[মহারাষ্ট্রে গোমাংসভক্ষণ নিষিদ্ধ করে আইন প্রণয়ণের প্রেক্ষিতে এই প্রবন্ধের গুরুত্ব অপরিসীম। প্রাচীন ভারতীয় মনীষিদের ঘোষিত ‘গোমাংস ভক্ষণ করিও না‘ এই উপদেশ বা নির্দ্দেশ-বাক্যের প্রকৃত অর্থ কী ছিল? পাশ্চাত্য ভাষাতত্ত্বের অন্ধ-অনুকরণ করে ‘গো‘-শব্দের অজস্র অর্থের সবগুলো ফেলে দিয়ে শুধুই ‘গরু‘ এই প্রতীকী অর্থে অধঃপতিত করার করুণ পরিণতিতেই আজ গরুর মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ হয়ে গেল। যদি যে-কোনো পশুর মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ হতো তাহলে তাকে পশু-প্রেম বা প্রতিবেশ/পরিবেশ-এর জীব-বৈচিত্র সুরক্ষার আন্দোলন বলে স্বাগত জানানো যেত। কিন্তু হায় ক্রিয়াভিত্তিক-শব্দার্থবিধি ফেলে দিয়ে ‘শব্দ বা বর্ণের ভিতরে কোন অর্থ নেই‘ সবকিছুই আরবিট্রারি বা লোগো-সেণ্ট্রিক করে, পাশ্চাত্যের দাসত্ব করে চলেছে আমাদের জ্ঞানজগৎ-প্রশাসনিক জগৎ-কর্ম্মজগতের পরিচালকেরা। আমাদের প্রাচীন পূর্ব্বসূরিরা নির্দ্দেশ দিয়েছিলেন পদে পদে চরণে চরণে যে জ্ঞানরস-প্রবাহ রয়েছে তা পান (পাদোদক-পান) করতে, কিন্তু আমরা ‘পাদোদক-মুঢ়‘ হয়ে ‘পা-ধোওয়া-জল‘ (পাদোদক-এর সাদৃশ্য ও প্রতীকী অর্থ) পান করে চলেছি। মনীষিদের নির্দ্দেশের প্রকৃত বা ‘প্রধান ও অদৃশ্য গোমাংস শব্দের অর্থটিই বুঝিনি, সেই প্রকৃত গোমাংস মহাসমারোহে খেয়েছি, খাচ্ছি – অর্থাৎ, বিপুল উদ্যমে পণ্য-উৎপাদন করে বিক্রিবাটা করে চলেছি এবং তা বেচে খেয়ে খেয়েই দিন গুজরান করছি। ফলত এখন আমরা আমাদের সেই সৃষ্ট পণ্যের ও সেই পণ্যজাত টাকার দাসে পরিণত হয়েছি; এবং মূর্খদের দর্শনের বাক্য ধার করে নিজেদের সমাজকে নির্লজ্জভাবে ‘ভোগিদের সমাজ‘ (consumer society) বলে ঘোষণা করে গৌরব বোধ করছি…’। আর এরই বিষময় ফল, আমরা রামায়ণ-মহাভারত-পুরাণকাহিনীগুলির (যা আসলে আমাদের যথার্থ ইতিহাস – রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য স্মর্তব্য) প্রকৃত অর্থোদ্ধার আজও বাঙলাভাষী তথা বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরা গেল না। ফলত – আমাদের ইতিহাস মৌলবাদী শক্তি এবং আধুনিকতার প্রবক্তাদের হাতে দু’রকমভাবে ধর্ষিত হল। আর প্রত্যক্ষত সম্প্রতি মহারাষ্ট্রে গরুর মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ করে সাম্প্রদায়িক বিভাজনকে উস্কে দেওয়া হল। (শুয়োরের মাংস কেন নিষিদ্ধ হয়েছিল জানতে হলে পরবর্তী নিবন্ধে পড়ুন – ‘এই প্রাচীর কি দুর্লঙ্ঘ্য? এই হিন্দু মুসলিম বিভাজন?