জন্মলগ্নের পর থেকেই বাংলাদেশ এক গভীর রাজনৈতিক সংকটের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে যা থেকে আজো মুক্তি লাভ হয় নি। বারবার সরকার পরিবর্তন করেও এই সংকট থেকে মুক্তি মিলছে না। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে বিভিন্ন সময়ে শাসন ব্যবস্থায় বিভিন্ন পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। আমরা বহুদলীয় ব্যবস্থা থেকে একদলীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি, আবার বহুদলীয় ব্যবস্থায় ফিরে এসেছি। বেসামরিক শাসন থেকে সামরিক শাসনের আওতায় এসেছি, আবার বেসামরিক শাসনে ফিরে এসেছি। মন্ত্রীপরিষদ (প্রকৃত অর্থে প্রধানমন্ত্রি) শাসিত সরকার পদ্ধতি ছেড়ে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার পদ্ধতি গ্রহণ করেছি, আবার মন্ত্রীপরিষদ (প্রকৃত অর্থে প্রধানমন্ত্রি) শাসিত সরকার পদ্ধতিতে ফেরত এসেছি। আবার দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠান রাজনৈতিক সংকটের কারণ মনে করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানকে শ্রেয় মনে করেছি। মনে করেছি সকল দলের অংশগ্রহণে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে এই সংকট থেকে মুক্তি মিলবে। মুক্তি মিলে নি। গত ৪৬ বছরে সকল দলের অংশগ্রহণে অনেকগুলো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক সংকটের স্থায়ী সমাধান হয় নি। এমন কি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে (অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হিসেবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত) সর্বদল নিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবার পরেও দেশ ঠিকই পুনরায় গভীর রাজনৈতিক সংকটে নিপতিত হয়েছে।
অথচ এসব পরিবর্তন সাধনে জনগণকে আন্দোলন-সংগ্রাম করতে হয়েছে। এজন্য ঝরে গেছে অনেক তাজা প্রাণ। এসব অনেক পরিবর্তন সাময়িক শান্তি ফিরে আনলেও, সংকটের আপাত সমধান হলেও স্থায়ী সমাধান দেয়নি। তাই দেখা যায়, এসব পরিবর্তনের রেশ কাটতে না কাটতেই নতুন করে সংকট দানা বাঁধতে শুরু করে, এবং এক সময় তা ঘনীভূত হয়ে চরম আকার লাভ করে। তাই ৪৬ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে আজ এটা নির্দ্বিধায় বলা যায়, শুধুমাত্র সরকার পরিবর্তন করে এই সংকট থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে না। বস্তুত বাংলাদেশ একটি রাজনৈতিক পরিবর্তনের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। ১৯৪৭ কিম্বা ১৯৭১ সালে যেরকম পরিবর্তন হয়েছিল, ভৌগলিক অর্থে নয়, রাজনৈতিক অর্থে তার চেয়েও বড় পরিবর্তন ছাড়া বাংলাদেশের মানুষের আর কোন উদ্ধার নেই। কিন্তু ১৯৪৭ বা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মানুষের সামনে যেমন রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও কর্মসূচি ছিল বর্তমানে তেমন কোন গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও দিক-নির্দেশনামূলক কর্মসূচি নেই। ফলে এক ভয়াবহ রাজনৈতিক শূন্যতা ও হতাশার মধ্যে দেশ নিমজ্জিত।
প্রশ্ন হল মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে গড়া একটি রাষ্ট্র কেন এই সংকটে পতিত হল। এর একটি কারণ আমাদের সর্বজন স্বীকৃত এবং জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার কোন রাষ্ট্রদর্শন নেই। অথচ আমাদের আছে উন্নত রাষ্ট্রদর্শন। যে রাষ্ট্র দর্শন সম্পর্কে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে সুস্পষ্ট ঘোষণা প্রদান করা হয়েছে। এতে অঙ্গীকার করা হয়েছে, ‘সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি যে ম্যানডেট দিয়েছেন, সে ম্যানডেট মোতাবেক আমরা, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা, পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে গণপরিষদ গঠন করে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে একটি সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী ঘোষণা করছি’। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র অনুযায়ী সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার হবে নতুন জন্ম নেয়া বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আদর্শ বা রাষ্ট্র দর্শন। এই তিন প্রতিশ্রুতি ছিল রাষ্ট্রের সাথে এর স্বাধীনতাকামী মানুষের প্রথম চুক্তি। বিশ্বের যে সব রাষ্ট্র সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছে সে সব রাষ্ট্র স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে ঘোষিত রাষ্ট্র দর্শনকে রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছে, সংবিধানের ভিত্তি করেছে এবং সে আলোকে দেশ পরিচালনা করছে। কেবল বাংলাদেশ তার ব্যতিক্রম। বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনায় বা অন্য কোথাও রাষ্ট্রের আদর্শিক ভিত্তি হিসেবে ঘোষণাপত্রকে উল্লেখ করা হয় নি এবং এর আলোকে দেশ পরিচালনা করা হয় না। এই ত্রয়ী আদর্শ হতে পারে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার ভিত্তি।
রাজনৈতিক সংকটের প্রধান কারণ বাংলাদেশ রাষ্ট্রে জনগণের ক্ষমতা চর্চার সুযোগ নেই। রাষ্ট্র ক্ষমতার মালিক জনগণ নয়। যদিও সংবিধানের মূলনীতিতে বলা হয়েছে ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ’। বাস্তবে রাষ্ট্রের সকল প্রকার ক্ষমতা এক ব্যক্তি বা রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহীর হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। যে পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এদেশের জনগণ দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রাম করেছে সে রাষ্ট্রটি ছিল একটি স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী তথা প্রেসিডেন্ট ছিলেন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানের যে সংবিধান ও শাসন ব্যবস্থাকে আমরা ১৯৭১ সালে নাকচ করেছিলাম, সেই সংবিধানে যে-বাক্যটি প্রেসিডেন্টকে একচ্ছত্র ক্ষমতা অর্পণ করা হয়েছিল, ঠিক সেই বাক্যে প্রেসিডেন্ট শব্দটি মুছে প্রধানমন্ত্রী বসানো হয় স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে। বস্তুত ৭২-এর সংবিধান প্রধানমন্ত্রী-তে কেন্দ্রীভূত শাসনের সনদ, যার অনিবার্য পরিণতি স্বৈরতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদ, গণতন্ত্র নয়। আর স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাজনৈতিক সংকট থাকবেই।
লুটপাট, দুর্নীতি, জাতীয় সম্পদ আত্মসাৎ ও পাচার অনুকূল এবং উৎপাদন ও উৎপাদক প্রতিকুল বিদ্যমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় জনগণের একটি ক্ষুদ্র ক্ষমতাবান অংশের হাতে রাষ্ট্রের সম্পদ কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। রাষ্ট্র ক্ষমতা ব্যবহারকারী ক্ষমতাশালীরা এই সুযোগ নিতে পারছে। এ অবস্থা প্রতিদ্বন্দ্বিতার অর্থনীতি বিকাশে যেমন বাধা হয়ে আছে, তেমনি মানুষে মানুষে দ্রুত বৈষম্য বৃদ্ধি করছে যা সংকটের আরেকটি কারণ। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০১৪ অনুযায়ী দেশের এক তৃতীয়াংশ (৩৬ শতাংশ) সম্পদের মালিকানা ১০% মানুষের হাতে কুক্ষিগত রয়েছে। বিপরীতে সবচেয়ে গরীব ১০% মানুষের হাতে সম্পদ রয়েছে মাত্র ২%। দেশের প্রায় ৭৮% মানুষের দৈনিক আয় ৩.১ ডলার বা ২৫০ টাকার নিচে। আর দৈনিক ১.০৯ ডলার বা ১৫০ টাকার নিচে আয় করেন প্রায় ৪৪% মানুষ (২০১৬ এর জুনে প্রকাশিত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় সমীক্ষা)। অর্থনীতিবিদসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের ৪০ থেকে ৫০ হাজার লোকের কাছে ৪০ শতাংশের বেশী সম্পদ কেন্দ্রীভূত হয়েছে। দেশের আয় বা প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। আর তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বৈষম্য – ধনী-গরীবে, শহরে-গ্রামে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য থেকে দেখা যায় ১৯৯০ সালের পর থেকে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়তে থাকে। একই সাথে বাড়তে থাকে আয় ও সম্পদ বৈষম্য। ১৯৮০-৯০ সময়কালে দেশের গড় প্রবৃদ্ধি ছিল ৩.৭ শতাংশ। ওই সময় জিনি বা গিনি সহগের মান ছিল ০.৩০। ১৯৯১-২০০০ সময়কালে গড় প্রবৃদ্ধি ছিল ৪.৮ শতাংশ, আর গিনি সহগের মান ছিল ০.৪১। আর ২০০১-১০ সময়কালে গড় প্রবৃদ্ধি ছিল ৫.৮ শতাংশ, এবং গিনি সহগের মান দাঁড়ায় ০.৪৫। অথচ বাংলাদেশের জন্মকালে তা ছিল মাত্র ০.২৮। অথচ পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই-সংগ্রামের অন্যতম ইস্যু ছিল বৈষম্য বা disparity. যদিও বাংলাদেশের সংবিধানের শুরুতে (প্রস্তাবনা থেকে তৃতীয় ভাগ পর্যন্ত) অনেক কল্যাণ আর অধিকারের কথা বলা আছে, যা মানুষে মানুষে বৈষম্যকে নিরুৎসাহিত করে। কিন্তু এর বাস্তবায়ন অংশে মানুষ যাতে তা না পায় তার ব্যবস্থাও করা আছে। বস্তুত মানুষে মানুষে বৈষম্য এমন হারে বৃদ্ধি পেয়েছে যা বিদ্যমান রাজনৈতিক-সামাজিক অস্থিরতার অন্যতম কারণ।
ঔপনিবেশিক আমলের সকল আইন কানুন বাংলাদেশের সংবিধানে বহাল রাখা হয়েছে যা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটের আরেকটি অন্যতম কারণ। অনুচ্ছেদ ১৪৯, ১৫২ ধারা বলে স্বাধীনতা ঘোষণার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত যে সমস্ত আইন এদেশে জারি ছিল, কার্যক্ষেত্রে তা সক্রিয় থাকুক আর না থাকুক, সে সবই স্বাধীন দেশের আইন হিসেবে বহাল রয়েছে। যেসব আইন ব্রিটিশরা তৈরি করেছিল তাদের ঔপনিবেশিক শাসন নিরুঙ্কুশ করা, অর্থনৈতিক লুণ্ঠন আর আন্দোলনকারীদের দমন-পীড়নের জন্য; যা অব্যাহত রেখেছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী একই উদ্দেশে; বাংলাদেশেও সেগুলো হুবহু কার্যকর করা হল। যা ছিল ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের মূলমন্ত্র, যে আকাঙ্ক্ষায় দেশের মানুষ পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, যে সমাজ গড়বে বলে কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র-জনতা মুক্তিযুদ্ধে জীবন দিয়েছে, সে আকাঙ্ক্ষাগুলো সংবিধানের প্রস্তাবনায়, মূলনীতিতে লেখা হয়েছে ঠিকই, তবে কার্যক্ষেত্রে এসে ঔপনিবেশিক আমলের সকল অগণতান্ত্রিক আইন কানুন বহাল রেখে এবং সেই সাথে নতুন কিছু অগণতান্ত্রিক আইন যুক্ত করে পাকিস্তান রাষ্ট্রটাই স্বাধীন দেশে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে । যে আইন ও বিধি দ্বারা বিদেশী শাসকেরা শাসন করেছে সে আইন ও বিধি একটি স্বাধীন দেশের মানুষের আকাঙ্ক্ষার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হতে পারে না। তাই পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পাবার পর ঔপনিবেশিক আইন ও বিধি বদলিয়ে নিজেদের উপযোগী আইন ও বিধি প্রণয়ন করা হয় যা বাংলাদেশে অনুসরণ করা হয় নি।
বাংলাদেশের বিদ্যমান নির্বাচন ব্যবস্থা রাজনৈতিক সংকটের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। আমাদের সংবিধান বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতা বা ভোটারবিহীন নির্বাচনের স্বীকৃতি প্রদান করে। এই নির্বাচন ব্যবস্থায় সংখ্যালঘিষ্ঠ ভোটারের রায়ে সরকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব। বাংলাদেশের এযাবতকালের নির্বাচনের ভোটের হিসাব থেকে দেখা যায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ৩০ শতাংশ থেকে ৪০ শতাংশ ভোট প্রাপ্তরা সরকার গঠন করেছে। আর বাকী ৬০ শতাংশ থেকে ৭০ শতাংশ ভোটার রয়েছে প্রতিনিধিত্বহীন। এ অবস্থা গণতন্ত্রের ধারণার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। গণতন্ত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠের রায়ে সরকার গঠিত হয়। বিদ্যমান নির্বাচন ব্যবস্থায় অবৈধ অর্থ, অস্ত্র, পেশী শক্তি, আঞ্চলিকতা, ধর্মীয় নিপীড়ন, সাম্প্রদায়িকতা, প্রশাসনকে প্রভাবিত করা অর্থাৎ নির্বাচনে যে কোন মূল্যে অন্তত ১টি ভোট বেশী পাবার জন্য যে ধরনের অপশক্তি প্রয়োগ সম্ভব তার সকল পদ্ধতির সৃজনশীল প্রয়োগ হয়। তাই বিদ্যমান নির্বাচন ব্যবস্থা অটুট রেখে নির্বাচন কমিশন সংস্কার করে বা সরকারের প্রভাব মুক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠান করে প্রকৃত সংখ্যাগরিষ্ঠের সরকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। এ জন্যে বিদ্যমান এলাকা ভিত্তিক সাধারণ নির্বাচন ব্যবস্থার পরিবর্তে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ প্রকৃত সংখ্যাগরিষ্ঠের সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা ও সকল নাগরিকের ভোটের মূল্যায়ন করার উপযোগী নির্বাচন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
ঔপনিবেশিক প্রশাসনিক কাঠামো ও দর্শন দ্বারা বাংলাদেশের প্রশাসন পরিচালিত হয়ে থাকে। ব্রিটিশরা এদেশ শাসনের জন্য যে আমলাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিল সেটা ছিল জনগণের প্রতি নির্লিপ্ত, নিপীড়ক, উদ্ধত এবং জনগণের নিকট বহিরাগত। এই ঔপনিবেশিক প্রশাসনিক কাঠামো ব্রিটিশদের এদেশের সম্পদ লুণ্ঠন ও পাচারে সহায়ক ছিল। যে আইন ও বিধির দ্বারা বিদেশী শাসকেরা শাসন করেছে তা স্বাধীন দেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হতে পারে না, তা স্বাধীন দেশের জনগণের জন্য পরাধীনতার নামান্তর। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকেরা শাসন কাঠামোতে দ্বিমুখী ধারা ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করেছিল। দুই দুইবার স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ – এত কিছুর পরেও ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া সেই আমলাতন্ত্র প্রায় অপরিবর্তিত রূপ নিয়ে রয়ে গেছে। রয়ে গেছে শাসন কাঠামোতে দ্বিমুখী ধারা ও কর্তৃত্ব। এটা গণতন্ত্র বিরোধী। গণতন্ত্রে শাসন কাঠামোতে জনগণের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত থাকে। গণতন্ত্র বিরোধী আমলাতন্ত্র রাজনৈতিক সংকট প্রলম্বিত করতে সাহায্য করছে। এ জন্যে প্রশাসনের সর্বস্তরে জনগণের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি দ্বারা প্রশাসন পরিচালিত হতে হবে। সরকারকে কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় – এই দুই স্তরে বিভক্ত করে কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় সরকারের দায়িত্ব, কর্তব্য, সীমারেখা ইত্যাদির স্পষ্ট রূপরেখা প্রদান করতে হবে। আর প্রশাসনিক এককাংশের প্রতিটি পর্যায়কেই স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার আওতায় আনতে হবে।
সবশেষে বলা যায় বিদ্যমান স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তর ছাড়া, রাষ্ট্রে জনগণের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা ছাড়া, রাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তার বাস্তবায়ন এবং বাস্তবায়ন পদ্ধতি তদারকির ক্ষমতা জনগণের হাতে অর্পণ করা ছাড়া অন্য কোন ভাবে চলমান রাজনৈতিক সংকট থেকে উদ্ধার পাওয়া সম্ভব নয়।