১৫৫৩ বার পঠিত
নারীর উপর পুরুষতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার সবচেয়ে যুতসই হাতিয়ার হলো সতীত্বের ধারণা সৃষ্টি। সতী-অসতী এই বিভাজনটি পুরুষের চরম ধুর্তামি ও নিয়ন্ত্রণকামীতার বহিঃপ্রকাশ। একটু ফিরে তাকানো যাক সতী নামক ধারণাটির দিকে। পুরুষের বংশধারার চেতনা প্রবল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নারীর যৌন জীবনের উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নিয়ন্ত্রণ। যে সম্পত্তির উত্তরাধিকার পাবে পুরুষের সন্তান সেই সন্তানটি কি আদৌও তার? পুরুষ সন্দেহের দোলাচলে ভুগেছে। মনে হয়েছে অন্য কোনো পুরুষের সন্তান ভাগ বসাচ্ছে না তো সম্পত্তিতে? যে শিশুর জন্ম হলো তার পিতৃত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার প্রয়োজন থেকেই সতীত্বের ধারণার উদ্ভব। সতী অর্থাৎ যে নারী এক ভিন্ন দ্বিতীয় পুরুষের সংস্পর্শে যায় না। পুরুষতন্ত্র শক্তি লাভ করার সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু সতীত্বের ধারণা বিকশিত হয়েছে। তার মানে প্রথমদিকের ‘সতী’দের চেয়ে পরের দিকের সতীরা আরও বেশি ‘সতী’ হযেছে। সময়ের ধারায় সতীত্বের আদর্শ কঠোর থেকে কঠোরতর হযেছে।
সতীত্বের ধারণার প্রথমদিকের একটি উদাহরণ দিলেই বিষয়টি সহজে বোধগম্য হবে। প্রাতঃস্মরণীয় পঞ্চসতীর নাম এখানে মনে করিয়ে দিচ্ছি উদাহরণ হিসেবে। অহল্যা, তারা, কুন্তী, দ্রৌপদী, মন্দোদরী হলেন প্রাতঃস্মরণীয় পঞ্চসতী। আসুন এদের ‘সতীত্ব’ বিশ্লেষণ করা যাক। প্রথম সতী অহল্যা। পরমা সুন্দরী অহল্যা ছিলেন ঋষি গৌতমের স্ত্রী। ইন্দ্র তার প্রতি লোলুপ ছিলেন। গৌতমের অনুপস্থিতিতে তার মতো রূপ ধারণ করে ইন্দ্র আসেন অহল্যার কাছে। অহল্যা স্বামী ভেবে ভুল করে তার সঙ্গে সংগম করেন। এই অপরাধে(!) গৌতম অহল্যাকে শাপ দেন। শাপ দেন ইন্দ্রকেও। তবে অহল্যা ইন্দ্রকে চিনতে পেরেও ইচ্ছাকৃতভাবে তার সাথে মিলিত হয়েছিলেন নাকি সত্যিই ভুল করেছিলেন সেটা নিয়ে পুরাণকারদের মধ্যে দ্বিমত আছে। কয়েকজন মনে করেন অহল্যার ভুলটি ছিল ইচ্ছাকৃত। আর সে কারণেই গৌতম তাকে শাপ দিয়েছিলেন। দ্বিতীয় সতী তারা। তারা ছিলেন কিষ্কিন্দ্যার রাজা বালীর স্ত্রী্। বালীর মৃত্যুর পর বিধবা তারার সঙ্গে বিয়ে হয় সুগ্রীবের। এ বিয়েটি দিয়েছিলেন স্বয়ং রামচন্দ্র। তৃতীয় সতী কুন্তী হলেন মহারাজ পাণ্ডুর স্ত্রী। পাণ্ডুর সঙ্গে বিয়ের আগে কুমারী অবস্থায় সূর্যের সাথে সংগমে এক পুত্রের(কর্ণ) জন্ম দেন কুন্তী। তিনি আবাহণ মন্ত্র জানতেন। দুর্বাসা মুনি তাকে এই মন্ত্র দেন। মন্ত্রের গুণাগুণ পরীক্ষার জন্য কুন্তী নিজেই আবাহণ করেছিলেন সূর্যকে কৌতুহলবশে। কর্ণের জন্মের পর লোকলজ্জায় তাকে ত্যাগ করেন কুন্তী। পরে তার বিয়ে হয় মহারাজ পাণ্ডুর সঙ্গে। পাণ্ডু এক মুনির শাপে স্ত্রী মিলনে বিরত থাকার সংকল্প নিলে পাণ্ডুর অনুমতিক্রমে কুন্তী ধর্ম, পবন ও ইন্দ্রর সঙ্গে মিলনের ফলে যুধিষ্ঠির, ভীম ও অজুর্নের জন্ম দেন। তার মানে স্বামী ছাড়া আরও তিন পুরুষ(দেবতা) এর সাথে তার সংগম ঘটেছে। চতুর্থ সতী দ্রৌপদীর তো স্বামীই পাঁচজন। আর পঞ্চম সতী মন্দোদরী ছিলেন রাবণের স্ত্রী্ । যিনি প্রায় সীতার মতোই সুন্দরী ছিলেন। রাবণের মৃত্যুর পর তার বিয়ে হয় বিভীষণের সঙ্গে। এই বিয়েও দেন রামচন্দ্র। তার মানে প্রাতঃস্মরণীয় পঞ্চসতীর প্রত্যেকেই কিন্তু একাধিক পুরুষের সঙ্গে শারিরীক সম্পর্কে গেছেন্ তবুও তারা শাস্ত্রে সতী বলেই সম্মানিত হয়েছেন।
সতীত্বের আদর্শ কিভাবে পাল্টেছে সেটা দুই মহাকাব্য থেকে উদাহরণ দেই। বাল্মিকীর রামায়ণে আছে সীতাকে রাবণ হরণ করে নিয়ে গিয়েছিলেন লংকায়। তাকে অশোকবনে রাখা হয়েছিল। রাবণ যখন সীতাকে হরণ করেন তখন তার হাত ধরে জোর করে টেনে রথে উঠান। কিন্তু সীতার মতো সতীর হাত পরপুরুষ(বা রাক্ষস) রাবণ ধরেছে এই বিষয়টি বাল্মিকীর সহ্য হলেও পরবর্তিকালের পুরাণকারদের মোটেই সহ্য হয়নি। তাই ‘ছায়াসীতা’ নামে এক উপাখ্যানের জন্ম হয়। এই উপাখ্যানে বলা হয় রাবণ নাকি সীতাকে কখনও লংকায় নেওয়া তো দুরের কথা চোখেই দেখেনি। সীতা হরণ হতে পারে এই আশংকায় অগ্নি আগেই রামকে সতর্ক করে দেন। তাই আসল সীতা অগ্নির কাছে গচ্ছিত ছিলেন। অগ্নির বরে এক ছায়াসীতার সৃষ্টি হয়্ সেই ছায়াসীতাকে নিয়েই রাম পঞ্চবটী বনে ছিলেন। সেখান থেকে ছায়াসীতাকেই রাবণ হরণ করেন। রাবণ বধের পর যখন সীতার প্রথম অগ্নিপরীক্ষা হয় তখন অগ্নি নিজে আসল সীতাকে নিয়ে আবির্ভূত হন আর ছায়া সীতাকে নিয়ে যান।
আশ্চর্যজনকভাবে একই রকম উপাখ্যান পাই গ্রিক মিথোলজিতেও। এখানে হলো ছায়া হেলেনের কাহিনী। হোমার লিখেছেন প্যারিস স্পার্টার রানী (হেলেন ছিলেন স্পার্টার রাজকন্যা। মেনেলাউস তাকে বিয়ে করে রাজত্ব পান) হেলেনকে হরণ করে ট্রয়ে নিয়ে যান। প্যারিসের প্রেমে পড়ে হেলেন নিজের ইচ্ছাতেই গিয়েছিলেন অবশ্য। তবে হোমার বলেছেন আফ্রোদিতির প্ররোচনায় হেলেন প্যারিসের প্রেমে পড়েন ও তার সঙ্গে পালিয়ে যান। ট্রয় যুদ্ধের পর হেলেন ফিরে আসেন স্বামী মেনেলাউসের সঙ্গে স্পার্টায়। এবং আবার সসম্মানে রানীর আসন অধিকার করেন। কিন্তু হোমারের পরবর্তি যুগের পুরাণকারদের মনে হয এমন ‘কুলটা’ নারীর রানীর সম্মান পাওয়া ঠিক নয়। তাই তারা ‘ছায়া হেলেনের’ ইতিবৃত্ত রচনা করেন। ছায়া হেলেনের কাহিনীতে বলা হয়, প্যারিস নাকি হেলেনকে কখনও ট্রয়ে নিযে যেতেই পারেননি। আসল হেলেন গচ্ছিত বা আশ্রিত ছিলেন সমুদ্রের অমর মানুষ প্রতেউসের কাছে। আর এক নকল হেলেনকে প্যারিস নিয়ে যান ট্রয়্। ট্রয়যুদ্ধের পর গ্রিকরা যখন দেশে ফিরছিলেন তখন আসল হেলেনকে ফেরত দেন প্রতেউস। বিষ্মযকরভাবে দ্রৌপদীর মতো হেলেনেরও কিন্তু পঞ্চস্বামী ছিলো বলে পুরাণকাররা উল্লেখ করেন। হেলেনের পঞ্চস্বামী হলেন থিসিউস(বালিকা অবস্থায় হেলেনকে যিনি অপহরণ করেন), মেনেলাউস, প্যারিস, ডাইফোবাস(প্যারিসের মৃত্যুর পর স্বল্পদিনের জন্য তার সাথে বিয়ে হয়) এবং একিলিস(যিনি স্বপ্নে হেলেনের সাথে মিলিত হন)।
প্রথম যুগের নারীদের তুলনায় পরবর্তিকালে সতীত্বের আদর্শ পাল্টে যায়। তখন সতী মানে অসূর্যমপশ্যা। চন্দ্র ও সূর্য যার আলয়ে প্রবেশ করতে পারে না বা তার মুখ দেখতে পায় না। মহাভারতের যুগে আমরা নারীদের অসংকোচে আত্মীয় ও অনাত্মীয় পুরুষের সঙ্গে আলাপ করতে দেখি। কুন্তী তার দেবর বিদুরের সঙ্গে দিব্যি আলাপ করতেন। মুনি ঋষিদের সঙ্গে কথা বলতেও কুলনারীদের কোন বাধা ছিল না। ঋষিদের স্ত্রীরা শিষ্যদের সামনে অসংকোচে চলাচল করতেন।
অথচ পরবর্তিকালে স্বামী ভিন্ন অপর পুরুষের সঙ্গে বাক্যালাপ তো দূরের কথা চন্দ্র সূর্যও যেন কুলনারীর মুখ দেখতে না পারে এমন ব্যবস্থা করা হযেছে। সতীত্ব রক্ষার নামে নারীর সমগ্র সামাজিক জীবনকেই হাতের মুঠোয় পুরে ফেলে পুরুষতন্ত্র।
বিশ্বের অনেক সমাজেই সতীত্বের নামে নারীর উপর চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে চরম নির্যাতন চালানো হয়েছে। ইউরোপে মধ্যযুগে নারীকে চেস্টিটি বেল্ট পরিয়ে রাখা হতো। সেই বেল্টের চাবি আবার থাকতো স্বামীর কাছে। স্ত্রী যেন গোপনে কারও সঙ্গে যৌন সম্পর্কে যেতে না পারে তারা পাকাপোক্ত ব্যবস্থা করতো পুরুষরা। আরব বিশ্বে পর্দা বা সতীত্ব রক্ষার নামে নারীকে পুরে রাখা হয়েছে হেরেমে। নববধূ কুমারী বা সতী কিনা তা দেখার একটি রীতি রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে। সেখানে বাসররাতে শয্যার উপর বিছিয়ে রাখা হয় একটি সাদা কাপড়। পরদিন সকালে সেই সাদা কাপড়ে রক্তের দাগ দেখিয়ে সগর্বে কুমারীকন্যার মালিকানা ঘোষণা করেন স্বামী। সমস্যা হলো নানা কারণে একটি মেয়ে বিয়ের সময় কুমারী নাও থাকতে পারে। এমনকি যদি কুমারীও থাকে তাহলেও কোন কারণে তার হাইমেন ছিঁড়েও যেতে পারে। এজন্য সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে আগেই ঘরে অল্প রক্ত বা অনুরূপ লালরঙ মজুদ রাখা হয়। অথচ কোন পুরুষকে কিন্তু কখনও সতীত্ব বা ভার্জিনিটি অথবা কৌমার্য প্রমাণ করতে হয় না।সীতার সতীত্বের অগ্নিপরীক্ষার ঘটনাটি সর্বজনবিদিত। তবে এটি শুধু মিথ নয়। অনুরূপভাবে অনেক নারীকেই যুগে যুগে সতীত্বের পরীক্ষা দিতে হয়েছে সম্ভব-অসম্ভব অনেক উপায়ে। জ্বলন্ত কয়লার উপর দিয়ে হাঁটা, জ্বলন্ত আগুনে হাত দেওয়া, গরম লোহা হাতে ধরা ইত্যাদির মাধ্যমে সতীত্বের পরীক্ষা দিতে হয়েছে এবং অবধারিতভাবে আহত বা নিহত হতে হয়েছে, পুড়ে মরতে হয়েছে। সতীত্বের পরীক্ষা প্রসঙ্গে ত্রিস্তান ও আইসোল্ডে উপাখ্যানের একটি অংশ মনে পড়ছে। আয়ারল্যান্ডের রাজকন্যা আইসোল্ডে ছিলেন কর্নওয়ালের রাজা মার্কের স্ত্রী। কিন্তু তার সঙ্গে প্রেম ছিল বীর নাইট ত্রিস্তানের। যে কিনা রাজার ভাগ্নে। অনেক ঘটনার পর ত্রিস্তান ও আইসোল্ডে বনে পালিয়ে যান। তারা সেখানে কয়েক বছর একত্রে বাস করেন। পরে রাজা মার্ক স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেন রাজ্যে এবং রানীর আসন দেন। তখন রাজ্যের কয়েকজন দুষ্টলোক রানীর সতীত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলে। তারা দাবী করে রানীকে অগ্নিপরীক্ষা দিতে হবে। এই পরীক্ষা হলো আগুনে টকটকে লাল একটি গরম পাথর হাত দিয়ে ধরতে হবে তাকে। যদি রানীর হাত না পোড়ে তবে তিনি সতী। বিখ্যাত রাজা আর্থার ও তার গোল টেবিল নাইটদের সাক্ষী রেখে অগ্নিপরীক্ষা দেন আইসোল্ডে। পরীক্ষা দিতে যাবার সময় একটি ঝরনা পার হতে হয়। ঝরনার উপর দিয়ে চেয়ারে বসিয়ে তাকে বয়ে নিয়ে যান ছদ্মবেশী ত্রিস্তান। রানী শপথ করে বলেন যে রাজা মার্ক এবং এই বাহক ছাড়া আর কোন পুরুষকে কখনও তিনি স্পর্শ করেননি। এই শপথে অগ্নিপরীক্ষা দিয়ে পাশ করে যান রানী। তার মানে মধ্যযুগে ইউরোপেও অগ্নিপরীক্ষা ছিল নারীর জন্য সতীত্বের পরিচয়বাহী। আগুনে গরম করা লোহা বা পাথর সতী-অসতী সকল মানুষের হাতই পোড়াবে। না জানি সেসময় কত নারকে অগ্নিপরীক্ষার নামে জীবন দিতে হয়েছে। অসতী ও ডাইনিদের আগুনে পোড়ানোর রীতি সপ্তদশ শতক পর্যন্ত ইউরোপে বহাল ছিল। আর এখনও মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকায় ব্যভিচারের অভিযোগে অর্থাৎ অসতী বলে নারকে পাথর ছুঁড়ে হত্যার বিধান রয়েছে। পর্দা তথা সতীত্বের দোহাই দিয়ে পারিবারিকভাবে নারীর উপর নির্মম নির্যাতন চালানো হয়েছে আর এই নির্যাতনকে সমর্থন দিয়েছে সমাজ ও রাষ্ট্র।
(চলবে…)
চারদেয়ালের কান্না (১ম পর্ব)
চারদেয়ালের কান্না (২য় পর্ব)
আগস্ট ৮, ২০১৭; ১২:১৪ পূর্বাহ্ন
বুদ্ধির ওভারডোজ হলে এইসব আইন গজায়।