০
১৬৪৪ বার পঠিত
ভারতের সবচেয়ে প্রাচীন ভাষা গোষ্ঠী দ্রাবিড় ভাষা গোষ্ঠী। সংস্কৃত ভাষার আগমনের পূর্বে সমগ্র ভারতবর্ষে মানুষ তামিল বা এর কাছাকাছি কোন দ্রাবিড় ভাষায় (প্রোটো-দ্রাবিড়িয়ান) কথা বলত। বৈদিক শাসনে সংস্কৃতের প্রভাবে তামিল কালচার ধীরে ধীরে দক্ষিণে সরতে থাকে। পাকিস্তানে ব্রাহুই ভাষা এবং বাংলা অঞ্চলে কুরুক ভাষার উপস্থিতি থেকে এই মতের সপক্ষে প্রমান পাওয়া যায়।
সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘বাঙালা ভাষাতত্ত্বের ভূমিকা’য় লিখেছেন,
“বাঙলার এই-সকল নদ-নদী-গ্রাম প্রভৃতির নাম বিশ্লেষণ করে দেখলে একটী বিষয় চোখে পড়েঃ অনেক নামের ব্যাখ্যা সংস্কৃত বা কোন আর্য্য ভাষা ধ’রে হয় না, – কি সংস্কৃত, কি প্রাকৃত, কেউ এখানে সাহায্য করেনা; সেই-সব নামের ব্যাখ্যার জন্য আর্য্য ভাষার গণ্ডীর বাইরে যেতে হয় – অনার্য্য, দ্রাবিড় আর কোলের ভাষার সাহায্য নিতে হয়।”
বর্তমানে দ্রাবিড়িয়ান ভাষা শেষ পর্যন্ত বর্তমান ভারতের দক্ষিণের কয়েকটি রাজ্যে টিকে আছে। এরমধ্যে প্রধান চারটি ভাষা হলো, তামিল, তেলুগু, কানাড়া, আর মালয়লাম। তামিল ছাড়া বাকিগুলো তিনটি ভাষা বিভিন্ন পরিমাণে সংস্কৃত ভাষার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে নতুন ভাষায় রুপ নিয়েছে, ফলে এগুলোকে বলা যায় তামিল প্লাস কিছু পরিমাণ সংস্কৃত ভাষার মিশ্রণ।একমাত্র তামিল ভাষা তাঁর পূর্ণ স্বকীয়তা ধরে রাখতে পেরেছে। তামিল ভাষা পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন ভাষা, সংস্কৃতের চেয়েও পুরনো হতে পারে, সেটা যদি নাও হয় অন্ততঃ সংস্কৃতের সমান পুরাতন ভাষা । তামিল ভাষার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো এটি লোকমুখে প্রচলিত ভাষা। গত কয়েক হাজার বছর ধরে একই রকম আছে। তামিল স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা কোন রকম সমস্যা ছাড়া ২ হাজার বছরের পুরনো তামিল লেখা পড়তে পারে। তামিল সংস্কৃতের মত মৃত বা কৃত্রিম কোন ভাষা নয়। সংস্কৃত ভাষা কখনো সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা ছিল না। সংস্কৃত হলো ক্ষমতাসীন ব্রাহ্মণ পন্ডিতদের জ্ঞানচর্চার ভাষা। এই ভাষায় তারা নিজেদের মধ্যে জ্ঞানের ভাব-বিনিময় করত।
সংস্কৃত আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তামিল জাতি কয়েক হাজার বছর ধরে সংগ্রাম করে আসতেছে। তামিল ভাব-সম্পদ লুট করে তাদেরকে শত্রু, ভিলেইন বানানোর ইতিহাস অনেক প্রাচীন। সংস্কৃতায়ন বলতে আমরা আক্ষরিকভাবে সাহিত্য, পুরানের সংস্কৃত ভাষায় রুপান্তর বুঝলেও এর আসল মানে হলো নতুন নতুন জনসমাজকে বর্ণাশ্রমের মধ্যে ঢুকানো। প্রথমে তাদের গল্প-গাঁথা, কাব্য-সাহিত্যকে সংস্কৃত ভাষায় রুপান্তরিত করে নিতে হয়। যেমন, কুন্ডলিনী শব্দটি এখন কুন্ডলী পাকানো সাপের মত শক্তি বলে কল্পনা করা হয়। এছাড়া সংস্কৃত ভাষায় কুন্ডলীর আর কোন মানে হয় না। অপরদিকে তামিল ভাষায় কুন্ডল বা কুন্ডি শব্দটির মানে পাছা বা বাটি এবং ইনিমাই (iniimai) মানে আনন্দ, সুস্বাস্থ্য, খুশি। কুন্ডলিনী মানে তাই কুন্ডল বা পাছা তথা পেটের শান্তি, Pleasure of the kundal, HAPPINESS of the STOMACH and butt..
সাংস্কৃতিকভাবে আত্তীকরণের পরে কয়েক জেনারেশন পরে দেবভাষা সংস্কৃতে রচিত যে কোন রচনা মানুষকে বিশ্বাস করানো যায়। আর একটা সংস্কৃত কিতাবে বিশ্বাস করার মানে হলো বাকিগুলোও সব আস্তে আস্তে মানতে হবে। বিশেষ করে চিরস্থায়ী বর্ণপ্রথার মাধ্যমে সদ্য অধীকৃত ভূমির মানুষকে অন্ত্যজ শ্রেণীতে ফেলে দিয়ে কঠোর বৈদিক নিয়ম অনুশাসনের জীবন ব্যবস্থা। তামিল যেহেতু প্রাচীন ভাষা ও সংস্কৃতি সেজন্য তাদের অভিজ্ঞতার ঝুলি অনেক ভারী। তারা ফার্স্ট হ্যান্ড আর্য্যকরণ, সংস্কৃতকরণের ফল দেখেছে।
আর্য্য আগ্রাসনের কারণে তামিল ভাষা দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়ে। ভারত এবং শ্রীলংকার বাইরে মালয়শিয়া ও সিঙ্গাপুরে এর আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি আছে। ব্যবসা-বাণিজ্যের সূত্রে সুপ্রাচীন তামিল জাতির পশ্চিমে ইওরোপ থেকে শুরু করে পূর্বে কোরিয়া ও জাপান পর্যন্ত যোগাযোগ ছিল।
ভাষাতাত্ত্বিক দিক থেকে কোরিয়া ও জাপানের ভাষার সাথে তামিল ভাষার অদ্ভূত মিল দেখতে পাওয়া যায়। পাশ্চাত্যের মিশনারীরা দক্ষিণ ভারত থেকে কোরিয়া ও জাপানে গিয়ে সেখানকার ভাষার সাথে তামিল ভাষার সম্পর্কের ব্যাপারটা প্রথম লক্ষ্য করেন।
কোরিয়ান ভাষার সাথে তামিল ভাষার মিলঃ
১৯০৫ সালে হোমার হুলবার্ট সর্বপ্রথম তামিল ভাষার সাথে কোরিয়ান ভাষার সম্পর্কের কথা বলেন। উনবিংশ শতকে ইওরোপিয়ান মিশনারীরা দক্ষিণ ভারত থেকে কোরিয়া, জাপানে পৌঁছালে সেখানকার ভাষার সাথে তামিল ভাষার মিল দেখতে পান। হোমার হুলবার্টের লেখা বইয়ের নাম, A Comparative Grammar of the Korean Language and the Dravidian Languages of South India– Homer B. Hulbert। সেখানে তিনি এই আলোচনার সূত্রপাত করেন এবং আশাবাদ ব্যক্ত করেন ভবিষ্যতে এই বিষয় নিয়ে আরো অনেক স্টাডি হবে, তখন আমরা এই সম্পর্ক সম্বন্ধে ভালোভাবে জানতে পারব।
“The time must come when special work will be done along the lines of the pre-Aryan languages which have survived and which today find so many exponents in Asia and the islands of the Pacific.”
এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য-প্রমান থেকে মনে করা যায় খুব সম্ভবত প্রাচীনকালে কোরিয়ান এবং দ্রাবিড়িয়ান ভাষার একটা কমন ঐতিহ্য ছিল। পরবর্তীকালে কোরিয়ান উপদ্বীপে তামিল ভাষাভাষী আরো অভিবাসী যাওয়ার ফলে সেই প্রাচীন সম্পর্ক আরো পাকাপোক্ত হয়। খ্রীস্টপূর্ব প্রথম মিলেনিয়ামের শেষ দিকে সেটা ঘটে বলে ধারণা করা হয়।
পঞ্চদশ শতকে কোরিয়ান বর্ণমালার প্রচলন হয়, এবং শব্দের উচ্চারণ থেকে এর লিখিত রূপের চালু করা হয়। তামিল ব্যাকরণবিদেরা মনে করতেন স্বরবর্ণ শব্দাংশের প্রাণ আর ব্যঞ্জন বর্ণ হলো এর শরীর। কোরিয়ানরাও একইভাবে মনে করে স্বরবর্ণগুলো হলো মা, আর ব্যঞ্জনবর্ণগুলো তাদের সন্তান। কোরিয়ান সর্বনাম আর দ্রাবিড়িয়ান ভাষার সর্বনামগুলো এক। সর্বনামের পরে ১ থেকে দশ পর্যন্ত সংখ্যাগুলো একই উচ্চারণ।
পার্থক্যঃ দ্রাবিড়িয়ান ভাষার সাথে কোরিয়ান ভাষার পার্থক্য হলো দ্রাবিড়িয়ান ভাষায় শব্দগুলো অবশ্যই স্বরবর্ণ দিয়ে শেষ করতে হবে। কোরিয়ান ভাষায় সেটা মানা হয় না। অপরদিকে জাপানিজ ভাষায় শব্দের বেলায় শেষে স্বরবর্ণ রাখতে হবে সেটা তো মানা হয়ই এমনকি সিলেবলের ক্ষেত্রেও সেটা মানা হয়। বুঝা যাচ্ছে ইতিহাসের কোন এক বাঁকে এসে তামিলের সাথে পৃথক হয়ে কোরিয়ান ও জাপানিজ ভাষা দুটি বিপরীত দিকে অগ্রসর হতে থাকে। কোরিয়ানরা স্বরবর্ণের পরিমান কমিয়ে দেয় অপরদিকে জাপানিজরা সেটাকে এক্সট্রিম পর্যায়ে নিয়ে যান, শব্দ তো বটেই, সিলেবলকেও স্বরবর্ণের প্রাধান্য দিতে শুরু করেন।
তামিল ভাষার সাথে জাপানিজ ভাষার সম্পর্কঃ
তামিল এবং জাপানিজ ভাষায় অনেক অনুকারশব্দ (Onomatopoeia) ব্যবহার করা হয়।
ওনো সুসুমু (Ohno Susumu, 大野 晋) নামের এক ভাষাবিদ ১৯৫০ এর দশকে জাপানিজ ভাষা তামিল ভাষা থেকে উৎপত্তি হয়েছে বলে মত প্রকাশ করেন। তিনি The Origin of the Japanese Language বইয়ে ভাষাতত্ত্ব, সংস্কৃতির ইতিহাস এবং নৃতাত্ত্বিক প্রয়োগ করে প্রচুর তথ্য-উপাত্ত প্রমাণ হিসেবে দাখিল করেন। বলাবাহুল্য আর্য্য অহংকারী জাপানিজরা সেটা ভালোভাবে নেয়নি। ফলে এই বিষয়ে তেমন গবেষণা হয় নি। ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানে ভাষাতত্ত্ব, নৃতত্ত্বের মত বিষয়গুলোর গুরুত্ব কমে যাওয়ায় এসব বিষয়ে গবেষণা আর এগোয়নি। তবে কেউ কেউ এখনো বিষয়টা নিয়ে ভাবছেন ( Korean and Dravidian: Lexical Evidence for an Old Theory- Morgan E. Clippinger)
তামিল সিদ্ধাদের প্রতীকের ব্যবহার থেকেও কোরিয়া ও জাপানের সংস্কৃতির সাথে তামিলদের সাথে আরেকটা মিলের জায়গা দেখা যায়। তামিল প্রতীককে কারাতের মত মার্শাল আর্টে উলটো করে আপসাইড-ডাউন করে ব্যবহার করা হয়। এই বিষয়টা নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ কারণ একই প্রতীককে উলটে দিয়ে ভিন্ন ধরণের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে।
বর্তমান ভাষাতাত্ত্বিক তালিকায় তামিল এবং জাপানিজ ভাষা ভিন্ন গ্রুপে অবস্থিত, তারপরেও তাদের মধ্যে শব্দগত মিল একেবারে অস্বীকার করা যায় না। হয়ত এখন তারা সম্পর্কিত নয়, অথবা একসময় সম্পর্কিত ছিল। সম্পর্কিত না হলেও যেকোন ভাবেই হোক দ্রাবিড়িয়ান ভাষাগুলো কোরিয়া ও জাপানী ভাষাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। বিশেষ করে কোরিয়া ও জাপানের ভাষায় এমন কিছু দ্রাবিড়িয়ান শব্দ আছে যেগুলো সাধারণত কোন জনগোষ্ঠী অন্যকারো কাছ থেকে গ্রহণ করে না, কারণ সেগুলো একান্ত নিজেদের, দৈনন্দিন ব্যবহৃত শব্দ।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন