(জেনারেল সুহার্তোর নেতৃত্বে ইন্দোনেশিয়ায় ১৯৬৫ সালে সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হন সুকর্ণ, এ সময় অসম্ভব শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল সে দেশের কমিউনিস্ট পার্টি। তখনকার সাত কোটির মত জনসংখ্যার দেশে ওই পার্টির সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায় ৩০ লাখ। সুহার্তোর নেতৃত্বে অভ্যুত্থানের সময় নির্বিচারে গণহত্যা চালায় সামরিক বাহিনীর একাংশ। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় ইসলামিক ধর্মীয় জঙ্গী গোষ্ঠী, বাদ যায় না চীন থেকে বিতাড়িত বিপ্লব বিরোধী বেঈমানরা এবং খ্রিস্টান মৌলবাদীরা। ২০ থেকে ৩০ লাখ মানুষ গণহত্যার শিকার হন। কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য, শুভাকাঙ্ক্ষী, শিল্পী, সাহিত্যিক, প্রগতিশীল চিন্তাবিদদের বেছে বেছে হত্যা চলে। ব্যাপক ধর্ষণের শিকার হন নারীরা। ঘটনার ৫০ বছর পর পুনরায় তিনি ইন্দোনেশিয়ায় যান। পরবর্তীবার ইন্দোনেশিয়ায় গিয়ে তিনি যা দেখেছেন, তাই বিবৃত হয়েছে এই লেখায়। – ইমাম গাজ্জালী)
গত বছর ইন্দোনেশিয়া গিয়েছিলাম। সেখানে যা দেখলাম, তা সহ্য করা দুঃসাধ্য। এটা আমাকে বেদনায় এতটাই কাতর করে তুলেছিল যে, আমি মানসিক ও শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। আমার মনে হয়েছে, ইন্দোনেশিয়া পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে দূর্নীতিগ্রস্ত ও দয়ামায়াহীন দেশ। খুব সম্ভবত দুনিয়ার মধ্যে সবচেয়ে কূপমণ্ডুক ও অন্ধ বিশ্বাসীদের দেশ। সেখানে ভুক্তভোগীরা বিচার পায় না, কিন্তু গণহত্যা ও ধর্ষণে অভিযুক্তরা বুক ফুলিয়ে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ায়। তারা সরকারের বিভিন্ন স্তরে দাপটের সঙ্গে অবস্থান করে।
যা কিছু ভাল এবং মহৎ, তা কখনোই সুপরিণতির দিকে যায় না। এর বিপরীতে সবকিছুই পরিণতির দিকে যেতে ভুল হয় না। যেমন দামী মদ তৈরি হতে পারে পচা দুধ কিংবা ভিনিগার থেকে। কখনো কখনো তারচেয়েও খারাপ কিছু থেকে। একদা সমাজতান্ত্রিক, প্রগতিশীল এবং সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী দেশ এভাবেই মৃত প্রাণীর ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপের সহযোগিতায় ১৯৬৫ সালের ক্যু দেতা’র পর, ইন্দোনেশিয়াতে ২০ থেকে ৩০ লাখ মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। হত্যা করা হয় শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, ইউনিয়ন নেতা এবং কমিউনিস্টদের। এদের হত্যা করার আগে তাদের বিস্তারিত তালিকা দেওয়া হতো জার্কাতায় অবস্থিত মার্কিন দূতাবাস থেকে। হত্যাকাণ্ডে সাম্রাজ্যবাদের অকুণ্ঠ সহযোগিতা ও সমর্থন ছিল। প্রধানত সেনা সদস্যরা এই হত্যাকাণ্ডে শামিল হয়। তাদের সাহায্য করতে ধর্মীয় উম্মাদনা নিয়ে এগিয়ে আসে জঙ্গীরা। তাদের মন-মগজ ধর্মীয় কূপমণ্ডুকতায় আচ্ছন্ন। যারা অন্তত চিন্তা করতে পারে, তাদের সকলকেই হয় হত্যা করা হয়, নয়তো কারাগারে অন্তরীণ রাখা হয়। হুমকির মুখে ফিল্ম স্টুডিওগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়, বই-পুস্তক সব জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। বামপন্থী দলের গণসংগঠনে সক্রিয় সকল নারী সদস্য ধর্ষণের শিকার হয়। বর্বরতার মাত্রা সীমা ছাড়িয়ে যায়। ধর্ষণের পর ওইসব নারীর স্তন কেটে ফেলা হয়। এভাবেই ধর্মোন্মাদ ও যৌন বিকৃতদের উল্লাস চলতে থাকে। শুধু ইসলামি মৌলবাদী জঙ্গীরাই নয়, ওই অভ্যুত্থানের আগে হল্যান্ডসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রফেশনাল খ্রিস্টান জঙ্গীরা ইন্দোনেশিয়ায় চলে আসে। সেনাবাহিনীসহ মুসলমান, হিন্দু, প্রটেস্ট্যান্ট ও ক্যাথলিক মৌলবাদীদের সঙ্গে ওই খ্রিস্টান জঙ্গীদের ছিল গলায় গলায় মিল। তারা কমিউনিস্ট এবং অন্য বামপন্থীদের ‘বিপজ্জনক নাস্তিক‘ বলে প্রচার করত। তাদের সমূলে উৎখাত করার জন্য নাগরিকদের মগজ ধোলাই করা হত। এজন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ চলত। চীনে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার পর সেখান থেকে বিতাড়িত হয় বিপ্লব বিরোধী বেঈমানরা। তারা দলে দলে আসতে থাকে ইন্দোনেশিয়ায়। পৈশাচিক উল্লাসে তারাও এসে যোগ দেয় খুনী, বিশ্বাসঘাতক এবং দেশদ্রোহী জেনারেল সুহার্তোর ছায়াতলে। চীন থেকে আসা বেঈমানরা কাজ করত গোয়েন্দাগিরির।
ইন্দোনেশিয়াতে সংখ্যালঘু চীনা বংশোদ্ভূত নাগরিকরা ছিল কিছু কিছু ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার। অথচ তারাও যোগ দেয় দেশী-বিদেশী নিপীড়ক শক্তির সঙ্গে। এরা সাম্রাজ্যবাদ, দুর্বৃত্ত পুঁজিবাদ এবং সামরিক স্বৈরতন্ত্রের সঙ্গে নিলর্জ্জভাবে সহযোগিতা করা শুরু করে। এতে তাদের ভিত্তি আরো শক্তিশালী হতে থাকে। এই চীনা বংশোদ্ভূত ইন্দোনেশীয়রা দেশের অর্থনীতির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ নিয়ন্ত্রণ করত। তাদের মালিকানাধীন ছিল মগজ ধোলাই করার মত অসংখ্য গণমাধ্যম আর বেসরকারি বিদ্যাপিঠ। ১৯৬৫ পরবর্তী ইন্দোনেশিয়ার পতনে সে দেশের চীনা সংখ্যলঘুরা খুবই নির্ধারক এবং ধ্বংসাত্মক ভূমিকা পালন করে। চীন বিপ্লবের সঙ্গে মিল থাকা সবকিছুই নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসে। সেগুলোকে ধ্বংস করা হয়। যেমন লাল রং, চীনা ভাষা এবং ‘কমিউনিজম‘ শব্দটি পর্যন্ত। চীনের দক্ষিণপন্থী সমাজতন্ত্র বিরোধী শক্তিগুলো গয়রহভাবে ইন্দোনেশিয়ায় পাড়ি জমাতে থাকে। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী প্রগতিশীল নেতা সুকর্ণের ‘গোল্ডেন চাইল্ড‘ ছিল ইন্দোনেশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি – পিকেআই। এ কারণে সুকর্ণকে ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করতে চীন থেকে বিতাড়িত হওয়া বেঈমানরা সুহার্তোর সঙ্গে হাত মেলায়। গণহত্যার পর ইন্দোনেশিয়াতে ব্যাপকহারে রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিক্রি শুরু হয়। সেই সঙ্গে চলে দূর্নীতি এবং বেসরকারিকরণ। বুদ্ধিবৃত্তিক বন্ধ্যাত্ব মানুষকে শাসন করত। লাখো মানুষের খুন, ধর্ষণ আর সীমাহীন চুরি-চামারি চলত রাষ্ট্রের আস্কারায়। এভাবেই বিশ শতকের বেঈমানীর ইতিহাস গড়ল তারা। ওই দুর্যোগের পর ইন্দোনেশিয়া ভ্রমণের ওপর আমি নিজের ওপর নিজেই নিষেধাজ্ঞা জারি করি। পরে সেই ঘটনার ৫০ বছর পর ফের যাওয়া হল দেশটিতে। এইসময় আমি ইন্দোনেশিয়া এসেছিলাম, সেটা কোনো একাডেমিক কাজ ছিল না, কারণ একাডেমিক কাজ থেকে নিজেকে দূরে রেখেছি। এসেছিলাম সাংবাদিকতার কাজে, অর্থাৎ একে বলা যায় নিছক পতিতাবৃত্তির কাজ। যখন সমকালীন একাডেমিক কাজ বুদ্ধির মৃত্যু ঘটায়, তখন প্রতিষ্ঠান এবং একাডেমিকতাকে ভেঙ্গে ফেলে দর্শন। কারণ দর্শনের কারবার জীবনকে নিয়ে।
আমার বইয়ের নাম, ‘ইন্দোনেশিয়া: আরকিপেলাগো অব্ ফিয়ার‘ (ইন্দোনেশিয়া: ভীতির দ্বীপপুঞ্জ)। এটা তিন বছর আগে প্রকাশিত হয় লন্ডনে, এরপর ইন্দোনেশিয়ার ভাষায় অনুবাদ করেও প্রকাশ করা হয়। আরো অন্যান্য ভাষাতেও অনূদিত হয়। আমি ফের ইন্দোনেশিয়ায় আসি সেই দূষিত বাতাসে নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য আর সেখানকার ক্ষয়ে যাওয়া সমাজ দেখার জন্য। সে ধ্বংসযজ্ঞ দেশটির রাজধানীতে গেলেই টের পাওয়া যায়। আমি দেখেছি, সেখানকার মানুষের ভাবলেশহীন মুখ, যেন অর্জনের পুরোটাই ধ্বংস হয়ে গেছে। সে অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হলাম পূনরায়। আমি এমন সমাজ প্রত্যক্ষ করলাম যেখানে বিজ্ঞান, দর্শন ও শিল্পকলাকে ধ্বংস করা হয়েছে। যেখানে স্থানীয় শ্রমিকরা দুইটি টাইলসকে যেন একসঙ্গে মেলাতে পারে না। এসব দেখে আমি চিৎকার করতে করতে ফিরে আসি। অভিশাপ দিতে দিতে ফিরে এসে কলম ধরি। কারণ আমি সতর্ক করে দিতে চাই। যারা সত্যিকার অর্থেই মনে করে এই দেশে দুর্বৃত্ত পুঁজিবাদ এখনো সক্রিয়, এখানকার কথিত অভিজাতেরা পশ্চিমাদের পা মোছার পাপোষ হিসাবে থাকতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করে। তারা কোনোপ্রকারে টিকে থাকা কিংবা নিজে নিজে ধনী হওয়াটাকেই বড় সার্থকতা মনে করে। আমি সত্যটাই বলতে এসেছিলাম যে,
‘ইন্দোনেশিয়ার মৃত্যু হয়ে গেছে, ১৯৬৫ সাল থেকেই দেশটিকে হত্যার আয়োজন শুরু হয়। এটা এখন মৃত, কফিনবন্দী লাশ। এটা আর জীবন ফিরে পাবে না। এ দেশের মানুষ বেঁচে আছে ঠিক, তবে একে সত্যকার বাঁচা বলে না। ভিতরে ভিতরে তারা ভয়ঙ্করভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত।’
কিন্তু এসব কথা আমাকে বলতে দেওয়া হয় নাই। কণ্ঠরোধ করা হয়েছে। এর একমাত্র সমাধান হল বিপ্লব। যেমনটা প্রমদ্য অনন্ত তোয়ের বলতেন,
“সামগ্রিক বিপ্লব হল একটা সম্পদ। এটা নতুন রূপে ফিরে আসবেই। যাকে ১৯৬৫ সালেই শেষ করে দেওয়া হয়েছিল। সেটা এখন মৃত, তাকে কবর দিতে হবে। যারা বিপ্লবের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল, তাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। তারপর প্রথম থেকে শুরু করতে হবে। শূন্য থেকে আরম্ভ করতে হবে। এটাই বাস্তবতা, এরজন্য কোনো চিন্তকের উদ্ধৃতি কিংবা পাদটীকার দরকার নাই।”
সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এবং দেশীয় ‘অভিজাত‘দের মধ্যকার সমঝোতা:
এই চুক্তিটিতে পরিষ্কার বলা ছিল, পশ্চিমারা শুধু অভ্যুত্থান সহযোগীদের লুটপাটের অনুমোদন দিবে। সেই তালিকায় থাকবে তাদের ধর্মীয় সাঙ্গাৎ আর দালাল বুদ্ধিজীবীরাও। সীমিত পর্যায়ের দূর্নীতিকে সহ্য করা হবে। এর বিনিময়ে ইন্দোনেশিয়ার জনগণের মগজ ধোলাইয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের অশিক্ষিত রাখতে হবে, কখনোই তারা কমিউনিস্ট পার্টির ছায়াতলে ফিরে আসার দাবী জানাবে না। মহৎ মতাদর্শের জন্য সংগ্রাম করবে না। ইন্দোনেশিয়ার প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর বাছবিচারহীন লুটপাট নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলবে না। কেউ প্রশ্ন করবে না বাজার অর্থনীতির মৌল নীতি নিয়ে। চুক্তিতে এর নিশ্চয়তা চাওয়া হয়েছিল।
উত্তর আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ার গোয়েন্দাদের চর হিসাবে কাজ করা খ্রিস্টানদের নিয়ে আসা হয়। এরাই সেখানে খ্রিস্ট্রিয় ধর্মান্ধতার বীজ বুনে দেয়। এরা ভয়েস অফ আমেরিকা শুনত, পশ্চিমা অর্থনৈতিক ম্যাগাজিন পড়ত, এরা হঠাৎ করেই নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। দেশটির সৌদি ওয়াহাবি সমর্থকরা ছিল পশ্চিমাদের নির্লজ্জ সহযোগী। তাদের সঙ্গে ইসলামি সমাজতন্ত্রের তকমা লাগানো স্থানীয় মুসলিম সমাজ সর্বগ্রাসী ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম চালাতে থাকে। সেইসঙ্গে ধ্বংসযজ্ঞ চলে বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদের। পশ্চিমা গণমাধ্যম এবং তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক আয়োজন নির্লজ্জভাবে ফ্যাসিস্ট ও ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীলতাকে সহায়তা দিতে থাকে। তারা নগ্নভাবে মিথ্যাচার শুরু করে। প্রচার করতে থাকে, ইন্দোনেশিয়া একটি সহিষ্ণু দেশে পরিণত হয়েছে, এটি একটি মধ্যপন্থী দেশ। পৃথিবীর মধ্যে তৃতীয় বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ – ইত্যাদি, ইত্যাদি।
পশ্চিমা দেশের নেতারা ইন্দোনেশিয়ার ব্যাপারে কথা বলার সময় দেশটির একটি বিশেষ পার্টির কথা কখনো উল্লেখ করত না। সতর্কতার সঙ্গে এড়িয়ে যেত। যে পার্টি ছিল সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী এবং সত্যিকারঅর্থেই জনগণের পার্টি। ইন্দোনেশিয়াকে তারা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হিসাবে অভিহিত করত। যা ছিল সম্পূর্ণ বিভ্রান্তিকর। তারা এই বিবেচনায় তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ বলত যে, কারণ ওই অঞ্চলের যে কোনো দেশের তুলনায় ইন্দোনেশিয়ায় জনসংখ্যা তিনগুণের বেশী। এ কারণেই এই সংজ্ঞা কী সেখানে খাটে? যেখানে বলতে গেলে প্রায় কোনো কিছুই উৎপাদন হয় না, দেশটির প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর চলে সীমাহীন লুটতরাজ। প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর পাপুয়া জাতিগতভাবে নিপীড়িত, অথচ সেখানে ইন্দোনেশিয়া ভয়ঙ্করভাবে চালায় নীরব গণহত্যা। দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ীর স্বার্থে কাজ করত স্থানীয় গণমাধ্যম। এরা নিরবচ্ছিন্নভাবে পশ্চিমাদের মিথ্যা প্রচারণা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে নিজেদের যুক্তি দাঁড় করাত। শুধুমাত্র জাভাতেই ৪০ শতাংশ শিক্ষককে হত্যা করা হয়। এ ঘটনার পর সেখানকার শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে। শিক্ষা চলে যায় মূর্খদের হাতে। যারা চরম স্বার্থপর, বেহায়া এবং টাকার কুমির। তারা সাম্রাজ্যবাদীদের পদলেহন করে চলত, শিক্ষা নিয়ে যাদের ন্যূনতম আগ্রহ ছিল না। প্রতিটি কাজে তাদের অজ্ঞতা ও নির্বুদ্ধিতা প্রকাশ পেত।
ব্যাপক লুটতরাজ, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা, জীবনের গভীরতম বোধ এবং সৃজনশীলতাকে থামিয়ে দেওয়ার ঘটনা, পৃথিবী সম্পর্কে সঠিক ধারণা দিতে যুবসমাজকে অন্ধকারে রাখা – এসব ঘটনার পর সত্যকার অর্থেই জাতি হিসাবে ইন্দোনেশিয়া তার ছন্দ হারিয়ে ফেলে। ৩০ কোটি জনসংখ্যার দেশে একজনও আন্তর্জাতিক মানের ব্যক্তিত্ব, বৈজ্ঞানিক অথবা সঙ্গীতজ্ঞ তৈরি হতে পারে নি। প্রমদ্য অনন্ত তোয়ের ছিলেন সুকর্ণ যুগের একজন বিশিষ্ট চিন্তাবিদ। তার সমতুল্য একজন চিন্তকও নেই।
দেশটির সবখানেই নোংরা আবর্জনা, সমাজের সবখানেই ভয়ঙ্কর অসততা এবং বৈপরীত্য। রেঞ্জ রোভার কার শপ কিংবা গুচ্চি বুটিক্স-এর মত অভিজাত ফ্যশনমলের পাশেই দেখা যায় খোলা নদর্মা আর হাড্ডিসার শিশুর দল। ইন্দোনেশিয়াতে শিশুদের খেলার মাঠ পাওয়া দুষ্কর। সেখানে বর্জ্য ব্যবস্থাপনাসহ পার্ক কিংবা ফুটপাত পাওয়াও কষ্টসাধ্য। দেশটিতে কোনো জনশিক্ষামূলক টেলিভিশন চ্যানেল নাই। এটা জেনে অবাক হবেন যে, দেশটিতে পাবলিক লাইব্রেরির অস্তিত্ব প্রায় নেই বললেই চলে। এমনকী পানীয়জলও সেখানে বেসরকারি মালিকানায়। নাগরিকদের পড়ালেখার বালাই নাই। একের পর এক বইয়ের দোকান বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল, বছরে মাত্র কয়েক’শ বই অনুবাদ হত। তার বেশিরভাগই বাণিজ্যিক, মানও ভয়াবহরকমের খারাপ। সেগুলো কোনো কাজের নয়।
শহর সবসময় অন্ধকার থাকে। সড়কগুলো খুবই সংকীর্ণ ও খানাখন্দে ভরা, এমনকী ট্রান্স জাভা মহাসড়কটিও মাত্র দুই লেনের, সেখানেও স্থানে স্থানে গভীর গর্ত। মালয়েশিয়া কিংবা থাইল্যান্ডের গ্রামের রাস্তাও এরচেয়ে ভাল। নগর ও দেশের সকল সড়কে লেগে থাকে নিত্যদিনের যানজট। এমনকী একজন দরিদ্র মানুষও সেখানে প্রাইভেটকারের ওপর নির্ভরশীল। সেখানকার যোগাযোগ ও অবকাঠামো দীর্ঘদিন ধরে অচল। ইন্টারনেট এবং ফোন নেটওয়ার্কের অবস্থা এতটাই খারাপ যে, শুধু একটা বড় ফাইল ডাউনলোড করতে আমাকে সিঙ্গাপুর পর্যন্ত যেতে হয়েছিল। পুরানো ফেরিগুলোর ডুবে যাওয়া, উড়োজাহাজ ফ্লাই করতে না পারা, ট্রেন লাইনচ্যুত হওয়া – এগুলো সেখানে সাধারণ ঘটনা। কোনো বন আর অক্ষত নাই, পুরো জাতিটাই যেন প্রস্থান করছে, মানসিকভাবে অচল, ধ্বংসপ্রাপ্ত এবং মাতাল। ইন্দোনেশিয়া বস্তত ভয়ঙ্কর মৃতদেহ, যা নিয়ে পশ্চিমারা উল্লাসে নৃত্য শুরু করছে। তারপরেও দেশটিকে ‘গণতান্ত্রিক, সহিষ্ণু’ বলে উপস্থাপন করছে। চিন্তা করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে ইন্দোনেশিয়ার যুবকরা। এর পরিবর্তে তারা শুনছে উদ্ভট অর্থহীন পপ সঙ্গীত, তাদের চোখমুখে বুদ্ধিদীপ্তির ছাপ নাই। তারা সবসময় তুচ্ছ এবং হালকা ও স্থূল রসিকতায় মেতে থাকে। পশ্চিমা সরকার ও কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের কাছে নিজেদেরকে নিঃশর্তভাবে উৎসর্গ করে দিয়েছে তারা।
ফিচার ডকুমেন্টারি ফিল্ম দেখানোর জন্য কিছুদিন পর পূনরায় চলে আসলাম ইন্দোনেশিয়ায়। জাকার্তার টিআইএম নামে একটি ফিল্ম ক্লাবে সেটি প্রদশর্নীর আয়োজন করা হয়েছিল। ফিল্ম ক্লাবে মাত্র ৪৫টি আসন ছিল। ৩০ কোটি মানুষের দেশটির এই একটি মাত্র ফিল্ম ক্লাব। আমার ফিল্মটি ছিল ১৯৬৫ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের ওপর। সেটি আমি ১১ বছর আগে নির্মাণ করেছিলাম। ১৯৬৫ সালের ঘটনার ওপর এটিই ছিল একমাত্র প্রামাণ্য চলচ্চিত্র। শিরোনাম ছিল: ‘Terlena – Breaking of A Nation‘ ব্রেকিং অব এ নেশন। ওই প্রামাণ্য চলচ্চিত্রে দেখানো হয়েছিল ইন্দোনেশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট আবদুর রহমান ওয়াহিদ এবং বিশিষ্ট চিন্তাবিদ প্রমদ্য অনন্ত তোয়েরকে। তারা দু’জনেই ছিলেন আমার খুব পুরানো বন্ধু। তারা কয়েকবছর আগেই মৃত্যুবরণ করেছেন। আমি তাদের খুব মিস করছিলাম। তারা ছিলেন প্রগতিশীল মানুষ এবং সমাজতন্ত্রীদের খুব বিশ্বস্ত বন্ধু। আবদুর রহমান ওয়াহিদকে সেদেশের তথাকথিত অভিজাতেরা উচ্ছেদ করে দেয়। আর প্রমদ্য অনন্ত তোয়ের ছিলেন ইন্দোনেশিয়ার একজন প্রখ্যাত চিন্তাবিদ। তিনি ছিলেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিশিষ্ট লেখক। আমার নিজের ছবিতে তাদের দেখে নিজেই মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হয়ে পড়ি। পর্দায় যখন তাদের মুখ ভেসে উঠে, আমি ভাবি কতই না জীবন্ত ছিলেন তারা। যখন বয়সের ভারে আর রোগে-শোকে ন্যূব্জ হয়ে পড়েছিলেন, তখনও তারা ছিলেন দৃঢ়চেতা ও আত্মপ্রত্যয়ী। জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের মহান নেতা প্রেসিডেন্ট সুকর্ণের হাত ধরে বেড়ে ওঠা প্রজন্মের প্রতিনিধি ছিলেন তারা। কত জীবন্তই না ছিলেন! তাদের সঙ্গে বর্তমানের প্রজন্মের যুবকদের এতটুকুও মেলানো যায় না। ইন্দোনেশিয়ার এই প্রজন্মের যুবকেরা হলো নিষ্ঠুর, লোভী, ধূর্ত আর স্বার্থপর। এরা ভাবলেশহীন, আবেগহীন ও নীচু মানের, যারা নিজের ছাড়া আর কিছুই বোঝে না। বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে বিচ্ছিন্ন ও নীতি-নৈতিকতাশূন্য যুবকের দঙ্গল। তাদের সঙ্গে কীভাবে মেলাব ওই দুই ব্যক্তিত্বকে? ছবিটি দেখানোর পর স্বভাবতই আশা করেছিলাম দর্শক সারি থেকে নানা প্রশ্ন আসবে। তারা বলবে, ‘এখন আমাদের করণীয় কী? কিংবা বর্তমান প্রজন্ম সম্পর্কে আপনি কী চিন্তা করেন?‘
অনেক আগে একবার এক তরুণী আমার কাছে জানতে চেয়েছিল,
“শাসক শ্রেণী যেভাবে আমাদের গড্ডালিকায় ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সেখান থেকে কীভাবে ফিরে আসবো? সেখান থেকে ফেরার পথ কী?”
তারা মানবতার পক্ষে কাজ করার অভিপ্রায় জানিয়েছিল। কিন্তু এখন চিন্তা করি, ওইসময় তারা কী মিথ্যা বলেছিল। কারণ তারা এখন পলায়নপর, ক্ষীণ বিপজ্জনক, বিশ্বাসভঙ্গকারী। হুইসেল দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যেন তারা ফ্যাসিস্টদের ক্যাম্পে ভিড়ে যাচ্ছে। তাদের দূর্নীতিগ্রস্ত পিতা, পিতামহ দেশকে বিষাক্ত করে তুলেছিল, দলে দলে তাদের ছায়াতলে আশ্রয় নিচ্ছে তথাকথিত তরুণরা। আমি ইন্দোনেশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কথা জানি। যখন আমি লেকচারে গুরুত্বপূর্ণ ও আবেগঘন কথা বলি, তখনও তারা উচ্চশব্দে মোবাইল ফোনে নিন্মমানের ব্যান্ডের গান শুনতো। কেউ কেউ সস্তামানের ফাস্ট ফুড খেত।
এই ইয়ং জেনারেশন দেখে আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। এরা নামেই শুধু ‘ইয়ং জেনারেশন’। সেখানকার ১৫ বছরের এক একটা বালক হল একটা ক্যাবলা, আহম্মক ও নির্বোধ, যেন বার্বি পুতুল। বাকিরা হল দাস, যেন পশ্চিমাদের চাকর-বাকর। এরা মননগতভাবে নির্যাতিত, ব্যক্তিত্বহীন, প্রশ্নহীন, লাজ-লজ্জাহীন ও অনুকরণ প্রিয়। খুবই দুঃখজনক ও হতাশাজনক পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে সেখানকার যুবসমাজ। তাদের কোনো স্বপ্ন নাই, মেধার প্রকাশ নাই, বিদ্রোহের ধার নাই। সবসময় হলিউডের নোংরা অশ্লীল কদর্য গান শুনত। দেশটি জ্বলছে, পুড়ছে। আধুনিক ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ গণহত্যা চলছিল পাপুয়াতে, আগে চলেছিল পূর্ব তিমুরে। এই দেশ এখন পশ্চিমা ফ্যাসিবাদের অভিশপ্ত সহযোগী। সাম্রাজ্যবাদের পোদ চেটে চলে। সেখানে দেশ বিক্রি করে দেওয়ার জন্য কেউ কারো শাস্তি দাবী করে না। এই ইন্দোনেশিয়ার যুব সমাজ হল পাশ্চাত্যের উদ্ভট ও কদর্য সংস্কৃতির ডাস্টবিন।
হায়রে ইন্দোনেশিয়ার যুব সমাজ! আমি যখন লেকচার দিই, তারা আমার কথা এক কান দিয়ে শুনে আরেক কান দিয়ে বের করে দেয়। তারপর বাড়ি ফিরে যায়। আমি ভাবি, আমার চিৎকার তাদের কাছে যেন বিনোদন। এর বেশী কিছু নয়। আমি ভেনিজুয়েলার কারাকাস কিংবা দক্ষিণ আমেরিকার কুইটোতে বসে চিৎকার করছি না। আমি জাকার্তায় বসে কথা বলছি। খুব সম্ভবত এখানে আর কোনো দিন বৈপ্লবিক পরিবেশ তৈরি হবে না।
পরবর্তী দিন বোগোর শহরের বাইরের একটি সাফারি পার্কে জলহস্তি দেখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু রাস্তায় দেখি পুলিশ জনতাকে লাঠি পেটা করছে। তারা রাস্তা বন্ধ করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে জনতার ওপর লাঠি পেটা করছে কোনো কারণ ছাড়াই। নিরস্ত্র জনতার ওপর নিজেদের বীরত্ব দেখাচ্ছিল যে, দেখ আমরাও পারি। তাছাড়া এই পথে অপরাধীরা তাদের অবৈধ পণ্য বেচা-কেনা করে থাকে। পুলিশও তার ভাগ পায়। অপরাধীদের জন্য সেফ জোন করতে সড়কটি ব্লক করলে পুলিশের পকেটও ভারী হয়। যা হোক, আমি কোনো মতে এই হাইওয়ে থেকে বের হয়ে আসি। কিন্তু ততক্ষণে দূষণে আমার ফুসফুস আক্রান্ত হয়ে পড়ে। আমি এরপর বোগর শহরের পাশে থাকা বোটানিক্যাল গার্ডেনে ঢুকি। এরকম গার্ডেন পুরো ইন্দোনেশিয়ায় সামান্যই রয়েছে। যখন সেই গার্ডেনে আমি পৌঁছাই, সেটা দেখে আমার মন খুবই খারাপ হয়ে যায়। বৃহৎ নির্মাণকাজের অজুহাত তুলে বাগানটি নিয়ম মেনে ধ্বংস করা হচ্ছে। পার্কের প্রাচীন মহীরুহ গাছগুলি কেটে ফেলা হয়েছে শুধু গাড়ি পার্ক করার জায়গা করার জন্য। একটি অতি পুরাতন সেতু ছিল, সেটা ভেঙ্গে ফেলে তার জায়গায় নতুন সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। পায়ে হাঁটার জায়গা বন্ধ করে গাড়ি চলাচলের রাস্তা নির্মাণ করা হচ্ছে। গাছপালার ছায়াময় শান্ত পরিবেশে চারদিক থেকে উচ্চস্বরে পপ মিউজিকের আওয়াজ ভেসে আসে। এসব থেকে রেহাই পেতে সেখান থেকে আরেক মহাসড়কে চলে আসি। ওই রাস্তার পাশে দেখি আবর্জনার ভাগাড়। ভাগাড়ের প্লাস্টিক পলিথিন ও কাগজ পোড়ানো হচ্ছে। বিষাক্ত ধোঁয়ায় দম নিতে পারি না। মহাসড়কের মাঝখানে ছিল একদল ভিক্ষুক। তাদের শরীর ছিল নোংরা, ঘা-পচড়ায় ভরা দুর্গন্ধময়। এটি ছিল রাজধানীর জাকার্তার মাঝখানের দৃশ্য।
আগে জাকার্তায় একটি বইয়ের দোকান ছিল, সেখানে এখন ফল বিক্রি করা হয়। হোটেল-রেস্টুরেন্টে খাবারের মান খুবই খারাপ, অস্বাস্থ্যকর অথচ দাম অত্যধিক চড়া। খাবারের অর্ডার দিতে ওয়েটারদের ডেকে ডেকেও পাওয়া যায় না। তারা কাস্টমারের দিকে চোখ তুলে তাকানোর দায়ই অনুভব করে না। কোনোকিছু জিজ্ঞেস করলে কথাই বলতে চায় না। অবশ্য প্রাডা ও ফেরারিসসহ বেশকিছু অভিজাত দোকান রয়েছে। সিগারেটের বিজ্ঞাপনের বিশালাকৃতির বড় বড় বিলবোর্ড শোভা পাচ্ছিল। কিন্তু সেখানে সৌন্দর্য বলতে কিছু ছিল না। সড়কজুড়ে তীব্র যানজট। তখন গাড়িতে থাকলে অসহায়ের মত বসে থাকা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। ইন্টারনেটে গতি বলতে গেলে নেই। মোবাইল ফোনে নেটওয়ার্ক পাওয়া সৌভাগ্যের ব্যাপার। খাল-নালাগুলো ময়লা আবর্জনায় বন্ধ, অথচ পাশেই অভিজাত পোশাকের দোকান।
৫০ বছর আগে এই দেশে অভ্যুত্থান হয়েছিল, এখন তার অর্ধশততম বর্ষপূর্তির সময়। কিন্তু সেই অভ্যুত্থান নিয়ে গৌরবান্বিত বোধ করার মত মানুষ হাতে গোনা কয়েকজন। এটা হল একটা জাতির বিশ্বাসঘাতকতা এবং সাম্রাজ্যবাদের প্রতি শর্তহীন আত্মসমর্পণের ফসল। দাসোচিত আত্মসমর্পণের দেশে কোনো বিপ্লবী দার্শনিক কিংবা বিদ্রোহী তেজ নিয়ে কোনো মানুষ জন্মাতে পারে না। সেখানে কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক আয়োজন নেই। সেখানে কারো কোনো সুকুমারবৃত্তি নেই, উদ্যম ও উদ্দীপনা নেই, কোনো মানুষের ওপরেই নির্ভর করা যায় না। কাউকে বিশ্বাস করা কঠিন। সবখানেই প্রেমহীন নিষ্ঠুরতা। আসলেই কারো মধ্যে কোনো ভালবাসা নেই। অব্যাহত মিথ্যাচার, নির্লজ্জ বিশ্বাসঘাতকতা, আর অন্যায়-অত্যাচার নিয়ে নিরবচ্ছিন্ন নীরবতা দেখতে দেখতে আমি সেদেশ থেকে পালাতে চেয়েছি। সেখানকার অবস্থা দেখে আমি শুধু মানসিক যাতনা ভোগ করি নি, উপরন্তু শারীরিকভাবেও অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম।
আমি পৃথিবীর অন্তত ১৫০টি দেশে গিয়েছি। সেবার ইন্দোনেশিয়ায় আমি সবমিলে ৭২ ঘন্টা ছিলাম। ওই ৭২ ঘন্টা যেন আমি নরকে ছিলাম। যা দেখেছি, সব ভুলে যেতে চাই। আমি ভুলে যেতে চাই ইরমা, পূর্ব তিমুরের ধর্ষিত নারীদের ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ, আমি ভুলে যেতে চাই সুরাবায়া চিড়িয়াখানায় শত শত নিরীহ প্রাণী হত্যার ঘটনা। সেখানে আন্তর্জাতিক কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত সংস্থার প্রকল্প নির্মাণের জন্য ওই প্রাণীদের হত্যা করা হয়।
আমি আচেহ্ প্রদেশের সুনামীর কথা স্মরণ করি। এই দুর্যোগের পর শুধু ঘুষের জন্য পুলিশ ও সৈনিকরা উদ্ধারকর্মীদের কাজে বাধা দিত। ঘুষ না পেলে ত্রাণের জন্য আনা নিরাপদ পানির ব্যারেলগুলো কেটে দিত। আমি আরো স্মরণ করি, সুনামীর পর মানুষ ও পশুর মৃতদেহ বেঘোরে পড়ে থাকত দিনের পর দিন। কারণ সরকারী কর্মীরা ঘুষ না পাওয়ায় সেগুলো সরানোর কাজে হাত দেওয়া থেকে বিরত থাকে।
আসলে ইন্দোনেশিয়া মুর্খের মত অনুগত, নৈতিকতাবোধহীন দুর্বৃত্ত পুঁজিবাদের সুযোগ্য সন্তান। একইসঙ্গে ইন্দোনেশিয়া হল জ্ঞান-বুদ্ধিহীন ধূর্ততা, অকল্পনীয় হিংস্রতা এবং দয়া-মায়াহীন নিষ্ঠুরতার দেশ। আমি ২০ বছর যাবত দেশটির অনেক বাজে জিনিশ লক্ষ করেছি, সেগুলোর প্রামাণ্য দলিল রাখার চেষ্টা করেছি। আমি বিভ্রান্ত খ্রিস্টান যাজকদের দেখেছি। আইএসআইয়ের মত তারা ছিল উগ্র ধর্মান্ধ এবং একই সঙ্গে ধর্ষণে মুখিয়ে থাকা স্বভাব। অখ্রিস্টান যুবকদের বিয়ে করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করার কারণে যারা নিজের মেয়েদের ঘরে তালাবদ্ধ করে রাখত। সুরাবায়া শপিং মলে একবার দেখেছি, এসব দুষ্ট প্রকৃতির যাজকদের, যারা বলতে ভালবাসত যে,
“ঈশ্বর ধনীদের পছন্দ করে, এ কারণে তারা ধনী।”
আমি লক্ষ করেছি ইংরাজি ভাষাভাষী মার্কিন ও অস্ট্রেলিয়ার মদতপুষ্ট কিছু কিছু গির্জা আছে, সেখানে অল্পবয়সী বালিকাদের সঙ্গে কুৎসিত ও খেমটা নাচ-গানের আসর বসানো হত। আমি দেখেছি, সৌদি ওয়াহাবি মদদপুষ্ঠ উগ্র সুন্নি মুসলিম জঙ্গীরা মাদুরা এলাকায় গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ধ্বংস করে দিত। আমি দেখেছি, অম্বন এলাকায় একটি মসজিদ হামলার ঘটনা ঘটে, এসময় সেখান থেকে বের হয়ে একটি ছোট্ট বালিকা আতঙ্কে প্রাণ ভয়ে দৌড়াচ্ছিল। অপরদিকে, একটি ছোট্ট খ্রিস্টান বালককে সেখানকার সুন্নী মুসলিমরা চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেছিল। আমি সেখানে আগুন দেখেছি, দেখেছি অসহিষ্ণুতা, ঘৃণা এবং ইতরামী। একদা কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে সংগঠিত প্রগতিশীল দেশ ইন্দোনেশিয়ার কী করুণ এই পরিণতি! আমি দেখেছি, পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, স্বৈরতন্ত্র আর অন্ধত্ব কীই না করতে পারে!
***
আমি খুব গভীরভাবে ভেবেচিন্তে শপথ করেছি, আমি প্রামাণ্যচিত্র ‘তারলেনা‘ পূনরায় সম্পাদনা করব। আমি ওই ফিল্ম সম্পাদনা করব আমার মননে, বাকি সব চুলোয় যাক, গোল্লায় যাক। আমি প্রতিজ্ঞা করেছি, সেটাই আমাকে ভাল রাখবে। আমি জানি, ইন্দোনেশিয়া হল বিশ্বসমাজে অনুল্লেখিত উপাখ্যান। ওই উপাখ্যানে বোঝা যায়, সাম্রাজ্যবাদের ক্ষমতা কতটুকু। বর্ণিয় এবং সুমাত্রার পুরো দ্বীপ থেকে বন উজাড় হয়ে গেছে। পুরো এলাকাটি দখল হয়ে গেছে। বন্যহাতি ও বিরল প্রজাতির বানরগুলোকে মেরে ফেলা হয়েছে। সবখানে দুর্নীতি ও চুরিচামারি, সবখানেই ময়লা আবর্জনা। শুধু রাস্তা-ঘাটেই নয়, আবর্জনা রয়েছে প্রধানত মানুষের মগজে। এখানে প্রত্যক্ষ করেছি মনুষ্যত্বের মৃত্যু। মৃত্যু হয়েছে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার, সুকুমারবৃত্তির, সৃজনশীলতা আর আবেগময় ভালবাসার। আমি পালানোর চেষ্টা করি। কিন্তু আমি ভুলিনি সেই সব লাখো মানুষের মুখ, যারা বলেছিল,
“আমরা ভীষণ একা, আমরা স্মৃতি ভুলে যাওয়া জাতি।”
তারা খুব জোর করে বলেছিল,
“আরো কিছু দিন থাকুন, আরো কিছু বই লিখুন, আরো সিনেমা নির্মাণ করুন, এখনি আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন না।”
আমি জানি তারা কী বলতে চেয়েছিল। আমি চলে যাচ্ছি, তবে আবার ফিরে আসব। আমি ফিরে আসব এই অরক্ষিত প্রাণীদের জন্য, যাদের হত্যা করা হচ্ছে। আমি ফিরে আসব এই উজাড় হওয়া বনের জন্য, যেগুলি বন্যপ্রাণীর বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠেছে। ধ্বংস হওয়া সত্ত্বেও ইন্দোনেশিয়ায় ফিরে আসব। সারা পৃথিবীকে সতর্ক করতে আমাকে আসতেই হবে। আমি ফিরে এসে হত্যাকারীদের আসল পরিচয় ফাঁস করে দিব। সেটাই তাদের প্রাপ্য। শিগগিরই ফিরে এসে সাম্রাজ্যবাদের মুখোশ খুলে দিব, যারা ইন্দোনেশিয়ার সাধারণ মানুষকে নিয়ে মরণ খেলায় মেতেছিল। এসকল অপকর্মে তাদের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহৃত বিভিন্ন ধর্ম এবং পুঁজিবাদী মতান্ধতার স্বরূপ যেমন উন্মোচন করব তেমন একই সঙ্গে স্থানীয় বেঈমানদের স্বরূপও প্রকাশ করব।
এই পথেই পুনরায় বিপ্লব শুরু হতে পারে। এখনো ইন্দোনেশিয়ায় সামান্য হলেও কিছু মর্যাদাবোধ টিকে আছে। তারা এখনো লড়াই করছেন। তারা জানেন কীভাবে ভালবাসতে হয়। তাদের অনেককে হত্যা করা হয়েছে। এই নীচু হীনমন্য ও স্বার্থপরতার দেশেও তারা চিরদিন মানুষের মনে বেঁচে থাকবেন। আমি জানি সেদিন শিগগিরই আসবে, যেদিন তাদের জন্যই আমাকে আবারো চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে হবে। আমি যখন চলে যাচ্ছি, ইন্দোনেশিয়া তখন ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে। সত্যিকার অর্থেই ইন্দোনেশিয়ার জনগণের কোনো দেশ নেই। দেশটি বহু আগেই জনগণের কাছ থেকে ছিনতাই হয়ে গেছে। সেটা হাইজাক করে নিয়ে গেছে সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের সৃষ্ট দূর্নীতিগ্রস্ত ‘উচ্চবর্গ‘ ও সেনাবাহিনী। যখন তারা বুঝতে শিখবে, আসলেই কী ঘটনা ঘটে গেছে তখনই তারা লড়াই গড়ে তুলতে সক্ষম হবে আর সেই সঙ্গে গড়ে তুলতে পারবে নতুন মার্তৃভূমি।
নোট: নিবন্ধটি Andre Vltchek-এর লিখা Horrid Carcass of Indonesia: 50 Years After the Coup থেকে বাংলায় ভাষান্তর করেছি।