লিখেছেন: রাজু আলাউদ্দিন
কৃতজ্ঞতায়: বিডিনিউজটোয়েন্টিফোরডটকম
বাংলা কবিতার প্রাচীন নিদর্শন চর্যাপদের কালপর্ব, ভাষিক উৎস ও এর ব্যাকরণিক সম্পর্ক নির্ণয়ে ঐতিহাসিক নিশ্চয়তামূলক যে পরিমাণ তথ্যের অধিকারী আমরা হতে পেরেছি, সেই তুলনায় এর সাহিত্যিক ও শিল্পমূল্যের উচ্চতা সম্পর্কে আলোচনা খুবই অকিঞ্চিৎকর। আরও আশ্চর্যের ব্যাপার এই, চর্যাপদ নিয়ে বিদ্যায়তনিক বৃত্তে এর শারীরতাত্ত্বিক আলোচনার প্রাচুর্য থাকলেও, বাংলাভাষার প্রথম সারির কবি ও কথাসাহিত্যিক, এমনকি প্রাবন্ধিকদের লেখাতেও চর্যাপদ নিয়ে তেমন কোন আলোচনা দেখা যায় না। চর্যাপদের যা-কিছু ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ আমরা দেখতে পাই তার প্রায় পুরোটাই গবেষকদের সৌজন্যে। কিন্তু তাদের এসব গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ বহু তথ্য উপাত্ত, পর্যবেক্ষণ ও টীকাটিপ্পনী থাকলেও বিশ্বসাহিত্য ও ভাবুকতার বিশ্ব-দরবারে তার ঔজ্জল্য কতটুকু কিংবা চর্যাপদের নান্দনিক গুরুত্ব আমাদের কাছে কেন আজও উর্ধ্বতন, এ নিয়ে আলোচনা তেমনটা চোখে পড়ে না। একমাত্র ব্যতিক্রম বোধহয় অতীন্দ্র মজুমদারের চর্যাপদ নামক বইটি যেখানে তিনি উত্তরকালের বাংলাভাষী কবিদের উপর চর্যাপদের প্রভাব ও বিস্তার সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন, কিন্তু সেখানে বিদেশি সাহিত্যের সাথে চর্যাপদের কোনো তুল্যমূল্য হাজির করেননি। অতীন্দ্র মজুমদারের আগে বা পরেও তা কেউ করেননি। অথচ চর্যাপদ, কেবল প্রাচীনতম নিদর্শন বলেই নয়, এর আলংকারিক, ভাষিক, কাব্যিক ও দার্শনিক প্রবনতায় রয়েছে কালোত্তর সেই সব লক্ষণ যা বিভাষী ও বিজাতি হৃদয়কেও অভিভূত করে।
অন্য এক লেখায় আমি বাংলাভাষার এই আশ্চর্য ভান্ডারের প্রতি মেহিকানো লেখক অক্তাবিও পাসের পক্ষপাতের কথা উল্লেখ করলেও, চর্যাপদের তান্ত্রিক প্রেক্ষাপটের প্রতি তার পর্যবেক্ষণ ও মন্তব্য তাতে অনুক্ত ছিল। অনুক্ত থাকার কারণ এ নিয়ে স্বতন্ত্র এক প্রবন্ধ লেখার অভিপ্রায়। আর পাসের পক্ষপাতের উল্লেখ করছি এই জন্য যে বাংলা কবিতা তিনি অনুবাদের আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছিলেন বহুকাল আগে, খুব সম্ভবত ভারতে মেহিকোর রাষ্ট্রদূত থাকাকালেই। তার এই আকাঙ্ক্ষা Versiones y Diversiones গ্রন্থের ভূমিকায় যেমন পাওয়া যাবে তেমনি সেই অভিপ্রায়ের প্রতিধ্বনি শুনতে পাবো কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের সাথে সাক্ষাতের অভিজ্ঞতাতেও,
“কয়েক লহমায় যখন পাজ-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল, তিনি এই মর্মে অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছিলেন, দ্বিভাষিক(বাংলা-স্পেনীয়) কবিতা পাঠের মাধ্যমে আরেকবার তিনি ভারতপথিক হবেন, শ্রোতাদের কাছে তাঁর প্রতিমা স্পষ্ট করে তুলবেন আরও।”
(অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, রিখিয়া থেকে অনেক দূরে, অলকানন্দা পাবলিশার্স, ২০১২, পৃ: ৮৪)
কিন্তু শেষ পর্যন্ত অনুবাদ না করলেও বাংলা কবিতার আদি নিদর্শন সম্পর্কে তিনি নিরব ছিলেন না।
চর্যাপদ প্রসঙ্গে অক্তাবিও পাসের মন্তব্য, পর্যবেক্ষণ ও ব্যাখ্যায় প্রবেশের আগে ইউরোপীয় প্রধান ভাষার কবিতার আদি নমুনাগুলোর সঙ্গে চর্যাপদের ভিন্ন স্বভাবকে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে দেখে নেয়াটা জরুরী। কারণ পাস চর্যাপদের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে আমাদেরকে সেই বৃহত্তর পরিসরে মূল্যায়নের দিকে ভার্জিলের মতো পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবেন।
আমরা সবাই জানি যে যে-কোনো ভাষার আদি নিদর্শন কবিতা। তবে অধিকাংশ ভাষাতেই প্রারম্ভে কবিতা হলেও তা মূলত আখ্যান বা গাথা-নির্ভর ছিল। জার্মান ভাষার হিল্ডেব্রান্ডসলিড (Hildebrandslied) বা ফরাসি ভাষায় ‘কর্মগাথা’ (Chansons de geste) কিংবা ‘রোলাঁ গাথা’ (Chansons de Roland) আমাদেরকে সেই সাক্ষ্যই দেয়। ফরাসি ভাষায় ত্রুবাদুরদের হাতেই প্রথম লিরিকের জন্ম হলো। অন্যদিকে স্প্যানিশ ভাষায় কবিতার আদি নিদর্শন ‘মোসারাবিব গীতি’ বা ‘হার্চা’র জন্ম হয়েছিল ফরাসি ত্রুবাদুরদেরও আগে– ১২ শতকে। ইউরোপীয় জীবিত ভাষাগুলোর মধ্যে একমাত্র স্প্যানিশই লিরিকের আদি জন্মদাতা হিসেবে গৌরবের দাবীদার।
এদিকে গোটা ভারতীয় উপমহাদেশে লিরিকের প্রথম জন্মদাত্রী হচ্ছে বাংলা ভাষা এবং চর্যাপদ এই ভাষার প্রথম কাব্যসন্তান। প্রাচীনতার বিচারে চর্যাপদ ইউরোপের জীবিত ভাষাগুলোর সমস্ত আদিতম লিরিকগুলোর পূর্বসূরী। অন্যদিকে ভারতের সেই সময়ে উপেক্ষিত ও নিম্নবর্গীয় এই ভাষায় রচিত লিরিকের প্রভাবেই জন্ম হয়েছিল the late Vaishnavite sanskrit and vernacular songs in one hand, and the Persian ghazals on the other. (Buddhist mystic songs, Dr. Muhammad Shahidullah, Bengali Academy, Revised and Enlarged Edition 1966)
প্রভাবসঞ্চারী এইসব ঐতিহাসিক ভূমিকা ছাড়াও চর্যাপদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট এর বহুস্তরী অর্থের ব্যঞ্জনা যা স্প্যানিশ হার্চার মধ্যে নেই। হার্চায় নেই সুগভীর, এমনকি অগভীর কাব্যবোধও, এগুলো–স্প্যানিশ ভাষার প্রধান কবি পেদ্রো সালিনাসের ভাষায়– very simple little songs এতে নেই চর্যাপদের মতো উপমা ও রূপকের আলংকারিক প্রাচুর্য। হার্চার মূল সৌন্দর্য এর সারল্য ও গীতলতা। অন্যদিকে, চর্যাপদের মূল সৌন্দর্য্য বাচ্যার্থের প্রচ্ছন্নতায়, দার্শনিকতা ও তান্ত্রিক সাধনাকে উপমা ও রূপকের আশ্রয়ে প্রকাশের জটিলতায়। আর এর আত্মা সতত স্পন্দিত কাব্যের সৌন্দর্যবোধ দ্বারা। গোটা ইউরোপের কোনো ভাষাতেই উষালগ্নের লিরিক কবিতায় এর সমুতল্য নজির নেই। ইউরোপের অন্যান্য ভাষায় রচিত প্রাচীন কাব্য নিদর্শনের সাথে চর্যাপদের আরও একটি বড় পার্থক্য এই যে ইউরোপীয় প্রাচীন কবিতাগুলো যেখানে যুদ্ধ, অভিযান কিংবা প্রেমাশ্রয়ী, চর্যাপদ সেখানে প্রেম নয়, বরং শরীরি অভিভ্যক্তিকে আশ্রয় করেছে তান্ত্রিক সাধনার উপায় হিসেবে। অক্তাবিও পাসের ভাষায়,
“আমরা যাকে প্রেম বলি তন্ত্রবাদ সে সম্পর্কে পুরোপুরি অজ্ঞ, তার যৌনকামনা হচ্ছে এক ধরনের ধর্মীয় আচার।”
El tantrismo ignora lo que llamamos amor y su erotismo es sacramental. ( Octavio Paz, Conjunciones y disyunciones, Editorial Joaquin Mortiz, Mexico, Febrero 1986, P 80) অর্থাৎ প্রেম ও আখ্যান-নির্ভরতা যে সময় প্রায় সব ভাষার ক্ষেত্রেই ছিল ধ্রুবাচার, চর্যাপদ সেই পথ এড়িয়ে প্রবেশ করেছিল দেহের জটিল অরণ্যে– কায়া যেখানে ‘তরুবর পঞ্চবি ডাল’। (চর্যা-১), যেখানে পরস্পর আলিঙ্গনে প্রস্ফূটিত (তিঅড়া চাপী জোইনি দে অঙ্কবালী (চর্যা-৪), যেখানে একে অপরকে চুম্বন করে কমলরস পানে (তো মুহ চুম্বী কমলরস পীবমি, চর্যা-৪) তৃপ্ত হয়। চর্যাপদগুলোয় দেহ ফিরে এসেছে বার বার কামজ বাসনা নিয়ে আর প্রতিবারই তা অর্থের নতুন ব্যঞ্জনায় উদ্ভাসিত:
ভনই গুন্ডরী আমহে কুন্দুরে বীরা
নরঅ নারী মাঝে উভিল চীরা (চর্যা-৪)দেহ নঅরী বিহরই একারে (চর্যা-১১)
পাঞ্চ তথাগত কিঅ কেডুয়াল।
বাহহ কাঅ কাহ্নিল মাআজাল। (চর্যা-১৩)কাহ্নে গাই তু কাম চন্ডালী।
ডোম্বি তো আগলি নাহি ছিনালী (চর্যা-১৮)ডোম্বী-এর সঙ্গে জো জোই রত্ত।
খণহ ন ছাড়ই সহজ উন্মত্ত। (চর্যা-১৯)বতিস জোইনী তসু অঙ্গ উল্লসিউ (চর্যা-২৭)
সবরো ভূঅঙ্গ নইরামনি দারী পেম্ম রাতি পোহাইলী।। (চর্যা-২৮)
মহাসুহে বিলসন্তি সবরো লইয়া সুণ মেহেলী।। (চর্যা-৫০)
সন্দেহ নেই যে দৈহিক সম্ভোগের বিষয়টি চর্যাগীতিতে এসেছে তান্ত্রিক ঐতিহ্যের সূত্রে, কিন্তু বাংলা কবিতার এই আদিম দেবতারা শরীরি সম্ভোগকে সংস্কারের উর্ধে তুলে ধরে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। অর্থাৎ এসব কবিতা সরাসরি প্রবেশ করেছে শরীর ও কামের উষ্ণ পরিমন্ডলে। পৃথিবীর অন্য কোনো প্রাচীন লিরিকে শরীরি-সংরাগ উন্মোচনের এমন নজির দুর্লভ।
চর্যাপদ কেবল আধেয়-বৈভবেই নয়, এর আলংকারিক নৈপুন্য ও বাচনিক কুশলতা, বাস্তব ও বিভ্রমকে অভিন্ন কররেখায় নাগরিকত্ব দানের দার্শনিক প্রতীতি বয়ানেও কালোত্তর হয়ে উঠেছে। ‘উদক চান্দ জিম সাচ না মিচ্ছা’ (জলের চাঁদ যেমন না সত্য না মিছা। চর্যা-২৯)—জ্ঞানতাত্ত্বিক ইতি ও নেতির এই পরস্পর-বিরোধী বিশ্বাসকে বন্ধনের মাধ্যমে চর্যাপদ বাস্তবের অদৃশ্য স্তরকে আবিষ্কারে অগ্রনী ভূমিকা পালন করেছে। আলংকারিক সৌন্দর্য্যে মোড়ানো ভাবুকতার বিরল দীপ্তি নক্ষত্রের মতো বিকিরিত হতে দেখি চর্যাপদের শরীর থেকে। চর্যাপদের প্রবাদপ্রতীম একটি পংক্তি হচ্ছে ‘অপনা মাংসে হরিনা বৈরী’, আরেকটি, যদিও প্রবাদপ্রতীম নয়, কিন্তু আলংকারিক বিবেচনায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ: ‘জোইনি জালে রঅনি পোহাই’। প্রথম উদ্ধৃতিটিতে ব্যক্তির সৌন্দর্য্য ও দৌলত যে নিজেরই বিনাশের বীজ হয়ে ওঠে তা এই চিত্রকল্পটিতে অসামান্য সহজতায় তুলে ধরা হয়েছে। দ্বিতীয় নজিরে আমরা এমন এক রূপকের মুখোমুখি হচ্ছি যার কাব্যিক সুষমা আমাদেরকে অভিভূত না করে পারে না। আধুনিক বাংলায় এই বাক্যটির আদল আমাদের কাছে এরকম: যোগিনীর জালে (কিংবা জোনাকিজালে) রজনী পোহায়। ‘জোনাকি জালে রজনী পোহায়’– এই রূপকটি আমাকে স্মরণ করিয়ে দেয়
হোর্হে লু্ইস বোর্হেস কর্তৃক প্রশংসিত নর্স(Norse) কবিতায় ব্যবহৃত এক রূপক: The web of men। যুদ্ধের প্রতিনিধিত্বকারী এই রূপকটি সম্পর্কে বোর্হেসের রূপতাত্ত্বিক ভাষ্যটি হাজির করলে আমাদের কাছে ‘জোনাকির জাল’-এর রূপকটির সৌন্দর্য্য আরও বেশি উন্মোচিত হবে:
“‘জাল’ শব্দটি এখানে আসলেই চমৎকার, কারণ জাল ধারণাটির মধ্যে আমরা পাচ্ছি মধ্যযুগীয় যুদ্ধের কাঠামো। আমাদের আছে তরবারি, আছে ঢাল, আছে পরস্পরাভিমুখী যুদ্ধাস্ত্র। জীবন্ত প্রাণসত্ত্বা দিয়ে তৈরি হওয়ার কারণে জালের একটা দুঃস্বপ্নময় স্পর্শও আছে এতে। “ মানুষের জাল”: মানুষের জাল হচ্ছে তারাই যারা মরছে এবং একে অন্যকে হত্যা করছে।”
The word `web’ is really wonderful here, for in the idea of a web we get the pattern of a medieval battle. We have the swords, the shields, the crossing of the weapons. Also there is the nightmare touch of a web being made of living beings. “A web of men”: a web of men who are dying and killing each other. (Jorge Luis Borges, This craft of verse, Harvard university press, 2000, P-38)
জোনাকির বিন্দু বিন্দু আলোয় রচিত এক জালের কল্পনার মাধ্যমে কবির সৌন্দর্য্যচেতনা রাত্রিকে কেবল অন্ধকার থেকে মুক্তই করেনি, একই সঙ্গে তা অলংকৃতও করেছে।
চর্যাপদই হচ্ছে বিশ্বের একমাত্র প্রাচীন কবিতা যা সরাসরি তান্ত্রিক দর্শনকে আশ্রয় করে গড়ে উঠেছিল। তান্ত্রিক নিয়মাবলীকে আড়ালে রেখে দর্শনপ্রবণ হয়ে ওঠার মধ্যে মুক্তি খুঁজেছিল চর্যাপদ। যে নিহিলিজম (Nihilism) পশ্চিমে ১৯ শতকে চিন্তাজগতে আলোড়ন তুলেছিল তা এই ভূখন্ডে নার্গাজুন, মাৎসেন্দ্রনাথ প্রমুখের শূন্যতাবাদের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল। এমনকি তা আবিষ্ট করেছিল চর্যাপদের কোনো কোনো কবিকেও। বিশেষ করে সরহ ও কনহকে।
Both the two kanha and Saraha are, in fact, Nihilists. As for the madhyamika Philosophers, nothing is existing, neither bhava the existance “nor nirvana” annihilation”, neither bhava the being “nor abhava” “the non-being.”
