০
২০৮৮ বার পঠিত
সাধারণভাবে শূন্য বলতে বোঝায় পঞ্চভুতের ব্যোম, স্পেস, স্থান, আকাশ ইত্যাদি। গণিতের ইতিহাসেও বিমূর্ত শূন্য সংখ্যার আবিষ্কার মানুষের জীবনে এক আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসে। ধর্ম ও দর্শনে বৌদ্ধ শূন্যবাদ এক অনন্য মতবাদ। বিজ্ঞানে শূন্য সংখ্যার ব্যবহারে দশভিত্তিক গণনাপদ্ধতি আমাদের গণনাপদ্ধতিকে সহজতর করেছে। আধুনিক ডিজিটাল প্রযুক্তিতে বাইনারি সংখ্যা পদ্ধতিতেও শূন্য গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে আছে।
বৌদ্ধ শূন্যবাদঃ নাগার্জুনের শূন্যবাদ
শূন্যবাদ বলতে সাধারণত সংসারকে শূন্যময় বুঝিয়ে থাকে। মাধ্যমিকের মতে শূন্যের অর্থ পাশ্চাত্য নিহিলিজমের শূন্যতা নয়। নাগার্জুনের মতে পরমতত্ত্ব বর্ণনাতীত। বৌদ্ধ ব্যতীত অন্যান্য ভারতীয় দার্শনিকরা সাধারণত মনে করেন যে, শূন্যবাদ অনুসারে বাহ্যবস্তু অথবা মানসিক প্রক্রিয়া সবই শূন্য। বস্তু বা মন বলে কোন কিছুরই সত্তা নেই। জড়জগৎ ও মনোজগৎ উভয়ই মিথ্যা। এ মতবাদের সমর্থনে অন্যতম যুক্তিটি হলো- জ্ঞাতা, জ্ঞেয় এবং জ্ঞান এই তিনটি বিষয় পরস্পর নির্ভরশীল, যেহেতু পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। তিনটির মধ্যে একটির যদি অস্তিত্ব না থাকে অথবা একটি যদি মিথ্যা প্রতিপন্ন হয়, তাহলে অন্যগুলিও মিথ্যা হতে বাধ্য।যখন আমরা দড়িকে সাপ বলে জানি তখন প্রকৃতপক্ষে সাপের অস্তিত্ব নেই। সুতরাং সাপের জ্ঞান মিথ্যা এবং যেহেতু মনের সাহায্যে এই জ্ঞান লাভ করা হয় সেহেতু মনও মিথ্যা। অতএব, বাইরের জগতে অথবা মনোজগতে আমরা যা কিছু প্রত্যক্ষ করি সবই মিথ্যা। সবই স্বপ্নবৎ অলীক। সুতরাং বস্তু বা মন কোন কিছুরই সত্তা নেই। এই জগত শূন্য। জগতে কোথাও কোন সদ্বস্তু নেই, সবই অসৎ, মিথ্যা ও শূন্য।
বস্তুর অভ্যন্তরে কোন স্থির তত্ত্ব নেই, যা আছে তা বিচ্ছিন্ন প্রবাহমাত্র। দার্শনিক বিচারে নাগার্জুনের দর্শন,সমস্ত ভাবের শূন্যতা প্রতীত্য-সমুৎপাদ (বিচ্ছিন্ন প্রবাহরূপে উৎপত্তি)। প্রতীত্য-সমুৎপাদ বিশ্ব এবং তার সমস্ত জড় চেতনা বস্তু কোন স্থির, অচল তত্ত্ব (আত্মা, দ্রব্য ইত্যাদি) থেকে পূর্ণরূপে শূন্য অর্থাৎ বিশ্ব ঘটনাসমূহ বর্তমান কিন্তু বস্তুসমূহ নয়। সমস্ত বস্তু আপন উৎপত্তিতে, আপন সত্তাকে পাবার জন্য অন্য কারণের ওপর নির্ভরশীল। এর অন্য অর্থ ক্ষণিকতা। সমস্ত বস্তুই ক্ষণপরে বিনষ্ট হয়ে যায় এবং দ্বিতীয় নতুন বস্তু বা ঘটনা ক্ষণের জন্য আবির্ভূত হয় অর্থাৎ উৎপত্তির বিচ্ছিন্ন প্রবাহ।
‘যে এই শূন্যতাকে অনুধাবন করতে সক্ষম, সে সমস্ত অর্থকেই হৃদয়ঙ্গম করতে সক্ষম। যে শূন্যতাকে বুঝতে অক্ষম সে কোন কিছুই বুঝতে অক্ষম’।
শূন্যতা বা নাথিংনেস নিয়ে শুধু প্রাচ্যে নয়, পাশ্চাত্যেও অনেক দর্শন রচিত হয়েছে। ‘বিয়িং‘ এবং ‘নাথিংনেস‘ পাশ্চাত্য দর্শনের একটা বড় থিম।
“The nothing is God and God has made all things out of the nothing and is the self-same Nothing.”
– Jakob Boehme
ধর্ম–সাহিত্যে শূন্যঃ
দৃশ্যমান জগতের চিরন্তন এবং অজ্ঞাত অবস্থান (স্পেস, শূন্য) নির্দেশ করতে আজ পর্যন্ত যত প্রতীকের ব্যবহার করা হয়েছে তার মধ্যে একটা শাদা কাগজের পৃষ্ঠা প্রতীক হিসেবে ধরলে ভুল হবার সম্ভাবনা সবচেয়ে কম । শাদা কাগজ অপরিমাপযোগ্য, চিরন্তন, নিখুঁত,অসীম ক্ষেত্রের রূপ, যেকোন ধরনের আকার বা আকৃতি এ রূপের সৌন্দর্যকে বিনষ্ট করে।
স্পেস বা স্থানে সবকিছুর উৎপত্তি, স্থান আ প্রায়োরি (a priori ) , অর্থাৎ অবস্থানগত কারণেই মানুষের বাকি সব অনুসন্ধিৎসা। এ ব্যাপারে কারো কোন সন্দেহ নেই, এ নিয়ে কোন প্রশ্নের অবকাশ নেই। এজন্য স্থান আর পরমাত্মা সমার্থক। ‘ব্রক্ষ্ম সত্য, জগৎ ব্রক্ষ্ম‘। বস্তু স্পেসের ঋণাত্মক প্রকাশ, আর আত্মা এর ধনাত্মক প্রকাশ। খ্রিস্টান ত্রিমূর্তিতে স্পেস বা শূন্য পিতা, আত্মা এর সন্তান আর বস্তুজগত হল পবিত্র ভূত।
ভারতবর্ষের আধ্যাত্মিক চিন্তায় শূন্যের ব্যবহার এবং গুরুত্ব অনেক। ভারতীয় চিন্তার একটা উল্লেখযোগ্য অংশ জুড়ে আছে জগত-সংসার মায়াময়, শূন্য। স্বামী বিবেকান্দ তার গুরুভাইদের বলতেন ‘আমি খ’,আর তার গুরুভাই বলত না ‘আমি খ’, ‘খ’ মানে আকাশ। জগৎ-সংসারে সবই শূন্য, বাংলা লোকগীতিতে এ প্রসঙ্গ বারবার এসেছে –
“মন ভেবে ভেবে বল
কি পাবি তুই মিছে এই সংসার …
শূন্য থেকে শুরু সবই, শূন্য শুধু সার।”
“এই মানুষ ছাড়া মন আমার
দেখবিরে তুই সব শূন্যকার।” – লালন
“শুন্যে আও, শুন্যে বাও, শুন্য ত্রিভুবন।
অন্তরজুড়ে দেখ না চেয়ে কে তোর আপন”। (ওয়াহিদ গীতি)
https://www.youtube.com/watch?v=y9pKcGX08nA
গণিতে শূন্য সংখ্যাঃ
বিভিন্ন সভ্যতায় অনেক মানুষ গণনাকর্মে শূন্যের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছেন। কিন্তু কোন জাতি প্রথম শূন্যের ব্যবহার সূচনা করে, কোন জাতি কার কাছ থেকে শেখে তার সঠিক ইতিহাস হয়ত কখনোই পুরোপুরি জানা যাবে না। কেউ মনে করেন দক্ষিণ আমেরিকার মায়া সভ্যতাতেই প্রথম শূন্যের ধারণা জন্মায়। আবার কারো কারো মতে চীনে প্রথম শূন্যের ব্যবহার হয়। কিন্তু শূন্যকে তারা কেউই সংখ্যা হিসেবে গণ্য করেনি, শূন্য তাদের কাছে একটা চিহ্ন। ভারতবর্ষে প্রথম শুন্য যে আসলেই একটি সংখ্যা, এবং অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ সংখ্যা সেই উপলব্ধিটা আসে। গণিতের অগ্রগতিতে শূন্যের আবিষ্কার ভারতীয় সভ্যতার এক মহান অবদান। ভারত থেকে এ সংখ্যা পদ্ধতি আরবে পৌঁছায়। আরবদের কাছ থেকে বিখ্যাত গণিতবিদ ফিবোনাচ্ছি এটি ইতালীর ব্যাংকিংয়ে প্রচলন করে। ইতালীতে তখনো এবাকাস দিয়ে গণনা করা হতো, কিন্তু দশভিত্তিক গণনাপদ্ধতি সহজ হওয়ায় অতি দ্রুত সেটা ব্যবসায় স্থান করে নেয়। আজকে আমরা যাকে আরবি সংখ্যা বলে আখ্যায়িত করি ভারতীয় গণনার পদ্ধতি বলতে গেলে প্রায় একই রকম ছিলঃ ১,২,…,৯,০। ঐতিহাসিকভাবে দেখা যায় আরবরা ভারতের কাছ থেকে শুন্য সংখ্যার ধারণা শেখে, তারপর তাদের কাছ থেকে পাশ্চাত্যে এ ধারণার প্রচার ও প্রসার ঘটে। তারা এর নামকরণ করে আরবি সংখ্যা। ফলে আধুনিক সংখ্যার লিখনপদ্ধতি প্রবর্তনের কৃতিত্বটা আরবদের না দিয়ে বরং ভারতীয়দের দেওয়াই বোধ হয় উচিত। তবে এটা অস্বীকার করা যাবে না যে, মধ্যযুগের আরব প্রভাবিত পৃথিবীতে ‘শূন্যের ব্যবহার আধুনিক সভ্যতাকে আরো খানিকটা এগিয়ে দেয়।
‘শূন্য’কে সংখ্যার স্তরে বসাবার পর মানুষের মনে পুরো একটা ‘সংখ্যারেখা’র ধারণা জেগে উঠবার সুযোগ পায়। ‘শূন্য’ হয়ে পড়ে ধনাত্নক আর ঋণাত্নক সংখ্যামালার মাঝখানে একটা সেতুর মত। অন্যভাবে ভাবতে গেলে শূন্য যেন একটি কাচের আর্শি যেখানে দাঁড়িয়ে ধনাত্নক রাশি দেখতে পারে তার প্রতিচ্ছবি ঋণাত্নক রাশিকে। ধনাত্নক আর ঋণাত্নক সংখ্যা একে অন্যের সখা হয়ে গেল, তাদের মাঝে সৃষ্টি হল এক অবিচ্ছেদ্য প্রতিসাম্য। এযেন সৃষ্টিরই দ্বৈতরূপ—একদিকে ধন, আরেকদিকে ঋণ, একদিকে জন্ম, আরেকদিকে মৃত্যু—দু’টি একই বাস্তবতার বন্ধনে নিবিড়ভাবে আবদ্ধ।
‘শূন্য’ শব্দটি ইংরেজিতে ‘zero’ হল কেমন করে তারও একটা ইতিহাস আছে। শুরুতে ভারতে এর নাম ছিল ‘শূনিয়া’– যার অর্থ খালি, নেই, অবিদ্যমান, যা থেকে বাংলা নাম শূন্য। আরবরা সে ‘শূনিয়া’কে তাদের নিজেদের ভাষায় ‘সিফর’এ পরিণত করেন। পশ্চিম বিজ্ঞজনদের হাতে এসে আরব ‘সিফর’ ল্যাটিন গন্ধযুক্ত ‘সিফাইরাস’এ দাঁড়ায়, যা যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে একসময় ইংরেজি জিরোতে রূপান্তরিত হয়।
পরম শূন্য কোন স্থান নেই, ‘বিশ্বজগত শূন্যস্থান পরিহার করে’, ‘Nature abhor emptiness’। পরম শূন্যের কল্পনা কেবল আমাদের মনে, কিন্তু বিমূর্ত শূন্যের চিন্তা আমাদের জীবনকে আজো প্রভাবিত করে চলছে।
আগের পর্ব:
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন