০
১০১৮ বার পঠিত
আমি নুহ নবীর আমলটা খুব মিস করি। সব যুগেই কম বেশি ভালো মন্দ থাকে। তবে বর্তমানে যারা ঢাকা মহানগরীর অধিবাসী তাঁদের কাছে নুহ নবীর আমলের মোজেজাই আলাদা। এর কারণ অবশ্য একটাই, আর সেটা হচ্ছে সেই আমলের যাতায়াত ব্যবস্থা।
চারপাশে মহা প্লাবনের পানি আর পানি। এর উপরে ভাসছে নোয়ার একমাত্র আর্ক। মাথার উপরে ভূ-মধ্য সাগরের সুনীল আকাশ। আহা! কোথাও জ্যাম নাই ট্রাফিক নাই। কারো কোথাও নামার তাড়াহুড়া নাই। কবীর সুমনের গানের ভাষায়- ”আমার আর কোথাও যাবার নেই… কিচ্ছু করার নেই…”
আমার স্বভাবের একটা বৈশিষ্ট্য হলো- আমি প্রচন্ড আশাবাদী মানুষ। এমনকি আমি যখন পল্টন থেকে তিন ঘন্টায় শাহবাগের মোড় ক্রস করতে পারি না, তখনও প্রচন্ড আশাবাদী হই। কারণ, যেই জনগণ বিগত দশক থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ঢাকার অধিবাসী তাঁরা পৃথিবীর যে কোনও সভ্যতার ঋষি, মুনি, দার্শনিক, বাউল এর থেকেও নির্লিপ্ত এবং ধৈর্যশীলতার প্রমান দিয়ে দিয়েছে। কোরআন শরীফের একটা আয়াতের কথা এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে, আল্লাহ্ বলছেন- ”হে, মানব সম্প্রদায় তোমাদের বড়ই তাড়াহুড়া”।
আমার মনে হয় যদি কোরআন শরীফ বর্তমানে নাযিল হতো, তাহলে হয়তো এমন আয়াত নাযিল হতো- ”হে বনিইস্রাইল, তোমরা কি দেখনাই ঢাকার অধিবাসীরা কি রকম ধৈর্যশীল এবং পরম সহিষ্ণু।” যে জাতি এ হেন গরমের মধ্যে, হাই হিউমেডিটিতে, ঘামে ভিজে, সারাদিন খাটাখাটনি করে এসে, ঠাসাঠাসি করে, উৎকট ঘামের গন্ধে, জ্যামের মধ্যে ঘন্টার পর ঘন্টা- নির্লিপ্ত মুখে দাঁড়িয়ে থাকা সহ্য করতে পারে, তাঁদেরকে নিয়ে আশাবাদী হতেই হয়।
কবি সাহিত্যকরা অনেক কিছু আগাম বুঝতে পারেন। তাঁদেরকে অন্তর্যামিও বলা হয়। আজ ঢাকার জ্যাম দেখে সেই কথার সার্থকতা দেখতে পাই। রবি ঠাকুর গেয়েছিলেন- ”আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে… ”
আজ আমাদের এই রাজপথে আমরা এই গানেরই বাস্তব প্রয়োগ দেখি। সব ড্রাইভারই রাজা। প্রাডো গাড়ির ড্রাইভারকেও ড্রাইভিং শেখান রিক্সাওয়ালা। সবাই সবার গাড়ি নিয়ে নিজের ডিরেকশনে চলেন। মোড়ে মোড়ে আন্ধা গিট্টু লাগে। যাত্রিরা তাঁদের ভাগ্য দৈবের হাতে ছেড়ে দিয়ে জানালার দিকে মুখ করে জগত সংসার ভুলে যাওয়া নির্লিপ্ত দৃষ্টপাত করেন।
জীবনানন্দ দাশও কম নন। তিনিও তো বলেছিলেন- ”স্থবিরতা, কবে তুমি আসিবে বলতো? ”
আমাদের এই ঢাকা মহানগরের ‘স্থবিরতা’ এসে গেছে।
তিন ঘন্টা জ্যামে বসে থেকে আমি ভাবুক দার্শনিক হয়ে যাই।
এই তিন ঘন্টায়-
পৃথিবী ৪৫ ডিগ্রী ঘুরে গেছে। আমি শাহবাগ।
পৃথিবী নিজ কেন্দ্রকে ঘিরে ৩,০০০ মাইল ঘুরে গেছে। আমি শাহবাগ।
পৃথিবী সূর্য’কে কেন্দ্র করে ২,০১,০০০ মাইল পথ অতিক্রম করেছে। আমি শাহবাগ।
চন্দ্র পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ৬,৮৬৪ মাইল পথ অতিক্রম করে ফেলেছে। আমি শাহবাগ।
নাসার হরিজন রকেট ১,৪১,০০০ মাইল পথ অতিক্রম করেছে। আমি শাহবাগ।
জাপানের ট্রেন ১,১২৫ মাইল পথ অতিক্রম করেছে। আমি শাহবাগ।
কচ্ছপ ১৫ মাইল পথ অতিক্রম করেছে। আমি ৩,০০০ সিসির গাড়িতে বসে শাহবাগ।
গ্রানাইড পাথরের হিমালয় ০.০০১৭১ এম এম লম্বা হয়েছে। আমি এক চুলও এগোয়নি।
২০,০০০ মানুষের জীবন অবসান হয়েছে। আমি শাহবাগ।
৪৫,০০০ শিশু পৃথিবীতে এসে গেছে। আমি শাহবাগ।
১৭৪,০০০০০০০০০০ ইউএস ডলার লেনাদেনা হয়েছে শুধু আমেরিকায়। আমি শাহবাগ।
১,৮৮,৩৫,৬১৬ টাকা এই জ্যামে অপচয় হয়ে গেছে। আমি শাহবাগ।
ঢাকা থেকে সিঙ্গাপুর ফ্লাইটের মানুষ সিঙ্গাপুরে পৌছে গেলো। আমি শাহবাগ।
একটা গল্প বলি শোনেন।
আমার এক বড় ভাই আমাকে এই গল্পটা বলেছিলেন বছর দশেক আগে। তাঁর এক মামা
যাবেন সিঙ্গাপুর। তিনি বিক্রমপুর থেকে তাঁর মামার সাথে এসেছেন এয়ারপোর্টে মামাকে সি অফ করতে। তাঁর মামা তাঁর কাছে থেকে বিদায় টিদায় নিয়ে এয়ারপোর্টে ঢুকে গেলেন। আর আমার ঐ ভাই বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। এয়ারপোর্ট থেকে তিনি বিক্রমপুর ফিরবেন। তো, ঘন্টা চারেক পরে তাঁর মামা তাঁকে কল দিয়েছেন।
বলছেন- সবুজ আমি সিঙ্গাপুরে নামছি। তুই বাইত সবাইরে কইস।
সবুজ ভাই বললেন, আইচ্ছা, কমুনে।
মামা বললেন- এহনি ক’।
সবুজ ভাই বললেন- বাইত গিয়া কমু।
মামা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন- তুই কই এখন?
সবুজ ভাই বললো- মামা, আমি এখন ‘পাগলা’ (একটা জায়গার নাম)। আরো দুই ঘন্টা লাগবো।
গল্পটা শুনে আমি তখন খুব হেসেছিলাম। আর এখন হিংসা হয়। তখন এয়ারপোর্ট থেকে পাগলা পোস্তগলা যেতে যেতে ঢাকা থেকে মানুষ সিঙ্গাপুর চলে যেতো। আর এখন তিন চার ঘণ্টায় এয়ারপোর্ট থেকে মহাখালি ফ্লাই ওভার পার হতে পারাটাও ময় মুরুব্বির দোয়া ছাড়া সম্ভব না।
একটা কৌতুক বলি। এই কৌতুক শুনলে আমার দুঃখও লাগে আবার হাসিও পায়।
গুলশানের এক বায়িং হাউজের মার্চেন্ডাইজারের ছুটি লাগবে। সে গেছে তাঁর ম্যানেজারের কাছে ছুটি চাইতে।
স্যার, আমার তিনদিন ছুটি লাগবে।
ম্যানেজার বললেন, বেশ ভালো কথা। কিসের জন্য ছুটি?
মার্চেন্ডাইজার হাসি হাসি মুখ করে বললো- মামার বাড়ি যাবো।
ম্যানেজার জিজ্ঞেস করলেন- কোথায় আপনার মামার বাড়ি?
মার্চেন্ডাইজার মুখ কাচুমাচু করে বললো- স্যার, গুলিস্তান।
ম্যানেজার অবাক হয়ে বললো- গুলিস্তান যাবেন তো তিন দিন ছুটি কেন?
মার্চেন্ডাইজার মিন মিন করে বললো- স্যার, গুলশান থেকে গুলিস্থান যাইতে একদিন আর আসতে একদিন। আমি তো শুধু স্যার মামার বাসায় মধ্যে একদিন থাকবো। টোটাল তিন দিন।
জ্যামে বসে বসে নানান কথা ভাবি। এর থেকে পরিত্রানের কথা আর ভাবি না। আমাদের এই ঢাকা মহানগরীতে কোনও সিটি কর্পোরেশন নেই। বিয়ারটিএ নেই। সড়ক ও যোগাযোগ মন্ত্রনালয় নেই। ট্রাফিক আইন নেই। এই ট্র্যাফিক জ্যামের দায় কারো নয়। এটা আমাদের কপাল। মন্ত্রীর দায় নেই, সরকারের নেই, আমলার নেই, মেয়রের নেই, জনগনের নেই। আমাদের রাস্তা ঘাট ভাঙ্গা থাকবে, বৃষ্টি হলে পানি জমবে, কেউ ট্রাফিক আইন মানবে না, ফুটপাথে এবং রাস্তার পাশে আমরা দোকান পাট করবো, গাড়ি পার্ক করবো, প্রাইভেট গাড়ি নামাবো, রিক্সা চলবে রাস্তার ডান পাশ দিয়ে, আমরা উদাস মনে জীবনানন্দের স্টাইলে রাস্তা পার হবো, ফুট ওভার ব্রীজে আমরা উঠিনা। আমাদের গলিতে জ্যাম, প্রধান সড়কে জ্যাম, ফ্লাই ওভারেও জ্যাম। আমরা কাজ শেষ করে বাসায় যে ফিরি এটাই অনেক বড় পাওয়া এই জীবনে। ”মাঞ্জিল কো ছুনে কি খুশি মিলতি হ্যায় আগার হাম ঘার পৌছেতো… ”
ব্যাঙের এই গল্প দিয়ে লেখা শেষ করি।
ব্যাঙ’কে যদি একটি পানি ভর্তি পাত্রে রেখে সেই পাত্রের পানি’কে চুলার আগুনে আস্তে আস্তে গরম করা হয়, তাহলে সেই ব্যাঙও পানির তাপমাত্রার সাথে সাথে তাঁর নিজের শরীরের তাপমাত্রা বাড়াতে শুরু করে। যাতে করে সে এই পানিতে টিকে থাকতে পারে।
পানির উত্তাপ যত বাড়ে ব্যাঙ নিজের শরীরের উত্তাপ তত বাড়িয়ে ঐ গরম পানিতে টিকে থাকতে চেষ্টা করে। কিন্তু, একসময় পানি যখন খুব বয়েল্ড হয়ে যায় তখন ব্যাঙ আর শরীরের তাপ অতটা বাড়াতে পারে না। তাঁর শক্তি শেষ। এখন যে সে এই গরম পানি ভর্তি পাত্র থেকে লাফ দিয়ে বের হয়ে যাবে, এটাও সে আর করতে পারছে না। কারণ, এতক্ষন ধরে সে ফুটন্ত পানিতে নিজেকে মানিয়ে নেবার জন্য তাঁর সমস্ত শক্তি অপচয় করে ফেলেছে। ব্যাঙটি এখন এই ফুটন্ত পানিতেই সিদ্ধ হয়ে ধীরে ধীরে প্রচন্ড যন্ত্রনায় মরে যায়।
এই ব্যাঙটি কেন মরে গেলো? পানির উত্তাপের সাথে তাঁর গায়ের উত্তাপ বাড়াতে না পেরে?
না, আসলে সে মরে গেলো- সঠিক সময়ে এই পাত্র থেকে লাফ দিয়ে বের হয়ে আসার সিদ্ধান্ত না নেবার কারণে। তাঁর মৃত্যুর কারণ, সঠিক সিদ্ধান্ত সঠিক সময়ে না নেবার অক্ষমতা।
আমি আশাবাদী- ঢাকার মানুষ ব্যাঙ নয়। শিক্ষিত সচেতন মানুষ। হয়তো তাঁরা ব্যাঙের মতো সহ্য করে করে বাঁচার শক্তিটুকুও ফুরিয়ে ফেলার আগেই এই জ্যাম থেকে লাফ দিয়ে বেরিয়ে আসবে। বসবাসের অযোগ্য নগরীর নাগরিক হিসেবে নিজের কাছে লজ্জিত হবে। নিজের নাগরিক অধিকারের বিষয়ে সচেতন হবে। এবং অবশ্যই অবশ্যই নিজের নাগরিক দায়িত্ব পালন করবে। আমরা যদি মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া’তে গিয়ে ওদের দেশের শহরের আইন কানুন সুষ্ঠ ভাবে মেনে চলি, তাহলে আমাদের দেশ দোষটা করলো কী?
এইখানে আমরা আমরাই তো তাইনা?
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন