০
৭৪৩ বার পঠিত
আসন্ন বাংলাদেশ নির্বাচন নিয়ে প্রধান প্রশ্ন হচ্ছে, এই নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের নিহত ভোটাধিকারের পুনর্জন্ম ঘটবে নাকি জনগণকে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ থেকে বঞ্চিত করা হবে!
২০০১-০৬ পর্বে বিএনপির শাসনামল আর ২০১৪-১৮ পর্বে আওয়ামী লীগের শাসনামলে; প্রতিহিংসার রাজনীতি, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, লুণ্ঠন-টাকা পাচার আর ধর্মীয় অনুভূতি নিয়ে রাজনীতি করার যে নেতিবাচক চর্চা দৃশ্যমান হয়েছে; তাতে এ’দুটি দলের কারো কাছ থেকেই ইতিবাচক রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও সভ্যতার প্রত্যাশা খুবই অবাস্তব।
এটি বাংলাদেশের মানুষের জন্য বেদনার বিষয় যে, দুটি মানবতা বিরোধী রাজনৈতিক দলের যে কোন একটিকে বেছে নেয়াই তাদের নিয়তি। সেখানে অন্ততঃ বেছে নেয়ার স্বাধীনতাই হচ্ছে ভোটাধিকার। যা থেকে গত পাঁচ বছর জনগণকে বঞ্চিত করে চলেছে আওয়ামী লীগ।
রাষ্ট্রক্ষমতার চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের চেষ্টায় বিএনপির চেয়ে নিজেদের শ্রেয়তর প্রমাণে আওয়ামী লীগ একাত্তরের মানতাবিরোধী অপরাধী জামাতের সঙ্গে বিএনপির জোটবদ্ধতাকে গাঢ়তর সূচক হিসেবে উপস্থাপন করে। অর্থাৎ একাত্তরের আদর্শের পৈতেটি পরে আওয়ামী লীগ রায় দেয়, পৃথিবীতে শেষবার মানবতাবিরোধী অপরাধ ১৯৭১ সালে ঘটেছিলো। অথচ বাংলাদেশের ইতিহাসে এ বছর সর্বোচ্চ বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে; সড়ক হত্যায় মৃত্যুর মিছিলটি ঘন হয়েছে; এর আগে হেফাজত নেতার “নাস্তিকদের কতল করা ওয়াজিব” ফতোয়া দেয়া, এরপর ধারাবাহিক লেখক, প্রকাশক, মুক্তচিন্তক হত্যা; অথচ আওয়ামী লীগের সঙ্গে হেফাজতের জোটটি ঘন হয়ে আসা। এসব যে চলমান মানবতাবিরোধী অপরাধ সে সম্বিত ফেরাবে কে!
পাকিস্তানের স্বৈরাচারী সরকারের উন্নয়নের গালভরা শ্লোগানে সন্তুষ্ট যারা পাকিস্তানের দখলদার বাহিনীর পক্ষ অবলম্বন করেছিলো; একইরকম ক্ষমতা ও উন্নয়নের উষ্ণ সান্নিধ্যে সমসাময়িক দখলদার ক্ষমতাসীনের পক্ষাবলম্বনকারীরা ক্ষমতার সঙ্গে কোলাবরেশনের
একই অপরাধ করে চলেছে।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলনের আদর্শের পৈতে পরা দখলদার মুসলিম লীগের স্বৈরাচারি মনোজগত যেভাবে উনার আত্মজীবনীতে বর্ণনা করেছেন; সেখানে মনে হয় যেন, ত্রিকালদর্শী এই রাজনীতিক আজকের বাংলাদেশ বাস্তবতা বর্ণনা করছেন।
এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়েই একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের সমর্থক পরিবারের সদস্যদের মনোনয়ন দিয়েছে। বাংলাদেশকালের মানবতা বিরোধী অপরাধী দুটো দলেই ঠাসা।
রাজনীতিতে রাজনীতিক নির্বাসিত; মনোনয়ন পেয়েছে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়; ঠিক যেন সেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমল; বণিকের মানদণ্ড দেখা দিয়েছে রাজদণ্ড হিসেবে।
আর ঔপন্যাসিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর লালসালু উপন্যাসের মতো, শস্যের চেয়ে টুপি বেশি, ধর্মের আগাছা বেশি; আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতাদের নির্বাচনী প্রচারণায় বক-ধার্মিক সাজার প্রতিযোগিতায়। জামাতের বাহুলগ্ন বিএনপি; হেফাজত-ওলামা লীগের বাহুলগ্ন আওয়ামী লীগের সৃষ্ট আজকের রাজনৈতিক দৃশ্যপটটি ধর্মভিত্তিক রাজনীতির মধ্যযুগ যেন!
তবু আওয়ামী লিগের নিরন্তর অপরাধ অস্বীকার প্রবণতা; একদলীয় শাসন ধরে রাখার লিপ সার্ভিসে, বিএনপি-জামাতের সম্পর্কটিই “দেশের একমাত্র অপরাধ”; বহুব্যবহারে জীর্ণ অপকৌশলটি প্রতিদিনই সক্রিয়।
জনগণের ভোটাধিকারটুকু ফিরিয়ে আনার চেষ্টায় ঐক্যফ্রন্ট গড়ে তোলার দায়ে ড কামাল হোসেনের মতো নেতারা এখন আওয়ামী লীগের হা ডু ডু খেলা রাজনীতির মূল লক্ষ্য। আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনার সমালোচনা করলেই যেখানে সাধারণ মানুষ আইনের কালোধারায় পড়ে গ্রেফতার হয়; সেখানে কামাল হোসেনকে প্রতিদিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গালাগালের যে কলতলার অপসংস্কৃতি দৃশ্যমান; তা-ও আলোহীন মধ্যযুগেরই ছবি।
ঐক্য ফ্রন্টের সদস্য হবার দায়ে টিভি টকশোতে ডেকে “জামায়াত” বলে ডিফেম করে রাগিয়ে দিয়ে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনকে জেলে পুরে দেবার পর থেকেই “রাগিয়ে দিয়ে জেলে ভরা”র হিটম্যান-ওম্যান দলীয় সাংবাদিকেরা তক্কে তক্কে আছে; যদি কোনভাবে কামাল হোসেনরে প্যাঁচ দিয়া ধরা যায়!
১৪ ডিসেম্বরের শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে সে চেষ্টা বেশ সফল হয়। প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে গিয়ে যে সাংবাদিকরা তেলের নহর বইয়ে দেয়; আওয়ামী লীগ ক্রমে ক্রমে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ও মানবাধিকার হননের আখড়া হয়ে পড়লো কেন; বিএনপির দক্ষিণপন্থার বিপরীতে আওয়ামী লীগ তার স্বাতন্ত্র্য ধরে না রেখে কেন নিজেই দক্ষিণপন্থার টুপি পরে কুচকাওয়াজ শুরু করলো; এসব প্রশ্ন যাদের মাথায় আসেনা; ঠিক তারাই ড কামাল হোসেনকে তার আদর্শ বিচ্যুতির কথা ধরিয়ে দিলো; সেই “জামাতের” প্রসঙ্গ এনে। যেন সব আদর্শের ঠেকা পড়েছে কামাল হোসেনের। আওয়ামী লীগের নিজের কোন আদর্শ-ফাদর্শ অনুশীলনের প্রশ্ন নেই; সে কেবল টিপে টুপে অন্যের আদর্শ পরখ করে বেড়াবে!
যথারীতি একাশি বছর বয়েসী কামাল হোসেন, দলীয় সাংবাদিকের এই রাগিয়ে দেয়া কৌশলে হেরে গেছেন; খামোশ বলেছেন।
অমনি “খামোশ” শব্দটি ঘাড়ে নিয়ে দৌড়াচ্ছে আওয়ামী আদর্শের ঠোঁট সৈনিকেরা। তাদের কাজ হচ্ছে, দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীরা যে আওয়ামী হামলার শিকার হচ্ছে; “তফসিল” ঘোষণার পর বিরোধী দলের নেতা কর্মীদের ধরপাকড় বন্ধ রাখার নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ অমান্য করে পুলিশ ক্ষমতাসীনের আজ্ঞাবহ হয়ে গ্রেফতার-নিপীড়ন অব্যাহত রেখেছে; এই যে ছলে বলে কৌশলে ক্ষমতায় থেকে যাওয়ার চেষ্টা; ভোটাধিকারকে খামোশ করে দেয়ার যে খলনৃত্য; এই সব অপরাধগুলোকে কলতলার হৈ চৈ-এর মাঝে ধামাচাপা দিয়ে দেয়া।
জনমানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার মত প্রকাশের স্বাধীনতা কেড়ে নিয়ে, কে রাষ্ট্র পরিচালনা করবে সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবার ভোটাধিকার হনন করে, ভিন্নমতকে দমন নিপীড়ন করে, হৈ চৈ করে; গলা বড় করে “একাত্তরের আদর্শে”র দাবীদার হবার মতো অবাস্তব অপচেষ্টা অত্যন্ত হাস্যকর।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন