মূল লেখক: অরুন্ধতী রায়।
মূল লেখা ইংরেজিতে, দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ প্রকাশিত
অনুবাদ: আইজান আব্রাহাম।
চীৎকারকে ছাপিয়ে যায় নীরবতা
ভারতীয় সরকার প্রায় ৭ লক্ষ কাশ্মীরীদের সকল যোগাযোগ থেকে বিছিন্ন করে রেখেছে, গৃহবন্দী অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে তারা
ইংরেজদের হাত থেকে মুক্তিলাভের ৭৩ তম বছরে স্বাধীনতা দিবস পালন কালে রাস্তায় রাস্তায় ছেলে-মেয়েরা বিভিন্ন আকৃতির পতাকা নিয়ে রাস্তায় নাচানাচি আর বিভিন্ন শব্দে বলতে থাকে মেরা ভারাত মহান হ্যায় (India is great)। বর্তমান প্রেক্ষাপট বিচার করলে এমন কিছু ভাবা বেশ দুষ্কর, আর বর্তমান শাসক গোষ্ঠী এর ওপর কালিমা লেপন করে দিয়েছে।
১৯৪৭ সালের (দেশভাগ) পর থেকে কাশ্মীর ভারতের সাথে যুক্ত। বিভিন্ন সময়ে কাশ্মীরিরা নিষ্পেষিত হয়ে আসছে। মৌলমানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত কাশ্মীর আজ অবরুদ্ধ।
নাগরিক অধিকার ক্ষুণ্ন হবার কারণে আজ তা কারাগারে রূপান্তরিত হয়েছে, সকল প্রকার যোগাযোগ ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন কাশ্মীরের ৭ লক্ষ মানুষ।
আগস্টের পাঁচ তারিখে ভারতীয় সংসদে ভারতীয় সংবিধান থেকে ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের প্রস্তাব আসে।
সংসদে প্রতিপক্ষের মতকে অগ্রাহ্য করেই তা উচ্চ ও নিম্নকক্ষের সম্মতিক্রমে তা পাসও হয়।
এর ফলে জম্মু ও কাশ্মীর তাদের নিজস্ব সংবিধান ও পতাকার অধিকার হারায় এবং এদের ভিতর যে সংহতি তা টুকরো হয়ে যায়।
এর ফলে যা হতে পারে-
প্রথমত:
এই রাজ্য দুটি কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক শাসিত হবে এবং নিজেদের ভোটে এরা জয়ী হলেও এদের সার্বভৌম যে ক্ষমতা তা আর থাকবে না।
দ্বিতীয়ত:
লাদাখ তার প্রশাসনিক ক্ষমতা হারাবে এবং সরাসরি দিল্লি থেকে নিয়ন্ত্রিত হবে।
এই আইন যখন সংসদে পাস হয় তখন ব্রিটিশদের আদলে ডেস্ক চাপড়িয়ে সাংসদগণ তার সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেন।
বাতাসে মৌ মৌ করে ঔপনিবেশিকতার গন্ধ, সাথে মানিবের স্বার্থে চুড়ান্তভাবে হাসিল হওয়ার আনন্দে ভরে যায় চারদিক।
এর ফলে এখন ভারতের জনগণ এখানে জমি কিনবে, আবাস গড়ে তুলবে। সাথে রিলায়েন্স কোম্পানির মালিক মুকেশ আম্বানি এ অঞ্চলের ভংগুর ইকো সিস্টেমের কথা বিবেচনা না করেই বিভিন্ন ধরনের ব্যাবসায়িক ঘোষণাও দিয়েছেন।
সরকার ও সাধারণ জনগণের কাশ্মীরে প্রবেশ করার অর্থই হলো কাশ্মীরিদেরকে তাদের ভিতরেই ভাগ করা এবং সংবিধানের ৩৫এর A অনুচ্ছেদ এর লংঘন, যেখানে পরিষ্কারভাবে কাশ্মীরিদের অধিকার সংরক্ষণ ও নিরাপত্তার বিষয় বর্ণিত আছে।
এই অনুচ্ছেদ লঙ্ঘন করার অর্থ হলো নিজের রাজ্যে এখন কাশ্মীরীদের দাসের মতো বাস করতে হবে আর নিজস্ব মৌলমানবিক অধিকার যে হারাবে তাতে সন্দেহ করার কিছু নেই।
ফলশ্রুতিতে বিষয়টা দাঁড়াবে ইসরাইলের মতো শাসন আর তিব্বতের মতো জনসংখ্যা বণ্টন নীতি।
এই সংবিধান ভাগ কিংবা অধিকার হারানোর ভয় কাশ্মীরিদের প্রথমথেকেই ছিল। আর তারা জানতো ট্রাম্পের দেখানো এই নীতির স্রোতে তারা ভেসেই যাবে।
কাশ্মীরকে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে নিয়ে আসার খবরে বিজেপির সদস্যরা শিশ বাজাতে থাকে, উল্লাসে ফেটে পড়ে। নানা মন্তব্য আসে, তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রথম শ্রেণির পত্রিকাগুলো একদমই চুপ থাকে এ বিষয়ে।
রাস্তায় রাস্তায় নৃত্য আর উল্লাস চলাকালেই খবর আসে কাশ্মীরিদের দুর্ভোগের তথ্য।
একইসময়ে দিল্লির পাশের রাজ্য হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী লিঙ্গ বৈষম্য নিয়ে সফলতার কথা বলছিলেন, আর মাঝখানে তিনি মজা করতে ছাড়লেন না। বললেন আগে আমাদের বাবা দাদারা বলতো বিহার থেকে মেয়ে নিয়ে আসবা, এখন তো তারা বলবে যাও কাশ্মীর থেকে মেয়ে নিয়ে আসো।
Here’s Haryana CM Khattar’s full video. Listen in and decide for yourselfhttps://t.co/atGLOEm1jk
— Manak Gupta (@manakgupta) August 10, 2019
সবকিছু চলতে থাকে, অতিরঞ্জিত উৎযাপনের মধ্যে কাশ্মীর শ্মশানের মতো নীরব হয়ে যাচ্ছে, হত্যা, নির্যাতন আর রাতের আঁধারে তাদের বুকে চলছে ছুরি। বীভৎস!
এই অধুনিক সময়ে হত্যা, গুম, গৃহবন্দী অবস্থা আর যোগাযোগ ব্যাবস্থার এই পরিস্থিতি আমাদেরকে বলে দিচ্ছে সামনে কী দিন অপেক্ষা করছে, কী ঘটতে চলেছে আগামীতে।
অনেকের মতে ১৯৪৭ সালে ইংরেজদের খেয়ালহীনভাবে করা দেশভাগের ফল হচ্ছে আজকের কাশ্মীর (রেফারেন্স: ৬) সাথে এটাও বলা হয়ে থাকে যে এটা পুরো ভারতবর্ষ ভাগের ফল। স্পষ্টত এখানে সমগ্র ভারতের যে ধারনা দেওয়া হয়েছে, যে বণ্টন ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে তা পুরোপুরি সঠিক নয়। অনেক রাজ্য-অঙ্গরাজ্য ছিল বা আছে যারা নিজেদের মধ্য আলোচনার মাধ্যমে সম্পর্কের উন্নতি করেছে এবং সমস্যার সমাধানও করেছে।
আর এখানে যে সমগ্রতার কথা বলা হয়েছে তার দরকার ছিল না এবং কাশ্মীর আদৌ এই সমগ্রতার মাঝে আসতে চায় নি। তাদেরকে জোর করে এই সমগ্রতার মাঝে নিয়ে আসা হয়েছে।
চলমান সময়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যে অবস্থা বিরাজমান, তা এই দেশভাগের কারণেই সৃষ্ট। আর সেইসময়ের ক্ষত আর আর যে যন্ত্রণা, তা এইসময়ের চলমান পরিস্থিতি আর যন্ত্রণাকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে এবং অবস্থার চরম অবনতি হয়েছে সেটা এক প্রকার নিশ্চিত।
অবস্থা এতো শোচনীয় যে, ১৯৪৭ সালের পর থেকে এমন কোন বছর নেই যে দেশগঠন (একাত্মকরণ)-এর নাম করে কাশ্মীর, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, মণিপুর, হায়দ্রাবাদ ও অসামে ভারত সরকার আগ্রাসন চালায়নি।
এই একাত্মকরণের ইতিহাস খুব করুণ। এর জন্য প্রায় ১০ হাজার মানুষ এ পর্যন্ত প্রাণ দিয়েছে সাথে দুই দেশ (ভারত-পাকিস্তান)-এর সীমান্তে আজও হত্যা চলমান।
এতে কোন সন্দেহ নেই, গত সপ্তাহে ভারতীয় সংসদে যে আইন পাশ হয়েছে তা চলমান অবস্থাকে আরো খারাপ করে তুলবে।
চলমান সংকটের শুরু রাজা হরি সিং থেকে তার ভংগুর নীতির ফলেই জম্মু ও কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিবাদ সৃষ্টি করে।
রাজা হরির বিপক্ষে বিদ্রোহ শুরু হয় ১৯৪৫ সালের দিকে এবং এটা বৃহতাকার ধারণ করে দেশভাগের পর। এসময় রাজ্যে (কাশ্মীর) বসবাসকারী অধিকাংশ মুসলমান হিন্দুধর্ম গ্রহণ করতে থাকে এবং একসময় রাজার সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়। তারপর বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয় এবং জম্মুতে ব্যাপক লুটতরাজ, হত্যা ও সহিংসতার ঘটনা ঘটে। ইতিহাস থেকে জানা যায় প্রায় ৭০ হাজার থেকে ২ লাখ মানুষ আশেপাশের রাজ্য ও বিভিন্ন স্থানে খুন হয়।
কাশ্মীরে চলমান ব্যাপক হত্যা ও নির্যাতনের খবর পাকিস্তানসহ অন্য রাজ্যে প্রকাশ পেলে জম্মু ও কাশ্মীর সীমান্তের পর্বত ঘেঁষে সেখানে সন্ত্রাসীরা প্রবেশ করে এবং রাজা হরিসিংকে আক্রমণ করে, অনেক আশ্রম ও বসবাসের জায়গা পুড়িয়ে দেয় সেখানে আতংক সৃষ্টি করে। নিরুপায় হরিসিং সেখান থেকে পালিয়ে যান এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেন। আর তখন থেকে মূলত দেশ একাত্মকরণের নামে সরকার এবং তার বাহিনী কাশ্মীরে প্রবেশ করার সুযোগ লাভ করে।
এরপরে ভারতীয় সেনারা সাধারণ মানুষের সাহায্য নিয়ে পর্বতের চারপাশ থেকে সন্ত্রাসীদের সরিয়ে দেয়। তবে এই সেনা আর সন্ত্রাসীদের কবলে পড়ে জম্মু এবং কাশ্মীর দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে।
এরপর বলা হয়, যে গণভোট হবে; সেটা কোনদিনও হয়নি। তারপর বলা হলো সাধারণ মানুষ তাদের ইচ্ছামত যে দেশে খুশি যাবে। এসব কিছুর মধ্য দিয়েই জন্ম নেয় উপমহাদেশের সবথেকে বড় রাজনৈতিক বিবাদ।
৭২ বছর চলে গেছে। ক্ষমতার পালা বদল হয়েছে, বার বার বিভিন্ন আইন আর নীতির পরিবর্তন হয়েছে; তবে কাশ্মীরী জনগণের সমস্যা সমাধানে যা হয়েছে তা একদমই নামমাত্র এবং তা সমস্যা সমাধানে কোন কাজেই আসেনি। এই সংকট কীভাবে এই অবস্থায় পৌঁছুলো এবং এটার পরিণতি কী তা বলা মুশকিল, তবে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে ১৯৫০-৬০ এর দশকে আমেরিকা ভিয়েতনাম এর মতোই।
একসময় কাশ্মীরে স্বাধীনতার দাবিতে অতি সাধারণ বা মৃদু আন্দোলন হতো। সেটা স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপ নেয় ১৯৮৯ সালে ব্যাপক এক কারচুপির নির্বাচনের পর। এরপর সেটি সহিংস অন্দোলনে রূপ নেয় এবং হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। কাশ্মীর হয়ে উঠে সেনাদের রাজ্য।
এরপর কাশ্মীরের অনেক যুবক-বৃদ্ধ পাকিস্তানি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী কর্তৃক সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নিতে থাকে। এসময় আবার অনেকে মৃত্যুবরণও করে।
এদের সাথে আফগানিস্তানের কিছু জনগণও যোগ দেয়। এভাবে কাশ্মীর নিয়ে উপমহাদেশের রাজনীতি গরম হয়ে উঠে। সবমিলিয়ে ইসলাম, আফগান ও পাকিস্তানিদের নিয়ে একরকমের ধর্মান্ধ জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটে।
এরপর বৃহৎ যে আঘাত আসে তা ১৯৯০ সালে যেখানে কাশ্মীর পণ্ডিত সংঘ সমিতির হিসাব মতে জঙ্গিরা প্রায় চারশো হিন্দু পুরোহিতকে হত্যা করে ২৫০০ পুরোহিত পরিবারকে সেখান থেকে উচ্ছেদ করে। তাদের বাসস্থান হারিয়ে তারা শত বাঁধা এবং বিপত্তির মুখোমুখি হয়, শুধু তারাই নয়; অনেক সাধারণ মুসলমানও এই জঙ্গি আগ্রাসনের শিকার হয়। KPPS এর মতে আরো ৬ শ পুরোহিত নিহত হয়েছে।
এরপর থেকেই অনেক পুরোহিত কাশ্মীরে রিফিউজির মতো বসবাস করে আসছে, কেউ তাদেরকে ঘরে ফেরায়নি এবং এরকম কোন প্রচেষ্টাও দেখা যায় নি।
পরে যা হয়েছে তা হলো, তারা সেখানে জাপ্টে বসে গেছে এবং কাশ্মীরে বসেই কাশ্মীরিদের প্রতি সেখানে ধর্মীয় অনুভুতির কথা বলে বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে। আর এটাই সেই অস্ত্র যা সেখানকার সব শান্তি বিলীন করে দিয়েছে।
সমসাময়িক সময়ে কাশ্মীর বিশ্বের সবথেকে বেশি সেনা অধ্যুষিত অঞ্চল। আর সেখানে বসবাসরত কাশ্মীরী জনগণকে বলা হচ্ছে তারা সন্ত্রাসী এবং সন্ত্রাসীদের দমনের অজুহাতেই সেখানে এই ব্যাপক পরিমাণ (৫০,০০০) সেনা মোতায়েন করা হয়েছে।
গত ত্রিশবছরে ভারত সরকার কাশ্মীরীদের সাথে যা করেছে তা আসলে ক্ষমার অযোগ্য এবং বর্ণনাতীত। দ্বন্দ্ব সংঘাতের রাজনীতি এ অঞ্চলের রাজনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। দিনেরপরদিন মানুষ আতংকের ভিতরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। এই দ্বন্দ্বের জেরে প্রাণ হারিয়েছে প্রায় ৭০ হাজার মানুষ এবং এখানে আবু গারিব কারাগারের মতো নির্যাতন চলানো হয়েছে। কারাগারে আটক রাখা হয়েছে ১০,০০০ হাজার মানুষ। কয়েকবছরে চলমান সহিংসতায় বুলেটের আগুনে চোখ হারিয়েছে অনেক তরুণ।
আন্দোলন সহিংসতায় রূপ নিয়েছে, অনেক কাশ্মীরী তরুণ তাদের স্বাধীনতার জন্য সেনাদের বিপক্ষে যুদ্ধে গেছে, কিন্তু আর ফিরে আসেনি; লাশ হয়ে ফিরে আসলে তারা কাশ্মীরী জনগণ এর কাছে উপাধি পেয়েছে শহীদ।
সেনাবাহিনী বা সেনাজীবনে অনেকের স্মরণীয় ঘটনা হলো তারা এমন অনেক ঘটনার সাক্ষী।
প্রথম দফায় মোদী যখন ক্ষমতায় আসেন তখন কাশ্মীরে সহিংসতার মাত্রা ভয়ংকরভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে আত্মঘাতী হামলায় কাশ্মীরে প্রায় ৪০ জন মানুষ জীবন হারায় (রেফারেন্স) তারই ফলশ্রুতিতে ভারত পাকিস্তানে বিমান হামলা চালায়। পাকিস্তানও এর জবাব দেয়, এর ফলে ইতিহাসে প্রথমবার দুই পরমাণু শক্তিধর দেশ একে অপরের সাথে বিমান হামলার নজির স্থাপন করে।
এবার নতুন মেয়াদে মোদী ক্ষমতায় আসার পর, মোদী তার সবথেকে বড় অস্ত্র প্রয়োগ করেছেন যা পূর্বের সকল ঘটনাকে এক অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছে। আর এটা এমনভাবে করেছেন তিনি শুধু ঘৃণার যোগ্য, যা করেছেন তা শুধু প্রতারণার সামিলই নয় পুরোপুরি অগ্রহণযোগ্য। গত জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে মোদী বিভিন্ন অযুহাতে কাশ্মীরে প্রায় ৪৫ হাজার সৈন্য পাঠিয়েছেন।
আর যেসকল ঘৃণ্য ঘটনার আশ্রয় তিনি নিয়েছেন তার একটা হলো ‘অমরনাথ যাত্রা’। এই অমরনাথ যাত্রায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সাধু-পুরোহিতরা আসেন এবং সেখানে শিবমন্দির প্রদক্ষিণ করেন, সাথে ব্যাপক জনসমাগম হয়। মোদী সরকার যা করেছে তা হলো তারা নাকী জানেন এখানে পাকিস্তানি সন্ত্রাসীরা হামলা চালাবে।
গত পহেলা আগস্টে ভারতীয় টিভি চ্যানেলে বলা হয় যে শিব মন্দিরের পাশে পাক সেনারা ল্যান্ডমাইন পুঁতে রাখছে। ২রা আগস্টে জরুরি অবস্থা জারি করা হয় এবং সকল দর্শনার্থীকে দ্রুততর সময়ের মধ্যে কাশ্মীর ত্যাগ করতে হয়। একটু হইচই হলেও সরকার অনুগত সাধু সংঘের সদস্য ছাড়া সাধারণ নাগরিক ও দর্শনার্থীদের কেউই কাশ্মীর ছাড়েনি।
এরপর রবিবার (৪ আগস্ট ২০১৯)থেকে কাশ্মীরের জনগণকে সকলপ্রকার যোগাযোগ থেকে বিছিন্ন করে গৃহবন্দি করা হয়। শত শত মানুষকে গ্রেফতার করা হয়, সাথে তাদের নেতা এবং আগের মন্ত্রীপরিষদ এর সদস্য ফারুক আব্দুল্লাহ ও তার ছেলে ওমর আব্দুল্লাহ ও মাহবুবা মুফতিকে গ্রেফতার করা হয়। বলা বাহুল্য এরাই সেই নেতাকর্মী যারা অনেক আগে থেকে কাশ্মীর ও সরকার এর মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করে আসছে।
সংবাদপত্রে বলা হচ্ছে কাশ্মীরী পুলিশের কাছ থেকে অস্ত্র কেড়ে নেওয়া হয়েছে। অথচ এই পুলিশেরা সরকারের কথামত অনেক সময় কাশ্মীরীদের বিপক্ষে কাজ করেছে, আত্মত্যাগ করেছে, হুকুম পালনের মধ্য দিয়ে ভারতীয় পতাকাকে উঁচিয়ে ধরেছে। আর অবস্থা এখন যখন বেগতিক, তখন সরকার তাদের কাছ থেকে অস্ত্র কেড়ে নিয়ে তাদেরকে বিপদের মুখে তুলে দিয়েছে এবং তারা নিরুপায়।
মিত্রদের সাথে প্রতারণা ও অশ্রদ্ধাবোধের যে পরিচয় মোদী দিয়েছেন তা নজিরবিহীন এবং তা যে ভারতীয় রাজনৈতিক চিন্তার পরিপন্থী ও সংকীর্ণ করেছে এতে সন্দেহ নেই। এতে করে নিজদের মধ্যেই মারাত্মক অসন্তোষ তৈরি হয়েছে আর অবস্থা আরো খারাপের দিকেই যাবে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে এখন সেনাদের না চাইলেও সাধারণ নাগরিকের সাথে সংঘর্ষে জড়াতে হচ্ছে এবং যেদিকেই তারা যাক না কেন, ফল বেশী ভালো হবে না।
কাশ্মীরের এই চলমান অবস্থার মধ্যে যেসব জঙ্গী আছে বা আগে থেকে যারা স্বাধীনতার দাবি তুলেছিল তারা যে শীর্ষস্থানীয় নেতাদের গ্রেফতারে খুশি হয়েছে তা বলা বাহুল্য। সাথে না চাইলেও ভারতীয় সরকার তাদেরকে একপ্রকার উস্কানিই দিয়েছে।
৮ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার ভাষণে জম্মু-কাশ্মীরকে সরাসরি কেন্দ্রীয় শাসনের অধীনে নিয়ে আসার ফলে কাশ্মীরবাসীদের কী কী উপকার হবে তার লম্বা ফিরিস্তি তুলে ধরেন।
কিন্তু তিনি এটা ব্যাখ্যা করে বললেন না, যে কাশ্মীরিদের সম্ভাব্য উন্নতি নিয়ে তিনি বক্তৃতা করছেন, সেই কাশ্মীরিদেকেই কেন তার ওই বক্তৃতার সময় খাঁচায় বন্দী করে রাখতে হচ্ছে। আর যে সিদ্ধান্তের ফলে কাশ্মীরিদের সমূহ উন্নতি হবে বলে তিনি বাকোয়াজ করছেন সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় কেন তাদের মতামত নেওয়া হলো না। তিনি এও ব্যাখ্যা করে বললেন না কীভাবে সামরিক দখলদারিত্বে থাকা একটি প্রদেশের জনগণ ভারতীয় গণতন্ত্রের মহান সব উপহার ভোগ করবে। তিনি তাদেরকে অগ্রিম ঈদ শুভেচ্ছা জানালেন কিন্তু তাদের বন্দীদশা কবে কাটবে তা জানালেন না। কাশ্মীর যেন আজ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কারাগার।
পরেরদিন ভারতের পত্রিকাগুলো এবং অনেক উদারপন্থী বুদ্ধিজীবি এবং মোদির সমালোচকও মোদির ওই ভাষণের প্রশংসা করলেন। ঠিক ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের মতোই ভারতের অনেকে যারা নিজেদের অধিকার ও স্বাধীনতা নিয়ে উচ্চকণ্ঠ তারাই আবার কাশ্মীরের জনগণের অধিকার নিয়ে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করছেন।
১৫ আগস্ট স্বাধীনতা দিবেসের ভাষণে মোদি দিল্লির লালকেল্লা থেকে দম্ভ ভরে ঘোষণা করলেন, “তার সরকার অবশেষ ভারতের ‘এক জাতি, এক সংবিধানের’ স্বপ্নকে বাস্তবে রুপ দিলো।” অথচ এর আগেরদিন সন্ধ্যায়ই উত্তরপূর্ব ভারতের কয়েককটি রাজ্যে বিদ্রোহীরা ভারতের স্বাধীনতা দিবস উদযাপনকে বয়কট করার ঘোষণা দেয়।
লালকেল্লায় যখন মোদির শ্রোতারা উল্লাস করছিলো তখনও কাশ্মীরের ৭০ লাখ মানুষ খাঁচায় বন্দি ছিলো। শোনা যাচ্ছে দুই সপ্তাহ ধরে পুরো দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন কাশ্মীরকে আরো বেশকিছু সময় ধরে বিচ্ছিন্ন থাকতে হবে। এরপর আস্তে আস্তে অচলাবস্থা কাটবে। ওই অচলাবস্থা কেটে যাওয়ার পর সূচনা হবে আরেকটি ভয়াবহ অধ্যায়ের। কাশ্মীরে যে সহিংসতা শুরু হবে তা ছড়িয়ে পড়বে ভারতজুড়ে।
কাশ্মীরে বিজেপি সরকারের আরোপ করা অচলাবস্থা কেটে যাওয়ার পর সেখানে যে সহিংসতা শুরু হবে তা ভারতের অন্যান্য অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়বে। আর একে পুঁজি করেই হিন্দুত্ববাদীরা পুরো ভারতজুড়েই মুসলিমদের ওপর আরো নিপীড়ন শুরু করবে। মুসলিমদের প্রতি শত্রুতা আরো বাড়বে। যে মুসলিমদেরকে ইতোমধ্যেই শত্রু হিসেবে চিত্রায়িত করে কোনঠাসা করে রাখা হয়েছে এবং আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে নিচের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। যাদেরকে নিয়মিতভাবে গণধোলাই দিয়ে হত্যাও করা হচ্ছে।
শুধু তাই নয়। মুসলিমদের বিরুদ্ধে অবিচারের প্রতিবাদকারী মানবাধিকার কর্মী, আইনজীবি, শিল্পী, শিক্ষার্থী, বুদ্ধিজীবি, সাংবাদিকদের ওপরও নিপীড়নের খড়গ নেমে আসবে। তাদেরও কণ্ঠরোধ করা হবে নৃশংসভাবে।
এছাড়া ভারতীয় গণতন্ত্রের ওপরও নেমে আসবে কালোছায়া। বর্তমানে ভারতের সবচেয়ে শক্তিশালি রাজনৈতিক সংগঠন হলো উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংগঠন আরএসএস। এই সংগঠনের রয়েছে ৬ লাখ সদস্য। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং তার সরকারের অনেক মন্ত্রীও এই সংগঠনের সদস্য। যাদের রয়েছে প্রশিক্ষিত মিলিশিয়া বাহিনী। ইতালির কুখ্যাত ফ্যাসিবাদি শাসক মুসোলিনির ব্ল্যাকশার্টের মতোই একটি সংগঠন এটি।
এখন থেকে প্রতিটি দিন আরএসএস ভারত রাষ্ট্রের সবগুলো গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান নিজেদের দখলে নিতে থাকবে। শক্ত হাতে সবগুলো প্রতিষ্ঠানে নিজেদের একচেটিয়া কর্তৃত্ব স্থাপন করতে থাকবে হিন্দুত্ববাদীরা। অবশ্য বাস্তবে আরএসএস ইতোমধ্যেই সেকাজে অনেকটা এগিয়ে গেছে। আর এই ধরনের সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের ছত্রছায়ায় বেড়ে উঠছে অনেক হিন্দুত্ববাদী উগ্র সংগঠন এবং দিনেরপরদিন তারা ভয়ংকর থেকে ভয়ংকরতর হয়ে উঠছে।
বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা একটি অন্যতম প্রধান কাজ। তবে বিজেপি জয়লাভ করার পরেরদিন পুর্বে RSS এর মুখপাত্র রাম মাধব বুদ্ধিজীবীদের তথাকথিত বলে আখ্যা দেন এবং তাঁদেরকে দেশের ভিতর থেকে বের করে দেওয়াসহ নিশ্চিহ্ন করে দেবার হুমকি দেন।
ভারতে প্রণীত নতুন আইনে সন্ত্রাসবাদের যে সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, সে সংজ্ঞায় সংগঠনকে বাদ দিয়ে সরাসরি ব্যক্তিকে যোগ করা হয়েছে। ফলে সরকার কোন ধরনের তথ্য সংগ্রহ চার্জশিট ও ট্রায়াল ছাড়াই ব্যাক্তির উপর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের দায়ভার চাপিয়ে দেওয়া হবে।
এর পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে আমাদের রসিক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন একমাত্র বন্দুকই পারে সন্ত্রাসীদের রুখতে। আর বর্তমান সময়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের যে গুজব ছড়িয়েছে তা ভয়ংকর। কারণ এই গুজবের কারণে অনেকে প্রাণ হারাবে এতে সন্দেহ নেই। আবার তিনি এও বলেন, যদি এই আইন পাশ হয় তবে আশা করছি কেউ এই আইনের বিরোধিতা করবে না।
আমাদের মধ্যে অনেকেই মনে করছে আমরাও বিপদে পড়তে পারি। তবে আমাদের কথা বাদ দিলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজেও গুজরাটের দাঙ্গা এবং হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী। এমনকী তার মামলার বিচারককে সন্দেহজনকভাবে হত্যা, তড়িঘড়ি করে নতুন আরেকজনকে নিয়োগ এবং দ্রুত মুক্তি তার নিজের অবস্থান সম্পর্কেও ধোয়াশার সৃষ্টি করেছে। সবকিছু মিলিয়ে বিশ্বের বুকে খুব দ্রুতই ভারতের বুকে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।
আমি গত ২৮ জুলাই আমার পরিচিতজনদর সাথে দেখা করতে কাশ্মীর যেতে চেয়েছিলাম। তাদের ভোগান্তি সম্পর্কে অবগত হতে চেয়েছিলাম। তবে আমার একজন কাছের বন্ধু একজন মুসলমান ডাক্তারের সাথে কথা বলছিলাম, কথা বলার এক পর্যায়ে দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েছিলাম।
কারণ হিসাবে বলতে পারি, আমাদের কথার এক পর্যায়ে দেশে চলমান নতুন অরাজকতা Jay Sree Ram (Lord Ram is great) নিয়ে কথা বলছিলাম। আর এর কারণে সৃষ্টি হওয়া বিশৃঙ্খলার বিষয়ও মাথায় ছিল।
এ পর্যায়ে ডাক্তার বন্ধু বলল তাকেও তো তারা জয় শ্রী রাম বলা নিয়ে আক্রমণ করতে পারে, কারণ তার পরিবার দিল্লী থেকে তিন চার ঘণ্টা দূরত্বে বসবাস করে। তখন আমি বললাম, তোমাকে জয় শ্রী রাম বলতে বললে তুমি বলবা, তখন সে বলল নাহ, আমি বলবো না, তুমি কী তাবরেজ আনসারীর কথা ভুলে গেছো। আমি বললেও তারা আমাকে মারবে, না বললেও মারবে।
এই হচ্ছে অবস্থা, বর্তমান ভারতে আমাদের আলোচনার বিষয় এসবই। তবে আমরা আশা করছি কাশ্মীর মাথা তুলে দাঁড়াবে, অবশ্যই তারা দাঁড়াবে।
দেখুন: The Guardians Video Documentory: The Hour of Lynching – vigilante violence in India
