জার্মানিতে নির্বাচন হবে ২৪ শে সেপ্টেম্বর৷ আর মাত্র ২ দিন বাঁকি, কিন্তু দৈনন্দিন জীবন যাত্রায় তার কোনো বড় ধরনের প্রভাব পরেনি৷ এটাই নিয়ম, এভাবেই জনগণ তাদের বহু গণতান্ত্রিক দায়িত্বের মধ্যে ভোটপর্বকে ও একটা অন্যতম দায়িত্ব হিসেবে দেখে, কারণ ভোট দেওয়াই একমাত্র গণতান্ত্রিক অধিকার নয়, বরং সেই গণতন্ত্রকে লালন করতে হয় সুশাসন দিয়ে৷
জার্মানির নির্বাচনে দুটি বৃহত্তর দলের চ্যান্সেলর (প্রধানমন্ত্রী) পদপ্রার্থী হলেন একজন বর্তমান চ্যান্সেলর, ক্রিস্টিয়ান রক্ষনশীল দলের (সি.ডি.ইউ) প্রধান আঙ্গেলা ম্যার্কেল এবং অন্যজন সোশ্যাল ডেমোক্রাট দলের বিজ্ঞ রাজনীতিবিদ, প্রাক্তন ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট এর স্পিকার মার্টিন শুলজ।
বেশ কয়েক সপ্তাহ আগে থেকেই জনগণের মাঝে একটা স্বস্তির আভাস পাওয়া গেছে যে, এবারেও আঙ্গেলা ম্যার্কেল পর পর চতুর্থ বারের জন্যে দেশটির সরকার প্রধান হতে চলেছেন৷
কে এই ব্যক্তি আঙ্গেলা ম্যার্কেল? কেনই বা তাঁর এতো জনপ্রিয়তা? যেমন তাঁর নিজ দেশে, তেমনি পুরো ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে?
অ্যাঙ্গেলা মর্কেলের রাজনীতিতে আগমন একরকম কাকতালীয়ভাবেই! তখন তাঁর বয়স ৩৪। বার্লিন ওয়াল পতনের পর ১৯৮৯ এ যখন পূর্ব-পশ্চিম জার্মানি একত্রিত হয় তখন তিনি সর্বশেষ পূর্ব জার্মানির প্রধানমন্ত্রী, লোথার ডে-মেসিয়ার এর রাজনৈতিক সচিব হিসেবে রাজনীতির মঞ্চে পদার্পণ করেন, পরবর্তীতে বৃহত্তর জার্মানির প্রথম নির্বাচনে তিনি পার্লামেন্ট সদস্য হলে, তৎকালীন চ্যান্সেলর হেলমুট কোল তাঁকে তার মন্ত্রিসভায় সর্বকনিষ্ঠ যুব ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রী হিসেবে, মের্কেলের (তখন ৩৫ বছর) দায়িত্বপূর্ণ রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়৷ এর পর থেকে তাকে আর কোনো দিন থেমে থাকতে দেখা যায়নি, যাকে বলে ধাপে ধাপে সফল ক্যারিয়ার তৈরি করেছেন তিনি৷
১৯৯৮ এ যখন তৎকালীন চ্যান্সেলর হেলমুট কোল তাঁর প্রতিপক্ষ সোশ্যাল ডেমোক্রাট দলের গেরহার্ড স্রোডার এর কাছে পরাজিত হন এবং ক্রিস্টিয়ান রক্ষনশীল দলের (সি.ডি.ইউ) চাঁদা কেলেঙ্কারিতে দলের ভরাডুবি হয়, তখন এগিয়ে আসেন আঙ্গেলা ম্যার্কেল, একধাপে দলের সভাপতি নির্বাচিত হন তিনি (মাত্র ৪৪ বছর বয়েসে সর্বকনিষ্ঠ দল প্রধান)৷
জার্মান সংবাদ সংস্থা ডয়চে ভেলে ম্যার্কেল সম্পর্কে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে উল্লেখ করেছে –
ম্যার্কেল তার সভাপতি পদে অধিষ্টিত হওয়ার পরেই প্রাথমিকভাবে ‘একটি পুরুষ-শাসিত, সমাজের‘ রক্ষণশীল ক্যাথলিক ধর্মের গভীর শিকড়ের সঙ্গে তাঁর পার্টি (সি.ডি.ইউ) উদারপন্থীদের একত্রিকরণে ব্যস্ত হয়ে পরেন এবং খুব সহজেই তাঁর ভারসাম্যতা রক্ষা করতে পেরেছে৷ ২০০৫ থেকে এ পর্যন্ত দুই দুইবার জার্মান চ্যান্সেলর হিসাবে, অত্যন্ত দক্ষতার সাথে না হলেও, বিজ্ঞ ম্যানেজার এর মতোই দেশশাসন করেছে ম্যার্কেল৷ সমগ্র বিষয়টি তিনি সুকৌশলে ম্যানেজ করেছেন৷ জার্মানির ‘ইউরো-সংশয়বাদী‘দের তিনি সন্তুষ্ট করেছেন বলিষ্ঠ অর্থনৈতিক সংস্কারের মাধ্যমে৷ অন্যদিকে, ‘ইউরোপ-বান্ধব‘দেরও তিনি খুশি করেছেন দলের আভ্যন্তরীণ প্রতিরোধ সত্ত্বেও সংস্কার উদ্যোগকে বাস্তবায়ন করে৷
আঙ্গেলা ম্যার্কেল এর রাজনীতিতে অনেক নেতিবাচক অধ্যায়ও রয়েছে; অবশ্যই তিনি সেটা নিজেও জানেন৷ যেমন ৩৪ বছর বয়সে রাজনীতিতে আশা, পূর্ব জার্মানির সমাজতান্ত্রিক পরিবেশে বড় হয়ে ওঠা একজন পদার্থ বিজ্ঞানী, জার্মানির মতো ইউরোপের এক ধনতান্ত্রিক দেশের সরকারপ্রধান হয়ে পর পর ৪ বার ক্ষমতায় থাকার পেছনে তাহলে কী এমন ইতিবাচক কারণ থাকতে পারে?
প্রথমত, তিনি স্বল্পভাষী (বেশি কথা বলেন না), যেটুকুই বলেন ঠিক যেন জনগণের কথারই প্রতিফলন তাঁর কথায় এবং কাজে ফুটে ওঠে, আর তাঁর বেশিরভাগ অর্জন করেছেন তিনি তাঁর বিগত তিনবারের সরকারপ্রধান থাকাকালীন সময়ে৷ তাঁর ইতিবাচক পদক্ষেপগুলোর মধ্যে অতি সাম্প্রতিক তিনটি উদাহরণ উল্লেখ করা যেতে পারে।
১) যখন ২০১১ খ্রিস্টাব্দে জাপানের ফুকুশিমা দূর্যোগের পরে জার্মান ভোটারদের বেশিরভাগ জনগোষ্ঠী জার্মানির সকল পারমানবিক শক্তিকেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়ার পক্ষে ছিল, আঙ্গেলা ম্যার্কেলও ঠিক সেই কাজটিই করলেন, অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের দাবি তিনি মেনে নিলেন৷ যদিও তিনি পারমাণবিক শক্তি নীতির একটি শক্তিশালী প্রবক্তা ছিলেন, তবুও পারমাণবিক শক্তি থেকে প্রস্থান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এতে তাঁর জনসমর্থন বেড়েছে বৈ কমেনি।
২) তিনি ইউরোপিয় রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন ইউরো কঠোরতার ক্ষেত্রে; তিনি বেশ ভাল ভাবে ইউরো সংকট মোকাবেলায় পদক্ষেপ রাখতে সক্ষম হয়েছেন৷ একদিকে যেমন ইউরো মুদ্রায় ধস নামেনি অন্যদিকে জার্মান ভোটারদেরকেও তিনি খুশি করতে পেরেছেন৷ গ্রিস, ইতালি ও পর্তুগালের অর্থনৈতিক সমস্যায় বিশাল পরিমাণ আর্থিক সহায়তা করে, নিজের দেশে ও ইউরোপে সুনাম কুড়িয়েছেন।
৩) ২০১০ খ্রিস্টাব্দে বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারির তথ্য ফাঁস হয়ে যাওয়ায় আঙ্গেলা ম্যার্কেল নিজের দেশের ভোটারদের সমালোচনায় বেশ বিপাকে পড়েন৷ ‘মার্কিন ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি’ নিজের দেশের তো বটেই, জার্মানিসহ ইউরোপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও মানুষজনের ওপর নজরদারি করেছে বলে প্রকাশ পায়৷ অন্যদিকে এই তথ্যও জানা যায় যে, জার্মানির কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা অনেক বছর ধরেই মার্কিনিদের গোয়েন্দাগিরির কথা জানতো, এমনকী সহযোগিতাও করে আসছিল তারা৷ বিষয়টি নিয়ে বিরোধীদল ও মিডিয়া সোচ্চার হয়ে ওঠে৷ বিশাল সমালোচনার সম্মুখীন হন চ্যান্সেলর ম্যার্কেল, তিনি যথারীতি কিছুদিন নিশ্চুপ ছিলেন৷ অপেক্ষা করেছেন এইভেবে যে, ‘দেখি জনগণ কী বলে’!
অবশেষে জার্মান টেলিভিশনে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন,
“মার্কিন গোয়েন্দাদের কার্যকলাপ হয়ত জার্মান আইনকে লঙ্ঘন করেছে ৷ ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা বিভাগ এই ধরনের কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকবে বলে আশা করছি।”
আসলে এটাই হচ্ছে ম্যার্কেলের ইতিবাচক শক্তি৷ সমস্যা হলে প্রথমে পরিস্থিতিটা কোনদিকে যাচ্ছে সেটা বোঝার চেষ্টা করেন তিনি৷ তারপর অধিকাংশের মতামতের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন৷ বলা বাহুল্য, তাঁর এই রাজনীতির জন্য প্রশংসিত ও সমালোচিত – দু’টোই হতে হয়েছে তাঁকে৷
আঙ্গেলা ম্যার্কেল জানেন তাঁর নিজের দূর্বলতা, যেমন সোশ্যাল ডেমোক্রাট দলের চ্যান্সেলর পদপ্রার্থী মার্টিন শুলজ এর মতো ইউরোপিয় পার্লামেন্টের বহুভাষায় অভিজ্ঞ সঞ্চয় করা বক্তা তিনি নন, এমনকী অর্থনৈতিক বিশারদও তিনি নন (ম্যার্কেল পদার্থ বিজ্ঞানের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন) তবুও এতোসব নেতিবাচক ঘটনা সত্ত্বেও, তিনি আগামী ২৪ শে সেপ্টেম্বর নির্বাচনে চতুর্থ বারের মতো জার্মানির চ্যান্সেলর হতে চলেছেন৷
সর্বশেষ একটি জরিপের ফলাফল অনুযায়ী আঙ্গেলা ম্যার্কেলের জয় প্রায় নিশ্চিত৷ তাঁর দল (CDU) খ্রিস্টান গণতান্ত্রিক দল প্রায় ৩৮% ভোট পাবেন আর তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী,মার্টিন শুলজ (SPD) সামাজিক গণতান্ত্রিক দল ২৩% ভোট পাবেন। তবে ম্যার্কেল একা সরকার গঠন করতে পারবেন না। তাই জল্পনা কল্পনা শুরু হয়েছে কার সাথে ম্যার্কেল কোয়ালিশন করবেন!
তৃতীয় যে দলটি পার্লামেন্টে জায়গা করে নিতে চায়, সেটি হলো প্রাক্তন পূর্ব জার্মানির কমিউনিস্ট পার্টি, তারা ২৫ বছর আগেই দুই জার্মানির একত্রিকরণের পরেই নতুন নামে জার্মান রাজনীতিতে আছে। দলটির নাম বাম দল বা Left, বিশেষজ্ঞদের মতে এই নির্বাচনে তারা ১২% ভোট পাবেন। তবে আঙ্গেলা ম্যার্কেল বাম দলের সাথে কোয়ালিশনে না ও যেতে পারেন।
এছাড়াও আছে সবুজ দল তারাও পেতে পারে ৫% ভোট, আর একটি দল গত তিন বছরে ম্যার্কেল এর শরণার্থী বিদ্বেষী রাজনীতি করে প্রায় ১০% এর কাছাকাছি আছে, তাদের সাথেও ম্যার্কেল কোয়ালিশনে যাবে না, কারণ তারা নিও নাৎসি দর্শনে বিশ্বাসী। তাহলে ঘুরে ফিরেই দেখা যাচ্ছে যে ম্যার্কেলকে সেই আগের কোয়ালিশনে CDU এবং SPD নিয়েই সরকার গঠন করতে হবে।
উল্লেখ্য যে, জার্মানিতে গত ৭০ বছরে (দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর থেকে) প্রথম ২ বছর বাদ দিলে কোনো সময়েই এককভাবে কোন একটি দল দেশশাসন করেনি। ম্যার্কেলকে আরো ৪ বছর জার্মানির ক্ষমতায় দেখতে চায় ইউরোপের রক্ষণশীল দেশগুলো, কারণ তাঁর বিচক্ষণ রাজনীতিতেই ইউরোপের শরণার্থী সমস্যা সমাধান হবে বলে মনে করেন বেশিরভাগ ইউরোপিয়ান দেশগুলো। এছাড়াও ম্যার্কেলই একমাত্র ইউরোপিয় রাজনীতিবিদ, যিনি ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ভ্লাদিমির পুতিনের মাঝে ভারসাম্য রক্ষা করে ইউরোপকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন, যার উদাহরণ তিনি জুলাই ২০১৭ তে হ্যামবুর্গ এর জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে দেখিয়েছেন।
ম্যার্কেল বিশ্ব পরিবেশ রাজনীতিতে দারুণ প্রভাব বিস্তার করে প্যারিস ক্লাইমেট সম্মেলনেও বেশ বড়ো ভূমিকা রেখেছেন। এছাড়াও সম্প্রতি নিউইয়র্কে জাতিসংঘের ৭২ তম সাধারণ সভায় ট্রাম্প এর উত্তর কোরিয়ার সাথে যুদ্ধের হুমকির কঠোর সমালোচনা করে বলেছেন ‘যুদ্ধ নয় কূটনীতি দিয়ে’ শান্তি ফিরিয়ে আনতে হবে। তাই এখন নতুন করে জল্পনা কল্পনা শুরু হয়েছে যে, আঙ্গেলা ম্যার্কেল হয়তো এবার ২০১৭ তে শান্তির নোবেল পুরস্কারেরও পেতে যাচ্ছেন।
বার্লিন, ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৭