২
৩০০ বার পঠিত
৩০০ বার পঠিত
মানবসভ্যতার ঊষালগ্নে সমাজকাঠামো ছিল সাম্যবাদী। এই আদিম সাম্যবাদী সমাজে সম্পদের মালিকানা সংক্রান্ত কোনো দ্বন্দ্ব সংঘাত ছিল না। নির্যাতনের ধারণাও তখন ছিল অপরিচিত। মাতৃশাসিত সমাজে মা ছিল সকল ক্ষমতার কেন্দ্র এবং মায়ের ক্ষমতা ছিল নিরঙ্কুশ।প্রকৃতিদত্ত যে বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী নারী-অর্থাৎ তার সন্তান জন্মদানের সক্ষমতা-এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যই ছিল তার ক্ষমতার উৎস।
আদিম সমাজে জীবন ছিল বিপদসংকুল। কিন্তু সেই মাতৃশাসনে শোষণ ছিল না। সে সময় শ্রম বিভাজন ছিল। কিন্তু ছিল না শ্রমশোষণ। সে সময় বিবাহ প্রথার উদ্ভব হয়নি। তাই একটি মানবগোষ্ঠির সকল পুরুষ ও সকল নারীর মধ্যেই যৌন সম্পর্ক স্থাপন ছিল স্বাভাবিক ঘটনা। তাই কোন সন্তানের কে পিতা তা নির্ধারণ করা যেত না। কিন্তু কে মা সেটা বলা যেত। যেহেতু প্রসবের সাক্ষী বর্তমান। সন্তানের পরিচয় নির্ধারিত হতো মায়ের নামে ও গোষ্ঠির নামে। মানব সন্তানের জন্মরহস্য তখনও অজ্ঞাত থাকায় শিশুর জন্মের জন্য নারীর কৃতিত্বই একমাত্র বলে মনে করা হতো। আকাশের বজ্র বিদ্যুৎ, ঝড়, নদী, সমুদ্র ইত্যাদি প্রাকৃতিক শক্তি যেমন মানুষকে বিষ্ময়াবিষ্ট করতো ঠিক তেমনি নতুন শিশুর জন্ম বা নারীর প্রজনন ক্ষমতাও মানুষকে অবাক করতো। এসব কিছুকেই মানুষ মনে করতো দৈবিক ক্ষমতা। পৃথিবীর আদিম মানব সমাজসমূহে তাই উপাস্য ছিল নারী-শক্তি। মায়াদের পুরাণ কাহিনীতে আছে এক নারী নেমে এলো আকাশ থেকে। সেই নারী পৃথিবীতে জন্ম দিল মানব সন্তান এবং সেই সৃষ্টি করলো নানা রকম শস্যবীজ। মিশরীয় পুরাণে আইসিস ছিলেন মাতৃদেবী। সুমেরিয়ান পুরাণে উপাস্য ছিল দেবী ইশতার। যে ছিল মাতৃদেবী।আদিম সুমেরিয়া, ব্যাবিলনিয়া, ফিনিসিয়াতে মাতৃদেবীর পূজা প্রচলিত ছিল। সেই মাতৃদেবীর যে মূর্তি পাওয়া গেছে তা হলো গর্ভবতী। তার মানে গর্ভবতী নারীকে পূজা করা হতো। এবং নারীর গর্ভধারণকে মনে করা হতো বিশেষ দৈবী ক্ষমতার প্রকাশ। এই প্রথার অবশেষ কিন্তু এখন পর্যন্ত বিশ্বের অনেক সমাজেই রয়েছে। বাঙালি সমাজে সাধ উৎসব বলে একটি প্রথা রয়েছে। যেখানে গর্ভবতী নারীকে উপহার দেওয়া হয় এবং তার জন্য বিশেষ ভোজ ও উৎসবের আয়োজন করা হয়। উত্তর ভারতে ‘গোদভরাই’ নামে একটি উৎসব রয়েছে যা সাধ উৎসবের মতোই। প্রাচীন ভারতে ‘দোহদ’ বা ‘সাধ’ নামে উৎসব প্রচলিত ছিল যা একই রকমভাবে গর্ভবতী নারীকে ঘিরে অনুষ্ঠিত হতো। পাশ্চাত্যে বেবি শাওয়ার নামে যে অনুষ্ঠানটি হয় সেটিও অনুরূপ।প্রাচীন গ্রিস ও রোমেও মাতৃদেবীর পূজা প্রচলিত ছিল।গ্রিক পুরাণে প্রাচীন মাতৃদেবী ছিলেন ধরিত্রীদেবী গেইয়া। পরে রিয়াও ছিলেন মাতৃদেবী। রোমান পুরাণ অনুসারে তিনজন মাতৃদেবী ছিলেন প্রধান। সিরিস, সিবিলি এবং ভেনাসকে মাতৃদেবী বলা হতো। মেয়েরা যে যুদ্ধেরও নেত্রী ছিল তার প্রমাণ হলো বিভিন্ন পুরাণে জয়দাত্রী বা যুদ্ধের উপাস্য শক্তি ছিল নারী। গ্রিকদের অ্যাথেনি, রোমানদের মিনার্ভা, ভারতে দুর্গা, মিশরে আইসিসের পূজা করা হতো যুদ্ধযাত্রার প্রাক্কালে।
বাংলাদেশের আদিম জনগোষ্ঠির উপাস্য ছিল নারী শক্তি। কালী,দুর্গা,মনসা,বিশালাক্ষী,লক্ষ্মীর মতো লোকজ দেবীরা পরবর্তীতে পিতৃতান্ত্রিক আর্য সমাজের পুরাণে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সময় কোন না কোন পুরুষ দেবতার স্ত্রী বা কন্যায় পরিণত হয়েছেন।বিশ্বের বিভিন্ন পুরাণকাহিনি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় নারী শক্তি এবং পুরুষ শক্তির মধ্যে একটি দ্বন্দ্বের ইংগিত সর্বত্রই রয়েছে। সমাজ যখন নারী-শাসন থেকে ধীরে ধীরে পুরুষ শাসনে রূপ নিয়েছে তখন পুরাণ কাহিনিতেও ধীরে ধীরে নারীদেবরা পুরুষদেবদের অধস্তন অবস্থানে চলে গেছে। যে কালী অনার্যদের মধ্যে ছিলেন নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী তিনিই পরিবর্তিত অবস্থায় আর্যদেবতা শিবের স্ত্রীতে পরিণত হয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে চলে গেছেন। নিরঙ্কুশ ক্ষমতাময়ী লোকজ দেবী মনসা পরবর্তিতে পরিণত হয়েছেন শিবের কন্যায়। মনসা মঙ্গলে মনসার সঙ্গে বিষ্ণুর বিরোধের কথা উল্লিখিত হয়েছে। হরের(শিবের) সঙ্গে পার্বতীর দ্বন্দ্বের কথা বিভিন্ন পুরাণে রয়েছে। গ্রিক পুরাণেও জিউস ও হেরার বিরোধ থেকে বহু কাহিনির জন্ম।রোমান জুপিটার ও জুনোর বিরোধের কথা রোমানপুরাণে অনেকবার উল্লিখিত হয়েছে।
গ্রিকপুরাণে আদিদেবী ছিলেন গেইয়া যিনি ধরিত্রী দেবী। তিনি তার পুত্র টাইটান ক্রোনাসকে দিয়ে স্বামী ইউরেনাসকে নিবীর্য করে ক্ষমতাচ্যূত করেন। একইভাবে ক্রোনাসের স্ত্রী এবং বোন রিয়া স্বামীকে স্বর্গের ক্ষমতা থেকে বিতাড়ন করেন ছেলে জিউস এবং অন্যান্য সন্তানদের সহায়তায়। তাকে এইকাজে সহায়তা করেন গেইয়া।
পরবর্তিকালের গ্রিক পুরাণে দেখা যায় ধরিত্রীদেবী দিমিতিরের কন্যা পার্সিফোনকে জোর করে হরণ করেন পাতালদেব হেডিস(যিনি দিমিতিরের ভাই)। একাজে তাকে সহায়তা করেন আরেক ভাই জিউস। এ কারণে দিমিতিরের সঙ্গে জিউস ও হেডিসের বিরোধ ছিল।
আসিরীয় ও ব্যাবিলিনীয় পুরাণে দেখা যায় দেবী ইশতারের সঙ্গে অন্ধকারের দেবতার বিরোধ ছিল। ফিনিশীয় পুরাণে ইশতারের নাম অ্যাসতার্তে। ইশতার ও অ্যাসতার্তে সকল জীবের মাতা এবং প্রেম ও যুদ্ধের অধিষ্ঠাত্রী দেবী।
গ্রিকপুরাণে নারীশাসিত রাজ্য আমাজন এর উল্লেখ রয়েছে। আমাজনরা ছিল গ্রিক পুরাণের বিখ্যাত নারী যোদ্ধাবাহিনী। এশিয়া মাইনরের কোনো এক স্থানে তারা বাস করতো। ট্রয়যুদ্ধে তারা ট্রয়এর পক্ষে যুদ্ধ করে। আমাজন রানী পেন্থেসিলি এবং হিপ্পোলাইতির নাম পাওয়া যায় পুরাণে। মহাভারতে নারীরাজ্যপ্রমীলার উল্লেখ রয়েছে। এই রাজ্যের নারী যোদ্ধাদের সঙ্গে অর্জুনের যুদ্ধ হয়েছিল।
মহিষাসুর বধে দেবতারা নারী শক্তি দুর্গার আরাধনা করেন। দেবী দুর্গার মহিষাসুর বধের কাহিনী সর্বজন বিদিত।
সমাজের ঠিক কোন বিশেষ স্তরে নারী তার ক্ষমতা হারাতে শুরু করে তা সময়ের হিসেবে হয়তো নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। কৃষিকাজের সূচনা যদিও নারীর হাতে কিন্তু কৃষিভিত্তিক সমাজকাঠামো বিকশিত হওয়ার সাথে সমান্তরালভাবে নারীর ক্ষমতা ধীরে ধীরে কমতে থাকে। কৃষিক্ষেত্রে শ্রম দিতে গিয়ে পুরুষ ভাবতে শুরু করে উদ্ভিদের জন্মকথা।মানুষ লক্ষ্য করে যে উদ্ভিদের জন্ম হওয়ার জন্য কৃষিক্ষেত্রে বীজবপন করতে হয়। পুরুষ তখন নারীকে ক্ষেত্র এবং নিজেকে উৎপাদক বলে ভাবতে থাকে।
বীজের চেতনা থেকে পুরুষ নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে সচেতন হতে থাকে। সন্তান জন্মের জন্য শুক্রাণুর ভূমিকা বা বীর্যের ভূমিকা সম্পর্কে তার মনে ধারণা জন্মাতে থাকে।
সেই সময় থেকেই পুরুষ নিজের শরীর সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে এবং নিজের শরীরকে শক্তি বা উৎপাদনের হাতিয়ার হিসেবে ভাবতে শেখে। কৃষিকর্মের আগে মানুষের স্থাবর সম্পত্তি বলতে কিছু ছিল না। মানুষ ছিল যাযাবর। কৃষিই মানুষকে যাযাবর থেকে স্থায়ী গ্রাম প্রতিষ্ঠার প্রেরণা দেয়। কৃষিকর্মের ফলে ভূমি যখন সম্পদে পরিণত হয তখন স্থায়ী সম্পদের ধারণার সৃষ্টি হতে থাকে। স্থায়ী সম্পদের ধারণার সময় থেকেই নারীর উপর পুরুষের আধিপত্য কায়েম এবং সেইসঙ্গে নারীর উপর নির্যাতনের শুরু। যার দ্বারা উৎপাদন করা যায়, অর্থাৎ ভূমি ও নারী, দুই-ই পুরুষের সম্পদে পরিণত হতে থাকে। কৃষিক্ষেত্রে শ্রম দেওয়ার জন্য প্রয়োজন হয় বেশি মানুষের। এই বেশি মানুষ অর্থাৎ শ্রমশক্তি কোত্থেকে আসবে? এজন্য প্রয়োজন বেশি সন্তান উৎপাদন। কিন্তু নারীর সন্তান উৎপাদন ক্ষমতা সীমিত। একজন নারী বছরে একের বেশিবার গর্ভধারণ করতে পারে না।তাই অধিক সন্তানের জন্য প্রয়োজন বেশি নারী। প্রতিবেশি গোত্রকে যুদ্ধে পরাস্ত করে তাদের ভূমি এবং নারীকে দখল করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় এই সময় থেকেই। এইভাবে পারিবারিক ও সামাজিক পর্যায়ে নারীর উপর শোষণ ও নির্যাতনের সূচনা ঘটে।
(চলবে)
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন
ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৭; ১০:৫৯ অপরাহ্ন
আমি আপনার লেখার একজন একনিষ্ঠ পাঠক। আপনার লেখায় অসম্ভব স্পিরিট আছে। দোয়া করি আপনি যেন আরও শতশত বছর এভাবে লিখে যেতে পারেন।
ফেব্রুয়ারি ২২, ২০১৭; ১১:২৯ অপরাহ্ন
অনেক ধন্যবাদ। প্রেরণা পেলাম।