The verity is innate (sahaja), i. e. the “nothingness.” The Vedas, the Puranas, the traditions, the didactic treatises, in fact, in all the sciences are useless for teaching of the truth. The teacher can only indicate it, but nothing can explain it, because it is beyond the pathway of words. (M. Shahidullah, The mystic songs of Kanha and Saraha the Doha Kosa, translated by Pranabesh sinha Roy published by the Asiatic society 2007, P 16-17)
শুধু কনহ এবং সরহই নন চর্যাপদের আরেক কবি কৃষ্ণাচার্যপাদানাম নিহিলিজমকে আরও ব্যাপক ও প্রগাঢ় করে তুলেছেন যখন তিনি বলেন,
“স্বপণে মই দেখিল তিহুবণ সুণ/ ঘোরিঅ অবণাগবণ বিহুণ (স্বপ্নে মুই দেখিলাম ত্রিভুবন শূন্য,/ ঘুরিয়া আনাগেনা বিহীন। চর্যা-৩৬ )।”
চর্যাপদ দার্শনিক দৌলতে যতটা ঐশ্বর্য্যময়, ঠিক ততটাই ঋদ্ধ ভাষা-সম্পর্কিত দার্শনিক ভাবুকতায়। সন্দেহ নেই যে এই ভাবুকতার বীজ সে নিয়ে এসেছে বুদ্ধের দর্শন থেকে। ভাষাকে আমরা সবকিছু প্রকাশের মাধ্যম ভাবলেও এমন কিছু বিষয় আছে যা প্রকাশ করতে গিয়ে আরও দুর্বোধ্য, জটিল ও অর্থহীনতার প্রান্তে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে। শহীদুল্লাহ্ চর্যার কবিদের তান্ত্রিক সাধনা ও জীবনাচরনের ভাষিক প্রকাশের সীমা ও সীমাবদ্ধতার হদিসটি জানতেন এবং তা আমাদেরকে জানাতে ভোলেননি তার গবেষণাকর্মে: noting can explain it, because it is beyond the pathway of words. শহীদুল্লাহর এই উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মনে পরবে গৌতম বুদ্ধের কথা যিনি জীবনের নানান বিধান প্রনয়ণ সত্ত্বেও নিরব ছিলেন এমন কযেকটি প্রশ্নে যার উত্তর দেয়া নিরর্থক মনে হয়েছিল তার কাছে। কিংবা সে সবের উত্তর মানেই বিভ্রান্তির সৃষ্টি। তাই নিরবতাই ছিল সঠিক উত্তর কারণ কোনকিছু না-বললেও, অন্তত বিভ্রান্ত করা থেকে আমাদেরকে রক্ষা করে। সবাই জানেন
কিছু প্রশ্নের জবাবে– যেমনটা আমরা বুদ্ধ সম্পর্কিত কাহিনিগুলো থেকে জানি– বুদ্ধ ছিলেন নিরব। কেন নিরব ছিলেন তার এক গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে অক্তাবিও পাস বলেছিলেন:
“বুদ্ধ এর জবাব দেননি, কারণ কিছু বিষয় আছে যেগুলো সম্পর্কে কথা বলা সম্ভব নয় বরং নিরব থাকাই শ্রেয়। শব্দরা দ্বান্দিক: একটাকে ইতিবাচক করতে গেলে অন্যটি হয়ে পড়ে নেতিবাচক। এমন এক মুহূর্ত আছে যখন কোনো কিছুকে ইতিবাচক বা নেতিবাচক করা সম্ভব নয় কিংবা আরও ভালোভাবে বললে দাঁড়ায় এই যে যখন ইতিবাচক ও নেতিবাচক, অর্থ ও অর্থহীনতা পরস্পর সহাবস্থান করে বা পরস্পরকে নিরপেক্ষ করে তোলে। এটাই হতে পারে বুদ্ধের নিরবতার অর্থ।
আমি মনে করি অর্থ ও অর্থহীনতা–এসব হচ্ছে ভাষিক ফাঁদ এবং নিরবতা ভূয়া এই বিয়োজককে দ্রবীভূত করে দেয়। কিন্তু শব্দের পরেই রয়েছে নিরবতা। বা বলা যায়, জানার পর যা রয়েছে এটা তাই।”
Buda no habia contestado porque hay ciertas cosas que no se pueden decir sino con el silencio. La palabra es dialectica: si afirma algo, niega algo. Solo que hay un momento en que no es possible ni afirmar ni negar, o major dicho en que afirmacion y negacion, signifivanion y no significacion coinciden o se neutralizan. Eso seria el sentido del silencio de Buda.
Yo creo que significacion y no significacion son trampas linguisticas y que el silencio disuelve esa falsa disyuntiva. Pero es el silencio despues de la palabra. O sea, lo que esta despues del saber. (Elena Poniatowska, Octavio Paz: las palabras del arbol, plaza Janez 1998, P 109-110) অক্তাবিও পাস এই নিরবতার কারণকে সংক্ষিপ্ত রূপে প্রকাশ করেছেন ‘জেনে না-জানা’ (un no saber sabiendo) রূপে।
ব্লায়েস পাস্কাল সন্ত্রস্ত ছিলেন বিপুল শূন্যতা ও নিরবতায়। এই সূত্রে আমাদের মনে পড়বে তার সেই বিখ্যাত উক্তি: The eternal silence of these infinite space frightens me.
বুঝতে অসুবিধা হয় না যে পাস্কালের এই নিরবতার উৎস বর্হিজগতের অসীমতা। কিন্তু মানুষের অন্তর্জগতেরও রয়েছে অনুরূপ অসীমতা যেটা সম্পর্কে ভাষিক প্রকাশ যথাযথতার পরিবর্তে বরং আরও জটিল ও দুরূহ, আরও বেশি দূরবর্তী ও গোলকধাঁধাময় হয়ে ওঠার আশংকায় পূর্ণ হয়ে ওঠে। আমাদের অন্তর্জগতের নির্জন এক প্রকোষ্ঠের বাসিন্দা প্রজ্ঞার এমন কিছু উপলব্ধি আছে যা unsayable, অকহতব্য। কবিতা তার অতিসংবেদনশীলতার কারণে ভাষার এই অক্ষমতাকে যতটা বুঝতে পারে জ্ঞানের অন্য কোনো মাধ্যম ততটা অনুভব করে না। প্রজ্ঞার এক বিশেষ উপলব্ধিকে যে ভাষা খুব বেশি দূর এগিয়ে নিতে পারে না চর্যাপদের কবি কাহ্নপাদানাম হাজার বছর আগে ঠিক এই উপলব্ধিটা করেছিলেন:
আঁলে গুরু উএসই সীস
বাক পথাতীত কহিব কীস।।
জেতই বোলী তেতবি টাল
গুরু বোব সে সীসা কাল।।(চর্যা-৪০)
শহীদুল্লাহ্ চর্যার এই অশংটুকু ইংরেজি অনুবাদ করেছেন এভাবে: How can he speak of the which is beyond the reach of the way of speach? The more it was said, the more it was subterfuge. The guru is dumb, the disciple is deaf. কথাটা যত সহজ ও স্পষ্ট মনে হয় এবং তা যতই হেঁয়ালিপূর্ণ মনে হোক না কেন– আসলে তা অত সোজা যেমন নয়, তেমনি নিছক হেঁয়ালির কূটাচ্ছাদিত অলংকার মাত্র।
কাহ্নুপার এই উপলব্ধির সূত্রে আমাদের মনে পরবে অস্ট্রীয় জার্মানভাষী দার্শনিক লুডভিগ ভিটগেন্সটাইনের ভাষা-সম্পর্কিত সেই উদ্বেগের কথা যার মূলে রয়েছে কখনো কখনো অর্থের বিমুখতা বা নিরবতায় অর্থের অদৃশ্য থাকার নিরাপদ অভিপ্রায়।
ভিটগেন্সটাইন জীবদ্দশায় প্রকাশিত Tractatus Logico-Philosophicus গ্রন্থে দর্শনের এমন কতগুলো কেন্দ্রীয় সমস্যার মোকাবেলা করছেন যার মূলে রয়েছে জগত, ভাবনা এবং ভাষা। সাতটি মৌল প্রস্তাবনার মাধ্যমে তিনি সমস্যাগুলোর মোকাবেলা করেন। যেহেতু এ আলোচনায় প্রাসঙ্গিক নয় তাই সবগুলোর উল্লেখ না করে এখানে কেবল আমাদের জন্য প্রাসঙ্গিক প্রস্তাবনাটা উল্লেখ করছি যা কাহ্নুপার চর্যাটির সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত। ভিটগেন্সটাইনের প্রবাদতুল্য উক্তিটি ছিল এরকম:
“what we can not speak about we must pass over in silence.”
(Ludwig Wittgenstein, Tractatus Logico-Philosophicus, Routledge 1974. (P-89)
এটি যদিও মূল সাতটি প্রস্তাবনার অন্তিম কিন্তু এই শেষ প্রস্তাবনাটিই তার দর্শনের অন্যান্য প্রস্তাবনার সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। এবং দর্শনের একটা প্রধান সমস্যা যে ভাষা ও অভিপ্রকাশ তা ভিটগেন্সটাইনের আগে পশ্চিমে এমন করে ভাবা হয়নি। ভিটগেন্সটাইনের দর্শনে এটি প্রায় এক কেন্দ্রিয় বিবৃতি হয়ে আছে। Tractatus-এর ৪ নং প্রস্তাবনা ও তার অনুচ্ছেদগুলোর দিকে তাকালেই আমরা বুঝতে পারবো কেন তা কেন্দ্রিয়:
4. A thought is a proposition with a sense.
4. 001 The totality of propositions is language.
এর পরের অনুচ্ছেদেই ভিটগেন্সটাইন বলছেন যে,
It is not humanly possible to gather immediately from it what the Logic of Language is. কেন সম্ভব নয় তার কারণ হিসেবে তিনি জানাচ্ছেন যে language disguises thought. So much so, that the outward form of the clothing it is impossible to infer the form of the thought beneath it, because the outward form of the clothing is not designed to reveal the form of the body, but for entirely different purpose.
তাহলে প্রশ্ন উঠবে স্বাভাবিকভাবেই এতদিন যে ভাষাকে আশ্রয় করে দার্শনিকদের ভাবুকতার প্রকাশ ঘটেছে তা কি অর্থহীন? তার সবটাই কি ব্যর্থ তাহলে? আশ্চর্য হলেও সত্য যে ভিটগেন্সটাইন ঠিক এই সন্দেহটাই উস্কে দিয়েছেন। পরের অনুচ্ছেদেই তিনি খোলাখুলি জানিয়ে দিলেন সন্দেহজাত সেই অনর্থের কথাও:
most of the propositions and questions to be found in philosophical works are not false but nonsensical. Consequently we cannot give any answer to questions of this kind, but can only point out that they are nonsensical.
(Ludwig Wittgenstein, Tractatus Logico-PhilosophicusTranslated by D. F. Pears and B. F. McGuinness, Routledge, Revised edition 1974, p 22-23)
কাহ্নুপাও ভাবনার এমন এক দশার ইঙ্গিত দিয়েছেন তার কবিতায় যা ‘অকহতব্য’ (unsayable), কেন না তা ‘বাক পথাতীত’। দার্শনিকদের মতো যদি এই অকহতব্যকে বলতে যাওয়া হয় তাহলে তা অনর্থবোধক (Nonsensical) হতে বাধ্য। ‘কারণ জেতই বোলী তেতবি টাল’ হবে, অর্থাৎ ভাষার চাতুরী (টাল) হয়ে উঠবে। আর ভাষার চাতুরী আর যাইহোক, তা শেষ পর্যন্ত কোনো অর্থকেই প্রকাশ করতে পারছে না, যেহেতু ভাষাটা হচ্ছে এক্ষেত্রে ভিটগেন্সটাইনের বয়ানে ‘দেহ’ (body) রূপী নিহিত ‘ভাবনার’ (thought) পোশাক মাত্র, আর এই পোশাকটি এমনভাবে ‘তৈরি’ (designed) করা হয়নি যা পোশাকের আড়ালে থাকা ‘দেহ’টিকে প্রকাশ করতে পারে। আর ভিটগেন্সটাইনের মতে বেশিরভাগ দার্শনিক সেই ‘দেহ’টি উন্মোচন করতে গিয়ে জন্ম দিয়েছেন অনর্থের (Nonsensical)। সুতরাং যে-সম্পর্কে বলা যায় না সে-সম্পর্কে নিরব থাকাই উচিত (what we can not speak about we must pass over in silence.)।
চর্যার কবি কাহ্নুপা ভিটগেন্সটাইনের বহু আগেই ভাষা ও ভাবনার মধ্যেকার এই অসমঝোতাকে উপলব্ধি করেছিলেন খুবই গুরুত্বের সাথে। দার্শনিকের মতো অনর্থের বিস্তার ঘটাবার পরিবর্তে কাহ্নুপা আমাদেরকে সতর্ক করে দিলেন এই বলে যে এ বিষয়ে নিরব থাকাই বরং শ্রেয়, কারণ তা নাহলে ভাষার মায়াবী ফাঁদে পড়ে হয়ে উঠতে হয় অনর্থের স্রষ্টা। কবি ও দার্শনিক এক অভিন্নকে উপলব্ধি করলেও দার্শনিক বলার মধ্য দিয়ে না-বলার অন্ধকারকে পুঞ্জীভূত করে তোলেন, অন্যদিকে কবি ‘ঘন যামিনীর মাঝে’ এক ‘না-বলা বাণী’কে বাঙ্ময় করে তোলেন।
আমরা একটু উৎকর্ণ হলেই লক্ষ্য করবো স্বদেশি ও বিদেশি ভাষায় আধুনিক মনীষার সেই সব হিরণ্ময় উচ্চারণ ও উপলব্ধি যা চর্যাপদের সমধর্মিতায় স্থিত। চর্যাপদ বাগৈশ্বর্যের গুণে আমাদের আধুনিক মনীষার কোনো কোনো শিল্পিত স্বভাবের যে অজ্ঞাত পূর্বসুরী হয়ে আছে তার একটা নমুনা দেখা যাবে ডেন্ডনপায়। ডেন্ডনপা যখন তার এক কবিতায় চিরচেনা বাস্তবকে উল্টো করে হাজির করেন তখন তা আমাদের কীটদষ্ট সময়েরই নিখুঁত ভাষ্য হয়ে ওঠে:
জো সো বুধী সোহি নিবুধী।
জো সো চোর সোহি সাধী।।( চর্যা- ৩৩)
হাজার বছরের ব্যবধানে ডিলান টমাস কিংবা জীবনানন্দ দাশও কি একই রকম সমান্তরাল ভাষ্য নিয়ে হাজির হন না ইতি ও নেতির পারস্পরিক অর্থের বিনিময় ঘটিয়ে, অনেকটা কূটাভাসের আশ্রয়ে?:
“So the blind man sees best”
কিংবা জীবনানন্দ দাশ:
অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা
যাদের হৃদয়ে কোন প্রেম নেই, প্রীতি নেই করুণার আলোড়ন নেই
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।
কিংবা ধরা যাক ইয়েট্স-এর The Second Coming কবিতাটি যার পরতে পরতে উপরোক্ত চর্যারই দীর্ঘশ্বাস ঘনীভূত হয়ে আছে ইষৎ ভিন্ন বর্ণ ও প্রকরণে:
Mere anarchy is loosed upon the world,
The blood-dimmed tide is loosed, and everywhere
The ceremony of innocence is drowned;
The best lack all conviction, while the worst
Are full of passionate intensity.
কুটিল বাস্তবতা ও সভ্যতার ক্ষতগুলো উন্মোচনের মাধ্যমে চর্যাপদের কবিকূল ও আধুনিককালের ডিলান টমাস, জীবনানন্দ, ইয়েট্স প্রমুখ মিলিত হন উপলব্ধির অভিন্ন এক উপত্যকায়। এমন কি শেক্সপিয়রও কখনো কখনো হয়ে ওঠেন তাদের সমধর্মী যখন ভাদেপাদানাম বলেন:
পেখমি দহদিহ সব্বহি সুন।
চিএ বিহুন্নে পাপ না পুন।।(চর্যা-৩৫)
শহীদুল্লাহকৃত এর ইংরেজি তর্জমায় নিকটবর্তী আদলটি হবে এরকম:
I see that all the ten directions are void.
Without the mind there is neither sin nor virtue.
পাঁচ’শ বছরের ব্যবধানে শেক্সপিয়রকে একই প্রতিধ্বনি করে বলতে শুনবো:
for there is nothing either good or bad, but thinking makes it so.
কালের উজান ঠেলে চর্যাপদের কবিরা কালোত্তর স্বভাবগুণে সমকালীন হয়ে আছে আজও। আর সম্ভবত এই কারণেই মেহিকোর অসামান্য কবি ও প্রাবন্ধিক অক্তাবিও পাসকে আকৃষ্ট করেছিলো চর্যাপদ।
শহীদুল্লাহ্ ও পাস
চর্যাপদের প্রতি পাসের আগ্রহ এবং উল্লেখ আমরা লক্ষ্য করবো ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত তার Conjunciones y Disyunciones গ্রন্থে। আর চর্যাপদ অনুবাদের এষণা আমরা লক্ষ্য করবো পাস কর্তৃক অনূদিত কাব্যগ্রন্থ versiones y Diversiones-এ। বিভিন্ন ভাষা থেকে কবিতার অনুবাদের এই সংকলনটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭৪ সালে। পাস ততদিনে ভারতের রাষ্ট্রদূতের চাকরি ছেড়ে মেহিকোতে থিতু হয়েছেন। ১৯৭৩ সালের ১২ মার্চে লিখিত প্রথম সংস্করণের ভূমিকায় তিনি জানালেন যে,
“ছয় বছরেরও বেশি সময় ভারতে থেকেছি এবং সংস্কৃত ও পালি ভাষায় বিশেষজ্ঞ কয়েকজনের সাথে আমার সম্পর্কও আছে, তাহলে কেন তাদের সাহায্য নিয়ে কাব্য (Kavya) কর্ম অনুবাদের চেষ্টা করছি না? দুই তিনটা খসড়া করেছিও, কিন্তু পছন্দ হয়নি: হেলেনিয় শিল্পকর্মের মতোই ‘কাব্য’-এর ঐতিহ্য আমাদের কাছে দূরবর্তী। আমার অনেক বেশি আগ্রহ বিভিন্ন স্বদেশী ভাষার কবিদের প্রতি–কবীর, তুকারাম, চন্ডিদাস, বিদ্যাপতি আর সর্বোপরি সরহ ও কনহর মতো কবিদের হেঁঁয়ালিপূর্ণ লেখাগুলোয়। পরে আবার গেলে, যদি যাই, তাহলে হয়তো তাদের কিছু লেখা অনুবাদে উদ্বুদ্ধ হবো।”
Vivi mas de seis años en la India y estoy en relacion con algunos especialistas en sanscrito y en pali: por que no intente traducir con su ayuda algun texto kavya? Hice dos o tres pruebas pero desisti: la tradicion kavya esta tan lejos de nosotros como el arte helenistico. Me interesan mas los poetas en lenguas vernaculos—Kabir, Toukaram, Chandidas, Vidyapati—y, sobre todo, los textos enigmaticos de poetas como Saraha y Kanha. En la segunda vuelta de mi vida, si hay segunda vuelta, quiza me anime a traducir algo de ellos.(Octavio Paz, Versiones y Diversiones, Joaquin Mortiz, 1984, Mexico, p 5-6)
পাঁচ বছর পর এই বইটির যখন দ্বিতীয় সংস্করণ বের হয় তখন তিনি এই নতুন সংস্করণের ভূমিকায় লিখলেন:
“কোনো বিশেষজ্ঞের সহায়তায় সরহ ও কনহকে কোনদিন অনুবাদের ধারণাটি আমাকে ছেড়ে যায়নি।”
No me abandona, ademas, la idea de traducir algun dia, con la ayuda de un especialista, a Saraha y Kanha.(Octavio Paz, Versiones y Diversiones, Joaquin Mortiz, 1984, Mexico, p 7)
লক্ষ্য করার বিষয় হলো মধ্যযুগের বাংলাভাষী কবি চন্ডীদাস ও বিদ্যাপতি ছাড়াও তিনি চর্যাপদের দুজন কবির প্রতি আগ্রহের কথা জানিয়েছিলেন এবং দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকায় কেবল চর্যাপদের সেই পূর্বোক্ত দুজনের কথাই উল্লেখ করেছেন। উল্লেখ্য যে পাসের এই বইটি তার মৃত্যুর পর আরও একটি সংস্করণ বেরিয়েছিল ২০০০ সালে। সেখানে ১৯৯৫ সালে লেখা একটা ভূমিকা থাকলেও বাংলাভাষার কোনো কবির উল্লেখ যেমন তাতে নেই, নেই তাদের কবিতার সেই প্রতিশ্রুত অনুবাদ। ১৯৯৫ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারিতে লেখা তার সর্বশেষ এই ভূমিকাতে তিনি জানালেন যে “বহু বছর গড়িয়ে যাওয়ায় সলজ্জভাবেই ত্যাগ করতে হলো আগের ভূমিকা দুটোয় উল্লেখিত পরিকল্পনাগুলো“।
Al correr de los años abandone, no sin pena, los proyectos que mencionan los dos notas preliminaries. (Octavio Paz, Versiones y Diversiones, Galaxia Gutenberg, 2000, Mexico, p 14)
বাংলা কবিতার, বিশেষ করে সরহ ও কনহর কবিতা যে-আগ্রহ নিয়ে অনুবাদের প্রতিশ্রুতি তিনি জানিয়েছিলেন শেষ পর্যন্ত তা আর করেননি, তবে যে-খসড়াগুলোর কথা তিনি উল্লেখ করেছিলেন প্রথম সংস্করণের ভূমিকায় সেগুলোর চেহারা দেখা যাবে তার সমস্ত পান্ডুলিপি এবং খসড়া লেখা যদি ভবিষ্যতে কখনো প্রকাশিত হয়। আপাতত তার প্রকাশিত রচনার পরিপ্রেক্ষিতে শুধু এটুকুই বলা যায় যে পাস কর্তৃক চর্যার কোনো পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ নেই, তবে চর্যার কিছু খন্ডিত অনুবাদ উদ্ধৃত আকারে আছে তার একটি প্রবন্ধে। সেই নমুনাগুলো দেখার আগে আমাদের মনে যে-কৌতুহলগুলো জমাট বেঁধে আছে তার দিকে একটু ফিরে তাকানো যাক আলোচনার সুবিধার্থে।
এতো ঠিক যে ভারতীয় যা কিছু আছে তা তাকে কৌতূহলী করে তুলেছিল এবং তিনি সেই কৌতূহলের জবাব দিয়েছিলেন অসামান্য সৃজনশীলতা ও পান্ডিত্যের মাধ্যমে যার মধ্যে রয়েছে কাব্যগ্রন্থ, প্রবন্ধগ্রন্থ এবং অনুবাদ। আমরা সেসবের বিস্তার, উল্লেখ ও আলোচনায় এ মুহূর্তে যাবো না, কারণ তা এখানে প্রাসঙ্গিকও নয়, বরং এ লেখার শিরোনামের সাথে সঙ্গতি রেখে মূল কৌতূহলে নিজেদেরকে কেন্দ্রীভূত রাখতে চাই।
চর্যাপদের খন্ডিত অনুবাদ ও চর্যাপদের কবিদের প্রসঙ্গে তার আলোচনায় যে-নমুনাগুলো দেখতে পাই তা এসেছিল মূলত ভারতীয় তন্ত্রবাদ নিয়ে আলোচনার সূত্রে। ভারতীয় দর্শন ও তান্ত্রিক সাধনা নিয়ে ভারতীয় ও অভারতীয় লেখক গবেষকদের রচিত বইগুলো ছিল তার ভাবনার উৎস ও উপাদান। সে সব উৎসের কথা তিনি জানিয়েছেনও তার লেখায়। আর সেই উৎসের তালিকায় আমরা দেখতে পাবো বহুভাষায় পন্ডিত মননশীল প্রাবন্ধিক ও গবেষক ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্কেও। ১৯২৮ সালে প্রকাশিত শহীদুল্লাহর অসামান্য গবেষণাকর্ম Les chants mystiques de kanha et saraha (pulished by Adrien Maesonneuve, Paris, 1928) গ্রন্থটি যে তিনি অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে পড়েছিলেন তার কিছু উদাহরণ পাওয়া যাবে তার রচিত এক প্রবন্ধে। তিনি কেবল মনোযোগ দিয়ে সেটি পাঠই করেন নি, শহীদুল্লাহ্ কর্তৃক চর্যার কবিদের, বিশেষ করে সরহ ও কনহর ধর্মতত্ত্ব ও দার্শনিক ভাবনার যে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে তার কিছু কিছু পরোক্ষ ছায়াও পাওয়া যাবে তাতে। তান্ত্রিক সাধনার দার্শনিক ও জ্ঞানতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে চর্যাপদের যে-কবিদের কথা উল্লেখ ও বিশ্লেষণ করেছেন একাধিক জায়গায় সেখানে কেবল শহীদুল্লাহ্ কর্তৃক নির্বাচিত ওই সরহ ও কনহকেই আমরা দেখতে পাই। পাসের লেখাটির দু এক জায়গায় অন্য দু একজন কবির রচনার অংশবিশেষ উল্লেখ থাকলেও তারা কখনোই স্বনামে হাজির হন না। আমার এই ধারণার পক্ষে নিশ্চয়তাজ্ঞাপক আরেকটি নমুনা হচ্ছে এই যে তিনি চর্যাপদের যে দুজন মাত্র কবির কবিতা অনুবাদের আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছিলেন তার অনুবাদগ্রন্থের (Versiones y Diversiones) প্রথম ও দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকায় পাই শহীদুল্লাহ-কথিত কেবল সরহ ও কনহরই উল্লেখ।
এসব উদাহরণের ফলে আমার অনুমান পাস চর্যাপদের প্রাথমিক স্বাদ গ্রহণ করেছিলেন শহীদুল্লাহর সৌজন্যে। যদিও আমাদের অজানা নয় যে চর্যাপদের ইংরেজি অনুবাদ ষাটের দশকে প্রকাশিত হতে শুরু করে তারাপদ মুখোপাধ্যায় এবং অতীন্দ্র মজুমদারের অনুবাদে। অতীন্দ্র মজুমদারের অনুবাদটি বেরিয়েছিল ১৯৬৮ সালে আর তারাপদ মুখোপাধ্যায়ের অনুবাদটিও বেরিয়েছিল ষাটের দশকের শেষের দিকেই। অক্তাবিও এসব অনুবাদ আদৌ দেখেছিলেন কিনা আমার সন্দেহ, যেহেতু এসব অনুবাদ বিদেশি কোনো প্রকাশনা সংস্থা থেকে বের হয়নি। আর যদি দেখেও থাকেন, সেগুলো তার কাছে ততটা গুরুত্ব বহন করেনি, যেহেতু তার কোনো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ উল্লেখ তার লেখায় নেই। অন্য আরেকটি অনুবাদ পাসের নজরে পড়ার সম্ভাবনা থাকলেও সেটি বেরিয়েছিল An anthology of Buddist Tantric song শিরোনামে Per Kvaerne-এর অনুবাদে ১৯৭৭ সালে। কিন্তু এটি কিংবা আগের কোনোটিই দেখার সম্ভাবনা এজন্যে নেই যে পাসের বইটি প্রকাশিত হয়েছে ১৯৬৯ সালে। তার মানে লেখাটি প্রস্তুত হয়েছে গ্রন্থাকারে প্রকাশেরও অন্তত দুএক বছর আগে, কিংবা তারও আগে। অতএব চর্যাপদের স্বাদ গ্রহণের ক্ষেত্রে শহীদুল্লাহই ছিলেন পাসের মূল ভরকেন্দ্র, তবে একমাত্র হয়তো নয়। এটা অসম্ভব নয় যে তিনি যখন ভারতে রাষ্ট্রদূত হিসেবে অবস্থান করছিলেন তখন এই লেখাটির আগে ভারত থেকে প্রকাশিত প্রবোধচন্দ্র বাগচী বা অন্য কারোর অনুবাদে চর্যাপদ পড়ে থাকতে পারেন। কিন্তু অক্তাবিও পাসের লেখাটিতে তার কোনো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ উল্লেখ যেহেতু নেই তাই এটি নিছকই অনুমান ছাড়া আর কিছু নয়। তবে এটা ঠিক যে তান্ত্রিক সাধনার ধর্মীয়, দার্শনিক ও জ্ঞানতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের জন্য তিনি Etienne Lamotte =এর Histoire du Bouddhisme indies (1958), Agehananda Bharati –এর The Tantric Tradition (1965), D.L. Snellgrove-এর অনুবাদ ও ভূমিকাসহ প্রকাশিত The Hevojra Tantra (1951), Philip Rawson–এর Erotic art of East (1966), R. A Slein–এর civilisation tibetanne (1962), Mircia Eliade–এর Le Yoga, inmortalite et liberte (1954), S. B. Dasgupta-এর An introduction to Tantric Buddhism (1958) এবং Obscure Religious cults (1962), Edward conze, I. B. Horner, David Snellgrove-এবং Arthur waley -এর অনুবাদ ও সম্পাদনায় প্রকাশিত Buddhist texts through Ages (1954) ইত্যাদি গ্রন্থের সাহায্য নিয়েছিলেন, এগুলোর উল্লেখ তার লেখায় টিকাটিপ্পনীতে রয়েছে।
শহীদুল্লাহর গবেষণাকর্মসহ উল্লেখিত এসব গ্রন্থের সাহায্যে পাস চর্যাপদ সম্পর্কে কোন দৃষ্টিভঙ্গি ও ব্যাখ্যা নিয়ে হাজির হয়েছিলেন আমরা বরং সেদিকটায় নজর দিতে চাই। তার আগে তন্ত্রবাদে, এমনকি চর্যাপদেও দেহ ও যৌনতা কেন প্রধান বিষয় হিসেবে হাজির হয়েছে তার অর্থ ও গুরুত্ব বুঝবার জন্য এ সম্পর্কে পাসের দু একটি মন্তব্য উল্লেখ করাটা আশা করি অপ্রাসঙ্গিক হবে না। “নোভালিস বলেছিলেন, নারী হচ্ছে সবচেয়ে উদ্ভাসিত এক শরীরি খাবার: তান্ত্রিক ধর্মাচারও কি–একেবারেই মাংসল ও আক্ষরিক অর্থে –তাই বলে না?” Novalis dijo que la mujer es el alimento corporal mas elevado: no es eso lo que tambien dice, solo que carnal y literalmente, el rito tantrico?( (Octavio Paz, Conjunciones y disyunciones, Cuadernos de Joaquin Mortiz, Mexico Segunda edicion: Febrero de 1985, P 78) কারণ পাসের ভাষায়,
“তন্ত্রবাদ সর্বোপরি এক যৌন আচার। খৃষ্টীয় বিবাহোৎসব জনসমক্ষে ঘটে কিন্তু স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যৌনকর্মটি সম্পাদিত হয় একান্তে। তান্ত্রিক উৎসবটি ঘটে ভক্তবৃন্দের সামনে একজন বা একাধিক দম্পতির প্রকাশ্য যৌন সঙ্গমের মাধ্যমে। এই যৌন চর্চা স্ত্রীর সঙ্গে নয়, বরং যোগিনীর সঙ্গে ঘটে থাকে, সাধারণত সেই যোগিনী হয়ে থাকে নিম্নবর্গের কেউ। খৃষ্টান সম্প্রদায় এই কাজটি সম্পাদন করে শয়নকক্ষে তার মানে এক ইহলৌকিক জায়গায় (un sitio profano)। তন্ত্র সুনির্দিষ্টভাবে এ কথা বলে যে এটি উদযাপিত হতে হবে মন্দির কিংবা পবিত্র কোনো জায়গায়, এমন সব জায়গা হলে বেশি ভালো যেখানে মৃতেরা ভস্মীভূত হয়। ভস্মের উপর যৌনসঙ্গম, এর মানে জীবন ও মৃত্যুর মাঝে বৈপরীত্যের বিনাশ, শূন্যতার মাঝে উভয়ের বিলয়।”
El tantrismo es ante todo un rito sexual. La ceremonia del matrimonio cristiano es publica pero la copulacion entre los esposos es privada. La ceremonia tantrica consiste en la copulacion en public, ya sea de varias parejas o de una sola ante el circulo de devotos. Ademas, no se practica con la esposa sino con una yogina, en general de baja casta. Entre los cristianos el acto se raliza en la alcoba, es decir, en un sitio profano; los Tantras prescriben formalmente que debe ser en un templo o en un lugar consagrado, de preferencia en los sitios de cremacion de los muertos. Copulacion sobre las cenizas: anulacion de la oposicion entre vida y muerte, disolucion de ambas en la vacuidad.
(Octavio Paz, Conjunciones y disyunciones, Cuadernos de Joaquin Mortiz, Mexico Segunda edicion: Febrero de 1985, P 78-79)
চর্যাপদে যে বার বার শরীর, সঙ্গম, শূন্যতা ও নির্বানের এত উল্লেখ তার গূঢ় তাৎপর্য আমাদের সামনে পাস কর্তৃক এই অসামান্য তুল্যমূল্যের বিচারে আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এই সঙ্গম যে পরস্পর-বিরোধী জিনিসের মধ্যে এক বৈপরীত্যের বন্ধন তা তিনি উল্লেখ করে বলেন,
“সঙ্গম আসলেই সংসার ও নির্বান-এর এক সত্যিকারের ঐক্য, অস্তিত্ব ও শূন্যতার মাঝে, ভাবনা ও অভাবনার মাঝে এক যথার্থ পরিচয়ত্ব”।
La copula es verdadera, realmente, la union de samsara y nirvana, la perfecta identidad entre la existencia y la vacuidad, el pensamiento y el no-pensamiento. (Octavio Paz, Conjunciones y disyunciones, Cuadernos de Joaquin Mortiz, Mexico Segunda edicion: Febrero de 1985, P 79)
সঙ্গমের মাধ্যমে শরীরি-সেতু পেরিয়ে উভয়ে যে আনন্দে পৌঁছান, তান্ত্রিক পরিভাষায় যাকে বলে মহাসুখ তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে পাস সরহ ও কনহর উল্লেখ করে বলেন:
“সহর ও কনহর কবিতাগুলোর বক্তব্যে বলা হয়: চরম আনন্দের মুহূর্তে জন্ম হয় দিব্যজ্ঞানের, তার মানে বীর্যপাত ঘটলো।”
Un comentario a los poemas de Sahara y Kanha dice: “en el momento del gran deleite, nace el pensamiento de la iluminacion, esto es, se produce el semen.” (Octavio Paz, Conjunciones y disyunciones, Cuadernos de Joaquin Mortiz, Mexico Segunda edicion: Febrero de 1985, P 82)
জ্ঞানের অভিব্যক্তি হিসেবে ভাষার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাকে চর্যাপদ কতটা তাৎপর্যের সাথে বিবেচনা করেছিল সে কথা এর আগে আমরা লক্ষ করেছি দার্শনিক ভিটগেন্সটাইনের ভাবনার আলোকে। চর্যাপদের ভাষা সান্ধ্যভাষা হিসেবে পরিচিত হলেও এই আলো-আঁধারি বয়ানের মধ্যেই একই প্রতীকে বহু প্রতীকের ব্যঞ্জনায় সমৃদ্ধ এক লিপিআলেখ্য হয়ে উঠেছে চর্যা–কল্পনার দৌলতে। শরীর কখনো হাজির হয়েছে বিশ্বলোকের ব্যাপ্তি নিয়ে, আবার কখনো শরীর ও বিশ্বলোকের প্রতীকি রূপ হয়ে উঠেছে ভাষা নিজেই। বহু প্রতীকের সম্মিলিত স্রোতের এক চঞ্চল মানচিত্র রূপে চর্যাপদ আমাদের কাছে জীবন্ত হয়ে আছে। অক্তাবিও চর্যাপদের কাব্যিক ব্যাঞ্জনা, প্রতীকি অর্থ ও ভাষিক দ্যোতনার বহু বর্ণিল বিকিরণের সমগ্রতা সম্পর্কে সুগভীর পর্যবেক্ষণ ও ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছেন: “এই কুহকী শারীরবৃত্তিক রূপের পাশেই রয়েছে এক ধর্মীয় মানচিত্র যার কথা আমি সংক্ষেপে বর্ণনা করেছি।
“এইখানে এই দেহে আছে পবিত্র নদী যমুনা এবং গঙ্গা, আছে প্রয়াগ এবং বেনারস, আছে সূর্য এবং চাঁদ। আমার তীর্থযাত্রায় আমি গিয়েছি অনেক পূণ্যস্থানে কিন্তু কোনেটাই আমার দেহের চেয়ে পবিত্রতর নয়” (সরহর কবিতা)।
শরীর যদি হয়ে থাকে পৃথিবী, পবিত্র এক পৃথিবী, তাহলে ভাষাও তাই–এবং তা এক প্রতীকি ভাষা: প্রত্যেক ধ্বনিরীতি ও প্রত্যেক অক্ষরে রয়েছে এক বীজ (bija) যা থেকে উচ্চারণমাত্র বিকিরিত হয় ধ্বনিতরঙ্গ ও নিহিতার্থ । রসনা প্রতিনিধিত্ব করে ব্যঞ্জনবর্ণ আর ললনা প্রতিনিধিত্ব করে স্বরবর্ণ। শরীরের দুই শিরা বা নালি এখন হয়ে ওঠে বক্তব্যের নারী ও পুরুষবাচক দিক। তন্ত্রবাদে কেন্দ্রীয় জায়গা জুড়ে আছে ভাষা, এ হচ্ছে মূর্ত রূপকের এক পদ্ধতি। এই পৃষ্ঠাগুলোর মধ্যে আমি তন্ত্রের (sandhabhasa) সংগুপ্ত ভাষার সমতুল্যতা, সংযোগ, ও প্রতিধ্বনির খেলার উল্লেখ করেছি। আদি মন্তব্যকারিরা (comentadors) এই কামজ-আধিবিদ্যক দূরধিগম্যতাকে (hermetismo) “সান্ধ্যভাষা” হিসেবে উল্লেখ করেছেন; মির্চা এলিয়াদকে অনুসরণ করে আধুনিক কালের মন্তব্যকারিরা একে বলেছেন “অভিপ্রায়মূলক ভাষা”। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা এটা বলেন না (বা এমনটা বলে থাকলেও একে তুলনা করেন জলন্ত কয়লার উপর দিয়ে কারোর হেঁটে যাওয়ার সাথে) যে এই ভাষা খুবই কাব্যিক এবং তা কাব্যিক সৃজনের একই বিধানসমূহ মান্য করে চলে।
তান্ত্রিক রূপকগুলো অনুপ্রবেশকারীদের কাছে কৃত্যানুষ্ঠানের সত্যিকারের অর্থকে কেবল লুকিয়েই ফেলতে চায় না বরং যে-সর্বজনীন তুলনা কবিতার ভিত্তি, তারও এক মৌখিক প্রকাশ হয়ে ওঠে এগুলো। এই রচনাকর্মগুলো সেই একই মনস্তাত্ত্বিক ও শৈল্পিক প্রয়োজনবোধ দ্বারা পরিচালিত যা আমাদের বারোক (Barrocos) কবিদেরকে স্প্যানিশ ভাষার মধ্যেই তাদের নিজেদের এক ভাষা নির্মাণে উদ্বুদ্ধ করেছিল, সেই একই প্রয়োজনবোধ জয়েস ও পরাবাস্তববাদীদের ভাষা নির্মাণে উৎসাহিত করেছে: বিশ্বজগতের দ্বৈতরূপ হিসেবে লেখার ধারণা। সরহর কাছে শরীর যদি হয়ে থাকে বিশ্বজগত, তাহলে তার কবিতা হচ্ছে এক শরীর আর এই বাচনিক শরীর হচ্ছে শূন্যতা। এর এক ঘনিষ্ঠতম ও মনোমুগ্ধকর উদাহরণ হচ্ছে প্রোভাশাঁল কবিদের Trobar clus, প্রোভাশাঁল কবিতার দূরধিগম্যতা হচ্ছে এক বাচনিক আচ্ছাদন যা অজ্ঞদের কাছে অস্পষ্ট আর রসজ্ঞদের কাছে তা প্রতিভাত হয় এমন এক স্বচ্ছতা নিয়ে যা নারীর নগ্নতাকে দেখার সুযোগ দেয়। এই গোপনের মাঝে থাকতে হবে। বলতে চাই, এর মধ্যে থেকেই একে না-জানতে হবে। অংশগ্রহণ করতে হবে এতে: আচ্ছাদন রচনা করাটা এক প্রেমময় কর্ম আর অনাচ্ছাদিত করা আরেক জিনিস। তন্ত্রের দূরধিগম্য ভাষার ক্ষেত্রেও ঠিক একই ব্যাপার ঘটে, এ ভাষার পাঠোদ্ধারের জন্য আসলে সংকেত (la clave) জানাটাই যথেষ্ঠ নয়, যদিও এটা জানারও দরকার আছে, বরং প্রবেশ করতে হবে প্রতীকের অরণ্যে, হতে হবে প্রতীকগুচ্ছের ভেতর এক প্রতীক। কবিতা এবং তন্ত্রবাদ এই অর্থে একই রকম যে দুটোই বাস্তব এবং চর্চিত অভিজ্ঞতা সঞ্জাত।
A la fisiologia magica que he descrito sumariamente se yuxtapone una geografia religiosa: “Aqui, en el cuerpo, estan los sagrados rios Jamuna y Ganges, aqui estan Pragaya y Benares, el Sol y la Luna. En mis peregrinaciones he visitado muchos santuarios pero ninguno mas santo que el de mi cuerpo.” (Poema de Sahara.) Si el cuerpo es tierra, y tierra santa, tambien es lenguaje y lenguaje simbolico: en cada fonema y cada silaba late una semilla (bija) que, al actualizarse en sonido, emite una vibracion sagrada y un sentide oculto. Resana representa a las consonantes y lalana a las vocales. Las dos venas o canales del curpo son ahora el lado masculino y femenino del habla.. El lenguaje ocupa un lugar central en el tantrismo, sistema de metaforas encarnadas. A lo largo do estas paginas he aludido al juego de ecos, correspondencias y equivalencias del lenguaje cifrado de los Tantras (sandhabhasa). Los antiguos comentaristas designaban a este hermetismo erotico-metafisico como “lenguaje crepuscular”; los modernos, siguiendo a Mircia Eliade, lo llaman “lenguaje intencional”. Pero los especialistas no dicen, o lo dicen como quien camina sobre ascuas, que ese lenguaje es esencialmente poetico y que obedce a las mismas leyes de la creacion poetica.
Las metaforas tantricas no solo estan destinadas a ocultar al intruso el verdadero significado de los ritos sino que son manifestaciones verbales de la analogia universal en que se funda la poesia. Estos textos estan regidos por la misma necesidad psicologica y artistica que llevo a nuestros poetas barrocos a construirse un idioma dentro del idioma español, la misma que inspira al lenguaje de Joyce y al de los surrealistas; la concepcion de la escritura como el doble del cosmos. Si el cuerpo es cosmospara Sahara, su poema es un curepo– y ese cuerpo verbal es sunyata. El ejemplo mas proximo e impresionante es el del trobar clus de los poetas provenazales. El hermetismo de la poesia provenzal es un velo verbal: opaciadd para el zafio y transparencia que deja ver la desnudez de la dama al que sabe contemplar. Hay que estar en el secreto. Digo: estar y no saber el secreto. Hay que participar: tejer el velo es un acto de amor y destejerlo es otro. Lo mismo sucede con el lenguaje hermetico de los Tantra: Para descifrarlo realmente no basta conocer la clave–aunque eso tambien cuente–sino penetrar en el bosque de simbolos, ser simbolo entre los simbolos. La poesia y el tantrismo se parecen en ser practicas, experiencias conceretas. (Octavio Paz, Conjunciones y disyunciones, Cuadernos de Joaquin Mortiz, Mexico Segunda edicion: Febrero de 1985, P 82-84)
চর্যাপদের ভাষা ও উক্তিকে যতই হেঁয়ালিপূর্ণ ও দূরধিগম্য মনে হোক না কেন তা আসলে বাস্তবের সেই অদৃশ্য স্তরের উন্মোচন যা আমাদের উপরিতলের বাস্তব অভিজ্ঞতার কাছে অজ্ঞাত। যেহেতু কবিতা সমতল ভাষার তাবেদারি করে না, ভাষার সীমাকে অতিক্রম করে বরং পৌঁছুতে চায় ‘বাক পথাতীত’ এক ইশারার উদ্যানে তাই এর প্রধান বাহন হয়ে ওঠে সংকেত। অক্তাবিও পাস তন্ত্রের সাধক ও কবিদের এই ভাষার স্বভাব ও অভিপ্রায়ের পাঠোদ্ধার করে বলেন:
“আরেকটা দিক আছে যেটার প্রতি– আমার ধারণা– বিশেষজ্ঞরা যথেষ্ট মনোযোগ দেননি: মন্ত্রগুলো হচ্ছে ইশারাময় সংকেত, চিহ্নিতকরণের ধ্বনিময় সংকেতমালা। প্রত্যেক দৈবত্ব, প্রত্যেক গুরু, প্রত্যেক শিষ্য, প্রত্যেক পূজারী, প্রত্যেক কুশলী, প্রতিটি আচার অনুষ্ঠানের ধারণা ও মুহূর্তের জন্য রয়েছে মন্ত্র। আমার এই জটিল ব্যাখ্যার চেয়ে বরং কবি কনহ এ সম্পর্কে আরও ভালোভাবে বলেছেন: অক্ষরগুলো আংটার মতো যোগিনীর নগ্ন গোড়ালিতে জড়িয়ে যায়। এগুলো হচ্ছে সুরেলা শ্রদ্ধাঞ্জলী। ”
Hay otro aspecto sobre el que, me parece, no han reparado bastante los especialistas: los mantras son signos indicativos, señales sonoras de indentifiacion. cada divinidad, cada “guru”, cada discipulo, cada adepto, cada concepto y cada momento del rito tiene su mantra. El poeta Kanha lo ha dicho mejor que esta enredada explicacion mia: las silabas ( bijas) se anudan en el tobillo desnudo de la yogina como ajorcas. Son atributos sonoros. (Octavio Paz, Conjunciones y disyunciones, Cuadernos de Joaquin Mortiz, Mexico Segunda edicion: Febrero de 1985, P 85)
অক্তাবিও তার এই দীর্ঘ প্রবন্ধের শেষের দিকে কনহর কথা আরও একবার, এবং শেষবারের মতো উল্লেখ করে বলেন:
“এ ধরনের অনুষ্ঠানে সঙ্গিনীই প্রথম শুরু করে এবং সবসময় সেই সঙ্গিনীটি হয়ে থাকে নিম্নবর্গের বা অচ্ছুৎ পেশার কেউ: চন্ডালি কিংবা ডোম্বী (ধোপিনী)। শূন্যতার প্রতি কনহ তার এক চর্যাগীতিতে বলছেন: “ কাহ্নে গাই তু কাম চন্ডলী। ডোম্বিতো আগলি নাহি ছিনালী।” এখানে চন্ডালীর অর্থ তিব্বতী মরমী উত্তাপ: সূর্য ও চাঁদ, রমনীর রস ও পুরুষের বীর্য, যথাযথ প্রজ্ঞার পদ্ম ও (কাম) করুণা-বজ্রের ঐক্য বিগলিত ও দ্রবীভূত হয় এক আকস্মিক অগ্নিস্ফোরণে। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বাস্তবতা হয়ে ওঠে সারবান বাস্তবতার শামিল: উভয়ই শূন্যতা। সংসারই নির্বাণ।* ”
La pareja es una iniciada casi siempre de casta baja o profesion impure: la candali o la dombi (lavandera). Kanha dice en uno de sus cantos a la vacuidad: “Tu eres la candali de la pasion. Oh dombi nadie es mas disoluta que tu.” Candali significa aqui el “calor mistico” de los tibetanos: la union del sol y de la luna, el humor de la mujer y el esperma del hombre, el loto de la Perfecta Sabiduria y el rayo de la (com) Pasion fundidos y disueltos en una llamarada. La realidad fenomenal es identica a la realidad esencial: las dos son vacuidad. Samsara es Nirvana.* (Octavio Paz, Conjunciones y disyunciones, Cuadernos de Joaquin Mortiz, Mexico Segunda edicion: Febrero de 1985, P 86)
লক্ষ্যনীয় এই যে উদ্ধৃতির শেষ বাক্যটির শেষে টিকানির্দেশক যে তারকা চিহ্নটি রয়েছে তার টিকায় তিনি শহীদুল্লাহর গবেষণাকর্মের কথা উল্লেখ করেছেন এভাবে:
“কনহ ও সরহ’র কবিতাগুলো সম্পর্কে দেখুন: Les chants mystiques de Kahana et Sahara, মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সম্পাদনা ও অনুবাদ, প্যারিস ১৯২১। ”
Sobre los poemas de Kanha y Sahara vease: Les Chants mystiques de Kanha et Sahara, edicion y traduccion de M. Shabidullah, Paris, 1921. ১ (Octavio Paz, Conjunciones y disyunciones, Cuadernos de Joaquin Mortiz, Mexico Segunda edicion: Febrero de 1985, P 86)
এই টীকা থেকে আমাদের কাছে এটা পরিস্কার যে তিনি শহীদুল্লাহর অনুবাদে কেবল সরহ ও কনহ’র চর্যাগুলোই পড়েননি, চর্যা সম্পর্কে শহীদুল্লাহর অনেক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণকেও গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেছেন। এমনটা ভাববার কারণ এই যে যেখানে যেখানে তিনি বিশেষজ্ঞদের সাথে দ্বিমত পোষণ করেছেন সেখানে তা উল্লেখ করেছেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে ভারতীয় ভাস্কর্য ও স্থাপত্যে বিদেশি প্রভাব প্রসঙ্গে আনন্দ কুমারস্বামীর সাথে পাসের ভিন্নমতের কথা দেখা যাবে এই গ্রন্থেরই ৫৮ নং পৃষ্ঠার পাদটীকায়। শহীদুল্লাহর কোনো ব্যাখ্যা ও বক্তব্যে তেমন কোনো দ্বিমত থাকলে তিনি তা জানাতেন বলেই আমার বিশ্বাস। যাইহোক, এখানে মতৈক্য ও মতান্তরের হদিস করা আমাদের মূল লক্ষ্য নয়, বরং চর্যাপদ সম্পর্কে পাসের উপলব্ধির মানচিত্রটি প্রত্যক্ষ করা।
চর্যাপদের প্রতি অক্তাবিও পাসের মতো একজন প্রথম সারির কবি ও সাহিত্য সমালোচকের মনোযোগ, এবং সেই মনোযোগকে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণে রূপান্তরিত করাটা নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। গুরুত্বের প্রধান কারণ বাংলাভাষী কিংবা অন্যভাষারও কোনো কবি ও সমালোচক বৈশ্বিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে চর্যাপদের বাচনিক অনন্যতা ও কাব্যিক সৌন্দর্য্যকে মূল্যায়ন করেননি কখনো। পাসের পক্ষে এই মূল্যায়ন সম্ভব হয়েছিল এই কারণে যে তিনি আমাদের কালের সেই বিরল লেখকদের একজন যিনি জ্ঞান বিজ্ঞানের বহু বিষয়ে কেবল সুপন্ডিতই নন, ছিলেন বহুভাষী ও সৃষ্টিশীল এক লেখক। সমালোচনা সাহিত্যে সৃজনশীলতা ও পান্ডিত্য– এ দুয়ের সফল ও আশ্চর্য প্রয়োগের মাধ্যমে তিনি পঠিত রচনার অর্থের ও সৌন্দর্য্যের অজ্ঞাত ঐশ্বর্যকে উন্মোচিত করেন। চর্যাপদের ক্ষেত্রে পাসের এই প্রণম্য উন্মোাচন ঘটেছিল ষাটের দশকেই কিন্তু বাংলাভাষী পাঠকদের গোচরে এলো উন্মোচনের অর্ধশতাব্দি পরে। আমি নিশ্চিত ভবিষ্যতের আরও বহু মনীষার শংসা-পালক যুক্ত হবে চর্যাপদের গৌরবোজ্জ্বল মুকুটে।
পাদটিকা:
১. লক্ষণীয় এই যে পাদটিকায় শহীদুল্লাহ নামের বানানটি ভুলভাবে লিখিত হয়েছে: Shabidullah. শহীদুল্লাহর গবেষণাটির প্রকাশের তারিখেও আছে একই রকম প্রমাদ, বইটি আসলে বেরিয়েছিল ১৯২৮ সালে, পাস-কথিত ১৯২১ সালে নয়। নিঃসন্দেহ নেই যে নিছক অসতর্কতা থেকেই এই প্রমাদের জন্ম।