গল্পটা লিখছিলাম একজন চেনা মানুষের জীবন থেকে। আমি খুব ভালো শ্রোতা। আমি লিখার অনুমতির পেয়েছি শুধুমাত্র আমার প্রতি তার আস্থার জোরে। জানিনা কতোটুকু সেই আস্থার যোগ্য আমি। সে যখন তার শৈশব আর কৈশোরের কথা আমাকে বলছিলো, তখন তার দুচোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়ছিলো।
আর আমি শুধু ভাবছিলাম, জন্ম দিলেই বাবা মা হওয়া যায় না। একটু একটু করে বাবা মা হয়ে উঠতে হয়। সন্তানকে ছুঁতে জানতে হয়। কজন বাবা মা সেই চেষ্টা করেন। এই দিবসগুলো বোধহয় সবচেয়ে বেশি বাবা মা হিসেবে আমাদের রিফ্লেক্ট করবার সুযোগ করে দেয়।
ভাবছিলাম আর এক ধরনের আতঙ্ক আমাকে গ্রাস করছিলো। এতো বড় দায়িত্ব তো স্রষ্টা আমার হাতেও অর্পণ করেছেন। পারবো কি?
“তোমার এ পতাকা যারে দাও তারে বহিবারে দাও শক্তি”।
ফাদার্স/মাদার্স ডে;
আজকাল ‘ফাদার্স ডে’, ‘মাদার্স ডে’ এই দিনগুলো আসছে ভাবলেই আতংক লাগে আমার। আমাদের ছোটবেলায় এগুলোর চল ছিলো না বললেই চলে। আর থাকলেই কি? ছোটবেলায় আমি বড়ই হয়েছে বাবা-মায়ের দুন্দুমার ঝগড়াঝাটি দেখে। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা, ঈদ পরব বাদ যেতো না কিছুই।
হয়তো বড় আগ্রহ করে সবাই মিলে ঈদের জামা বানাতে বের হয়েছি। তখন আবার জামা কেনার চেয়ে বানানোর চলই ছিলো বেশি। প্রথমে পরিচিত দর্জির দোকানে বসে ক্যাটালোগ দেখে জামার ডিজাইন পছন্দ করা। সেই ডিজাইন দেখে, মাপ নিয়ে কতোখানি কাপড় লাগবে সেটা দর্জি জানিয়ে দিলে তারপর পছন্দের কাপড় কেনা। এটুকু পর্যন্ত যদি বাবা-মায়ের ঝগড়া না লেগে সব ঠিকঠাক থাকতো তবে সেটা ছিলো চরম ভাগ্যের ব্যাপার। তবে সেই সৌভাগ্য খুব বেশিক্ষন স্থায়ী হতো না। কাপড়ের দোকানে যেয়েই শুরু হতো কাক-চিল পালানো ঝগড়া। কে দেখলো, কে শুনলো সেই হিতাহিতজ্ঞান হারাতো দু’জনেই। ছোট্ট আমি চোখ বন্ধ করে, নিজের ছোট্ট শরীরটাকে পারলে হাওয়ায় মিশিয়ে দিতে চাইতাম। বাবা-মা দু’জনকেই বলতে চাইতাম ” আমার ঈদের জামা লাগবে না, তবুও তোমরা ঝগড়া করো না”। আমার গলা দিয়ে একটি শব্দও বের হতো না। কেউ যেন দু’হাত দিয়ে চেপে ধরতো।
কখনো মনে হতো বাবার দোষ আবার কখনো মনে হতো মায়ের দোষ। দোষ যারই হোক শৈশবকে আর মনে করতে চাই না আমি। তবুও এইসব দিনে সবকিছু ফ্ল্যাশব্যাকের মতো ফিরে ফিরে আসে।
বাড়িওয়ালার মেয়েটি ছিলো আমার প্রায় সমবয়সী,বড্ড আদুরে টাইপ। একদিন ওর বিদেশে থাকা চাচাতো বোনের জন্মদিনের ছবি দেখালো আমাকে। আমাদের চেয়ে বছর দু’য়েকের বড় একটি ফুটফুটে মেয়ে। পরীর মতো অনেক ঘেরঅলা, থাকথাক ডিজাইনের প্রায় মাটি ছোঁয়া একটা সাদা জামা পরে আছে। কাঁধের সামান্য নীচে নেমে আসা চুলগুলো কেমন যেন প্যাঁচানো প্যাঁচানো। তার মাথার উপর কি সুন্দর একটা মুকুট পরা।
বাড়িওয়ালার মেয়ের চোখদুটো তার চাচাতো বোনের গর্বে জ্বলজ্বল করছে। বরাবরের আদুরে ঢং বাদ দিয়ে খুব গর্বিত গলায় সে জানালো চুলগুলো না কি একটা বিশেষ মেশিন দিয়ে এরকম প্যাঁচানো হয়েছে, আর মাথার মুকুটটি পুরো খাঁটি সোনার। গায়ের জামাটি না কি স্পেশাল অর্ডার দিয়ে বানানো। এতে প্রায় হাজার খানেক পাথর আর মুক্তো বসানো। এতো কারুকাজ করতে যেয়ে জামাটি না কি এতো ভারি হয়ে গিয়েছিলো যে ওর বোন জামা পরেই কেঁদে ফেলেছিলো। পরে অবশ্য অনেক বুঝিয়ে কেকটা কাটার পরপরই সাদা জামা চেঞ্জ করে সেকেন্ড জামাটা পরাতে রক্ষা। পুরো পার্টিতে ও মোট চারবার জামা চেঞ্জ করেছে। ওগুলোর ছবি অবশ্য বাড়িওয়ালার মেয়ের কাছে নেই। তবে লাল, নীল আর বেবি পিংক- জামার রংগুলি ও জানে।
বাড়িওয়ালা মেয়ের গল্প আমি ভিতরে ভিতরে গোগ্রাসে গিলছি, কিন্তু উপরে খুব একটা বুঝতে দিচ্ছি না। তাহলে আবার ও আমাকে ছোঁচা ভাববে। আমারও যে খুব শখ একটা সাদা জামা পরে জন্মদিনের কেক কাটার এটাও বলা যাবে না। তাহলে বলবে আমি ওর কাজিনের দেখাদেখি এটা করছি। বাড়িওয়ালার মেয়েটা আবার কেমন যেন সব কথার অন্য মানে করে।
তবে আগে আরও ছোট থাকতে আমার বন্ধু আর পাড়া প্রতিবেশীদের নিয়ে আমার জন্মদিন হতো। তখন আমরা অন্য শহরে থাকতাম তো, তাই সে খবর বাড়িওয়ালার মেয়ে জানেনা। জন্মদিনে আমার নতুন জামাও বানানো হতো। বাবার চাকরিটা চলে যাবার পর আমরা এই শহরে চলে এসেছি। তারপর থেকে আর আমার জন্মদিন হয় না। মামা আর চাচারা মিলে এখন আমাদের তিনজনের পরিবারটাকে টানছে। ভদ্রচিতভাবে যেটুকু না হলেই নয় সেটুকুই আমাদের জীবনে এখন উপস্থিত। সেখানে জন্মদিন করাটা বিশেষ মানায় না।
আমি বয়সে এতো ছোট না যে সেটা বুঝিনা। প্রায়ই এখানে সেখানে ধারদেনা করা নিয়ে আব্বা-আম্মার ঝগড়া শুনি। আবার এতো বড়ও হইনি যে, জন্মদিন উদযাপনের বিষয়টা মাথা থেকে মুছে ফেলবো।
প্রতিমাসেই আশা করে থাকি, এইবার বোধহয় আব্বার সদ্য শুরু করা ব্যবসাটা লাভের মুখ দেখবে আর অনেক ধুমধাম করে আমার এবারের জন্মদিনটা হবে। এতো পাথর বসানো বা অনেক থাকওয়ালা না হলেও মোটামুটি একটা সাদা জামা আর ছোট্ট একটা কেক হলেই আমি খুশি।
দেখতে দেখতে আমার জন্মদিন এসে গেলো। কোন আয়োজনেরই খবর নেই। গত পরশুও শুনেছি আব্বার না কি বড় একটা বিল আটকে আছে। মায়ের ভাষায় ‘সব ভাঁওতাবাজি”। আমি কিন্তু মনে মনে আব্বাকে বিশ্বাস করতে চাইছি। আব্বার ‘বড় বিল’ কথাটার মাঝে আশা আছে, আম্মার ‘ভাঁওতাবাজি” কথাটার মাঝে আশা নেই, নিষ্ঠুর সত্য আছে।
ঠিক জন্মদিনের বিকেলেই আমার চোখের ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিলো। খুব আশায় ছিলাম হয়তো চোখের ডাক্তারের কথা বলে আব্বা আমাকে কোন বই বা খেলনার দোকানে নিয়ে চমকে দেবে। নাহ! রিক্সা এসে ডাক্তারের চেম্বারের সামনেই থামলো। ডাক্তার চোখ দেখে চশমা দিলেন। উনার চেম্বারের সাথেই চশমার দোকান। চশমার কথা শুনে আব্বার মুখ শুকিয়ে গেছে। বারবার মুখে বলছেন, “এতো ছোট বয়সে চশমা”? কিন্তু আমি ভিতরে ভিতরে বুঝতে পারছি, চশমা না, আব্বার মূল চিন্তা টাকা নিয়ে। ডাক্তারের ফি আর চশমার দাম শুনে এবার আব্বা তার মোক্ষম এবং শেষ অস্ত্রটা ছুঁড়লেন (শুরুতে এসে উনি কার বন্ধু, কার আত্নীয় এগুলো বলে খানিকটা অ্যাডভান্টেজ নেবার চেষ্টা করেছেন)।
“ডাক্তার সাহেব আজকে আমার মেয়েটার জন্মদিন। কিছু কম রাখা যায় না”।
ডাক্তার সাহেব একটু চুপ করে বললেন, “চশমার দামের ব্যাপারে আমার করার কিছু নেই। তবে ফি আমি কিছু কমিয়ে রাখছি”। আমি আমার মুখ নামিয়ে রেখেছি মাটির দিকে, প্রাণপনে চোখের পানি আটকাচ্ছি। পারছি কই? আমার দু’কান দিয়ে যেন আগুনের হল্কা বের হচ্ছে। তবে আশার কথা চোখের সমস্যার কারণে আজকাল আমার চোখ দিয়ে অনবরত পানিও পড়ে। কোনটা অপমানের অশ্রু আর কোনটা চোখের অসুখজনিত অশ্রু সেটা নিশ্চয়ই ডাক্তারের দোকানের লোকগুলো আলাদা করে বুঝতে পারবে না।
মনে মনে ঠিক করলাম ফেরার পথে আব্বার সাথে আর একটাও কথা বলবো না। বইয়ের দোকানে নিয়ে যেতে চাইলেও যাবো না। বইয়ের পোঁকা আমি। আমার জন্য এই পণ বিশাল ব্যাপার। কিন্তু আব্বা দেখি রিক্সাওয়ালাকে বাসার দিকে যেতে বলে উনার সাথেই গল্পে মেতে গেলো।
বাসায় এসে গটমট করে ভিতরে ঢুকে গেলাম। কানে আসলো আব্বা আম্মার সাথে গল্প করছেন, ‘বুঝলা, চশমার আজকাল যা দাম। তার উপর আমি বললাম যে টা বেষ্ট সেটাই দিন। শুধুমাত্র ডাক্তার আমার পরিচিত বলেই কিছু কম রাখলো”। আমি গল্পগুলো শুনতে চাচ্ছিলাম না, প্রাণপণে ভুলতে চাচ্ছিলাম আজ আমার জন্মদিন। এভাবে কতোক্ষন পার হয়েছে জানি না।
হঠাৎ পাশের বাসার আংকেলের গলা পেলাম ড্রইংরুমে। আমি তড়াক করে লাফিয়ে উঠলাম। আংকেল মানেই সাথে থাকবে মুন্না, আংকেলের পাঁচ বছর বয়সী ছেলে। আমার খুব ভক্ত। আমি দৌড়ে ড্রইংরুমে ঢুকে দেখি মুন্না নেই শুধু আংকেল বসে আছেন। আমার বিমর্ষ মুখ দেখে আংকেল বললেন, “সরি মা, মুন্নাকে নিয়ে আসতে চেয়েছিলাম, কিন্তু ও হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়েছে। তবে ও তোমাকে একটা জিনিস পাঠিয়েছে” বলে সুন্দর র্যাপ করা একটি চারকোনা বাক্স বাড়িয়ে দিলেন আমার দিকে। আমি তো হতভম্ভ। বক্স হাতে নিয়ে আম্মার অনুমতির অপেক্ষায় বসে আছি। আংকেলই বললেন খুলে দেখো। খুলতেই দেখলাম কি সুন্দর লাল টকটকে একটা ফাউন্টেনপেন আর উপরে বাচ্চার ছবি দেয়া বড় একটা অ্যালবাম। অ্যালবামের প্রথম পাতা উল্টাতেই মুন্নার একটা ছবি, পাশের খোপে একটা হ্যাপি বার্থডে লেখা ভিউকার্ড। আমার খুশিতে যেন দমবন্ধ হয়ে আসছিলো। আংকেল আন্টি আমার জন্মদিন মনে রেখেছেন। একমাত্র ডাক্তারের ফী কমানোর সময় ছাড়া সারাদিনে এই প্রথম কেউ আমার জন্মদিন কথাটি উচ্চারণ করলো। নিজেকে সাদা ফ্রক পরা বিদেশে থাকা সেই মেয়েটির চেয়েও বেশী ভাগ্যবান মনে হলো।
আমার পরের দুটো দিন গেলো অ্যালবাম আর কলমটা নেড়েচেড়ে। তৃতীয় দিনে মুন্নার ছবি আর ভিউকার্ডটি বের করে আমার হাতে দিয়ে অ্যালবামটি নিয়ে আম্মা তার কাঁচের শো-কেসে তালাবদ্ধ করতেই আমার মনের ভিতর কূ ডাক দিলো। বাচ্চাদের এসব অনুভূতি খুব প্রবল হয়। দু একবার অ্যালবাম আর কলমের কথা জানতে চাইলে আম্মা বললেন, থাক ওগুলো যত্নে আছে। পরের মাসেই এক ছুটির দিনের বিকেলে আমরা আম্মার এক মামাতো ভাইয়ের বাচ্চার জন্মদিনে গেলাম সেই অ্যালবামটি নিয়ে। আমি মুন্নার দেয়া উপহারটি রাখার জন্য অনেক কাঁদলাম। শুনলাম ঘরে যথেষ্ট প্রাইজবন্ড না থাকায় সাথে আরও একটা কিছু না দিলে না কি আম্মার মান সম্মান থাকবে না। তাই অ্যালবামটা সাথে দেয়া।
সেদিনের পড়ে কেন যেন আর লাল ফাউন্টেনপেনটিরও কোন খোঁজ নেই নি, নিতে ইচ্ছে করে নি। আমার ইচ্ছে অনিচ্ছেগুলোর মুল্য কতোখানি সেটা আমি খুব অল্প বয়সেই কিভাবে যেন বুঝে গেছি।
বুঝে গিয়েছিলাম আম্মার ভাই-বোনের ছেলেমেয়েদের দাম আম্মার কাছে আমাদের চেয়ে অনেক বেশি। ছোটবেলায় সবাই একসাথে খেলতে খেলতে গন্ডগোল হলে, কোনকিছু না শুনেই আম্মার বিচার ছিলো আমিই দোষী। অন্যান্য খালাতো ভাইবোনদের সামনেই পিঠে পড়তো নির্দয় পিটুনি। আব্বার বাকি পড়া বিলের ক্ষোভ যেন আম্মা আমার পিঠের উপর ঝাড়তেন।
ধীরে ধীরে বড় হলাম। এমন আরও হাজারো ঘটনা আছে, লিখতে গেলে উপন্যাস হয়ে যাবে। প্রাপ্তবয়স্ক হবার আগেই নিজের দায়িত্ব নিজে নেয়া শিখতে হলো। দু’একবার বুভুক্ষের মতো চেষ্টা করেছি সম্পর্কটা গাঢ় করতে। কিন্তু একসময় দেখলাম আমার একলা অর্জিত সাফল্য ব্যবহৃত হচ্ছে আব্বার সমাজের বিভিন্ন জায়গায় সুবিধা নেবার হাতিয়ার হিসেবে। আর আম্মা আমার সমসাময়িক সুবিধাপ্রাপ্ত ছেলেমেয়ের প্রাপ্তির সাথে আমার প্রাপ্তির তুলনা করে অসুখী। কেন আরও কিছু করলাম না এই জীবনে। ‘অমুক’ তো তার বাবা মায়ের জন্য এটা করেছে, সেটা করেছে। বুঝলাম আমার জীবনের এই অংশটুকু একলা চলাই আমার নিয়তি। তাই দেশ ছাড়তে এতোটুকুও কষ্ট হয় নি।
আলহামদুলিল্লাহ, বাবা-মা দু’জনেই এখনো জীবিত আছেন। বিদেশ থেকে নিয়মিত যোগাযোগ, খোঁজখবর, প্রয়োজন মেটানো সাধ্যমতো সবই করি। দুবার এখানে ঘুরেও গেছেন। কিন্তু কোথায় যেন বাঁধনটা বড্ড আলগা হয়ে গেছে। নাড়ির সম্পর্ক আর টানেনা আমাকে। স্বার্থপর বলবেন তো? বলুন! এখন আর কষ্ট পাইনা।
শুধু কষ্ট পাই যখন দেখি সবাই তার মা কিংবা বাবাকে জড়িয়ে ধরে ছবি দিচ্ছে, সুন্দর সুন্দর স্মৃতি শেয়ার করছে, তাদের সঙ্গ মিস করছে। এমন সম্পর্কের জন্য আমার বড্ড লোভ হয়। পুরনো অ্যালবাম ঘেটে স্টুডিওর কিছু কাঠ হয়ে দাঁড়ানো নিস্প্রাণ ছবি আর স্মৃতি বারবার হানা দেয়। আজকাল আমি উনাদের জন্য দোয়া করতেও ভয় পাই
“রাব্বির হাম হুমা কামা রাব্বায়ানি সাগীরা”
-হে আমার প্রতিপালক! আমার পিতা-মাতার প্রতি দয়া করো, যেমন তারা দয়া, মায়া, মমতা সহকারে শৈশবে আমাকে প্রতিপালন করেছিলেন”
আমি চাইনা আমার শৈশবের মতো উনাদের বার্ধক্যের সময়টুকু কাটুক।