টকি শো হাউস সিনেমাহলটার নাম। তার পাশে মোহনবাগান লেন, ডান পাশে। আর বামপাশে মাটির গলি। মাটির গলি দিয়ে একজন লোক ছাতা খুলে আর দুজন লোক এমনি পাশাপাশি হাঁটতে পারে না। মাটির গলি গিয়ে পড়ে ফ্রেন্ডস কেবিনের পাশে। তারপর রাস্তা ক্রস করলেই শুরু হয় বিশ্বকোষ লেন। চুলের ফিতে উড়িয়ে দিলে যেরকমভাবে মাটিতে পড়বে, অবিকল গলিটা সেইভাবে গেছে। এই বাঁকে তো ওই বাঁকে, যেন গলির নদী একটা বয়ে চলেছে। রোদ বেশ চড়া। ওই যে দেখতে পাচ্ছোনা হাতে একটা ক্লাসমেটের খাতা লম্বামতো, হাতে না বগলে রাখা। মুখে সিগারেটটা ঝোলানো, ধরানো হয়নি, হোল্ডারে।
এক মাথা ঝাঁকড়া চুল, কালোই বলা যায় ছেলেটাকে। লম্বা না, মাঝারী হাইট, লম্বাটে বলা যায়, ছিপছিপে চেহারা। একটা গাঢ় নিল রঙের টি-শার্ট, ট্র্যাকস্যুট ছাই রঙের, স্যান্ডাকের চপ্পল। বড্ডো অন্যমনস্ক, ঘেমে নেয়ে জবজবে, মাঝে মাঝে মাথাটা ঝাঁকিয়ে নিলে চুলগুলো থেকে ঘাম ঝরে পড়ছে। যেন একটা চূড়ান্ত অবিন্যস্ত কিন্তু ভয়ানক আনন্দিত প্রাণীকে মানুষের স্ট্রাকচারে ঢোকানো আছে। আনন্দিত কেননা ভ্রু কুঁচকে আছে তা সত্ত্বেও মুখে বেশ হাসি একগাল, চোখে কালো মোটা ফ্রেমের চশমা। খুব লক্ষ্য করলে বোঝা যাবে কার সাথে যেন কথা বলতে বলতে হাঁটছে, অথচ গলিতে জনপ্রানী নেই। কি করে থাকে ভর দুপুর, ঝাঁঝাঁ রোদ? যদি ভাবেন এ একজন আর্টিস্ট বা লেখক, নিজের লেখার কথা ভাবতে ভাবতে চলেছে বা আঁকার কথা, এ্যাপিয়ারেন্স থেকে তাই মনে হবে, তাহলে ভয়ংকর ভুল করবেন। ফলো করুন, দারুন মজা দেখতে পাবেন। বিশ্বকোষ লেন হঠাৎ একটা ডজ মেরে খানিকটা সোজা চলে গেছে।
ওই ডজের জায়গাটায় একটা বহু পুরোনো বাড়ি, তার লাল দেওয়াল, কালো খড়খড়ি জানলা। বাড়িটা ভঙ্গিচুরচুর বললে অবস্থা সবচেয়ে ভালো বোঝানো যায়। বাইরের দিকে একটা রক, তাতে হেলান দেওয়ার জায়গা, ওপরে কার্নিশটা ছায়া দেয়। শ্যাওলা পড়েছে রকটায় বাড়ির গা বেয়ে জল নেমে। দু চারটে গাছ পাতা বের করে আছে, আর অসংখ্য ফুটিফাটা। ও ওখানে গিয়ে বসবে। টি শার্টটা তুলে নিয়ে ঘামটা মুছলো। বেশ হাসি মেশানো নিঃশ্বাস ছেড়ে ফুটিফাটা গুলোর দিকে তাকিয়ে “কি রে” বলে বসে পড়লো। হালকা শ্যাওলাটায় হাত বোলাতে বোলাতে বসে “শেষ হয়ে গেছি রে। ”
“সে তো দেখতেই পাচ্ছি। বেশি স্মার্ট হওয়ার চেষ্টা করিস না, তোর অবস্থা খারাপ। বেশ জটিল দেখছি। হাসছিস, জোর করে…এ…এ, না জোর করে না, হাসিটাতো ঠিকঠাক বেশ কূয়ো কূয়ো মার্কা, অতল-তোমার-সাক্ষাৎ টাইপ” কথা শেষ হয় না ফুটিফাটার
“ধ্যাৎ, কি যে বলিস না” কেমন যেন লজ্জ্বা লজ্জ্বা গলায় বলে ঝাঁকড়াচুলো।
“ও মা গো!!! জাঁহাপনার লজ্জা হচ্ছে। কি হয়েছে রে? সকাল থেকে গোরভাঙা খেয়েছিস নাকি? (যারা জানে না, তাদেরকে বলা যেতে পারে গোরভাঙা হচ্ছে একটা স্পেশাল ধরণের গাঁজা, খুব উন্নত মানের। মিহি স্বাদ তার। আরো মিহিন তার নেশা) আরে, পাগলাবাবা মারে থাবা, তোর কি হয়েছে টা কি?”
“চুপ কর ক্ষাপচুর। বলে দিচ্ছি।” এটা সেই তোন বিশেষ যাকে ছদ্মরাগ বলে থাকে। নষ্টনীড়ে অমল যেমন চারুকে দেখাতো, বলতো আমার কবিতা পড়ে কি হবে, আমি কি কাব্য করতে পারি না বিহারীলালবাবুর মতো লিখতে পারি, আমার জন্য তো আর আসন বুনে দেওয়া হবে না। ভঙ্গিটা এমন ওই যেন বলতে চাইছি অথচ জিজ্ঞেস করার জন্য কপট রাগ।
ঝাঁকড়াচুলো শ্যাওলাটার ওপর হাত বুলোয়। রকটা সোফার মতো দেখতে, পিঠের দিকটা বেঁকে আছে, ওখানেই শ্যাওলাটা হয়েছে। হাত বুলোতেই, ফুটিফাটা বলে ওঠে “এ্যাই, এ্যাই, কতবার বলেছি এরকম করবি না, সুড়সুড়ি লাগে। এ্যাই”…… ছেলেটা আরো রকটার শ্যাওলাটায় হাত বোলায়, খিলখিল করে হাসতে হাসতে হাসতে। ওই জরাজীর্ন ফুটিফাটা রকটা যেন কাতুকুতু খেয়ে এদিক ওদিক বেঁকে যায় নিজেকে বাঁচাতে। এসব কারোর চোখে পড়বে না অবশ্য। ভালো করে নজর করলে দেখা যাবে রকটার নীচে ছোটো করে পাথর দিয়ে লেখা আছে ক্ষ্যাপাচোরাগঞ্জ। ওটিই ওনার নাম, ক্ষাপচুর শর্ট ফর্ম। হি হি হাসির শব্দ আসে উল্টোদিক থেকে।
ক্ষ্যাপাচোরাগঞ্জ খুব রেগে গিয়ে বলে “কতোবার বলেছি এরকম দিনের বেলা শ্যাওলায় হাত বোলাবি না, ক্ষুদেখুকী ড্যাবড্যাব করে সারাদিন আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। ”ও আর কি করবে, শালা নাচতে গিয়ে আটকে গেছে আর খুলতে পারে না, তাকিয়ে থাকা ছাড়া কি করবে?“। ”এক থাবড়া লাগাবো বাঞ্চোৎ“। মহিলাকন্ঠে ভেসে আসে। ”ও বাবা, নর্তকীর মুখে খস্তকী। খস্তকী হচ্ছে খিস্তির ধরে নে এক ধরণের সংস্কৃত যা আমি বানালাম“। আচ্ছা ক্ষুদেখুকী হচ্ছেন ওই ক্ষ্যাপাচোরাগঞ্জের ঠিক পেছনের দেওয়ালে খাজুরাহো স্টাইলের এক নর্তকী এঁকেবেঁকে দেওয়ালে খোদাই করা আছে। তার নাক চোখ মুখ সব উকো দিয়ে ঘষা যেন, সময়ের উকো, ফিগারটি বোঝা যায় দারুণ। ইনিই নাকি ঝাঁকড়াচুলোর মতে পোজ মেরে নাচতে গিয়ে এমন পোজ দিয়েছিলো যে আটকে গেছে পা কোমর টোমর আর খুলতে না পেরে লাস্টে দেওয়ালে খোদাই হয়ে গেছে। এই ক্ষ্যাপাচোরাগঞ্জ, ক্ষুদেখুকী, এরা ঝাঁকড়াচুলোকে ভারি চেনে। ইনফ্যাক্ট দিনে দু তিনবার দেখা না হলে তো ভাত হজম হয় না। আর কিছু হলে তো কথাই নেই। ভালো করে খেয়াল করলে দেখা যাবে ওই রকটার পাথরে আর হেলানের পাথরে অনেক কিছু লেখা আছে। এক জায়গায় লেখা
ওমিতওয়া পহর্বাজ
c/o – অমিতাভ প্রহরাজ
মেসার্স- খামক্ষেয়াল এ্যাণ্ড খামভজন যাদব স্যানিটরি হার্ডওয়ার্স স্টোর্স
৩/৫- লার্নার লাইসেন্স রোড (আপার)
ভীমধন ভবন (অপ টু কম্যুনিস্ট মেমোরিয়াল পার্ক)
মহিষাসুর কলোনি
লাগাইলাপুর/ ব্লক-লান্ডুক
জেলা- কিচকিচির রাজ্য-বড়োবেঙ্গল
এটি নাকি ঠিকানা নয়, ক্ষ্যাপাচোরাগঞ্জের লেখা কবিতা, ঝাঁকড়াচুলোকে দেখে লিখেছিলো। শালা নিজে একটা গঞ্জ তো, কবিতাগুলো ঠিকানার মতো। আরেকদিকে লেখা আছে “গর্বের সাথে বলো হযবরল আমার বাবা”। এটা খুদেখুকীর লেখা। ওর বক্তব্য ক্ষ্যাপাচোরাগঞ্জের বাবা নাকি তার মায়ের সাথে ফুলশয্যার রাতে অন্যকিছু করার বদলে হযবরল করে ফেলেছিলো, তাই ক্ষ্যাপাচোরাগঞ্জের মতোন সন্তান জন্মেছে। ক্ষ্যাপাচোরাগঞ্জও এর প্রতিশোধ কম নেয়নি। খুদেখুকীর নাকের ওপরে লাল ইঁট দিয়ে খুদি খুদি করে লেখা “লজ্জার লেভেল আছে, খুব উঁচু লেভেলের লজ্জা না হলে জিভ কাটা হয় না। সেরকম লজ্জার অর্ডার পাইলে জিভ কাটিবো।” অর্থাৎ কিনা খুদেখুকীর এ্যাম্বিশন ওই বেঁকে পোজ মেরে মা কালী হওয়া। কিন্তু ঠিকঠাক লেভেলের লজ্জা পাওয়া যাচ্ছে না, পেলে খুদেখুকী মোটামুটি কোমরে আর বুকে যা দুটো বাঁধা আছে খুলে ফেলে জিভ কেটে মা কালী হয়ে যাবে। তা খুদেখুকীর লজ্জার মতো ঘটনা কম ঘটেনা, কোনোদিন কাঁচপোকা এসে বুকে বসে, তো কোনোদিন শালিখ এসে পেটের ওপর এ্যাঁ করে দিয়ে যায়।
একবার জাঁহাপনা বা সর্দার অর্থাৎ সেই ঝাঁকড়াচুলো বসেছিলো ক্ষ্যাপাচোরাগঞ্জে, আর একজন মহিলা একটা খালি দুধের পলিপ্যাক ওপর থেকে এমন ফেললেন সোজা খুদেখুকীর বুকে। ব্যাস তারপর ক্ষ্যাপাচোরাগঞ্জের সে কি নাচ, “দুধের গায়ে দুধ লেগেছে বলে”। সেইসব নাচ অবশ্য লোকে দেখতে পায় না, ও খালি সর্দার বা জাঁহাপনার চোখে পড়ে। যাকগে, কথা থেকে ঘুরে যাচ্ছি, সর্দারকে অন্যমনস্ক মুড অফ দেখেছে কিন্তু কনফিউজড কেউ দেখেনি কোনোদিন, লাজুক তো দেখেইনি জীবনে। ওইজন্য সর্দারের এক বই এর নাম ছিলো “লাজুক লটারিদের ডায়েরী”, অর্থাৎ কিনা লটারি করে করে যে যে তারিখ উঠবে, সেইসব তারিখে খুব লাজুক হয়ে লেখা হবে। তাই আজকের এই ঝাঁঝাঁ রোদে, সিগারেট ঝুলিয়ে, না জ্বালিয়ে, এই মূর্ত্তি খুব একটা পরিচিত নয়। অপরিচিত থেকেও অনেক বড় কথা ভারি আমোদের বিষয়। “কি হয়েছে রে?” কাঁধে একটা দশাসই জরাজীর্ণ জানালা সারাক্ষণ ধরে রেখেছে খুদেখুকী, এ্যাটলাসের মতো। জিজ্ঞেস করে, ভারি কুলকুলে কন্ঠস্বর তার।
একটা মোটা গলার আওয়াজ, খোট্টার মতো বলে,
“হামার মোনে হয় পুঁচকে দি ফিন কিছু বোলেছে সর্দারকে। বা কিছু উত্তম উত্তম লিখাপড়া কোরেছে। সর্দার ভারি হ্যাপি আছে”।
“তুই চুপ কর তো বটুয়া, উপড়ে মেরে ফেলবো তোকে”। গলার আওয়াজটা হচ্ছে এখানকার আরেক পাব্লিক, একটি বটচারা ক্ষ্যাপাচোরাগঞ্জের ফুটিফাটার মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে বেশ কিছু পাতা গজিয়ে, মোটামুটি মোটা হয়ে উঠেছে। আগে রোগা লিকলিকে ছিলো। কিন্তু এখন দু পাতাতেই হরিপদ মালতী দুজনকেই ধরে থাকতে পারে। হরিপদ আর মালতী হলো দুজন শালিখ এই জানালাটার ওপরে থাকে, প্রচন্ড ব্যস্ত, প্রচণ্ড ঝগড়ুটে। সারাক্ষণ এটা নিয়ে আসছে, ওটা নিয়ে আসছে, আর কুচির কাচুর করে ফাঁকতালে লাফিয়ে লাফিয়ে ঝগড়া করে। মাঝে মাঝে রাস্তার ওদিকের লালকুমার, লালচোখো শালিখ, মালতীর পেছনে লাইন মারতে আসে, আর তিনজনের কি লাফিয়ে লাফিয়ে ঝগড়া……যাকগে হরিপদ মালতী জানলার ওপর থেকে নামে বটুয়ার ওপরে, একদম নিখুঁত দুটি পাতায় দুজন। বটুয়া আগে বেঁকে যেত, এখন মোটা হয়েছে তাই ঠিক থাকে। বটুয়া নিশ্চিত মাড়োয়ারী এটা খুদেখুকী বলেছিলো কারন ক্ষ্যাপাচোরাগঞ্জের ফাঁকফোঁকর দিয়ে মাথা তুলেছে মানেই মাড়োয়ারী না হয়ে যায় না। তাই বটুয়া নাম। তা বটুয়া গম্ভীরভাবে মতামত দিলেন কি “হামার মোনে হয় পুঁচকে দি ফিন কিছু বোলেছে সর্দারকে। বা কিছু উত্তম উত্তম লিখাপড়া কোরেছে। সর্দার ভারি হ্যাপি আছে”।
উত্তম-উত্তম লিখাপড়া কোরেছে মানে হচ্ছে সর্দার রোজ এসে ওই পুঁচকেদির গল্প বলে, কেমন লিখছে, কি দারুণ শিখছে সেইসব। কখনো সাংঘাতিক কোনো লেখা পড়লেই চলে আসে এখানে, বলতে। কখনো খুব খুব খুউউউব সিক্রেট কোনো দুঃখ হলেও বলে। তা এখানে সকলেই সেই পুঁচকেদিকে চেনে। দেখেনি কোনোদিন, কিন্তু চেনে বিস্তরভাবে। হঠাৎ এটা ভেবে ভারি ভালো লাগে সর্দারের। ও বেশ মাথাটা দোলায়। ক্ষ্যাপাচরাগঞ্জ বলে “কি হয়েছে বলতো? তুই নিশ্চিত কিছু কেস ঘটিয়েছিস? আবার বকেছিস? বা কিছু বলেছিস বিস্তর বকবক হাবিজাবি? তোকে কতোবার বলেছি একটু মাঝেমাঝে হাবিজাবি বকা থামাবি”, ঝাঁকড়াচুলো বলে “না-আ-আ-আ। পুরো উলটো। বলতে পারিনি তো। তাইইইইইই। কাল রাত্রে এক মহা কেস ঘটিয়েছিলাম। আমারও মগজমারী হয়েছিলো কি। ভারি ভয় পেয়ে গেছিলাম। ও যদি হেব্বি রেগে যায়। যাক তারপর রাত্রে চলে গেছে আড়াইটের সময়, মুভি দেখবে বলে। আর তারপর আমি, আমি, আমি লেখামোর সাইটের কাজ করছিলাম আর খুব খুব খুব মিসু করছিলাম। হঠাৎ সকালবেলা একটা চিঠি দেয়……”
“পত্রে কি বলিয়াছেন কন্যা?” এইবারের গলাটা পালিশ করা হুঙ্কারের মতো, খাতাটা রাখা আছে যে রকটার ওপরে তার নীচ থেকে ভেসে আসে। এটি ব্যাঘ্রবাবুর গলা। ওই রকে একতা বাঘবন্দি খেলার ঘর কাটা আছে। উনিই হলেন ব্যাঘ্রবাবু। খুদেখুকী অত বাবু টাবু বলে না, ওকে চ্যাপ্টাবাঘা বলে ডাকে। ব্যাঘ্রবাবু তাতে ক্ষুন্ন হয়ে বলেন ফাজিল-নারী। ব্যাঘ্রবাবু গম্ভীর মানুষ, ভেবেচিন্তে দান দিয়ে খেলতে হতো ওনাকে, যাঁরা খেলতো একসময়। ওনার আবার অসভ্যতা পছন্দ হয়না। আর এদিকে খুদেখূকী ক্ষ্যাপাচরাগঞ্জকে সেইভাবেই খচায় প্রায়ই। বটুয়া যখন প্রথম মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিলো। খুদেখুকী বলেছিলো সর্দারকে “ওটা কি বলতো? ওটা হচ্ছে এত বছর ধরে ক্ষ্যাপাচোরাগঞ্জ চোখের সামনে আমাকে দেখে খুব মানে প্রাণপন চেষ্টা করছিলো। এতদিনে, এত বছর বাদে খাড়া হয়েছে। আর নামবে না দেখবে, ওমনিই থেকে যাবে”। ক্ষ্যাপাচরাগঞ্জ রেগে কাঁই। ব্যাঘ্রবাবু অন্তত্য অপ্রসন্ন হয়ে বলেছিলেন, প্রগলভ রমনী। ক্ষ্যাপাচোরাগঞ্জ খচে অস্থির হয়ে বলেছিলো “সবার কোমরের নীচে খোলা থাকে চলাচলের পথ, তোর মাথার ওপরে খোলা। জানলা। তাই এসব তোর মাথার ওপর দিয়ে বেরিয়ে যায়।” খুদেখুকী বলেছিলো ফিক করে “ঢোকেও”। “চুপ কর”। (আপনারা যারা ফলো করে এসেছেন, এদের কথাবার্তা শুনে প্লিজ কিছু মনে নেবেন না মহাশয়, এরা এমনই নির্লজ্জ। আসলে সর্দার না থাকলে তো এরা সবাই বোবা। সর্দারের কথা শুনে শুনেই তারা এমনধারা হয়েছে)।
“চিঠিতে কিছু না…… কিছু…… মানে আমি পড়ে আর লিখতে পারছি না। খুব খুব খুব অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে করছে, সব কিছু জট পাকিয়ে গেছে। বলতে পারছি না। কিচ্ছু লিখতে পারছি না। এমন একটা লেখা খালি মনে হচ্ছে আমি যেটা লিখবো সেটা এর যোগ্য হবে তো। ঠিকঠাক এর পক্ষে সমান না হলেও খুব কম কিছু হয়ে যাবে না তো। সকালে ঘুম ছুটে গেছিলো। কোনো শব্দের যেন মানে বুঝতে পারছি না। চিঠিটা বাদ দিয়ে। এমন করে কেউ কাউকে আপন করতে পারে? আমি কি বলবো…… আমি তারপর মনে হলো, বাকি আর কারর কোনো কথাই বুঝতে পারছি না। কোনোমতে বুঝলাম আমাকে বলছে রেস্ট নিতে একটু। আমি ওই চিঠি পেয়ে ভাবলাম, এরকম য লেখে, সে আমার মালিক। ফুল মালিক, সুতরাং যা বলবে আমি তাই করবো। তাই শুতে চলে গেলাম। চার ঘন্টা ঘুমিয়ে দশটায় উঠে পড়লাম। লিখতে বসলাম। তিরিশখানা চিঠি লিখলাম, তারপর তিরিশখানাই ফেলে দিলাম। কোনোটাই ওটার পাশে দাঁড়াচ্ছে না। আমি লিখতে জানিনা। জীবনে সত্যি কোনোদিন কেউ ভালোবেসে কথা বলেনি তো, সত্যিকারের কেউ বললে, তাও সকালবেলা, এরকমভাবে, কি লিখতে হয় আমি জানিনা। আমি লিখতে জানিনা, বিশ্বাস কর…… আমি শব্দ জানিনা ভালোবাসার…… আমি দুপুরেভ শেষে কিছু না পেয়ে, পুরোনো একটা লেখার টুকরো পাঠিয়েদিলাম। তখনো বদমাইশি আমার। এই বদমাইশি আমার মরতে বসলেও যাবে না। ইচ্ছে কতে পুরোনো লেখা পাঠিয়েছি, জানি ওটা ওর পড়া, গাছের ফুল জোটে”
“হাঁ হাঁ, হোটা দিয়ে আপনি তো পুঁচকে দি কিরিয়া পদ শিখাতেছিলেন। গাছের ফুল ফোটে না বোলেন যেন জোটেন বোলেন। হামার ভি মনে আছে। আমার গাছে তো ফুল জুটবেন”
বটুয়া বলে ওঠে
“আ মর যা আপদ কোথাকার, তর কবে ফুল জুটবে। বটগাছের ফুল!!! হরিপদকে বলবো ওই কালিবাড়ি থেকে পচা গাঁদা এনে তর ওপর রেখে যেতে” বাধা পেয়ে ভারি বিরক্ত হয়ে বলে ঝাঁকড়াচুলো……
“হ্যাঁ, তা ওটা পড়ে বললো “হুঁ, অন্যরকম”…… আমি ওর প্রতিটা হুঁ শুনতে পাই, আমি বুঝলাম খুব্ববাজে বদমাইশি হয়েছে, কিন্তু আমি কি করবো, আমি লিখতে পারছিলাম না, ওরকম লেখার ক্ষমতা আমার নেই। ওরকম্ভালোবাসার কথা বলার ক্ষমতা আমার নেই। আমি নেহাত শব্দ বাক্যার তোমাদের সাথে দিন কাটাই, ঠাট্টা ইয়ার্কি করে। অতো নরম কোলের ওম কি আমার ভাষা আমার লেখা দিতে পারে। কোনোদিন পাইনি, জানিনা কি করতে হয় পেলে। এই ক্ষ্যাপাচোরাগঞ্জকে যদি একদিন হঠাৎ কেউ এসে কাঁচে মুড়ে, মিউরাল এঁকে রাখে, বা খুদেখুকীকে যদিকেউ এসে অনামিকা খান্নার বুটিকের সাড়ি দিয়ে যায় কি করবে ও, তাই বেরিয়ে এসেছি ছুটে……… ঝাঁ ঝাঁ রোদের মধ্যে”
“কন্যার প্রিয় কি?” ব্যাঘ্রবাবু বলেন। ঝাঁকড়াচুলো আবার বলে ওঠে “এই যদি ব্যঘ্রবাবুতে বিশ্বনাথন আনন্দ খেলতে আসেন ওনার কি লাগবে, এমন সম্মান পেলে, অন্য লোকে গুটখা খেয়ে থুতু ফেলে”
“বাজে প্রলাপ বাদ দিয়ে, বলো কন্যার প্রিয় কি?”
“গোধূলি ইয়ে মানে বিকেল শেষ”
“যাই হোক না কেন, বিকেল শেষের আগে তুমি কিছু দিও, একটি গোধূলি দিও”
“আমি লিখতে জানিনা…… ভুলে গেছি, আমি আমি নেই…… কি করে গোধূলি দেবো”
“হাপনি হামি নেই, হমি হয়ে গেছেন। পুঁচকে দি কে হামি খেয়ে নিন।”
বটুয়া বলে
ঝাঁকড়া সর্দার দাঁত কিড়মিড় করে বলে “তোকে আমি খেয়ে নেবো কাঁচা”
হঠাৎ কোথথেকে ডাক আসে “অমিতাভ, অমিতাভ,অমিইইইইইইই কিছু হয়েছে”
আমি দৌড় আলাগাই, আমার পেছনে ঝাঁকড়া সর্দার, তার পেছনে ক্ষ্যাপাচোরাগঞ্জ, তার পেছনে খুদেখুকী, তার পেছনে ব্যাঘ্যবাবু, তার পেছনে বটুয়া। অনেক লোক দৌড় লাগায় ওই “অমি” ডাকটার দিকে, ওরা যে এতদিন আটকে ছিলো স্থির ছিলো, আজএ দেখি ওরাও আমার সাথে দৌড়চ্ছে। আমার প্রচুর কমপিটিটর হয়ে গেল। বটুয়া আমার পাশে দৌড়তে দৌড়তে বলে “হামি ভি আছি, হামার চান্স ভি ভালো আছে। পুঁচকে দি ভি তো হামার মতো গাছ আছে”।