০
১৬৮৯ বার পঠিত
একটি মৃতদেহ পড়ে আছে নিথর; মাথার কাছে জমাট বাধা রক্ত। আশেপাশের লোকজন দুঃখ করছে।
– আহারে বড় ভালো লোক ছিলো।
একজন খেঁকিয়ে ওঠে, একজন খেরেস্তানের মৃত্যুতে এতো কান্দাকাটির কিছু নাই। এর বাপে মুসলমান ছেলো। চার্চের টেকাটুকা নিয়ে সে খেরেস্তান কাফের হইছে।
কিছু লোক প্রভাবিত হয়; মৃতদেহের ধর্ম খতিয়ে দেখা খতিবের বয়ানে। কিছু লোক তবুও মন থেকে মেনে নিতে পারে না এই মৃত্যু। লোকটার একটা মুদি দোকান ছিলো; সেইখানে বাকির খাতায় অসংখ্য মুসলমানের নাম। এমন কী একটু আগে মৃতদেহ হয়ে পড়ে থাকা মুদি দোকানীকে যে লোকটি কাফের বলে ফতোয়া দিলো; তার নামটিও ঝলমল করছে সেখানে।
পুলিশের গাড়ি আসে; বাঁশি দেয় উপস্থিত জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে। সাংবাদিকরা ছবি তুলতে থাকে। বিরস বদনে এক সাংবাদিক বলে, আইজ আরেকটা ভিআইপি খুন হইচে; এই ডেডবডি কাভারেজ পাবেনানে কয়া রাকলাম।
মৃতদেহটি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়। মৃতদেহের স্ত্রী পুলিশকে অনুরোধ করে, আর লাশ কাটছিরা করি লাভ কী! মন্ত্রী কয়া দিবে, বিচ্ছিন্ন ঘটনা; অযথা লাশডা আরো শতবিচ্ছিন্ন কইরেন না।
পুলিশ কর্মকর্তা বুঝিয়ে বলে, বৃটিশ আমল থিকা যে সিস্টেম চইলা আসতেছে; সেইডা আমি বন্ধ করনের কেডা! আমরা তো চাকরী করি। ওপরের হুকুম তামিল করি।
মৃতদেহের বাড়িতে হাতীদের পা পড়তে থাকে। নানা রাজনৈতিক দলের নেতারা গভীর সমবেদনা জানাতে আসে। শোকে বিহ্বল পরিবারটিকে সান্ত্বনা দেবার ফাঁকে ফাঁকে; কেউ দেখে বাড়িটা, মনের মধ্যে বাড়িটা দখলের কালো কেউটে কিলবিল করে। কারো চোখ খুঁজে ফেরে এ বাড়িতে কোন যুবতী মেয়ে আছে কীনা; থাকলে একটু ডেকে নিয়ে সান্ত্বনা দেয়া যায়। যুবতী মেয়েকে সান্ত্বনা দেবার লোভের কেঁচোর মতো আঙ্গুলগুলো নিশপিশ করে। কেউ বা খোঁজে খেরেস্তানের বাড়িতে একটু খুশীজল যদি মেলে।
এইভাবে মৃতদেহের বাড়িটি একটি উৎসবের বাড়ি হয়ে ওঠে।
ওদিকে হাসপাতালের লাশকাটা ঘরে মৃতদেহের বাবা আসে। মুচকি হাসে।
– তোকেও কুপিয়েছে রে! আমি তো বাঁচার জন্য মুসলমান হইছিলাম; তা-ও তো একাত্তরের যুদ্ধে পাকিস্তানী মুসলমান সেনাদের হাতে ঠিকই মারা পড়লাম। তোর মায়েক ধরি লিয়া গ্যালো ক্যাম্পে। আর তার খোঁজ মেলেনি। তা তুই খৃস্টান হই কী লাভ পালুক!
– আব্বা! তোমার মৃত্যুর পর আমি বুঝে গেলাম মুসলমান-মুসলমান ভাই ভাই এসব বাকোয়াজ। আর মিশনারি স্কুলে পড়তাম, ভাবলাম এই ধর্মে যদি একটু শান্তি পাই।
– ও হয়নারে। আমার বাপের সেই বনজঙ্গলের জীবনই সুখের ছিলি। মন খারাপ হলি গাছের কাছে যেতো। মন ভালো থাকলি চাঁদের আলোয় হাঁটতো নদীর পাড়ে। মা সবসুমায় পূজা-আর্চা করতো। একদিন বৃটিশেরা তাদের উচ্ছেদ করি দিলো। বুললি উন্নয়ন হবে। বাপ আমার উচ্চবর্ণের হিন্দু বাবুদির কাছে যাইয়্যা বিপদের কথা জানালি। তারা তো নমঃশূদ্র বলি দূর দূর করি তাড়ায় দিলো আমার বাপেক।
এরপরেও বাপ-কাকারা বৃটিশ পুলিশের সঙ্গে যার যা ছিলো তাই লিয়ে যুদ্ধ করিছিলি। শেষ রক্ষা হয়নিরে। বৃটিশ পুলিশ গুটা এলাকার পুরুষ মানুষের এগেন্সটি মামলা ঠুকি দিলি। জেলখানায় মরি গেলি তোর দাদা। তারপর দেশভাগ হলি। বুঝনু, বাঁচতে হলি মুসলমান হতি হবি!
– মুসলমান হলিই যে বাঁচা যাবি সে শিউরিটি কতি! আইজতো একজন পর্দানশীন মুসলমান নারীকেও আমার মতো করি খুন করিছে। তার দুটি শিশুর কান্দা সওয়া যায়না।
হঠাত মর্গে এসে ঢোকে মৃতদেহের দাদা।
– কেমন আছিসরে ডেডবডি! নাহ টিভি টকশো’তে তোর কথা কিছুই বললো না।
– দাদা অনেকদিন ধরেই দেখছি। মিশনারি স্কুলে স্যার যেমন ব্ল্যাকবোর্ডে একটা অংক মুছে আরেকটা অংক কষতেন, তারপর সেটা মুছে আরেকটা; তেমনি এক একটা ঘটনা-মৃত্যুর খবর মুছে আরেকটা ঘটনা-মৃত্যুর অংক কষে মিডিয়ার ব্ল্যাকবোর্ডে; আমাদের বুদ্ধিজীবী স্যারেরা। এরা তো মনেও রাখে না কতজন এভাবে মরলো। আমার মুদি দোকানের বাকীর খাতাটাই ভালো। সব লেখা থাকে; কিছুই মুছিনা।
– এরা খুব উচ্চবর্ণের লোক। সুমিষ্ট করি কথা বুলে। একজন আরেকজনের দলেক দোষ দেয়। এরা ঠিক বুদ্ধিজীবী নয়রে। এরা হচ্ছি পরে ধামাচাপাজীবী। বৃটিশ আমলেও এরম উচ্চবর্ণের হিন্দু আর আশরাফ মুসলমান ধামাচাপাজীবী ছিলো। তারা আমাদের উচ্ছেদের ঘটনাটা ধামাচাপা দিয়ে দিইছিলো।
মৃতদেহের আব্বা বলে, পাকিস্তান আমলেও এরকম রাজাকার ছিলো; যারা আমার লাশ বধ্যভূমিতে পুঁতে পুরো হত্যার ঘটনাটা ধামাচাপা দিইছিলো। এইজন্যেই ওদের অনেকে বদমায়েশি করে বলে, মুক্তিযুদ্ধে অল্পমানুষ মারা গিছে। ঐ যে আমার মতো কতো লাশ গায়েব করে দিয়ে তারপর থিকে ধামাচাপা দিয়ে দিয়েছে।
মৃতদেহের দাদা জিজ্ঞেস করে, তা তুই কী করিছিলিরে নাতি যে তোক মাইরলো; তুই কী ফেসবুকে কারো পোস্টে লাইক দি অনুভূতি না কী জানি বুলে তাত আঘাত দিছিস! তুই কী সেতার শুনিস রেডিওত! নাকি বিজ্ঞান পড়িস! নাকী তুই খৃস্টান হইছিস বুলি এই মৃত্যুদণ্ড! নাকী কোন নেতাক তোর মুদির দোকানের বাকী শোধ দিতে কইছিস! তুই একটা মুদি দোকানী; তুই আবার ভুল করি বাউল গান গাইয়ি ফেলিসনিতো। তোর দিদিমার গানের গলা সুন্দর ছিলিরে। পদ্মার পাড়ে চাঁদনী রাতে সে আমাক গান গাই শুনাতো; তোর দিদিমার গলার সুরে সুরে নিওর সরি যেতো; ভোর হোতো; ওর কপালের সিঁদুরের মতো লাল সূইরযো উঠতো!
মৃতদেহের বাড়িতে সহানুভূতি জানাতে আসা মানুষের সংখ্যা কমতে থাকে। বাড়তে থাকে অমানুষের সংখ্যা। গলা খাঁকারি দিয়ে এক নেতা গোছের লোক বলে, এইখানে তুমাদের পরিবার নিরাপদ নয়। তুমরা খেরেস্তান মিশনারিতে গিয়া ওঠো।
নেতা তার এক সাইডকিককে জিজ্ঞেস করে, এই এলাকায় হিন্দু-খেরেস্তানদিগের আর কত মৌজা জমি বাকি আছেরে!
– প্রায় হয়্যা আসছে বুরহান ভাইয়া।
এক পাণ্ডা এসে খবর দেয়, এই বাড়িত বুম্বাই ফিলিমের হিরোইন থাকে ওস্তাদ! মিশনারি স্কুলে গান গাইতে দেকচি।
ওস্তাদের চোখে চাপা উত্তেজনা। সবাই প্রায় সমস্বরে বলে ওঠে, বুম্বাইয়ের হিরোইন!
ওস্তাদ সবাইকে চুপ করতে বলে। মৃতদেহের মায়ের কাছে যায়। কণ্ঠে মধু মাখিয়ে বলে,
– আন্টি আপনেরা এই বাড়িত থাকেন। উপরে গড; নীচে আমরা আপনার সন্তানেরা।
মৃতদেহের স্ত্রী এই ভীষণ বিপদে; সারাদিনের কান্নার ক্লান্তিতে খড়কুটোর মতো আঁকড়ে ধরে নেতাটির পাঞ্জাবীর হাতা।
– বাবা তুমরা আমার সন্তানের মতো। তুমরা ছাড়া তো আমাদের আর কেউ নেই বাবা।
ওদিকে মসজিদ গরম করে ফেলেছে সেই লোকটি; মৃতদেহের মুদী দোকানের বাকির খাতায় যে লোকটির নাম লেখা আছে; যে লোকটি সবাইকে শোকে বাধা দিয়ে মৃতদেহটিকে কাফের বলে ফতোয়া দিয়েছিলো,
– মুসলমানের দেশে কাফের থাকপি ক্যা! বাপের দেশে যাউক। আপনেরা একটা সিদ্ধান্তে আসেন। চক্ষের সামনি ইসলামের ক্ষতি হইতেছে চাইরপাশে; এরে রক্ষা করতি গেলি; এইসব কাফের তাড়াতি হবি।
নেতা গোছের লোকটি মৃতদেহের স্ত্রীকে প্রস্তাব দেয়, আপনার মিয়ের শরীর ভালো ঠেকতিছে না। হাসপাতালে না নিয়া গেলি সর্বনাশ হইয়ি যাইতে পারে। আপনার শেষ সম্বল এই মিয়ে; আমারে বইনের মতোন।
সারাদিন কেঁদে-পানিটুকু স্পর্শ না করে প্রায় অসাড় হয়ে যাওয়া তরুণীটিকে হাসপাতালে নিয়ে যাবার কথা বলে একটা বনভূমিতে নিয়ে যায় একপাল শৃগাল। বনভূমির মধ্যে শৃগালের উল্লাসে টুপটাপ করে শুকনো পাতা ঝরতে থাকে। গাছের শাখায় হঠাত ঘুমভাঙ্গা পাখীদের চোখ অশ্রুর বৃষ্টিতে ভিজতে থাকে।
হাসপাতালের লাশ কাটাঘরে হঠাত চিৎকার করে উঠে বসে মৃতদেহ।
– দাদা, আব্বা আমাদের আবার কোন সর্বনাশ হচ্ছে। আমি কেন জানি স্বপ্নের মধ্যি মায়ের চিৎকার শুনলাম; দেকলাম সেই পাকিস্তানী আর্মির ক্যাম্পের জানলা থিকে আম্মা ডাকতিছে।
তিনজন পাগলের মতো দৌড়াতে থাকে।
– গড পথ দ্যাখাও!
– আল্লাহ রাস্তা দ্যাখাও!
– ও ভগবান কোথায় যেতে হবে বলো!
তিনজন দৌড়াতে দৌড়াতে পৌঁছে যায় নদীর ধারের বনভূমিতে। আচমকা মুদী দোকানীকে দেখে সবাই ভুত দেখার মতো করে পালায়। মুদি দোকানীর বাবা-দাদা স্নেহের চুমু দেয় তাদের বংশের শেষ চিহ্ন তরুণীটির কপালে। মেয়েটি চোখ খুলে তাকায়,
বনভূমির পাখীরা এসে অসংখ্য পালক রেখে যায় তরুণীর পাশে। হিন্দু-মুসলমান-খৃস্টান হয়েও মানুষের ভালোবাসা পেলোনা যে তিনটি মানুষ; তারা তাদের উত্তর প্রজন্মের পিঠে পাখীর পালক গেঁথে দিতে থাকে। চারপাশে পাখিরা জীবনের উৎসব করে; কিচির মিচির করে মানবী পাখীটিকে তাদের জগতে স্বাগত জানায়। পাখীর গানে যেন ইন্দ্রজাল ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে। পাখীদের সঙ্গে উড়ে যায় মানুষের হিংস্র জঙ্গলে কোনমতে প্রাণে বেঁচে যাওয়া মানবী।
উত্তরনারীর ডানা মেলে ভোরের আকাশে উড়ে যাবার পথের দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে পিতা-পিতামহ-প্রপিতামহ।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন