামন্তবাদের ক্লেদ মিশ্রিত। এখানে সরকারের কাছ থেকে একটা ভিটামিন ট্যাবলেট পাওয়াকেও সরকার প্রধানের অপার মহিমা জ্ঞান করা হয়। আর তাই ন্যায্য দাবী জানানোর জন্য অন্যায্য অনুমতি নিতে হয়।
যারা এই ‘যথাযথ’ ইস্যুতে আন্দোলন করছেন তাদের বোঝা উচিৎ ছিল কোটা পদ্ধতি নিশ্চিতভাবেই একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তজাত। কোটা বিশ্বের অনেক দেশেই আছে। থাকতে হয়। কোনো কোনো জনগোষ্ঠিকে টেনে তুলে মেইনস্ট্রিমে সামিল করার জন্য থাকতে হয়। সেটা তখনই ‘বোঝা’ হয়ে ওঠে যখন কোটায় না পড়লে দলীয় লোক দিয়ে কোটা পুরণ করা হয় বা দেশে কোটি কোটি বেকারত্ব সৃষ্টি হয় তখন। কিন্তু দেশে যে কোটি কোটি বেকার সেটা তো কোটার কারণে নয়। সেটা কাজের ক্ষেত্র নেই বলে। কাজের ক্ষেত্র সৃষ্টি না করে বক্তৃতা-বিবিৃতি দিয়েই যদি উন্নয়নের রাজহাঁস দেখানো যায় তাহলে ক্ষেত্র প্রস্তৃত করার দরকার নেই মনে করে সরকার। তাই শুধু কোটাবিরোধী আন্দোলন নয়, যে কোনো গণতান্ত্রিক আন্দোলনই প্রকৃতপক্ষে রাজনৈতিক। তাকে অরাজনৈতিক মোড়ক দেয়ার মানে স্টাবলিশমেন্টের সাথে দরকষাকষি করে আপোষ করা। এর নাম আন্দোলন নয়। ‘এটা আমাদের ন্যায্য আন্দোলন এখানে রাজনীতি টানবেন না’ বলে যারা আন্দোলন করতে চান তারা রাজনৈতিকভাবেই দেউলিয়া বা রাজনৈতিক মূর্খ। ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রে মনুষ্যসহ সকল প্রাণিকে নিশ্বাস-প্রশ্বাসও নিতে হয় রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে। রাজনীতির বাইরে কেউ নেই। কিসসু নেই। এটা না বুঝে ‘অরাজনৈতিক আন্দোলন’ এর নিয়তি তা-ই হয় এখন যা হয়েছে। এই ঘেরাটোপ থেকে বেরুতে হলেও সেই জনসম্পৃক্ততা দরকার, কারণ কোটার বেনিফিশিয়ারি কিংবা ননবেনিফিশিয়ারি উভয়ই জনগণ।
হামলার ভিডিও:
https://www.youtube.com/watch?time_continue=2&v=GUpls2HpI28
সহায়ক সংবাদ:
১) হাতুড়ির আঘাতে ‘জীবনের আশা ছেড়ে দেওয়া’ তরিকুল!
২) [ভিডিও] ‘এখন এতেও যদি আপনাদের বিবেক-বোধ না জাগে…’
৩) হাতুড়ি পেটায় তরিকুলের মেরুদণ্ডের হাড়ও ভেঙ্গেছে
৪) আহত তরিকুলকে সরকারি হাসপাতাল ছাড়তে হলো
৫)