০
১১১০ বার পঠিত
তাহলে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র কেন বন্ধ করবেন না ? সুন্দরবন বাঁচাতে নতুন করে গর্জে ওঠুন
প্রথম আলোতে আমার করা একটা প্রতিবেদন শেয়ার করছি। প্রতিবেদনে খুব পরিষ্কার করে বলা হয়েছে রেন্টাল-কুইক রেন্টাল সহ সরকারের বেশ কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়া হবে। এর সম্মিলিত ক্ষমতা ৩ হাজার মেগাওয়াট। এই কেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দেওয়া হবে কারণ বর্তমানে যত কেন্দ্র রয়েছে তার সম্মিলিত ক্ষমতার অর্ধেকের কম ব্যবহার হয়। ফলে রেন্টাল-কুইক রেন্টালের মত শ্বেত হাতি টানার মানে নেই। এসব রেন্টাল কুইক রেন্টাল ছাড়াই যদি বিদ্যুৎ সরবরাহ সাভাবিক থাকে তাহলে রেন্টাল-কুইক রেন্টাল কেন্দ্র বন্ধ হতে সরকারের আপত্তি নেই।
এবার কিছু তথ্য নেন। জাপানের জাইকা আমাদের ওপর কয়লাভিত্তিক কেন্দ্র চাপিয়ে দিয়েছে। আপনারা যারা মনে করেন জাপান মানে অতিব সুন্দর একটা দেশ, তারা শুধু বাংলাদেশের ভালো চায় তাদের নতুন করে ভাবুন। এই দেশ ছিল নদী নালা খাল বিলের দেশ যার আগে থেকে বিস্তৃত ট্রেন লাইন ছিল। ট্রেন ও নদী কেন্দ্রীক যোগাযোগে খরচ কম, সড়ক দুর্ঘটনা নেই বললেই চলে। অন্তত সড়ক দুর্ঘটনার সাথে যদি আপনি কোনো অংক মেলাতে চান তাহলে এটি বলতেই হবে। কিন্তু জাপানের গাড়ির বাজার এ দেশে প্রসারের জন্য রেল লাভজনক হয়নি, নদী ভারত যেমন মেরেছে আমরাও বোল্ডার পোল্ডার দিয়ে নদী মেরেছি। কারণ জাপানের গাড়িতো পানিতে নামে না। এসব মেরে কেটে আমরা জাপানকে মহান করেছি।
এবার আসেন বিদ্যুৎখাতে। জাপানের জাইকা ২০১০ সালে বিদ্যুতের মাস্টার প্লান দিল। মাস্টার প্ল্যানে বলা হলো ২০৪০ সালে বাংলাদেশের ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ দরকার যার ৩৫ ভাগ আসবে কয়লা থেকে। আর আমাদের মহান সরকার জাপানের পাতানো ফাদে যেনো সেধে সেধে পা দিল। মাস্টার প্ল্যানের এর কিছু বছর পর জাপানে নিজেই সরকারকে প্রস্তাব দিল কক্সবাজারের মাতারবাড়িতে জাপানের জাইকার টাকায় কয়লা খালাসের জন্য একটা গভীর
সমুদ্র বন্দর করতে চায়, সাথে ১২০০ মেগাওয়াটের কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র। বাংলাদেশে প্রচুর কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হচ্ছে, এসব কেন্দ্রের কয়লা আনারতো বন্দর লাগবে। কারণ দেশের কোনো বন্দরে কয়লার মাদার ভেসেল আসবে না। কয়লাতো বারবার নামানো যাবে না, অন্যান্য শিপমেন্টে যেমন লাইটার ইউজ করা হয় এটিতে এভাবে হবে না। সরকার গভীর সমুদ্র বন্দর করতে রাজি হয়ে গেলেন জাপানের জাইকার টাকায়।
জাপান জানত ২০৫০ সালের মধ্যে সারা দুনিয়া থেকে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নাই হয়ে যাবে প্যারিস চুক্তির কারণে। ফলে বাংলাদেশে যদি তাদের টেকনোলোজি বেচা বিক্রি করা করা যায়। সাথে বন্দরের মত ভূ-কৌশলগত অবস্থানও শক্তিশালী হলো।
এখন প্রশ্ন হলো যে প্রতিষ্ঠান নিজে কেনাো ব্যাপারে পরামর্শ দেয়-তারা সে বিষয়তো ব্যবসা করতে পারে না। এটিতো পরিষ্কার কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট বা স্বার্থ সংঘাতযুক্ত। জাপান সেটি করল। বাংলাদেশকে একটা রং ডিরেকশনে নিয়ে গেলো।
শুধু তাই নয়-জাপান একটা ভুল মেথডে হিসাব করল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের। সেটি হলো জিডিপির সাথে মিলিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ। জাইকা বললো, ২০১০ সালে ৩০ বছর বাংলাদেশে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) গড়ে ৭ শতাংশ বাড়বে। এ হিসাবে ২০৪০ সালে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রয়োজন। কিন্তু বাস্তবে বাংলাদেশে জিডিপি গড়ে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ৬ দশমিক ৩ শতাংশ হারে বেড়েছে।
জিডিপির প্রবৃদ্ধির সাথে মিলিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্র করাটা কতখানি সঠিক? জাপান সরকারকে বুঝিয়েছিল যে, জিডিপি বাড়লে কলকারখানা বসবে, প্রয়োজন হবে প্রচুর বিদ্যুতের। কিন্তু বাংলাদেশে জিডিপি বাড়লেই কলকারখানা বসবে এটাতো খুব ভুল প্রাক্কলন করা। কারণ বাংলাদেশে পদ্মাসেতু নির্মাণ, ফোর লেন, মেট্রোরেল, কর্নফুলি টানেল, রূপপুর, রামপাল, মাতারবাড়ি, পায়রার মত প্রকল্পের কারণে জিডিপি বাড়ছে। এর সাথেতো কলকারখানা নির্মাণের সম্পর্ক নেই। এটি কিন্তু জাইকা জানত না, তা না। কিন্তু তারা এই ফোরকাস্টটি ইচ্ছে করে ভিন্নখাতে নিয়ে নিজেতের ব্যবসা করার অভিলাষটি গোপন রেখে বাংলাদেশেক একটি ডার্টি এনার্জির ভাগাড়ে, একটি পুরানো ধরনের টেকনোলজির ফাদে ফেলার সুনির্দিষ্ট ইচ্ছে ছিল। সরকার এখন ৬২ হাজার কোটি টাকা শুধু কেন্দ্র ভাড়া দিয়ে বুঝতে শিখেছে, কতবড় ধরা তারা খেয়েছে।
বলবেন চীন, ভারত অন্যান্যরাতো ঠিকই বিনিয়োগ করেছে। তাদের দোষ নেই? আলবৎ তাদের দোষ আছে। কিন্তু এটির বুদ্ধিদাতাতো ভারত ও চীন না; এটার বুদ্ধিদাতাতো জাপান। চীনে প্রচলিত বুর্জোয়া গণতন্ত্র নেই। সে কারণে তাদের গণতন্ত্রের প্রতি দ্বায়বদ্ধতাও নেই। কিন্তু জাপানকে আমরা জানি উন্নত ধনতান্ত্রিক দেশের উন্নত গণতান্ত্রিক দেশের মডেল হিসেবে। সেই জাপানের সাথে চীন-ভারতের ফারাক কই? ফারাক নেই। বরং বিশ্বব্যাংক-আইএফমেরও একটা নীতি আছে। সেই নীতি হলো তারা কোন প্রকল্পে বিনিয়োগ করবে সেখানে একটা তথাকথিত নীতি নিয়মের সেট রুলস রাখা হয়। সেই সেট রুলসে রামপাল বিনিয়োগ করতে পারবে না বিশ্বব্যাংক। আমরা বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের বিরোধীতা করে আরও কঠিন সাম্রাজ্যবাদ ডেকে নিয়ে এলাম না কমরেড?
রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করুন
রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে। প্রায় ২ হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। এই কেন্দ্রের যে পরিবেশ প্রভাবগত প্রভাব ও স্বাস্থগত প্রভাব কত হতে পা্রে? এর নিরপেক্ষ কোনো তদন্ত সরকার নেয়নি। এ বিষয়ে পরিবেশবাদী আন্দোলনকারিরা সম্ভববত আট বা নয়টি দলিল সরকারকে দিয়েছে। সরকার জবাব দেয়নি, নাকচও করেনি।
কিন্তু সরকার এখন নিজে বলছে, জাপানের জাইকার মাস্টারপ্ল্যানের প্রাক্কলনে ভুল আছে। এতো বিদ্যুৎ বাংলাদেশের দরকার হবে না। সে কারণে পরিকল্পনায় রয়েছে এরকম কিছু বিদ্যুৎকে্দ্রের সাথে চুক্তি বাতিল করবে সরকার। এ অর্থ বিদ্যুতের যা দরকার হবে তার চেয়ে পরিকল্পনা বেশি করা হয়েছে। এরকম অতিরিক্ত প্লান করে সব থেকে বড় ধরা খেয়েছে ইন্দোনেশিয়া। তাদের প্রতি বছর এরকম অলস বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাড়া দিতে হয় প্রায় ৪৩ হাজার কোটি টাকা। সে কারণে তারা বড় কয়লাভিত্তিক কিছু কেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি বাতিল করেছে।
এরকম পরিস্থিতিতে রামপাল কেন্দ্র নির্মাণ বাতিল করতে সমস্যা কোথায়? সমস্যা হলো ভারতের সাথে চুক্তি? আচ্ছা চুক্তির বিষয় সুরহা করা যাবে। কেমন? যদি রামপালে সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র করা যায় তাহলে সেখানে ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ করা সম্ভব। জার্মানি ও চীনে সৌর বিদ্যুতের সাথে কৃষি কাজ ও ফার্মিং করছে। রামপালে যদি এমনটা করা যায় তাহলে পরিস্থিতির আমুল পরিবর্তন ঘটে যাবে। যেমন, জার্মানিতে গ্রীণ হাউজ করে পুরো ঘরটাতে সৌর বিদ্যুতের প্যানেল দিয়ে করা হয়েছে। এতে জমিতে তিন ফসল ফলানো সম্ভব। শুধু তাই নয় শীতকালে গরমকালের ফসল, গরমকালে শীতকালের ফসল করা সম্ভব। এতে করে যেসব সবজি ফলবে তার দামও বেশি পাওয়া যাবে। কোনো জমিও নস্ট হবে না। ফসলও বাড়বে। আবার বিদ্যুৎও আসবে। এ প্রকল্পের মালিকানা আধাআধি ভারত থাকুক। যেহেতু তাদের সাথে দীর্ঘ মেয়াদি চুক্তি হয়েছে।
ফলে সরকারি যুক্তি আর খাটছে না যে, বিদ্যুতের প্রয়োজন সে কারণে রামপাল কেন্দ্র করতেই হবে। কেননা সরকারই বলছে কেন্দ্র প্রয়োজনের চেয়ে বেশি, পরিকল্পনার কিছু কেন্দ্র বাতিল করা হবে, তাহলে রামপাল কেন্দ্র কেন বাতিল নয়।
এরপরও সরকারের যুক্তি আছে বলে আপনার মনে হয়?
প্রথম আলোয় প্রকাশিত এ সম্পর্কিত প্রতিবেদন পড়ুন এখানে: দরকার নেই এত বিদ্যুতের, বন্ধ হবে রেন্টাল–কুইক রেন্টাল
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন