০
১০০৭ বার পঠিত
১০০৭ বার পঠিত
মাতৃতান্ত্রিক পরিবার প্রথার পরিবর্তে পিতৃতান্ত্রিক পরিবার প্রথার সূচনা লগ্নেও কিন্তু নারী পুরোপুরি পুরুষের অধীনে ছিল না। তখন বিয়ে এবং পরিবার প্রথার সূচনা হয়েছে। কিন্তু নারীর যৌনতা এবং সন্তান জন্মদানের ক্ষমতার উপর তখনও পুরুষের একচেটিয়া অধিকার কায়েম হয়নি। একজন পুরুষের বিবাহিত স্ত্রী হলেও নারী কোন পুরুষের সন্তানকে গর্ভে ধারণ করবে তার নিয়ন্ত্রণ অনেকটাই নারীর হাতে ছিল। তখনও গোষ্ঠিতান্ত্রিক সমাজ কাঠামো বিদ্যমান ছিল।
সেসময় অধিক মানব শিশুর জন্ম হওয়াটাই ছিল মূল লক্ষ্য। কারণ শ্রমশক্তি বৃদ্ধির জন্য চাই মানুষ এবং আরও বেশি মানুষ। তাই শাসন ক্ষমতা হ্রাস পেলেও নারীর যৌনজীবন কিছুটা স্বাধীন ছিল।
মহাভারতে মহর্ষি উদ্দালক ও তার পুত্র শ্বেতকেতুর উপাখ্যান এখানে স্মরণীয়। স্বামী ও শিশুপুত্রের সামনে দিয়েই স্ত্রী চলে যাচ্ছে এক ব্রাহ্মণের সঙ্গে বিহারে। মাকে অন্য লোকের সঙ্গে চলে যেতে দেখে শ্বেতকেতু অস্থিরতা প্রকাশ করলে উদ্দালক তাকে সান্তনা দিয়ে বলছেন যে স্ত্রী জাতি গোজাতির মতোই স্বাধীন। গো ধর্ম অর্থাৎ পশুর মতো বাছবিচারহীন সংগম তখন নিন্দিত হলেও স্বীকৃত অর্থাৎ নিষিদ্ধ নয়। শ্বেতকেতু বড় হয়ে অবশ্য বিধান দেন যে, স্ত্রী এবং পুরুষ উভয়েই বিবাহিত অবস্থায় বিনা কারণে অন্যত্র সংগম করতে পারবে না। তবে সে বিধান খুব বেশি পালিত হয়নি।
মহাভারতে বিভিন্ন রকম পুত্রের উল্লেখ রয়েছে। যদিও তখন স্বামী (মানে প্রভু) ও স্ত্রীর সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে তবু নারীর যৌনতার উপর এবং সন্তান ধারণের উপর পুরুষের নিরঙ্কুশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তবে যার দ্বারাই স্ত্রীর গর্ভে সন্তান আসুক তার ওপর অধিকার স্বামীর। সন্তান হলেই হলো। কানীন, নিরুক্তজ বা ক্ষেত্রজ, প্রসূতিজ, অঢ়্যুঢ় যাই হোক। কুমারী নারীর সন্তানকে বলা হতো কানীন। আবার বিবাহিত নারীর অন্য পুরুষ দ্বারা উৎপন্ন সন্তানকে বলা হতো ক্ষেত্রজ। কোনো নারীর যদি বিয়ের আগে যে কোনো পুরুষ দ্বারা সন্তান জন্মায় তাহলে মেয়েটির বিয়ের পর যে তার স্বামী হবে সেই ওই সন্তানের আইনত পিতা বলে গণ্য হবে। যদিও সে সন্তানের বায়োলজিকাল ফাদার হয়তো অন্য পুরুষ। আর ক্ষেত্রজ সন্তানের ক্ষেত্রে বিবাহিত নারী যদি স্বামী ছাড়া অন্য পুরুষ দ্বারা সন্তান জন্ম দেয় তাহলে ওই সন্তানের পিতা হবে তার স্বামী। বায়োলজিকাল ফাদার পিতার অধিকার পাবে না।
কানীন ও ক্ষেত্রজ সন্তানের উদাহরণ পুরাণ মহাভারত সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। যেমন, কর্ণ হলেন কুন্তীর এবং ব্যসদেব সত্যবতীর কানীন পুত্র। আইনত কর্ণের বাবা হলেন পাণ্ডু এবং ব্যসদেবের আইনসিদ্ধ পিতা মহারাজ শান্তনু। যদিও কর্ণর বায়োলজিকাল পিতা সূর্য এবং ব্যাসদেবের পিতা পরাশর। অন্যদিকে তিন পাণ্ডব কুন্তীর ক্ষেত্রজ পুত্র। তাদের আইনত পিতা পাণ্ডু। কিন্তু বায়োলজিকাল পিতা ধর্ম, পবন, ইন্দ্র। আর মাদ্রীর দুই পুত্রের পিতা পাণ্ডু ও জনক অশ্বিনী কুমারদ্বয়। একইভাবে পাণ্ডু ও ধৃতরাষ্ট্র অম্বিকা ও অম্বালিকার গর্ভে জন্ম নেওয়া ক্ষেত্রজ পুত্র। যাদের আইনত পিতা বিচিত্রবীর্য় হলেও বায়োলজিকাল পিতা ব্যসদেব।
সমাজে সম্পত্তির ধারণার যতই বিকাশ ঘটেছে ততোই নারীর স্বাধীনতা খর্ব হয়েছে। নারীর স্বাধীনতা যতই খর্ব হয়েছে ততোই তার উপর নির্যাতনের পরিমাণ ধীরে ধীরে বেড়েছে।নারীর উপর এই নির্যাতন ঘটেছে সমাজের সহায়তায়।
গোষ্ঠির শাসন থেকে একসময় উদ্ভব ঘটেছে ব্যক্তির শাসন বা রাজার শাসনের। রাজার শাসনকে কায়েম রাখার জন্য নতুনভাবে তৈরি হয়েছে শাস্ত্র, পুরাণ। রাজাকে দেবতার প্রতিনিধি কিংবা দেবতার বংশধর বলে প্রচার করা হয়েছে। উৎপত্তি ঘটেছে সূর্যবংশ, চন্দ্রবংশ ইত্যাদির। বিশ্বে বিভিন্ন সমাজেই এমনটি ঘটেছে। মিশরে ফারাওকে মনে করা হতো দেবতা বা দেবতার বংশধর। প্রাচীন সুমেরিয়াতে রাজাকে দেব বংশধর মনে করা হতো। প্রাচীন গ্রিসে বিভিন্ন দেবতা থেকে বিভিন্ন রাজার জন্ম হয়েছে এমন ধারণা ছিল। রোমে দেবী ভিনাস থেকে রোমান আদি পুরুষের জন্ম হয়েছিল বলে মনে করা হতো।
এই সেদিন পর্যন্ত জাপানে রাজাকে সূর্য দেবতার বংশধর মনে করা হয়েছে। রাজতন্ত্র কায়েম রাখার জন্যই রাজার উপর এই ঈশ্বরত্ব আরোপ তা বলাই বাহুল্য। ঠিক একইভাবে পুরুষকে সুকৌশলে দেবতার আসনে বসানোর প্রক্রিয়া চলে।
পৃথিবীতে ঈশ্বরের প্রতিনিধি রাজা আর পরিবারে রাজার প্রতিনিধি পুরুষ। রাজা যেমন তার প্রজাবর্গের উপর নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী তেমনি পরিবারের প্রধান পুরুষ তার পরিবারের সদস্যদের উপর নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী। রাজা যেমন ইচ্ছা করলে অবাধ্য প্রজাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করতে পারেন তেমনি প্রধান পুরুষও পরিবারের যে কোনো সদস্যকে মৃত্যুদণ্ড দিতে পারতেন। রাজতন্ত্র এবং পিতৃতন্ত্র এভাবে সমান্তরালভাবে পরষ্পরকে শক্তিপ্রদান করেছে।
নিয়ন্ত্রণ কায়েম রাখার উদ্দেশ্যে রাজা এবং পিতার উপর দেবত্ব আরোপ করা হয়েছে। রাজার সন্তুষ্টিতে স্বর্গের সন্তষ্টি এটাই প্রচার করা হয়েছে। ‘পিতাঃ ধর্ম, পিতাঃ স্বর্গ, পিতাহি পরম পূজ্যতে’, ‘পতি পরম দেবতা’ ইত্যাদি শাস্ত্র বচনের মাধ্যমে পুরুষের মাহাত্য প্রচার করা হয়েছে।
সেসময় থেকেই পুত্র সন্তানের কদর বেড়েছে। পুত্রই বংশ ধারা একথা প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা বলা হয়েছে। পুত্র ও কন্যা সন্তানের জন্মের জন্য এক্স ও ওয়াই ক্রোমোজমের ভূমিকা তখন অজ্ঞাত ছিল। তাই ধরে নেওয়া হয়েছে নারীর গর্ভে যেহেতু সন্তান জন্ম নেয়, অতএব পুত্র ও কন্যা সন্তান জন্মের জন্য নারীই দায়ী। তাই পুত্র জন্ম নিয়েছে যে নারীর গর্ভে সেই সৌভাগ্যবতী বলে গণ্য হয়েছে।
ধীরে ধীরে নারীকে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে যে, পুরুষের সেবা করাই তার জীবনের চরম সার্থকতা। সে পুরুষ পিতা, ভাই, স্বামী, পুত্র , শ্বশুর ভাসুর বিভিন্ন রূপে বিরাজ করে। স্বামীর সেবা করাই নারীর জীবনের পরম ধর্ম বলে মেনে নেওয়া হয়েছে। নারী কখনও কন্যারূপে, কখনও স্ত্রী রূপে কখনও মাতা রূপে সংসারের সবাইকে সেবা করবে। এটাই তার ধর্ম। এমনকি ব্রাহ্মণের সেবার চেয়েও স্বামীর সেবা বড়। এমনি একটি কাহিনী আছে মহাভারতে।
একবার এক মহর্ষি এক গৃহী ব্রাহ্মণের গৃহে আসেন। তিনি গৃহস্থের স্ত্রীর কাছে খাদ্য চান। এমন সময় গৃহস্থ ঘরে আসে। স্ত্রী তখন আগে স্বামীর সেবায় নিরত হন। ঋষি ক্রোধ প্রকাশ করলে কূলবধূ বলেন, তোমার শাপে বা ক্রোধে আমার কিছুই হবে না। কারণ পতির সেবা করা আমার প্রথম ধর্ম। আমি আগে পতির সেবা করে তারপর তোমাকে খাদ্য দান করব। পতিপ্রাণা স্ত্রীর গুণকীর্তনের মাধ্যমে পুরুষতন্ত্র নারীর উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠাকে বৈধতা দিয়েছে।
(চলবে…)
চারদেয়ালের কান্না (১ম পর্ব)
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন