৫
৪১৭৭ বার পঠিত
অনেকের কাছে অর্থ না জানলে লালন ফকিরের গান ‘চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে’ জটিল ও দুর্বোধ্য লাগে। বাউলরা অধিকাংশ গানেই মেটাফর ব্যবহার করেন। এবং বাউলদের নিজস্ব শব্দার্থ থাকায় তাদের গানের অর্থ তাই অনেক সময় সাধারণ মানুষের কাছে দুর্বোধ্য হয়ে উঠে। যদিও মনে হবে আমরা এই গানের অর্থ বুঝি আবার শেষাবধি মনে হবে কিছুই বুঝি না। তবে জ্ঞানী সাধকদের লেখা গানসমূহ নিজে আত্মস্থ করে সেই গানকে বুঝার মধ্যে অনেক তৃপ্তি আছে। এবার আসুন ‘চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে…‘ গানের মূল অর্থ খোঁজার চেষ্টা করি।
চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে,
আমরা ভেবে করব কী,
ঝিয়ের পেটে মায়ের জন্ম,
তাকে তোমরা বলো কী।
শ্রোতাদের নিকট গানের প্রথম চার লাইন বিরাট জট পাকিয়ে ফেলে। ‘ঝিয়ের পেটে মায়ের জন্ম’ তেমনি এক জটিল ধাঁধাঁ! তাই প্রথমেই মনে রাখতে হবে বাউলরা তাদের তত্ত্বকথা প্রচলিত শব্দের মধ্যে গোপন রাখেন। প্রচলিত অভিধানে এই শব্দের যে অর্থ আমরা জানি, বাউলদের অভিধানে একই শব্দের অর্থ সম্পূর্ণ আলাদা। এই ভিন্নতাই বাউলদের স্বাতন্ত্র্যতা এনে দিয়েছে।
যেমন ‘ঝি‘ মানে কন্যা, মেয়েসন্তান ইত্যাদি। কিন্তু বাউলদের আত্মদর্শনে ‘ঝি’ মানে মানবদেহ, কায়া, কিবা শরীর বুঝায়। এবার সেই অর্থ ধরে যদি আমরা সামনে এগোই, তাহলে ‘ঝিয়ের পেটে মায়ের জন্ম…‘ এখানে মা এর অর্থ বলতে বাউলদের অন্য কোন অর্থ আছে। ঠিক ধরেছেন, মা বলতে এখানে বাউলরা শুক্র, বীর্যকে বুঝিয়েছেন।
এবার আসুন চার লাইনের অর্থ বের করি। দেহের মাঝে শুক্রের জন্ম হয়েছে। কখন আমাদের দেহে বীর্য আসে, যখন আমরা বাল্য থেকে যৌবনে পদার্পণ করি। এ কারণেই লালন গানটি শুরু করেছেন ‘চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে’ বলে, যার অর্থ কৈশোর থেকে যৌবনে পা দিয়েছে…।
ছয়মাসের এক কন্যা ছিল,
নয়মাসে তার গর্ভ হলো,
এগারোমাসে তিন সন্তান হলো,
কোনটা করবে ফকিরি।
এখানে ‘ছয় মাসের কন্যা’ বলতে লালনসাঁই রূপক অর্থে মানুষের ছয় রিপু যথা, কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, এবং মাৎসর্য্য বুঝিয়েছেন।
এরপর ‘নয় মাসে তার গর্ভ হলো’ বলতে লালন মানবদেহের নয়টি ছিদ্রপথ যেমন, দুই চোখ, দুই কান, নাকের দুই ছিদ্র, মুখ, মুত্র ও মলদ্বার বুঝিয়েছেন। এর ছিদ্রগুলো যখন পরিপুষ্ট হয়ে উঠে সেটিকে বাউলরা ‘গর্ভ’ হওয়া বলে বুঝিয়ে থাকেন।
তারপরের লাইন ‘এগারোমাসে তিন সন্তান হলো’ বলতে সাঁই রূপক অর্থে এই লাইনের ‘এগারো’ হচ্ছে নয়টি ছিদ্রপথের সঙ্গে আরো দুটি সুস্পষ্ট ছিদ্র যা মানবদেহে শুরুতে বিকশিত হয় না, যৌবনে বিকশিত হয়, যেমন- শুক্রদ্বার ও রজদ্বার। এই মিলে এগারো। এই এগারো মাসে ‘তিন সন্তান’ বুঝাতে দেহতত্ত্বে শুক্র, সুধা ও মধু– এ তিনটি ধারাকে তিনটি সন্তান বুঝানো হয়।
লালনসাঁই এই তিন সন্তানের মেঝ, মানে সে সুধার সাধন করেছেন। পুরো অর্থ করলে দাঁড়ায়- মানবদেহ যখন পূর্ণ বিকশিত তখন জীবনের তিনটি পথ খুলে যায়। এই তিন পথের কোনটা সাধন করবে, লালনসাঁই সেই প্রশ্ন রেখে এই চারণ শেষ করেন, যেমন- ‘কোনটা করবে ফকিরি…‘।
ঘর আছে দুয়ার নাই,
মানুষ আছে তার কথা নাই,
কেবা তার আহার জোগায়,
কে দেয় সন্ধ্যাবাতি।
এই চার লাইন বুঝতে কোনো সমস্যা হবার কথা না। কারণ এই ৪ লাইন গানটির সবচেয়ে বোধযোগ্য অংশ। এখানে আমরা সহজেই বুঝতে পারছি- লালন এখানে মাতৃগর্ভে ভ্রুণ জন্মাবার কথা বলেছেন।
লালন সাঁইজি ভেবে বলে,
মাকে ছুঁলে মরে ছেলে,
এ তিন কথার অর্থ নইলে,
তার হয় না ফকিরি।
আমরা আগেই জেনেছি, এখানে শুক্র হচ্ছে মাতা। তাহলে ‘মাকে ছুঁলে মরে ছেলে’ বলতে কী বুঝানো হয়েছে নিশ্চয় বুঝতে পারছেন! ‘ছেলে’ শব্দটি বুঝাতে এখানে পুত্র বোঝানো হয় নি। এখানে ছেলে মানে শিশ্ন বা লিঙ্গ। বাউল দর্শন মতে, এর অর্থ বীর্যপাতের মাধ্যমে জীবের দেহাবসান। কামযজ্ঞে গিয়ে বীর্যপাত করা মানে মৃত্যুবরণ করা। যখন মানুষ শুক্রপাত বন্ধ করবে তখন লাল সাদা ও কালো ধারার সন্ধান পাবে।
লালনের মতে মানুষের দৈহিক মৃত্যুর আগে এই মরমী জীবন বা পার্থিব জীবনের কোনো মৃত্যু ঘটবে না। সাধারণ মানুষ দৈহিকভাবে একবার মরলেও জীবনের প্রতি পদে পদে তার মৃত্যু ঘটে। ভগবান বুদ্ধের মতে, জীবনের উদ্দেশ্য নির্বাণ লাভ করা। এই মোক্ষলাভের মাধ্যমেই জগতের কোন দুঃখ, হতাশা বা উচ্চাশার জন্য সে মনকষ্ট পাবে না। বরং তার মুক্তি মিলবে। বাউলরা সেরকম সাধনাই করেন।
এই ‘তিন কথা অর্থ নইলে তার হয় না ফকিরি’। এখানেই আমাদের সীমাবদ্ধতা, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ লালনকে বলেছিলেন, ‘ফকির মশাই, আপনি যা বলেন তা বুঝেও যেন বুঝি না…’। আমাদেরও একই অবস্থা। গানটার অর্থ করে শেষ করার পর মনে হয় যেন আমরা কিছুই বুঝিনি।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন
সেপ্টেম্বর ২৫, ২০২১; ১১:১৭ পূর্বাহ্ন
অসাধারন
জুন ১৫, ২০২২; ৩:৪১ অপরাহ্ন
অনেক কিছু জানলাম, শিখলাম এবং বুঝলাম।
আগস্ট ২৮, ২০২৩; ১১:৫৮ অপরাহ্ন
ভালোই লাগলো।।লালনের সকল বাণীর স্পষ্ট ব্যাখ্যা চাই।
সেপ্টেম্বর ১৫, ২০২৩; ৮:৩৮ পূর্বাহ্ন
ভালো লাগলো
অক্টোবর ৫, ২০২৩; ৯:১২ অপরাহ্ন
লালন সাইজির গানের অর্থ করা মুর্খ লোকের কাজ নয়।