‘)। হে পাঠক, ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থতত্ত্বের আলোকে নিবন্ধটি পাঠের আমন্ত্রণ গ্রহন করুন এবং ভালো লাগলে মতামত দিন এবং শেয়ার করে বন্ধুমহলে ছড়িয়ে দিন]।
গো
গো = গম্+ও(ড)-কর্ত্তৃবাচ্যে। যে (কেউ) যায়। / যে যায়; যাহা দ্বারা স্বর্গে যায়। গোজাতি, গরু, বৃষরাশি, সূর্য্য, চন্দ্র, গোমেধযজ্ঞ, ইন্দ্রিয়, ঋষিবিশেষ, গায়ক, গৃহ, ৯-সংখ্যা, গোজাতি স্ত্রী, ধেনু, গোধূম, দিক, বাক্, বাক্যাধিদেবতা সরস্বতী, পৃথিবী, স্বর্গ, বজ্র, অম্বু, জল, আকাশ, রশ্মি, কিরণ, চক্ষুঃ, বাণ, লোম, কেশ, হীরক, গোসম্বন্ধী দুগ্ধঘৃতচর্ম্মাদি, গৃহপালিত পশুগণ, সিংহ ইত্যাদি।
বঙ্গীয় শব্দকোষ এই শব্দের সংক্ষিপ্ততম ও যথার্থ ক্রিয়াভিত্তিক অর্থ দিয়েছেন ‘যে যায়’। এর প্রকৃত অর্থ হল গ (=গামী), গি (=গতিশীল গামী), গু (=নবরূপে উত্তীর্ণ গামী), গে (=দিশাগ্রস্ত গামী) প্রভৃতি সর্ব্বপ্রকারের গামিদের আশ্রয় যাহাতে, সেই হল ‘গো’ (যেহেতু ও=অ+ই+উ); সে অতি উচ্চ মার্গের গো (ধরা যাক সূর্য্য কিংবা গোলোকবাসী নারায়ণ, গোবিন্দ) থেকে অতি নিম্ন মার্গের গো (ধরা যাক গরু), এদের মধ্যে যে কেউ হতে পারে। কোনো গো বাহ্য চোখে দেখা যায়, কোনো গো-কে চোখ বন্ধ করে দেখতে হয়, নইলে দেখা যায় না; যেমন বাক্ কিংবা তত্ত্বকথা। কেউ মুহূর্ত্তে বিশ্বের যে-কোনো স্থানে যেতে পারে, কাউকে আপনি যতটুকু তাড়ালেন ততটুকুই গেল। তার মানে ‘গতিশীল বস্তু’ মাত্রেই ‘গো’ পদবাচ্য; অর্থাৎ, Whoever or Whatever goes। উপরোক্ত ৩২টি অর্থের প্রত্যেকটিই কোনো না কোনো ভাবে ‘যাওয়া’ ক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত; তাদের সে-যাওয়ার কথা আমরা জানি কিংবা না-জানি। তবে cow-কে যে ‘গো’ বলা হত, তার কারণ ভিন্ন। সে অন্য জীবদের মতো হেঁটে-চলে স্থানান্তরে যেতে পারে বলে তাকে ‘গো’ বলা হত না; তাহলে তো ঘোড়া-গাধা-ছাগলকেও গো বলা যেত। cow-কে ‘গো’ বলা হত তার বিশেষ ‘গতিশীল’ ভূমিকার জন্য। এই জীবটিই মানবসভ্যতার হাতে পোষমানা প্রথম জীব যা ‘প্রেরিত’ হ’ত, তা সে বিনিময়যোগ্য পণ্যরূপে হোক আর বিনিময়ের মাধ্যম রূপেই হোক। উভয় ক্ষেত্রেই সে ‘প্রেরিত’ হ’ত বা ‘যেত’।
একই কথা গোধূম (ধূম বা ধোঁয়ার মতো গুঁড়ো যে বস্তু যায়; অর্থাৎ, গমের আটা-ময়দা ইত্যাদি) সম্পর্কেও বলা যায়। (চালও ‘চলে যেত’ বলে তার নাম হয়ে যায় চাউল বা চাল। (দ্রষ্টব্য – চাল)। এখানে এ’কথাটি স্মরণে রাখা চাই যে, একালের অর্থনীতির সূত্রানুসারে ‘উৎপন্ন’ (production) ‘পণ্য’-এ (commodity-তে) পরিণত হয় অন্যত্র প্রেরিত হওয়ার জন্য উৎপাদিত হলে। সেই সুবাদে ‘গো’-এর বৃদ্ধি করার অর্থই হল পণ্য-উৎপাদন (গো) বাড়ানো (গো-বর্দ্ধন)। তার cow-এর ছিল সর্ব্বপ্রথম ‘বিনিময়ের মাধ্যম’ হওয়ার যোগ্যতা। Gold-money আবিষ্কারের আগে ‘গো’-এর যে সে ভূমিকা ছিলই, তার স্পষ্ট সাক্ষ্য পাওয়া যায় মহাভারতে; কালীপ্রসন্ন সিংহের অনুবাদে যার বয়ান এইরূপ – “গো প্রভৃতি পবিত্রতা-সম্পাদক পদার্থসমূহের মধ্যে সুবর্ণই সর্ব্বাপেক্ষা অধিক পবিত্রতা-সম্পাদক পাদার্থ”। তার মানে গরু দিয়ে যেভাবে যত মাল কেনা যায়, সোনা দিয়ে তার চেয়ে সহজভাবে অনেক বেশী মাল কেনা যায়। (দ্রষ্টব্য – পবিত্র, গুপ্ত, গোপ)। অন্যান্য ভাষায় আজকের প্রতীকায়িত ‘গো’-শব্দের (সাদৃশ্য অর্থে বা ‘গরু’-অর্থে ভ্রাতৃপ্রতিম (অনাবাসী ভারতীয়!) শব্দের বিভিন্ন রূপগুলি এইরকম – ( Avesta) – gao, (Greek) – Bous, (Latin) – Bos, (Lithuanian) – Cow, (Kelt) – Bo, (English) – cow।
আমাদের মতে, এই গো শব্দের উত্তরাধিকার ইংরেজীর রয়েছে ‘go’-রূপে। ‘গো’ শব্দের যে মূল অর্থ – ‘যে যায়’ – তার থেকে তাঁরা কেবলমাত্র ‘যাওয়া’-কেই ধরে রেখেছেন, যাত্রীকে হারিয়ে ফেলেছেন। পৃথিবীর অন্যান্য ভাষারও এই উত্তরাধিকার কমবেশী রয়েছে। যেমন চীনের ‘ngo’। তবে এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সমাধান বলে নেওয়া দরকার। তা হল, আধুনিক যুগে যে-বঙ্গভাষাবিদগণ একটি ভাষার একটি শব্দের সঙ্গে অন্য ভাষার সমার্থক শব্দের মিল খুঁজতে গিয়েছিলেন, তাঁরা ক্রিয়ামূল ও ধ্বনির দিক দিয়ে তাঁদের অনুসন্ধান করতে যাননি। গিয়েছিলেন শব্দটি যে বস্তু বা বিষয়কে বোঝাচ্ছে, সেই বস্তু বা বিষয়কে অন্য ভাষায় কী বলা হয় তা জানতে। এই ‘দেহভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গী’ই তাঁদেরকে সর্ব্ব ভাষার একজাতিয়তায় পৌঁছতে দেয়নি। এর কারণ ছিল ‘আধুনিক’ যুগের ‘দেহভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গীর’ রমরমা। হরিচরণও অনেক ক্ষেত্রে সেই ভুল পথে পা দিয়েছেন (যেমন অন্য ভাষায় বাঙলা শব্দের সমার্থক শব্দ খুঁজতে গিয়ে), যদিও নিজের স্বাভাবিক পথটি অনুসরণ করতে তিনি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভোলেননি।
মাংস
মাংস = মন্+স-কর্ম্মবাচ্যে। ম-এর (সীমায়িতের) অংস (বিভাজিত রূপ) থাকে যাহাতে; মাং-এর [ মাং=মাম্ বা আমাকে; সীমায়িত অংরূপিণী যাহাতে; সীমায়িতের আধার রহস্যরূপী যাহাতে ] নির্য্যাস বা অস্তিত্বটুকু যাহাতে। পিশিত, আমিষ, মৎস্যপিশিত, ফলের শস্য বা শাঁস (the fleshy part of a fruit)। আগেই দেখেছি, মৎস্য শব্দটি বানানোর সময়, পুরুষ প্রকৃতি উভয়ের যোগে কোনো বস্তু তৈরী হয় বলেই পুরুষও তাকে মৎ বা ‘আমার’ বলতে পারে, প্রকৃতিও তাকে মৎ বা ‘আমার’ বলতে পারে। কেননা, তাতে উভয়ের মৎ-রূপ ‘স’ বা অস্তিত্ব প্রবিষ্ট থাকে। মাংস শব্দের বেলায় ঘটেছে একটু আলাদা রকমের ভাবনা। তাতে মানুষের শ্রম-মেধার সীমায়িত রূপের বা ম-এর একপ্রকার অংস (অংশ) বা ভাগ থাকার কথা বলা হয়। যেহেতু ‘মাং’ শব্দের ভিতরে ‘আমি’র একটি রূপ বিদ্যমান, এবং যেহেতু মানুষের উৎপাদিত বস্তু বা বিষয়ে তার শ্রম-মেধার রহস্যরূপ বা ং-রূপ [ অম্-রূপ বা অং-রূপ ] ঢুকে পড়ে অস্তিত্ব (স) লাভ করে, সেহেতু মানুষের উৎপাদিত বস্তু বা বিষয় মাত্রেই তেমন বস্তু বিষয়, যার ভিতরে মানুষের শ্রমমেধা-রূপ অস্তিত্বের নিঃসারিত অংশ প্রবিষ্ট হয়ে রয়েছে। (দ্রষ্টব্য – বিশ্ব)। সেই অংশের প্রতি মানুষের দাবিই মাংস-এর প্রতি দাবি। অতএব, মাংসভক্ষণ করা মানে উৎপাদিত বস্তুর ভিতরে ঢুকে থাকা নিজের সেই নিঃসারিত অংশ বা তার পরিবর্ত্ত দাবি করা। তাই অদৃশ্যলোকে এই মাংসের মানে আমরা বুঝব উৎপাদিত বস্তুশরীরের অংশ (বা তার উপর অধিকার বা মালিকানা), এবং দৃশ্যলোকে এই মাংসের মানে বুঝব জীব-শরীরের অংশ। এভাবে দেখলেই দেখা যায়, আমাদের প্রাচীন পূর্ব্বসূরিদের বিভিন্ন বয়ানে থাকা ‘মাংস’ শব্দটির অর্থ ঠিকঠাক বোঝা যাচ্ছে। এবং এভাবে বুঝলেই ‘গোমাংস’, ‘বৃথামাংস’, ‘মীমাংসা’ প্রভৃতি শব্দের মানে সুষ্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে; এতদিন যেগুলির মানে কিছুতেই ঠিকঠাক বোঝা যায়নি।
শব্দসৃষ্টির ক্ষেত্রে যথারীতি আমাদের প্রাচীন শব্দবিদগণ অদৃশ্য মাংসকেই গুরুত্ব দিয়েছিলেন বেশী; একালে তাকে আমরা ‘ব্যক্তিমালিকানার বোধ’রূপে চিনতে পারি। সাদৃশ্যে এসেছে বাহ্যিক flesh ইত্যাদির কথা। উপরোক্ত মৎস্যাদি শব্দে আমরা সেই অদৃশ্য মাংসের কথাও কমবেশী বলেছি। আমাদের বিভিন্ন গ্রন্থেও এ বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা রয়েছে। সেই কারণে এখানে শুধুমাত্র এই কথাটি উল্লেখ করে যাব যে, অধিকাংশ অভিধানেই গোমাংস শব্দটি নেই। অথচ তা নিয়ে আমাদের সংস্কৃতির কত কথাই না আছে, (দ্রষ্টব্য- বৃথামাংস)। তাছাড়া, একথা এখন প্রমাণিত যে, আমাদের পূর্ব্বসূরিগণ ‘বিক্রয়ের জন্য পণ্য উৎপাদন ক’রে, তা বেচে খাওয়ার দ্বারা জীবনযাপন করতে নিষেধ করেছিলেন’ (দ্রষ্টব্য – গো), এবং সেকথা বোঝাতে তাঁরা তাঁদের স্বাভাবিক ক্রিয়াভিত্তিক ভাষায় বলে গিয়েছিলেন – ‘গো-মাংস ভক্ষণ করিও না’। আমরা আমাদের পাদোদক-মূঢ়তার কারণে তাঁদের সেকথার প্রকৃতি বা প্রধান ও অদৃশ্য গোমাংস শব্দের অর্থটিই বুঝিনি, সেই প্রকৃত গোমাংস মহাসমারোহে খেয়েছি, খাচ্ছি – অর্থাৎ, বিপুল উদ্যমে পণ্য-উৎপাদন করে বিক্রিবাটা করে চলেছি এবং তা বেচে খেয়ে খেয়েই দিন গুজরান করছি। ফলত এখন আমরা আমাদের সেই সৃষ্ট পণ্যের ও সেই পণ্যজাত টাকার দাসে পরিণত হয়েছি; এবং মূর্খদের দর্শনের বাক্য ধার করে নিজেদের সমাজকে নির্লজ্জভাবে ‘ভোগিদের সমাজ’ (consumer society) বলে ঘোষণা করে গৌরব বোধ করছি। এককালে ‘তেন ত্যক্তেন ভূঞ্জীথাঃ’ (life from withdrawal) বাক্যের প্রতীকী মানে বা ভুল মানে বুঝে ‘ত্যাগিদের সমাজ’ গড়ে তুলেছিলাম আমরা; সে ছিল এক জ্বালা! না খেয়ে রোগা রুগী হয়ে মরতে বসেছিলাম আমরা। এখন ‘ভোগিদের সমাজ’ গড়ে তুলে পড়েছি আরেক জ্বালায়! খেয়ে খেয়ে মোটা রুগী হয়ে আবারও মরতে বসেছি! কে যেন বলেছিল – কাদায় পড়া সারসটা যখন লেজটা তুলতে যায়, ঠোঁটটা যায় কাদায় গেঁথে; আর যখন ঠোঁটটা তুলতে যায়, লেজটা যায় কাদায় আটকে; আমাদের হয়েছে সেই অবস্থা। কি মুশকিলেই না পড়েছি!
তা সে যাই হোক, এখন আমরা দেখছি যে, হিন্দু-মুসলমান নির্ব্বিশেষে এই পণ্যজাত অর্থরূপ গোমাংস আমরা সবাই খেয়ে চলেছি, আজও। তবে আমরা হিন্দুরা উপরোক্ত নির্দ্দেশের গোমাংস শব্দের গৌণ ‘দৃশ্য-গোমাংস’ অর্থটি কিন্তু ঠিকই বুঝেছি। তাই আমরা সাধারণ হিন্দুরা গোমাংস খাইনি (যাঁরা লুকিয়ে চুরিয়ে খান কিংবা বিদেশে গেলে খান, অথবা যাঁরা কলকাতার ‘বিফ-ইটার্স এসোসিয়েশন’-এর সদস্যরূপে খান, তাঁদের কথা আমরা ধরছি না)। তার মানে এই নয় যে, আমরা অদৃশ্য মাংস-মৎস্য খাইনি তা নয়। কী খাই না খাই, সেই সব কথা আমরা মৎস্য থেকে মৎস্যগন্ধ পর্য্যন্ত শব্দগুলিতে বিস্তারিত ভাবে বলেছি। অনাবাসী এই ভারতীয় শব্দের ভাই-বেরাদররা হলেন – (Slavonic) – meso, (Prussian) – mensa, (Lithuanian) – misa।
গোমাংস
গোমাংস = গো-এর [ যাহা চলিয়া যায় সেই পণ্য-এর ] মাংস (মূল্যগ্রহণ) যাহাতে। [ পণ্য ও উৎপন্নে যে পার্থক্য, তাহা স্মর্তব্য ]। পণ্যমূল্য; (সাদৃশ্যে) গরুর মাংস।
গো-মাংসভক্ষণ
গো-মাংসভক্ষণ = গো-মাংস ভক্ষণ করা হয় যাহাতে; পণ্য উৎদন ও বিক্রয় করিয়া সম্পদ বৃদ্ধি করা বা মনের চর্ব্বি বাড়ানো [ অর্থাৎ মানসিক-গোমাংস ভক্ষণ করা ] হয় যাহাতে; (সাদৃশ্যে) গরুর হাড়মাস খাইয়া দেহের চর্ব্বি বৃদ্ধি করা [ অর্থাৎ বাহ্যিক-গোমাংসভক্ষণ করা ] হয় যাহাতে। [ লক্ষ্যণীয় যে, গুজরাটি ব্যবসায়ীরা বাহ্যিক গোমাংস স্পর্শ করে না, কিন্তু মানসিক গোমাংসভক্ষণে সারাদিন ডুবিয়া থাকেন; যখন কিনা ভারতীয় উপমহাদেশের অধিকাংশ অধিবাসী, বাহ্যিক গোমাংসভক্ষণ করুন আর নাই করুন, মানসিক গোমাংসভক্ষণ করার প্রতি একপ্রকার গভীর বিরাগ পোষণ করিয়া থাকেন ]।
বৃথামাংস
বৃথামাংস = বৃথা যে মাংস; যে মাংস ভক্ষণ করা নিষিদ্ধ; প্রয়োজন নাই তবুও ‘আমার অংশ’ (মাংস) ‘আমার অংশ’ (মাংস) বলিয়া ব্যক্তিমালিকানার বৃদ্ধি বা রোজগার করা হয় যাহাতে; যে বাড়তি রোজগারের বা বৃদ্ধির অংশ শাসককে ‘কর’, ‘খাজনা’, ‘বলি’ (ট্যাক্স) রূপে বা ‘দেবোদ্দেশে নিবেদন’ করিয়া গ্রহণ করিলে (ভক্ষণ করিলে) সেই মাংসভক্ষণ আর বৃথা-মাংসভক্ষণ থাকে না; যে অর্জ্জিত সম্পদের কর দেওয়া হয়নি। / যাহা দেবাদ্যর্চ্চনাবিশিষ্ট নহে এবং আত্মার্থ সাধিত (হইয়াছে)। কালো টাকা, কৃষ্ণধন, (পৌরাণিক ভাষায়) দেব-দেবীকে উৎসর্গ করা হয়নি এমন মাংস।
পুরাণাদি পাঠকালে এই বৃথামাংস শব্দটি আপনাকে বারবার বিব্রত করবেই। আপনি দেখবেন, একদিকে বৃথামাংস ভক্ষণ নিষিদ্ধ, অন্য দিকে কেউ কেউ তা ভক্ষণ করছে বলে শাসকের কোপে পড়ছে … আপনি বুঝতে চাইবেন ব্যাপার কী?
প্রথম প্রথম আপনি কিছুতেই শব্দটির কোনো কূলকিনারা পাবেন ন। কিন্তু যেই না আপনি মৎস্য ও মাংস শব্দের অদৃশ্য অর্থটি (‘নিজস্ব’ ও ‘নিজ মালিকানার অংশ’) জেনে যাবেন, তৎক্ষণাৎ এক তেপান্তরের মাঠ দেখতে পেয়ে যাবেন। সেই তেপান্তরের মাঠে এই মৎস্য মাংস নিয়ে কত যে কথা, বাদবিতণ্ডা, তর্কাতর্কি … বেদপুরাণাদি গ্রন্থে তা সবই লিপিবদ্ধ আছে। কোনো বস্তুকে ‘আমার’ বা মৎস্য বলা যায় কি না, ‘আমার-অংশ’ বা মাংস বলে ভোগ করা উচিত কি না, অন্যের উৎপাদিত বস্তু বা মৎস্য-মাংস নেওয়া উচিত কি না, তা সে বিনিময়ে হোক আর দানেই হোক, এবং সেগুলি নিয়ে নিজের বলে ভোগ করা উচিত কি না – এসব নিয়ে যুগে যুগে কত যে বিতর্ক চলেছে তার ইয়ত্তা নেই। সর্ব্বোপরি, “আর প্রয়োজন নেই, তাও ‘আমার অংশ’, ‘আমার-অংশ’, ‘আমার’, ‘আমার’ করে করে রোজগার করে যাওয়া” – পুরাণাদিতে একেই নাম দেওয়া হয়েছিল ‘বৃথামাংস-ভক্ষণ’ এবং প্রাচীন ভারতের প্রায় সমস্ত গ্রন্থে এইরূপ বৃথামাংস ভক্ষণ নিন্দনীয় ও নিষিদ্ধ বলে ঘোষিত হয়েছিল।
তা হোক, কিন্তু তার ফল কী হয়েছিল? তার ফল এই হয়েছিল যে, আপনি যত বেশীই রোজগার করুন, শাসককে তার অংশ দিতে হবে, কর দিতে হবে, বলি দিতে হবে, খাজনা দিতে হবে, ট্যাক্স দিতে হবে, দেবোদ্দেশে নিবেদন করে তবেই আপনি তা ভোগ করতে পারবেন, অন্যথায় আপনার মাংস-ভক্ষণ বৃথামাংস-ভক্ষণ হয়ে যাবে, নিন্দনীয় হয়ে যাবে, নিষিদ্ধ বলে মনে করা হবে। …
অতএব নগদ নারায়ণের বা অর্থের তিনটি রূপ এসে গেল সামনে – শুক্ল, শবল, ও কৃষ্ণ। বলি দিয়ে খান, আপনি শুক্ল অর্থ বা ‘হোয়াইট মানি’ ভোগ করছেন। অন্যথায় নগদ-নারায়ণ শ্রীকৃষ্ণ বলে ঘোষিত হবেন এবং কংসরাজা আপনার উপর খড়্গহস্ত হয়ে আপনাকে তাড়া করবে।
তাহলে তো এই বাস্তব বলি-প্রদান কর্ম্মের প্রতীকী আচরণের সূচনা হওয়া চাই, সেই প্রতীকী আচরণ প্রথা রূপে প্রচলিত থাকা চাই, সবক্ষেত্রে যা হয়ে থাকে। অতএব শুরু হল এর প্রতীকী আচরণ – অদৃশ্য দেবতার উদ্দেশ্যে দৃশ্য পশু বলি দিয়ে নিজেরা তার মাংস খেয়ে নেওয়া। তার মানে বাস্তবে আমরা ধনীরা যত খুশী রোজগার করছি, বৃথামাংস খাচ্ছি, তার কর বা বলি বা ট্যাক্স দিয়ে দিচ্ছি শাসক দেবতাকে; আর তার প্রতীকী আচরণ করছি বলির পশুতে দেবত্ব আরোপ করে, Holy Communion (Eucharist) করে, সে পশুর বলি দিয়ে তার মাংস খেয়ে। রীতিটি এত গভীরভাবে সমাজে আজও প্রচলিত রয়েছে যে, যে-ব্রাহ্মণ কদাপি মাংস ভোজন করেন না, তিনিও বলির মাংস প্রসাদ রূপে ভক্ষণ করতে রাজী হয়ে যান। এমনকি মুসলিম মহিলাদের মধ্যে দেখা গেছে, যিনি কখনো কোনো মাংসই খান না, কোরবানির মাংস তিনি প্রসাদরূপে একবারের জন্য হলেও অবশ্যই খেয়ে থাকেন। জানি না হিন্দু-মুসলিম-খ্রিস্টান ধর্ম্ম বাদে বিশ্বের অন্যান্য ধর্ম্মে ও সংস্কৃতিতে এর কিরূপ উত্তরাধিকার আজও বিদ্যমান আছে। তবে বৃথাপাক-এর মতো ধারণাধারী শব্দ কোনো সংস্কৃতিতে আদৌ থাকতে পারে, এমন কথা ভাবা কঠিন।
আমিষ
আমিষ = আমি দিশাগ্রস্ত যাহাতে; মিষ-এর (অভিভব করিবার ইচ্ছার) আশ্রয় যাহাতে; ‘আমি’ ‘আমি’ ‘আমার’ ‘আমার’ করিবার (মৎস্য মাংস খাইবার) ইচ্ছা থাকে যাহাতে। ব্যক্তিমালিক হওয়ার ইচ্ছা, বিষয়াভিলাষ, উপঢৌকন, উৎকোচ, (সাদৃশ্যে) অপক্ক মাংস, মাংস, মাছ।
গোবর্দ্ধন
গোবর্দ্ধন = যে বা যিনি গো-বৃদ্ধি করেন; যে সামাজিক সংস্থা (বা পর্ব্বত) পণ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করেন; বৌদ্ধযুগের (রামরাজত্বের) শেষ কালখণ্ডে যে শাসকসত্তা ব্যাপক পণ্য উৎপাদন করায় ‘রাজ্যবর্দ্ধন’ করিবার (সাম্রাজ্যবাদী হইবার) একান্ত প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল। রাজ্যবর্দ্ধনের পিতা, বৃন্দাবনে প্রতিষ্ঠিত পণ্য উৎপাদন ও বিনিময় ব্যবস্থা; (সাদৃশ্যে) গোবর্দ্ধন নামে পর্ব্বত।
গোবর
গোবর = গো-এর (…পণ্যমূল্যের) বহন রহে যাহাতে; পণ্যাদি বিক্রয় করিয়া যে গোবর (হার্ড ক্যাশ) লাভ করা যায়; কিংবা কর্ম্মযজ্ঞে যাহা বিনিয়োগ করিতে হয়; অথবা, (সাদৃশ্যে) গরু যে বিষ্ঠা ত্যাগ করে। শুষ্কচূর্ণিত গোময়।
গোমূত্র
গোমূত্র= গো (…পণ্যমূল্য) মূত্র (সীমায়িত রূপে ত্রাণ পায়) যাহাতে; পণ্যাদি বিক্রয় করিয়া যে গোমূত্র (লিকুয়িড মানি) লাভ করা যায়; (সাদৃশ্যে) গরু যে মূত্র ত্যাগ করে। গরুর মূত্র বা প্রস্রাব।
‘আমিষ’ ভক্ষণে আমাদের আপত্তি একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহ্য। তবে ঠিক ভোগবিলাসে আপত্তির মতোই, নিন্দা করে আবার তারই জন্য প্রাণপাত করি। কিন্তু নিন্দাটা বহুকাল থেকে চলে আসছে, যদিও সেসব কথা আমরা অনেকটাই ভুলে গেছি। …আমরা বিস্মৃত হয়েছি, কেন অপক্ক মাংস বোঝাতে ঋগবেদে আমিষ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছিল? কেন পরবর্তীকালে যে-কোনও ভোগ্যবস্তু বা উপভোগ্য দ্রব্য বোঝাতে ওই আমিষ শব্দটিই ব্যবহার করা হত? কেনই বা উৎকোচ, উপঢৌকন, বিষয়াভিলাষ, কামগুণ, সুন্দর-আকৃতি-রূপ-কে আমিষ বলা হত? কেনই বা একালে কেউ ঘুষ খেলে, আমরা বলি না – লোকটা আমিষ খাচ্ছে? কেন জমির ফলকে আমিষ বলা হয়? কেনই বা আমিষী শব্দের অর্থ জটামাংসী?