০
৬৪২ বার পঠিত
কোপা শামসু, কোপা
শামসু এখন জেলে…
দুই.
হাইস্কুলে পড়ার সময় মাঝে মধ্যেই পত্রিকায় খবর বেরুতো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামি ছাত্র শিবির এবং বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রীর মধ্যে হামলা-পাল্টা হামলায় চায়নিজ কুড়ালের আঘাতে অমুক নিহত। কিংবা ছাত্র শিবিরের ক্যাডাররা ছাত্র মৈত্রীর অমুক কর্মীর পায়ের রগ কেটে দিয়েছে। মাঝে মধ্যে আওয়ামী লীগ সমর্থক ছাত্রলীগ কিংবা জাসদ সমর্থিত ছাত্রলীগের কর্মীরাও জামাত শিবিরের চায়নিজ কুড়াল হামলার শিকার হতো। কিছু ব্যতিক্রম হলেও বিএনপির ছাত্রদল কর্মী শিবির ক্যাডারদের হামলার শিকার হয়েছে, এমন খবরও পত্রিকায় পড়েছি। ঘটনা নব্বুই দশকের।
তিন.
পাবনা টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পোস্টিং। পাবনা শহরের রূপকথা রোডের ‘আজাদ প্রিন্টিং প্রেস’-এ ছাপাছাপির কাজে প্রায়শই যেতে হয়। রূপকথা রোডে বেশ কয়েকটি খাবার হোটেল আছে, পাবনা শহরের সবচে সুস্বাদু হোটেলগুলো এই সড়কেই অবস্থিত। একদিন প্রেসে বসে কাজ করছি, বাইরে প্রচণ্ড হৈ চৈ। প্রেসের গ্রাফিক্স ডিজাইনাররা আমাকে বাইরে বেরুতে নিষেধ করলেন। তারা জানালেন যে বাইরে কোপাকুপি চলছে। এখন বাইরে বের হওয়া সেফ না। কোপাকুপি শব্দটা তখনো আমার কাছে অপরিচিত ছিল।
চার.
দিনাজপুর, পাবনা, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, বরিশাল কোর্স কমপ্লিট করে আবারও ঘটনাচক্রে পাবনা বদলী। আবারও একই কর্মস্থল। আব্দুল হামিদ রোডে মুক্তিযোদ্ধা মার্কেটে গেছি একটা কাজে। মার্কেটের নিচে হঠাৎ র্যাবের বহর হাজির। ওখানে একটা মিডিয়া হাউসে হানা দিয়ে এক সংগীত শিল্পীকে আটক করে নিয়ে গেল। ঘটনা জানার চেষ্টা করলাম, সংগীত শিল্পীর কী অপরাধ। জানলাম, আটককৃত ব্যক্তি নাকী একটা অশ্লীল গান গেয়ে পাবনা শহরে ভাইরাল করেছে। গানটির কথা ছিল অনেকটা এরকম-
কোপা শামসু কোপা…
শামসু এখন সাভারে
কোপাইতে কইছে আমারে
শামসু এখন জেলে
কোপায় তার ছেলে।
মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করলেও, কোপাকুপির এই গানের বিষয়ে র্যাবের আপত্তিকে নেতিবাচক হিসেবে দেখি নাই। কারণ সমাজে অস্থিরতা ও অশ্লীলতা ব্যাপকতা পায় এমন কিছুকে বাক স্বাধীনতার আওতায় ধরতে রাজি নই বলেই।
পাঁচ.
২০১৩ সাল, যুদ্ধাপরাধী বিচারে কাদের মোল্লার প্রহসনমূলক রায়ের প্রতিবাদে আমরা যখন মাঠে নামলাম; শাহবাগ যখন উত্তাল, সেসময় ১৫ ফেব্রুয়ারি চাপাতির ‘কোপে’ নিহত হন সহযোদ্ধা, বন্ধু আহমেদ রাজিব হায়দার, যিনি ব্লগে ‘থাবা বাবা’ নামে পরিচিত ছিলেন। সেসময় প্রথম ‘কোপাকুপি’ শব্দটা দেশব্যাপী পরিচিতি ও ব্যাপকতা পায়। ইসলামি জঙ্গীবাদমূলক বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায় কোপাকুপিতে বিশেষভাবে দক্ষ ইসলামি জিহাদি দলের সদস্যরা। তাদেরকে কোপাকুপিতে প্রশিক্ষণ দেয়া হয় জিহাদি লাইনে আসার পরপরই। এরপরের কয়েকবছর ইসলামি জিহাদিদের কোপাকুপিতে অনেক ব্লগার, লেখক প্রকাশক প্রাণ হারিয়েছেন। অনেকেই জীবন বাঁচাতে দেশ ছেড়ে বিদেশে আশ্রয় নিয়েছেন, যেমন আমিও নিয়েছি।
ছয়.
দেশ ছেড়ে ভারতে আত্মগোপনে ছিলাম দীর্ঘদিন। সেসময় বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ মিত্র, শেখ হাসিনার প্রিয়ভাজন ধর্মীয় নেতা হেফাজতে ইসলামের আমির হযরত আল্লামা শফি কোপাকুপিকে জায়েজ (বৈধ) বলে স্বীকৃতি দেয় অনেকটা প্রকাশ্যেই। শফি হুজুর প্রকাশ্যেই ঘোষণা দিয়ে জানান যে যারা ধর্ম মানেনা (অর্থাৎ নাস্তিক) তাদের কোপানো সঠিক (উনি আরবি ফরম্যাটে বলেছেন- কোতল করা ওয়াজিব)। ক্ষমতাসীন সরকার কিংবা পুলিস প্রশাসন আল্লামা শফির বিরুদ্ধে এখনোব্দি কোনো প্রশাসনিক অথবা আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করেন নি। ফলে দেশে কোপাকুপি একটা নতুন ডাইমেনশন লাভ করে। হুজুরের বাণীতে দেশব্যাপী কোপাকুপিতে উদ্বুদ্ধ হয় দেশের শান্তিকামী জনগণ।
সাত.
দেশে এখন প্রেমিক কোপাচ্ছে তার প্রেমিকাকে, প্রেমে ব্যর্থ হয়ে ‘রোমিও’ কোপাচ্ছে প্রেম প্রত্যাশী নারীর স্বামীকে, স্বামী কোপাচ্ছে তার স্ত্রীকে, মন্দিরের সেবক কোপাচ্ছে মন্দিরের পুরোহিত ঠাকুরকে, বৃদ্ধ পিতাকে কোপাচ্ছে তার মাদকাসক্ত ছেলে, ভাড়া নিয়ে বচসার কারণে বাসের হেলপার কোপাচ্ছে যাত্রীকে, বাকীতে মাল বিক্রি করতে রাজি না হওয়ায় দোকানিকে কোপাচ্ছে ক্রেতা। এরকম কোপাকুপির সংবাদে পত্র-পত্রিকার বেশিরভাগ জায়গা ভর্তি।
আট.
কোপাকুপির এই মহোৎসবে কোনো একদিন হয়তো পত্রিকার শিরোনাম পড়বো, ‘দেহরক্ষীর হাতে কোপ খেয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নিহত‘। এরকম শিরোনামের খবর কি আপনি পড়তে চান?
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন