০
১৩১৮ বার পঠিত
ঈদের দিন। অলস সময়। আমার বয়সীদের ঈদের দিন ছুটি পেলে হাতে আর কাজ থাকে না। তবে কোরবানির ব্যাপারটা থাকলে আলাদা। ওই ব্যস্ততাতেই দিন পোহানো যায়। কিন্তু পরিবারের ইতিহাস ভেঙ্গে এবারই আমাদের কোরবানি দেয়া হয়নি। কেন হয়নি, তা আমার মতো সদ্য তরুণ সন্তান হারানো বাবার হয়তো ব্যাখ্যা না করলেও চলে।
ধর্মে হয়তো নানা ব্যাখ্যা আছে। সান্তনা আছে। কিন্তু সন্তানহারা বাবা-মা’র মন বোধহয় কোন কিছুতেই প্রবোধ মানে না। সে অর্থে এবার আমাদের উৎসবের জায়গা দখল করেছে বিষাদ। এক ধরণের বিপন্নতাও বলতে পারেন। বিপন্ন বলছি এ কারণে যে, শুধু আমার সন্তান নয়, আততায়ীর হাতে, মারিতে-মড়কে, দুর্ঘটনায় অনেকেই আজ সন্তানহারা। সবদিক থেকে এতটা দুঃসময় বোধহয় আমাদের আর পাড়ি দিতে হয়নি।
যাহোক উৎসবের দিনে দুঃখগাথা বলে উৎসবটাকে পানসে করে দিতে চাই না। কারণ বাঙাল উৎসবপ্রবণ জাতি। উৎসবের প্রবলতায় তাদের দুঃখ-কষ্ট-মানবতা সাথে বেদনার বোধও হারিয়ে যায়। বাড়ির পাশে প্রতিবেশি অভুক্ত। আত্মীয় অসুস্থ, টাকার অভাবে চিকিৎসা হচ্ছে না। তারপরেও আমরা উৎসব করে, সবাইকে জানান দিয়ে হজ করতে যাই। কোরবানি হয়ে গেছে দীর্ঘদিন ধরেই বিত্তের কিম্ভুত প্রকাশের অংশ। এ নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। কালো-সাদা টাকা দেখারও কিছু নেই।
সব কিছু দেখা বাদ দিয়ে আমরা উৎসব করি। জনপ্রিয় করি চর্চিত শ্লোগান ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’। আরে ভাই, প্রতিটি ধর্মতেই মানবতার কথা রয়েছে, যার যার ধর্ম সঠিকভাবে পালন করলেই মানুষ মানুষের। ‘মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব’ আর ‘মানুষ অমৃতের সন্তান’ এগুলো ধর্মেরই কথা। বরং উৎসব ধর্মটাকে মেরে ফেলেছে। এখন উৎসবের জবরদস্তিতে মানুষে মানুষে ধর্ম নিয়ে বিবাদ হয়।
উৎসবটা বানিজ্যিক। কর্পোরেট বিশ্ব ‘বানিজ্যে বসতি লক্ষ্মী’ এ মন্ত্রেই বিশ্বাস করে। যত উৎসব তত বানিজ্য। ঈদ বা পূজার বিভিন্ন অফারের দিকে তাকালেই তা মগজে ঢোকার কথা। অবশ্য মগজও যদি কর্পোরেট হয়ে যায় তবেই মুশকিল।
কর্পোরেট কৌশল না বোঝা এক ফেসবুক বুদ্ধিজীবী’র ধারণা নিয়ে কথা বলি। কিভাবে এরা ধর্মকে বানিজ্যের সাথে মিলিয়ে ফেলে সেই নিয়েই বলা। ওই বুদ্ধিজীবীর খুব আফসোস, বাংলাদেশের মুসলিমরা ভারতীয় সাবান-শ্যাম্পু-কসমেটিক ব্যবহার করবে, ভারতীয় মোটরসাইকেল চড়বে, চলচিত্র দেখবে, চিকিৎসা করাবে তারপরেও ফেসবুকে কাশ্মীরের পক্ষ নেবে।
এই বুদ্ধিজীবী মশাইকে বলি, দাদা বাংলাদেশের ইলেকট্রনিকস তথা মোবাইল, টিভি-ফ্রিজ সবকিছুর বাজারইতো চীনের দখলে। এখানে ভারতীয় জিনিস জায়গা করতে পারছে না কেনো। আপনি যদি বাংলাদেশি বা বাঙালের ভারতীয় পন্য-প্রীতির কথা তোলেন তাহলে এ বিষয়টি সেই প্রীতির সাথে যায় না।
আরে ভাই, মানুষ পণ্য কেনে নিজের অর্থনৈতিক সুবিধা বিবেচনা করে, সহজলভ্যতা চিন্তা করে। ভারতীয় প্রসাধন সামগ্রীর দাম অন্য বিদেশি সামগ্রীর চেয়ে কম। মোটরসাইকেলটাও সহজলভ্য। তাই এসবের বাজার এখানে বেশি। বিপরীতে চীনা ইলেকট্রনিকসের চেয়ে জাপান-ইউরোপ-অ্যামেরিকার জিনিসপত্রের দাম অনেক বেশি। আর ভারত ইলেকট্রনিকসে চীনের সাথে কুলিয়ে উঠতে পারছে না। খোদ ভারতের ইলেকট্রনিকসের বাজারের বড় অংশই চীনের দখলে। অতএব আমাদের বাজার থাকবে অর্থনৈতিক সুবিধা ও সহজলভ্যতার দখলেই। এটা স্রেফ কর্পোরেট একটা বিষয়। এর সাথে যারা ধর্ম মেলান তারা নেহাতই বোকা নয় তাদের কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে।
যারা নেশা-ভাং করেন, তারাও কিন্তু ভারতীয় মদ, ফেন্সিডিল, গাঁজা ইত্যাদি দিয়েই করেন। কারণ এসবের সহজলভ্যতা ভারতের কারণেই। আবার যারা ইয়াবা’কে নেশার উপকরণ হিসাবে নেন, তারা নির্ভর করেন মিয়ানমারের উপর। যেহেতু ইয়াবা আসে সেখান থেকেই। তাই অহেতুক ধর্মকে বানিজ্যর সাথে মেলানোটা অকারণ সংঘাত উস্কে দেয়া ছাড়া আর কিছু নয়।
এই ভদ্রলোক আবার প্রিয়া সাহার ‘হিন্দু নিখোঁজে’র বক্তব্যকেও এসবের সাথে যোগ করেছেন। তিনি বলেছেন, ১৯৪৭ থেকে এখন পর্যন্ত এদেশ থেকে হিন্দু নিখোঁজের সংখ্যাটি প্রিয়া সাহার বক্তব্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। মার্কিন এক ব্যাক্তির পরিসংখ্যান এর কথা উল্লেখ করে, তিনি প্রমান করতে চেয়েছেন এমনটা।
এই দাদাটির বোধহয় জোশে হুশ উড়ে গিয়েছে। তিনি ‘দ্বি-জাতি তত্ত্ব’ কাদের মাথা থেকে উদ্ভাবিত, ‘বঙ্গভঙ্গ’ বিষয়ে কুশিলব কারা। কাদের প্রয়োগিক কর্মকান্ডে এমনটা হয়েছিল, সেসব ইতিহাস বোধহয় হুশের সাথে হারিয়ে গেছে। ’৪৭ এর দেশ বিভাগ হয়েছে দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে। ভারত-পাকিস্তান ভাগ হবার পর সেখান থেকে মুসলমানরা তৎকালীন পাকিস্তানের পূর্ব ও পশ্চিম দুই অংশেই এসেছে এবং হিন্দুরা দুই অংশ থেকেই ভারতে গিয়েছে। এখন যদি ভারতের মুসলমানরা সে হিসাব ধরে বলে, আমাদের এত মিলিয়ন ‘নিখোঁজ’, তখন কেমন হবে! ’৭১-এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়েও অনেকে গিয়েছেন। এরপরেও গিয়েছেন, সে যাবার ব্যাখ্যাও রয়েছে। যা দিলে হয়তো অনেকেরই মুখোশ খুলে যাবে। তাই সেদিকে না যাওয়াই ভালো।
যেটা ভালো সেটা হলো, ধর্মকে বানিজ্যমুক্ত করা। পার্থিব স্বার্থে যেখানে সংঘাত, সেখানে ধর্ম পার্থিব চিন্তাকে প্রাধান্য দেয় না। আর অপার্থিব চিন্তার মধ্যে কোনো স্বার্থ থাকে না। ধর্মকে ধর্মের জায়গা রাখতে দিলে সংঘাত-সংঘর্ষের সৃষ্টি হয় না। পার্থিব উৎসবকে, অপার্থিব ধর্মের সাথে একাকার করার কোনো দরকার নেই। ধর্মভিত্তিক উৎসব অপার্থিবই থাক। পার্থিব উৎসবতো অনেক। নববর্ষ, নিউ-ইয়ার, ভ্যালেন্টাইন ডে, কুমড়া ডে, টমাটো ডে, কত কিছুইতো রয়েছে। সেগুলো না হয় সবার হোক।
পুনশ্চ : উৎসবের কথায় আরেকটু বলি। সামাজিকমাধ্যমে কয়েকজনকে দেখলাম বলেছেন, ‘উৎসব যদি সবার হয় তাহলে সবাই আমাদের সাথে গরুর গোশত খাক’। এটা অত্যন্ত উৎকট একটি সাম্প্রদায়িক চিন্তা। জোরজবরদস্তি বা প্ররোচনার মাধ্যমে উৎসবের নামে কারো ধর্ম বা সামাজিক চিন্তার বাইরে অন্য কিছুতে যোগ দিতে বাধ্য করার মত চিন্তাটাই মূলত সাম্প্রদায়িক। সেটা গরুর গোশত খাওয়াতেই হোক, হোলি’র রঙ মাখাতেই হোক। মানুষের চিন্তার সাথে জবরদস্তিই সাম্প্রদায়িকতা।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন