যে কোন উপন্যাসের প্রথম লাইন বিখ্যাত হলে সেটা বইয়ের মত আলাদা একটা মর্যাদা পায়। বাংলা উপন্যাসের প্রথম লাইন নিয়ে কোন লেখা আমার চোখে পড়েনি। ইন্টারনেট সার্চ ইঞ্জিনও এক্ষেত্রে তেমন কোন সহায়তা করতে পারেনি। ইংরেজি উপন্যাসের ক্ষেত্রে এমন তথ্য খুব সহজে জানা যায়। কিছু উপন্যাসের প্রথম লাইন আছে যেগুলো খুবই বিখ্যাত। বাংলার ক্ষেত্রে সেরকম কিছু পেতে এই ব্লগে জনপ্রিয় কিছু ঔপন্যাসিকের উপন্যাসের প্রথম লাইন সন্নিবেশিত করা হল।
উপন্যাসের ক্ষেত্রে প্রথম লাইন, ওপেনিং লাইন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একটা ‘কিলার ইন্ট্রো’র জন্য ভাল ওপেনিং লাইন মাস্ট। বিখ্যাত লেখকেরা প্রথম লাইনে অনেক চিরন্তন সত্য, দার্শনিক সত্য বা চমকপ্রদ কিছু দিয়ে শুরু করেন।
অনেক লেখকের জন্য যে কোন লেখার প্রথম লাইন লেখাটা নাকী খুবই কষ্টকর, ধৈর্য্যের ব্যাপার । কারো কারো এর জন্য জন্য দিন, মাস এমনকী বছর লেগে যায়, তবু প্রথম লাইনটা লেখা হয় না। তবে একবার শুরু হলে তখন দ্রুত লেখা এগোতে থাকে। কিন্তু শুরু করাটাই অনেক ঝামেলার, রাইটার্স ব্লক থাকলে সেটা কাটানো যায় না। কারো কারো হয়ত লেখার শুরুটা পছন্দ হয় না, একবার লেখে আবার কেটে ফেলে। এভাবে পছন্দ না হওয়া পর্যন্ত কাটাছেঁড়া চলতে থাকতে।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ঃ
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অনেক উপন্যাসের প্রথম লাইন মনে দাগ কাটার মত। তার ওপেনিং লাইনে নাটকীয়তা আছে, প্রথম লাইনকে তাই আগ্রহ উদ্দীপক কাহিনীর সূচনা বলে বুঝা যায়।
কেষ্টর মা মুড়ি-কড়াই ভাজিয়া, চাহিয়া-চিন্তিয়া, অনেক দুঃখে কেষ্টধনকে চৌদ্দ বছরেরটি করিয়া মারা গেলে, গ্রামে তাহার আর দাঁড়াইবার স্থান রহিল না। – মেজদিদি, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
আমার এই ভবঘুরে জীবনের অপরাহ্ন বেলায় ইহারই একটা অধ্যায় বলিতে বসিয়া আজ কত কথাই না মনে পড়িতেছে। – শ্রীকান্ত, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
একদিন বৈশাখের দ্বিপ্রহরে রৌদ্রেরও অন্ত ছিল না, উত্তাপেরও সীমা ছিল না। – দেবদাস, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
বৎসর পাঁচ-ছয় পূর্বে বাবুগঞ্জের বৈকুণ্ঠ মজুমদারের মুদীর দোকান যখন অনেক প্রকার ঝড়-ঝাপ্টা সহ্য করিয়াও টিকিয়া গেল, তখন অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করিল। – বৈকুণ্ঠের উইল, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
অপূর্বর সহিত তাহার বন্ধুদের নিম্নলিখিত প্রথায় প্রায়ই তর্ক-বিতর্ক হইত। – পথের দাবী, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
সেকালে হুগলি ব্রাঞ্চ স্কুলে হেডমাস্টারবাবু বিদ্যালয়ের রত্ন বলিয়া যে তিনটি ছেলেকে নির্দেশ করিতেন, তাহারা তিনখানি বিভিন্ন গ্রাম হইতে প্রত্যহ এক ক্রোশ পথ হাঁটিয়া পড়িতে আসিত। – দত্তা, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
এ পৃথিবীতে এক সম্প্রদায়ের লোক আছে, তাহারা যেন খড়ের আগুন। – বড়দিদি, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
বেণী ঘোষাল মুখুয্যদের অন্দরের প্রাঙ্গণে পা দিয়াই সম্মুখে এক প্রোঢ়া রমণীকে পাইয়া প্রশ্ন করিল, এই যে মাসি, রমা কই গা? – পল্লী সমাজ, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ঃ
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাসের প্রথম লাইনে তেমন চাঞ্চল্য নেই। ধীরে-সুস্থে গল্প শুরু করা, সাহিত্যিক মুন্সীয়ানা দেখানোর প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়।
প্রায় আড়াইশো বছর আগের কথা। – কপাল্কুণ্ডলা
৯৯৭ বঙ্গাব্দের নিদাঘশেষে একদিন একজন অশ্বারোহী পুরুষ বিষ্ণুপুর হইতে মান্দারণের পথে একাকী গমন করিতেছিলেন। – দুর্গেশনন্দিনী
বহুকাল বিস্মৃত সুখস্বপ্নের স্মৃতির ন্যায় ঐ মধুর গীতি কর্ণরন্ধ্রে প্রবেশ করিল। – কমলাকান্তের দপ্তর
বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত তিন বন্দোপাধ্যায়ের মধ্যে কারো উপন্যাসের প্রথম লাইন তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। তবে প্রথম লাইন থেকে তাদের গল্পের বিষয়বস্তু, এলাকা, আবহ সম্বন্ধে টের পাওয়া যায়। বিভূতিভূষণ গ্রাম-বাংলা নিয়ে লিখেছেন, তারাশংকর গ্রাম-বাংলার মধ্যে বিশেষ করে রাঢ় বাংলার লেখক। আর গ্রামীণ অথবা শহুরে শ্রমজীবী মানুষ এবং মনঃস্তত্ত্ব নিয়ে মানিক বন্দোপাধ্যায়। তার মধ্যে চিরায়ত ধারায় ধীরে-সুস্থে তারিয়ে গল্প বলার প্রবণতা দেখা যায়।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ঃ
নিশ্চিন্দিপুর গ্রামের একেবারে উত্তরপ্রান্তে হরিহর রায়ের ক্ষুদ্র কোঠাবাড়ী। – পথের পাঁচালী, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়।
শঙ্কর একেবারে অজ পাড়াগাঁয়ের ছেলে। -চাঁদের পাহাড়, বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়।
নদীর ঘাটে তালগাছের গুঁড়ি দিয়ে ধাপ তৈরী করা হয়েছে। -অশনি সংকেত, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়।
তারাশংকর বন্দোপাধ্যায়ঃ
হাঁসুলী বাঁকের ঘন জঙ্গলের মধ্যে রাত্রে কেউ শিস দিচ্ছে। – হাঁসুলী বাঁকের উপকথা, তারাশংকর বন্দোপাধ্যায়
পশ্চিম বাংলার রাঢ় দেশ – রাইকমল, তারাশংকর বন্দোপাধ্যায়
অনাবৃষ্টির-বর্ষার খররৌদ্রে সমস্ত আকাশ যেন মরুভূমি হইয়া উঠিয়াছে; সারা নীলিমা ব্যাপিয়া একটা ধোঁয়াটে কুয়াশাচ্ছন্ন ভাব; মাঝে মাঝে উত্তপ্ত বাতাস, হু হু করিয়া একটা দাহ বহিয়া যায়। – চৈতালি ঘূর্ণি, তারাশংকর বন্দোপাধ্যায়
বাংলা দেশের কৃষ্ণাভ কোমল উর্বর ভূমি-প্রকৃতি বর্তমান বেহারের প্রান্তভাগে বীরভূমে অকস্মাৎ রূপান্তর গ্রহণ করিয়াছে। -ধাত্রীদেবতা, তারাশংকর বন্দোপাধ্যায়।
মানিক বন্দোপাধ্যায়ঃ
খালের ধারে প্রকাণ্ড বটগাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়া হারু ঘোষ দাঁড়াইয়া ছিল। আকাশের দেবতা সেইখানে তাহার দিকে চাহিয়া কটাক্ষ করিলেন। – পুতুল নাচের ইতিকথা, মানিক বন্দোপাধ্যায়।
বর্ষার মাঝামাঝি। পদ্মায় ইলিশ মাছ ধরারর মরসুম চলিয়াছে। দিবারাত্রি কোন সময়েই মাছ ধরিবার কামাই নাই। – মানিক বন্দোপাধ্যায়, পদ্মানদীর মাঝি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরঃ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মানসম্মত উপন্যাসের সংখ্যা কম। তার লেখা উপন্যাসগুলোর প্রথম লাইনেও তেমন কোন কারিশমা নেই। ছোট ছোট লাইন দিয়ে শুরু। প্রথম লাইনে গল্পের চমক নেই বরং একটু একটু করে বর্ণনা দিয়ে গল্প ফাঁদার, প্লট সৃষ্টির প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়।
রাত্রি অনেক হইয়াছে। বাতাস বন্ধ হইয়া গিয়াছে। গাছের পাতাটিও নড়িতেছে না।- বউ ঠাকুরানীর হাট, রঠা।
অমিত রায় ব্যারিস্টার। ইংরেজি ছাঁদে রায় পদবী “রয়” ও “রে” রূপান্তর যখন ধারণ করলে তখন তার শ্রী গেল ঘুচে, কিন্তু সংখ্যা হল বৃদ্ধি। – শেষের কবিতা, রঠা।
রমেশ এবার আইন-পরীক্ষায় যে পাস হইবে, সে সম্বন্ধে কাহারো কোনো সন্দেহ ছিল না।- নৌকাডুবি, রঠা।
শ্রাবণ মাসের সকালবেলায় মেঘ কাটিয়া গিয়া নির্মল রৌদ্রে কলিকাতার আকাশ ভরিয়া গিয়াছে। – গোরা, রঠা।
বিনোদিনীর মাতা হরিমতি মহেন্দ্রের মাতা রাজলক্ষ্মীর কাছে আসিয়া ধন্না দিয়া পড়িল। দুই জনেই এক গ্রামের মেয়ে, বাল্যকালে একত্রে খেলা করিয়াছেন।- চোখের বালি, রঠা।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহঃ
আধুনিক ঔপন্যাসিকদের মধ্যে ওয়ালীউল্লাহর উপন্যাসের প্রথম লাইনে চমক আছে। প্রথম লাইনের প্রাকৃতিক বর্ণনা থেকে উপন্যাসের বিষয়বস্তু ও গল্পের একটা ভাল পটভূমি পাওয়া যায়।
শস্যহীন জনবহুল এ-অঞ্চলের বাসিন্দাদের বেরিয়ে পড়বার ব্যাকুলতা ধোঁয়াটে আকাশকে পর্যন্ত যেন সদা সন্ত্রস্ত করে রাখে। – লালসালু, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ
লোকটিকে যখন দেখতে পাই তখন অপরাহ্ন, হেলে-পড়া সূর্য গা-ঘেঁষাঘেঁষি হয়ে থাকা অসংখ্য যাত্রীর উষ্ণ নিঃশ্বাসে দেহতাপে এমনিতে উত্তপ্ত তৃতীয়শ্রেণীকে আরো উত্তপ্ত করে তুলেছে। -কাঁদো নদী কাঁদো, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ
মীর মশাররফ হোসেনঃ
তুমি আমার একমাত্র পুত্র। এই অতুল বিভব, সুবিস্তৃত রাজ্য এবং অসংখ্য সৈন্যসামন্ত সকলই তোমার। -বিষাদ সিন্ধু, মীর মশাররফ হোসেন।
কাজী ইমদাদুল হকঃ
কাজী ইমদাদুল হকের আবদুল্লাহ উপন্যাসের প্রথম লাইনে আকস্মিকতা আছে যেটা পুরো উপন্যাসের টোন সেট করে দেয়।
বিএ পরীক্ষার আর কয়েক মাস মাত্র বাকী আছে, এমন সময় হঠাৎ পিতার মৃত্যু হওয়ায় আবদুল্লার পড়াশুনা বন্ধ হইয়া গেল। – আবদুল্লাহ, কাজী ইমদাদুল হক।
সৈয়দ মুজতবা আলীঃ
মুজতবা আলীও প্রথম লাইনে ভাল মুন্সীয়ানা দেখিয়েছেন। শবনমের প্রথম লাইন থেকেই আমরা বুঝি ঘটনাস্থল কোন মুসলিম দেশ, যেখানে বাদশাহী সিস্টেম চালু আছে, এবং বাদশার নাম আমানুল্লা। দেশটাও তখন পাঠকের জন্য সহজ হয়। তারপরে বাদশার মাথা খারাপ। কী কারণে মাথা খারাপ? কেন মাথা খারাপ? সে কী করেছে? পাঠকের মনে ইত্যাদি নানা প্রশ্নের আবির্ভাব ঘটে।
বাদশা আমানুল্লার নিশ্চয়ই মাথা খারাপ। না হলে আফগানিস্থানের মত বিদকুটে গোঁড়া দেশে বল-ডান্সের ব্যবস্থা করতে যাবেন কেন? – শবনম, সৈয়দ মুজতবা আলী।
যাযাবরঃ
সাত ঘন্টা আকাশ্চারণের পরে উইলিংডন এয়ারপোর্টে ভূমি স্পর্শ করা গেল। – দৃষ্টিপাত, যাযাবর।
শওকত ওসমানঃ
আলী আজহার খাঁ মহেশডাঙার মামুলি চাষী। – জননী, শওকত ওসমান।
জহির রায়হানঃ
মস্ত বড় অজগরের মতো সড়কটা এঁকেবেঁকে চলে গেছে বিস্তীর্ণ ধানক্ষেতের মাঝ দিয়ে। – হাজার বছর ধরে, জহির রায়হান
একটু পরে হোস্টেলের ভেতরে কয়েকটা কাঁদুনে গ্যাস ছুড়ে মারলো- আরেক ফালগুন, জহির রায়হান।
জাহানারা ইমামঃ
সরকার এখন সবকিছু স্বাভাবিক দেখাবার চেষ্টা করছে। – একাত্তরের দিনগুলি, জাহানারা ইমাম।
আলাউদ্দিন আল আজাদঃ
আল আজাদের উপন্যাস তেইশ নম্বর তৈলচিত্রের প্রথম লাইনে অনেক চিত্রকল্পের সমাহার। প্রথম লাইনের মাধ্যমে পাঠককে একটা পার্টির মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দিয়ে তার উতসুক্য জাগিয়ে দেয়া হয়।
রঙ বেরং গাউন, শাড়ি ওড়নার খসখস, পালিশ করা কালো চকচকে জুতোর মচমচ, বিচিত্র কণ্ঠনিঃসৃত সংলাপের ঐকতান, এখন আর নেই। – তেইশ নম্বর তৈলচিত্র, আলাউদ্দিন আল আজাদ।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াসঃ
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস তার খোয়াবনামা উপন্যাসে অন্যদের মত ছোট লাইন ব্যবহার না করে দীর্ঘ লাইন দিয়ে শুরু করেন, ফলে প্রথম লাইনেই আমরা কাদামাটিতে গাঁথা প্রাকৃতিক পরিবেশে উপন্যাসের নায়ক তমিজের বাপের সাক্ষাৎ পেয়ে যাই।
পায়ের পাতা কাদায় একটুখানি গেঁথে যেখানে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গলার রগ টানটান করে যতোটা পারে উঁচুতে তাকিয়ে গাঢ় ছাই রঙের মেঘ তাড়াতে তমিজের বাপ কালো কুচকুচে হাত দুটো নাড়ছিলো, ঐ জায়গাটা ভালো করে খেয়াল করা দরকার। – খোয়াবনামা, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস।
তোমার রঞ্জু পড়ি রইলো কোন বিদেশ বিভুঁয়ে, একবার চোখের দ্যাখাটাও দেখতি পাল্লে না গো। – চিলেকোঠার সেপাই, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস।
আহমদ ছফাঃ
আহমদ ছফার গাভী বিত্তান্তের প্রথম লাইনে চমক আছে, পাঠককে উদ্দীপ্ত করে গল্পের ভেতরে প্রবেশ করিয়ে দেয়ার মত। বাকি উপন্যাসগুলো গতানুগতিক ধারা অনুসরণ করে ছোট ছোট বাক্যের মাধ্যমে গল্প সৃষ্টি করে।
আবু জুনায়েদের উপাচার্য পদে নিয়োগপ্রাপ্তির ঘটনাটি প্রমাণ করে দিল আমাদের এই যুগেও আশ্চর্য ঘটনা ঘটে। -গাভী বিত্তান্ত , আহমদ ছফা।
তোমার একটা নাম আছে। – অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী, আহমদ ছফা।
আমাদের কিছু জমিজমা ছিল। -ওঙ্কার, আহমদ ছফা।
হুমায়ুন আজাদঃ
হুমায়ুন আজাদের উপন্যাসের বেশিরভাগ শুরুটা চমকপ্রদ। এক লাইনের হলে সেটায় নাটকীয়তা থাকে। একটু বড় লাইন হলে তার থেকে মোটামুটি একটা ধারণা পাওয়া যায়।
আমরা হচ্ছি গরিব জনগণ, সাধারণ মূর্খ মানুষ; আমরা রাজাবাদশা রাজনীতি প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি এইসব জিনিশের কী বুঝি! – রাজনীতিবিদ্গণ, হুমায়ুন আজাদ।
আমি ব্রিজ বানাই; বলতে পারতাম সেতু বানাই, তবে সেতু কথাটি, অন্যদের মতোই, সাধারণত আমিও বলি না, বলি ব্রিজ; – ব্রিজ বললেই ব্যাপারটি স্পষ্ট হয় আমার কাছে, চোখের সামনে ব্যাপারটি আর বস্তুটি দাঁড়ানো দেখতে পাই। – সব কিছু ভেঙে পড়ে, হুমায়ুন আজাদ।
শুভব্রত সেই প্রথম রাজগৃহে ভ্রমণে যায়, যখন তার দশ বছর। – শুভব্রত তার সম্পর্কিত সুসমাচার, হুমায়ুন আজাদ
আমি সম্ভবত দণ্ডিত মানুষ, আমি কবি। – কবি অথবা দণ্ডিত অপুরুষ, হুমায়ুন আজাদ।
আমরা ইছলামি জিহাদে বিশ্বাস করি। – পাক সার জমিন সাদ বাদ, হুমায়ুন আজাদ।
শহীদুল জহিরঃ
বাংলা সাহিত্যের জাদু-বাস্তবতার ঔপন্যাসিক শহীদুল জহির, তার উপন্যাসের প্রথম লাইনেই বুঝতে পারা যায়। প্রথম লাইনেই বুঝা যায় গল্প খুব ধীরে-সুস্থে এগোবে, গল্পকারের যেন কোন তাড়াহুড়ো নেই। জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতার সাথে মার্কেজের ‘হান্ড্রেড ইয়ারস অফ সলিচুড’ এর প্রথম লাইন তুলনীয়।
উনিশ শ পঁচাশি সনে একদিন লক্ষ্মীবাজারের শ্যামাপ্রসাদ চৌধুরী লেনের যুবক আবদুল মজিদের পায়ের স্যান্ডেল পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গতি বিধানে ব্যর্থ হয়ে ফট করে ছিঁড়ে যায়। – জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা, শহীদুল জহির।
গ্রামের লোকেদের সে রাতের চাঁদের কথা মনে পড়ে এবং তারা সেই চাঁদের বর্ণনা দেয়। – সে রাতে পূর্ণিমা ছিল, শহীদুল জহির।
তসলিমা নাসরিনঃ
তসলিমা নাসরিনের উপন্যাসেও প্রথম লাইনে তেমন চমক নেই। একমাত্র উতল হাওয়ায় সেরকম কিছু করার চেষ্টা দেখা যায়।
সুরঞ্জন শুয়ে আছে, মায়া এসে বারবার তাড়া দিচ্ছে দাদা ওঠ, কিছু একটা ব্যবস্থা কর। – লজ্জা, তসলিমা নাসরিন।
মেট্রিক পরীক্ষার ফরম পুরণ করে জমা দেবার পর বাংলার মাস্টার চারফুট এক ইঞ্চি বেড়ালচোখি দ্য ভিঞ্চি কল্যাণী পাল বলে দিলেন তোমার পরীক্ষা দেয়া হবে না। – উতল হাওয়া, তসলিমা নাসরিন।
চারদিন হল এরকম হচ্ছে। – শোধ, তসলিমা নাসরিন।
এই ব্লগে যে কয়জন বাংলা ঔপন্যাসিকের লেখা উল্লেখ করা হলো তাতে বলা যায় বাংলা উপন্যাসে চমকপ্রদ, মনে রাখার মত প্রথম লাইন খুব কম। বেশির ভাগ লেখক ছোট ছোট গতানুগতিক লাইন দিয়ে গল্প শুরু করেছেন যাতে প্রথম লাইনে প্রকৃতির বর্ণনা বা প্লট ছাঁদা ছাড়া তেমন কোন উদ্দেশ্য নেই। এদের মধ্যে শরতচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সৈয়দ মুজতবা আলী, হুমায়ুন আজাদ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, শহীদুল জহির এদের উপন্যাসের প্রথম লাইনে চমকপ্রদ নাটকীয়তা আছ।
বাংলা উপন্যাসে ইংরেজি উপন্যাসের ন্যায় উদ্ধৃত করার মত তেমন প্রথম লাইন বিরল বা নাই বললেই চলে। তুলনার জন্য কিছু ইংরেজি উপন্যাসের বিখ্যাত প্রথম লাইন নীচে উদ্ধৃত করা হলো।
জেইন অস্টেন এর ‘প্রাইড এন্ড প্রেজুডিস’ এর প্রথম লাইনটি একটা সার্বজনীন সত্যের রূপ নিয়েছে। ‘এটি একটি সর্বজন মান্য সত্য যে কোন ব্যাচেলরের যদি অনেক সম্পদ থাকে তাহলে তার একটা বউ দরকার’। 😛
It is a truth universally acknowledged, that a single man in possession of a good fortune, must be in want of a wife. —Jane Austen, Pride and Prejudice (1813)
লিও টলস্টয়ের ‘আনা কারেনিনা’ উপন্যাসের প্রথম লাইন পড়লে মনে হয় যেন একটা চিরন্তন সত্য পড়ছি। ‘সব সুখী পরিবার একই রকম; সব অসুখী পরিবার তাদের নিজ নিজ ভাবে অসুখী’।
Happy families are all alike; every unhappy family is unhappy in its own way. —Leo Tolstoy, Anna Karenina (1877; trans. Constance Garnett)
অথবা, চার্লস জনসনের লেখা ‘মিডল প্যাসেজ’ উপন্যাসের প্রথম লাইন, ‘ যা বুঝলাম যেসব বিষয় মানুষকে সমুদ্রে ঠেলে পাঠায়, তারমধ্যে সবচেয়ে কমন আপদ হলো মেয়েমানুষ’।
Of all the things that drive men to sea, the most common disaster, I’ve come to learn, is women. —Charles Johnson, Middle Passage (1990)
মার্গারেট এটউড এর ‘ক্যাট’স আই’ উপন্যাসের প্রথম লাইন একটা বৈজ্ঞানিক সত্য, ‘সময় রৈখিক নয়, বরং মাত্রিক, যেমন স্থানের একটা মাত্রা’।
Time is not a line but a dimension, like the dimensions of space. —Margaret Atwood, Cat’s Eye (1988)
সালমান রুশদীর উপন্যাস ‘স্যাটানিক ভার্সেস’ এর প্রথম লাইন, “আকাশ থেকে পড়ার সময় জিব্রাইল ফেরেশ্তা গাইল, ‘আরেকবার জীবিত হতে হলে তোমাকে আগে মরতে হবে’”।
“To be born again,” sang Gibreel Farishta tumbling from the heavens, “first you have to die.” —Salman Rushdie, The Satanic Verses (1988)
উপন্যাসের প্রথম লাইন ছোট হলেও অনেক শক্তিশালী এবং ইউনিক হতে পারে। এরমধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হেরমান মেলভিল বিখ্যাত উপন্যাস ‘মবি ডিক এর প্রথম লাইন, ‘আমাকে ইসমাইল বলে ডাকতে পার’। এরকম একটা সিম্পল লাইনের মাধ্যমে ইসমাইলকে দিয়ে মেলভিল আমাদেরকে তার ম্যাগনাম ওপাস এর কাহিনী শুনান।
Call me Ishmael. —Herman Melville, Moby-Dick (1851)
আলব্যের কামু’র দ্য স্ট্রেঞ্জার উপন্যাসের প্রথম লাইনও অনেক বিখ্যাত। ‘আজ মা মারা গেলেন’। পরের লাইনটা আরো চমকপ্রদ, ‘ নাকী গতকাল, আমি জানি না’।
Mother died today. —Albert Camus, The Stranger (1942; trans. Stuart Gilbert)
কার্ট ভনেগাটের বিখ্যাত উপন্যাস স্লটারহাউস ফাইভ এর প্রথম লাইন। ‘এসব কিছু ঘটেছে, কম-বেশি’। প্রথম লাইনেই কেমন যেন একটা অস্পষ্টতা দিয়ে শুরু।
All this happened, more or less. —Kurt Vonnegut, Slaughterhouse-Five (1969)
স্যামুয়েল ব্যাকেটের লেখা মার্ফি’র প্রথম লাইন, ‘গত্যন্তর না থাকায় চির পুরাতন এ জায়গায় সূর্য আবার উঠেছিল’।
The sun shone, having no alternative, on the nothing new. —Samuel Beckett, Murphy (1938)
উইলিয়াম গ্যাডিস এর ‘এ ফ্রলিক অফ হিস ওন’ এর প্রথম লাইন, ‘বিচার? – সেটা পরকালে পেতে পার, এ জগতে আইন পাবে’।
Justice?—You get justice in the next world, in this world you have the law. —William Gaddis, A Frolic of His Own (1994)
প্রথম লাইন অনেক বড়ও হতে পারে। যেমন চার্লস ডিকেন্সের এ টেইল অফ টু সিটিজ এর প্রথম লাইন। এ লাইন দেখে মনে পড়া স্বাভাবিক যে অনেকে বলেন, চার্লস ডিকেন্স প্রকাশকের কাছ থেকে শব্দ প্রতি টাকা পেতেন। 😛 তাই বেশি শব্দ লেখার প্রতি তার একটা ঝোঁক ছিল।
It was the best of times, it was the worst of times, it was the age of wisdom, it was the age of foolishness, it was the epoch of belief, it was the epoch of incredulity, it was the season of Light, it was the season of Darkness, it was the spring of hope, it was the winter of despair. —Charles Dickens, A Tale of Two Cities (1859)