পরীক্ষকেরও পরীক্ষক থাকা খুব দরকার। নাহলে কাজকর্মে ফাঁকির সম্ভাবনা। ভেবেছিলাম ঘৃতকুমারী বা ‘এলো ভেরা‘ র একটি গল্প করে পার পেয়ে যাবো, কিন্তু হল না। চারদিকে পরীক্ষক খুব কড়া। ফাঁকি দেওয়ার জো নেই।
প্রায়ই ভাবি বিজ্ঞানের তথ্য ভরা বৃহৎ কলেবরের প্রবন্ধ বুঝি মানুষকে ক্লান্ত করে আর হাই ওঠায়। একে প্রবন্ধ সাহিত্য, তার ওপর বিজ্ঞান। এইধরনের লেখার ধারেকাছে খুব একটা কেউ ঘেঁষতে চায় না। এই মহাব্যস্ততার যুগে এত মানুষ ধৈর্য ধরে যে আমার হাতিদীর্ঘ (নাতিদীর্ঘের বাজার চলতি বিপরীত শব্দ!) লেখা পড়েন তারজন্য আমি সত্যিই তাঁদের সকলের কাছে বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ।
এদিকে বাংলাদেশে আমার এক অলস বোন (অলস বলেছি, জানি কপালে দুর্ভোগ আছে, তবু্ও সত্য কথা কইয়া দিলাম) ও কোলকাতা পুলিশের দায়িত্বশীল এক ভীষণ ব্যস্ত ভাই দু‘জনে দু‘রকম কারণেই আমাকে নোটিশ দিয়েছে প্রায় এভাবে –
“লেখাগুলোকে হেলথ ড্রিঙ্ক খাইয়ে খাইয়ে দূরদর্শনে দেখানো বিজ্ঞাপনের বাচ্চা করছ কেন? ওরা গায়েগতরে ও আড়েবহরে একটু কম হলে ও একটু রোগা রোগা হলে তোমার কি খুব কষ্ট হয় দাদা?”
মা তারা হয়তো দাঁড়াবার জায়গা ঠিক দেখিয়ে দেবে কিন্তু আপনারাই বলুন তো এখন আমি দাঁড়াই কোথায়! ওদের দুজনের কথা মাথায় রেখেই আগের লেখায় একটু পাশ কাটানোর চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু বামাল ধরাপড়ে গেলাম শক্ত শক্ত সব পরীক্ষকদের হাতেই। তাঁদের বক্তব্য – “পুরো ফাঁকি মেরেছ। আসল বস্তু দাও নাই! সে জিনিশ কই?”
আবার কেউকেউ আক্ষেপ করেছেন, “এখানে আপনাকে ঠিক আগের মতো করে পাওয়া গেলো না”। শ্যাম এবং কুলকে একসাথে কীভাবে যে রাখা যায় তার কায়দা তো শুধু একজনই জানতো। এখন আমি যে কী করি!
যাইহোক, সোস্যাল মিডিয়াকে স্কুল–কলেজ বানানোর অসৎ উদ্দেশ্য আমার কোনদিনও ছিল না। এখনোও নেই। সে দায়িত্ব ইতোমধ্যে আরো বহু লোক নিয়ে নিয়েছে।
আমি কেবল আপনাদের সাথে গল্প করি। তবে এখন বেশ বুঝেছি গল্পও একধরনের মাদক। নেশার বস্তুতে টান পড়লে মানুষ অভিযোগ করতেই পারেন। তাতে তাঁদের কোনমতেই দোষ দেওয়া যায় না। অতএব আর বেশি কথা না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আসল বস্তুতেই ফেরা যাক ও তাকে ফিরিয়ে দেওয়া যাক।
ঘৃতকুমারী – নামটা বড় অদ্ভুত। বাংলা নামটায় ‘ঘি‘ এর সাথে ‘কুমারী‘র যোগ কীভাবে হলো জানতে ইচ্ছা হয়। কিন্তু কোন উপায় নেই। দু‘একজনকে জিজ্ঞেস করেও কোন সদুত্তর পাইনি। উল্টো তারা বলেছে, নামের কারণ খুঁজতে গেলে সেখান থেকে বেরুনো কঠিন হবে। এই যে আম, জাম, কুল ও জামরুল ইত্যাদি, তাদেরইবা নামটি কেন – আম, জাম, কুল ও জামরুল? বলতে পারো বকুলইবা কেন হবে ফুল?
সাধে কী আর মহাকবি শেক্সপিয়ার বলেছেন – What’s in a name!
আমের নাম যদি জাম আর জামের নাম যদি হতো আম তাহলে তোমার কী খুব অসুবিধা? তুমি জামের নামে আম খাবে আর আমের নামে জাম। তাই নাম নিয়ে বেকার মাথা ঘামিয়ো না।
বুঝলাম– সব্বোনাশ, কার কাছে কী জানতে এসেছি! বলে কীনা নাম কিচ্ছু না। এদিকে যে গোটা দুনিয়াটা দেখছি নামের ফেরেই ঘুরে মরছে আর নামটাকে সামনে আনার জন্য জিভ বার করে প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে সবাই!
যাইহোক বেশ বুঝেছি, নাম যেমন কারণে হয় তেমনি অকারণেও হয় ৷ তাই আমাদের ঘি কুমারী নাহয় সেই অকারণেরই – ঘৃতকুমারী আর উদ্ভিদ বিজ্ঞানীর Aloe vera।
প্রায় কাণ্ডবিহীন এক উদ্ভিদ। পাতা আছে কিন্তু তা পাতার মতোও না, অদ্ভুত দর্শনের এই মরু উদ্ভিদটির আদি নিবাস আরবের মরু অঞ্চল হলেও আফ্রিকা এবং এশিয়াসহ পৃথিবীর সব উষ্ণ ও নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলেই এদের পাওয়া যায়।
ক্যাকটাস বা মরু জাতীয় উদ্ভিদের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো – এদের মূল বা শিকড় সাধারণত গাছটির যে অংশ মাটির বাইরে তার থেকে অনেক লম্বা। দূর থেকে জল সংগ্রহ করতে হয় বলে তাকে এমন লম্বা হতে হয়। তাই এই ব্যবস্থা। কিন্তু ঘৃতকুমারী এ ব্যাপারে পুরো ব্যাতিক্রম, তার মূল অন্যান্য মরু উদ্ভিদের তুলনায় অনেক কম বা ছোট। তাছাড়া এর রসালো পাতায় পত্ররন্ধ্র বা Stomata- র সংখ্যাও তুলনামূলকভাবে বেশ কম। দুষ্প্রাপ্য ও কষ্টার্জিত জল বাষ্পমোচন বা প্রস্বেদন (Transpiration)-এর মাধ্যমে যাতে বেরিয়ে যেতে না পারে তারজন্য পাতার কিনারা কাঁটায় রূপান্তরিত। লাখো কোটি বছরের অভিযোজন ও অভিব্যক্তির ফল। উদ্ভিদটি শরীরের মধ্যে যে পরিমাণ জল রাখে সেই পরিমাণ জলই হয়তো তাকে কেউ কোনদিনই দেয় না বা সে প্রকৃতি থেকেও পায় না। তবু্ও সে বেঁচে থাকে। মৃত্যুঞ্জয়ী এই উদ্ভিদটি উদ্ভিদকুলের এক বিস্ময়।
এদের ফুল, ফল ও বীজ হয়। বীজের দ্বারা বংশবিস্তার হলেও অঙ্গজ জনন বা গাছ থেকে চারাগাছ হয় যথেষ্টই। তাই এর ফুল, ফল ও বীজ নিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনা হলেও প্রকৃত বংশবৃদ্ধিতে তার তেমন কোনো গুরুত্ব নেই।
অমর এই গাছটিকে একবার বাড়িতে এনে একটু মাটি বা বালিমাটি দিয়ে একটা টবে বসালে তারপর এক দু‘বছর যদি তার কথা ভুলেও যান এবং জল–টল না দিতে পারেন তাহলে আক্ষেপ করবেন না। অপরাধবোধেও ভুগবেন না এই ভেবে যে, ‘আহারে! কেষ্টর জীবটাকে শখ করে বাড়িতে ডেকে আনলাম কিন্তু একটু জল খেতেও দিলাম না বছরভর, পাপ হয়ে গেলো‘। তার দরকার নেই। দু‘এক বছর পরেও গিয়ে দেখবেন আপনি তাকে ভুলে গেলেও সে কিন্তু আপনাকে দেখবে বলে অপেক্ষা করে আছে তার ছানা–বাচ্চাসহ।
এই কারণে এর অপর নাম অমর উদ্ভিদ বা অমরত্বের গাছ – Plant of Immortality। আবার এই নাম দ্ব্যর্থকও হতে পারে। কারণ, মানবদেহে এর গুণাগুণের নিরিখেও হতে পারে তার এই নাম।ঘৃতকুমারীর বিজ্ঞানসম্মত নাম– Aloe vera।
Aloe – Genus বা গণ, vera – Species বা প্রজাতি।
গণ ও প্রজাতি মিলিয়েই বিজ্ঞানসম্মত নাম হয়। সেটাই নিয়ম। তাই – Aloe vera।
সারা পৃথিবীতে Aloeগণের কমবেশি ৪০০ প্রজাতি আছে, Vera – তেমনই এক প্রজাতিমাত্র। আর Aloeগণের বাইরেও উদ্ভিদটির কাছাকাছি চরিত্রের উদ্ভিদও আছে প্রচুর ও অগুণতি।
Asphodelaceae গোত্রের এই উদ্ভিদ পুরু ও রসালো পাতার মধ্যে যে ‘জেল‘ বা হড়হড়ে রস রাখে, তাকে বলে Aloe Gel। পাতার মোট আয়তনের প্রায় সবটাই Aloe Gel। থেঁতলে বা পিষলে তা বের হয়ে আসে। এই Aloe Gel হল উদ্ভিদটির জাদু। Aloe gel এর ৯৬ শতাংশ জল। স্বাদ ভীষণ তেতো। পাতা রোদে শুকালে সুক্ষ্ম ও শক্ত তন্তুময় অবশেষ মিলিয়ে যা অবশিষ্ট থাকে তা সামান্যই। পাতার ওজনেরই ৯৬ শতাংশ কেবল জল।
পাতার চটচটে আঠালো রসে থাকে বিভিন্নরকম উপকারী জৈব ও অজৈব উপাদান থাকে। লিগনিন, সাপোলিন, স্যালিসাইলিক অ্যাসিড, ফোলিক অ্যাসিডসহ প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন A, B, C ও E থাকে।
গবেষণায় জানা যায়, মানবদেহের জন্য বিশেষ প্রয়োজনীয় কিছু ভিটামিন, এনজাইম, অনু খনিজপদার্থ, ত্বকের পুষ্টি ও ত্বকের প্রদাহ রোধকারী, ক্ষয় রোধকারী ও অন্যান্য বহু প্রয়োজনীয় অতি ঔষধি গুণসম্পন্ন মোট ৭৫ রকমের জৈব ও অজৈব বস্তুর সন্ধান মিলেছে আজ পর্যন্ত এই হেলাফেলার গাছটিতে। যার মধ্যে আছে ১৮ থেকে ২০ রকমের প্রয়োজনীয় অ্যামাইনো অ্যাসিড। এগুলো সে সঞ্চিত রাখে রসালো পাতার ওই হড়হড়ে রসে বা Aloe gel-এ।
মারাত্মক তেতো স্বাদের জন্য কোন গবাদিপশু কিম্বা অন্যান্য তৃণভোজীরা এতে মুখও দেয় না।
Aloe vera উদ্ভিদের গুণের শেষ নেই। তাই খাদ্য, পানীয়, ওষুধ, রূপচর্চার সামগ্রী, ত্বকের নানা সমস্যার নানা মলম, ক্রিম, শ্যাম্পু, সাবান, লোশন ইত্যাদি সব জায়গাতে এর সদম্ভ ও উজ্জ্বল উপস্থিতি। শুধুমাত্র Aloe vera এই নামেই বাণিজ্য একেবারে সফল ও বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার এ পকেট থেকে ও পকেটে আমদানি–রপ্তানি।
একে বলা হয় বিস্ময়কর উদ্ভিদ বা Wonder Plant, আবার কেউ বলে জাদু উদ্ভিদ, The Magic Plant। ওষুধ হিসেবে এর নানান ব্যবহারের ইতিহাস এক হাজার বছরেরও বেশী পুরনো। মিশরের প্যাপিরাস গ্রন্থসূত্র বলছে যিশু খ্রিস্টের জন্মের ১৬০০ বছর আগের চিকিৎসাতেও এর ব্যবহারের কথা ৷
মানবদেহের ত্বক ও কেশের পরিচর্যায় এর ব্যবহার যেমন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি শরীরের আভ্যন্তরীণ সমস্যায় ওষুধ হিসাবে এর ব্যবহারও যথেষ্ট উল্লেখযোগ্য। সূর্যের U.V ray যা ত্বকের সবচেয়ে বেশী ক্ষতি করে, তাকে বাধা দেওয়ার বিশেষ গুণ আছে Aloe gel এর। পোড়া ও কাটা ঘা, র্যাশ বা অন্য নানানরকমের ত্বক সমস্যায় এবং Constipation বা কোষ্ঠকাঠিন্যসহ বহু অসুস্থতার মহৌষধ হল এই Aloe vera।
Aloe vera’র গুণাগুণ নতুন নয়, কিন্তু বিগত দু‘এক দশকে এর ব্যাপক বাণিজ্যিক প্রচার হয়েছে সারাবিশ্ব জুড়ে। ফলে, অভিজ্ঞ–অনভিজ্ঞ, শিক্ষিত–অশিক্ষিত সবাই এখন নামটি জানে। অদ্ভুত একটি ব্যাপার হল দেশজ এই উদ্ভিদটিকে দেশজ নামে না জানলেও মানুষ এর বিজ্ঞানসম্মত নামটি জেনে ফেলেছে প্রবল বাণিজ্যিক প্রচারের কারণেই। গাছ–গাছড়ার আঞ্চলিক নাম সবাই জানে, কিন্তু সাধারণ মানুষ তার বিজ্ঞানসম্মত নামের খোঁজই রাখে না।
Aloe vera হলো সেই ব্যাতিক্রমী উদ্ভিদ যারক্ষেত্রে বিষয়টা হয়েছে উল্টো। এই গাছের বৈজ্ঞানিক নাম যতটা মানুষ জানে, ততটা জানেনা তার দেশজ বা আঞ্চলিক নাম।
Aloe vera ছাড়া অন্য কোন উদ্ভিদ নেই যার বিজ্ঞানসম্মত নাম পৃথিবীর এত বেশিসংখ্যক মানুষ জানে।
বাস্তবে দেখা যায়, পৃথিবীর নানা প্রান্তের একজন সাধারণ মানুষ তার দেশজ বা আঞ্চলিক নামে হয়তো গাছটিকে চেনেনা কিন্তু বৈজ্ঞানিক নাম ‘এলোভেরা‘কে সে জেনে নিয়েছে লোকমুখে শুনে শুনেই। অন্তত আমার জানা সেই বিরল গাছ হলো আমাদের ঘৃতকুমারী (Aloe vera)। যে বিশ্বজুড়ে এমন সমাদর ও সম্মান লাভ করেছে এবং এত বেশিসংখ্যক মানুষও তার নাম জেনেছে।
এতবেশি গুণসম্পন্ন এই উদ্ভিদটিকে বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা খুব সহজ। পরিচর্যা কম, রুক্ষ ও বন্ধ্যা মাটি যেখানে কিছুই হয় না এমনকী বালি, কাঁকর ও পাথুরে জমিতেও এদের চাষ করা যায় প্রায় বিনা খরচে ও নামমাত্র পরিচর্যায়। এর কাঁচামালের যোগান যতো বেশী হবে এর থেকে উৎপাদিত নানান ভেষজ দ্রব্যের উৎপাদন খরচও তত কম হবে। ব্যবসায়ীরাও অকৃপণভাবে যথাযথ মাত্রায় সেইসব দ্রব্য উৎপাদন করবে এমনটি আশা করা যায়। একই কারণে এর আকাশছোঁয়া দামও তখন একটু কমা উচিত।
Aloe vera-র বাজার আজ বিশ্বজুড়ে। জাতীয় তো বটেই, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও Aloe vera আজ এক বিশেষ নাম।
প্রয়োজন আরো বেশি চর্চা ও গবেষণা এবং সেইসাথে গণসচেতনতা। অন্যান্য ওষুধপত্রের কথা নাহয় থাকলো, কিন্তু মাথার যন্ত্রণা, পোড়ায় ও কাটাছেঁড়াতে কিংবা ত্বক ও চুলের রুক্ষতা দূর করতে বাড়ির Aloe vera-র পাতার রস বা জেলি ব্যবহার করাই যায়।
শেষকথা, ঘৃতকুমারীর মোটা পাতার পিচ্ছিল আঠালো রসের সব খবর যে জানা ও বোঝা হয়ে গেছে এমন কথা বলার দুঃসাহস আমি মোটেও দেখাচ্ছি না।
আদিকাল থেকে মানুষের দেহের বাইরের অংশে এর ব্যবহারের লোক পরম্পরা সবার জানা হলেও এর পাতার রস মানবদেহের ভিতরে গিয়ে যে অজস্র কাজ করে তারজন্য চাই পরিশোধিত Aloe vera juice, যা বাড়িতে তৈরি করা প্রায় অসম্ভব। বলাবাহুল্য এই রচনা পড়ে কেউ যদি ডাক্তারি বা কবিরাজি করেন তার দায় আমার নয়। কেননা আমি নিজে ডাক্তার বা কবিরাজ কোনটিই নই।
তবে জনান্তিকে বলে রাখা ভালো, তার দু‘একটা ভুলভাল কবিতা ও ঘেত্তকুমারী পাতার রসের মতো হাকুচ তেতো প্রবন্ধ – ট্রবন্ধ পড়ে কেউ কেউ দু‘একবার তাকে কী মনে করে যেন ‘কবিরাজ‘ বলেছে। জানি না কী ছিল তাদের মনে!