Arundhati Roy is the author of the novel “The Ministry of Utmost Happiness.” Her most recent book is a collection of essays, “My Seditious Heart.”
রেফারেন্স:
১) Modis Majoritarian March to Kashmir
২) Inside Kashmir, Cut Off From the World: ‘A Living Hell’ of Anger and Fear
৩) What Is Article 370, and Why Does It Matter in Kashmir?
৪) Murder of Insaniyat, and of India’s Solemn Commitment to Kashmir
৭) Here’s Haryana CM Khattar’s full video. Listen in and decide for yourself
৮) Inside Kashmir, Cut Off From the World: ‘A Living Hell’ of Anger and Fear
৯) Who Is to Blame for Partition? Above All, Imperial Britain
১০) Hyderabad 1948: India’s hidden massacre
১১) The Backstory of Article 370: A True Copy of J&K’s Instrument of Accession
১৩) The Backstory of Article 370: A True Copy of J&K’s Instrument of Accession
১৪) Pankaj Mishra: Death in Kashmir
১৫) Why Kashmiris want a fair probe into the killings of Pandits, prosecution of guilty
১৭) Kashmiri Pandits: Why we never fled Kashmir
২০) An Epidemic of ‘Dead Eyes’ in Kashmir as India Uses Pellet Guns on Protesters
২২) Before abolishing Article 370, Indian Army identified possible trouble spots in Kashmir
২৩) India boosts Hindu pilgrimage to holy cave in conflict-torn Kashmir
২৪) Leave Kashmir ASAP: J&K govt issues advisory for Amarnath yatra pilgrims and tourists
২৫) Mehbooba Mufti, Omar Abdullah arrested after scrapping of Article 370
২৬) Disarmed fall guys of Article 370
২৭) ভিডিও: PM Narendra Modi’s Address to the Nation, Abrogation of Article 370 in J&K, August 8, 2019
২৮) India’s Modi trumpets Kashmir, Muslim marriage moves in Independence Day speech
২৯) Kashmir effect: Rebel groups ban Independence Day celebrations in Northeast
৩০) Ajaz Ashraf, India’s Muslims and the Price of Partition
৩১) The Guardians Video Documentary: The Hour of Lynching – vigilante violence in India
৩২) Pankaj Mishra, The Other Face of Fanaticism
৩৩) How the RSS Became Involved In Running the Bhonsala Military School
৩৪) Railing Against India’s Right-Wing Nationalism Was a Calling. It Was Also a Death Sentence.
৩৫) This election result is a positive mandate in favour of Narendra Modi
৩৬) Back to the Future: India’s 2008 Counterterrorism Laws
৩৭) Rajya Sabha: UAPA Bill passed despite Opposition fears
৩৮) ভিডিও: Amit Shah’s speech in Rajya Sabha on UAPA bill
৩৯) Allowing the State to Designate Someone as a ‘Terrorist’ Without Trial is Dangerous
৪১) Jai Shri Ram: The Hindu chant that became a murder cry
৪২) Tabrez Ansari 18th mob violence victim in Jharkhand in three years