১৫২৩ বার পঠিত
দ্য মুসলিম রিফর্ম মুভমেন্টের চেষ্টা দয়াময়, সমন্বয়ধর্মী ইসলামের প্রতনিধিত্ব করা। একে বড়জোর কাল্পনিক ইসলাম বলা যেতে পারে।
দেখা যাক কোরান কী বলে।
দ্য মুসলিম রিফর্ম মুভমেন্ট (এম আর এম) ইসলামের দয়াময় এবং রূপ তুলে ধরার চেষ্টা শুরু করে প্রথম থেকেই। এম আর এম প্রতিষ্ঠা করা হয় ২০১৫ সালে ওয়াশিংটন ডিসিতে। কয়েকজন সংস্কার মনস্ক মানুষের উদ্যোগে তা গড়ে ওঠে। তারা বলেন তারা হলেন “একবিংশ শতাব্দীর মুসলমান” যারা “ইসলামের আত্মা (অন্তর্ণিহিত তাৎপর্য) সন্ধানে” লড়াইরত। তারা ঘোষণা করেন তারা ইসলামের “শিষ্ট, দয়াময় এবং সমন্বয়ধর্মী ব্যাখ্যা” করার পক্ষপাতী।
এম আর এম- এর ওয়েবসাইট দাবি করে তারা ‘মুসলমান সংস্কারকদের একটি বিশ্ব-সংস্থা। কিন্তু শুরু থেকেই দেখা যায় তাদের একেকজন সংস্কারক ইসলামের নিজ নিজ ব্যাখ্যা দিয়ে আসছেন। একে আমি কাল্পনিক ইসলাম বলে চিহ্নিত করেছি।
সংস্থার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, বর্তমানে লন্ডনবাসী ড.উসামা হাসানের লেখা “জিহাদ সম্পর্কে দশটি সত্য (Ten Truths About Jihad)” তাদের ফেসবুক পেজে স্থান পায়। লেখাটি পড়তে ভাল। কিন্তু সমস্যা হলো, হাসান ইসলামের গৃহীত তত্ত্বের অনেকটাই তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে চেয়েছেন।
একে একে হাসানের দশটি “সত্য” খতিয়ে দেখা যাক।
অসততার বিরুদ্ধে সততার অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের, অসত্যের বিরুদ্ধে সত্যের জন্য আজীবন অহিংস সংগ্রামই জিহাদ।
হাসান লিখেছেন:
“জিহাদ সম্পর্কে কোরানের মূল শিক্ষা হলো যে, এটি সব ধরনের অসততার বিরুদ্ধে সততা প্রতিষ্ঠার অহিংস সংগ্রাম।”
এরপর তিনি মক্কায় রচিত বা নাজেল হওয়া কোরানের দুটি সুরা (২২:৭৮ এবং ২৫:৫২{৩} উল্লেখ করেছেন তার এই বক্তব্যের সমর্থনে। তা করতে গিয়ে হাসান ইসলামকে বোঝার ক্ষেত্রে মৌলিক একটি তত্ত্ব এড়িয়ে গেছেন-তা হলো বাতিল করার তত্ত্ব (Doctrine of Abrogation)।
ত্রয়োদশ শতাব্দীর মুসলমান গবেষক আল-কুরতুবি লিখেছেন: “এই বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং গবেষকদের এসম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে।”
দেখা যাক তত্ত্বটি কী। তা বুঝতে হলে কোরান সম্পর্কে আমাদের মৌলিক ধারণা লাভ করতে হবে। কোরান ইসলামের পবিত্র গ্রন্থ। কোরানের সুরাগুলি ফেরেস্তা জিব্রিল মহম্মদের কাছে নাজেল করেন। এর কতগুলি নাজেল হয় মক্কায় ৬১০ সাল থেকে। তারপর মহম্মদ মদিনায় চলে যান ৬২২ সালে। ৬৩২ সালে তার এন্তেকাল পর্যন্ত সুরা নাজেল হতে থাকে।
কোরানের অনুবাদে সাধারণত দেখানো থাকে কোন অনুচ্ছেদ মক্কায়, কোনটা মদিনায় নাজেল হয়েছে। কোন সময়ে কোন সুরা বা অধ্যায় ‘নাজেল’ হলো তার একটা গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য রয়েছে। মহম্মদ যখন মক্কায় তখন ইসলাম ধর্মের সূচনা হয় মাত্র। তখন ইসলামকে সাধারনভাবে স্বাগত জানানো হয়নি। তাই হয়তো মক্কাযুগে ‘নাজেল’ হওয়া সুরাগুলিতে সাধারণভাবে পরে মদিনা যুগের সুরার তুলনায় বেশী শান্তিপূর্ণ ও অমুলিমদের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার বৈশিষ্ট্য ও মেজাজ লক্ষ করা যায়। মদিনা যুগের সুরাগুলিতে সাধারণভাবে তুলনায় বেশী যুদ্ধাংদেহী ও অসহিষ্ণু প্রবণতা দেখা যায়। পরবর্তীকালের এই সুরাগুলিতে মুসলমান (ইমানদার) এবং অমুসলমান (কাফের)-এর মধ্যে স্পষ্ট বিভাজন তৈরীর ঝোঁক তুলনায় বেশী।
মদিনা যুগের একটি সুরায়’“বিলোপ’-এর ধারনা আনা হয় – অধ্যায় ২, সুরা ১০৬ : আমরা কোনো সুরা বাতিল করি কিংবা তা ভুলে যেতে দিই।এরপর আমরা উন্নততর অনুরূপ সুরা আনি। তোমরা কি জানোনা যে, আল্লাহ সব করতে পারেন। অর্থাৎ দুটি সুরার মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে অপেক্ষাকৃত পরের সুরাটি গ্রহনযোগ্য বলে ধরে নেওয়া হয়। এই অর্থে মদিনা যুগের সুরার গ্রহনযোগ্যতা চূড়ান্ত।
হাসান জিহাদকে অহিংস বলেছেন মক্কা যুগের সুরার উপর নির্ভর করে। কিন্তু এই সুরা দুটির জায়গায় জিহাদ নিয়ে মদিনা পর্বের সুরার আবির্ভাব ঘটে যাতে সহিংস জিহাদের কথা বলা হয়েছে। (৬২৩{৬}) সালের মে মাস নাগাদ মক্কা পর্বের সুরা দুটি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়।
মদিনায় নবীর ১০ বছরের মিশনের সময় আত্মরক্ষায় সামরিক জিহাদের অনুমতি দেওয়া হয়।
হাসান তার এই বক্তব্যের সমর্থনে হিজরত ২২:৩৯–৪০ এবং হেইফার ২:১৯০ সুরার উল্লেখ করেছেন।
মুসলমানগণ মদিনায় হিজরত করেন ৬২২ সালের শরতে এবং পরের বছর মে মাসে সুরা ২:২১৬ নজেল হয়। এই সুরায় মুসলমনদের নির্দেশ দেওয়া হয় তারা যেন সর্বত্র অমুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়াই করে শুধু এই কারণে যে তারা বিধর্মী।
সুরা ২:১৯০ নাজেল হয় ৬২৯ সালে এবং স্বল্প কালের মধ্যেই বাতিল হয়ে যায় সুরা ২:২৯১ নাজেল হওয়ার মধ্য দিয়ে (“যেখানেই পাবে ওদের {অমুসলমানদের} কোতল কর”)।
বৈধ কর্তৃপক্ষই শুধু সামরিক জিহাদ ঘোষণা করতে পারে ।
হাসান দাবী করেছেন, “বৈধ কর্তৃপক্ষই শুধু যুদ্ধ বা সামরিক জিহাদ ঘোষণা করতে পারে।” হাসানের মতে, এর অর্থ দাঁড়ায় “সন্ত্রাসীদের মতো অরাষ্ট্রিক শক্তি”-র এই ধরনের ‘ইসলামী কর্তৃত্ব” নেই। তিনি কোরানের ৪:৮৪ ও ৮:৬১ সুরা উল্লেখ করে বলেছেন মহম্মদের জীবদ্দশায় একমাত্র তারই এই কর্তৃত্ব ছিল।
শরিয়তী আইনের সুপরিচিত ম্যানুয়াল Reliance of the Traveler-এর একটি বিবৃতি এবং এর উপর মন্তব্য কিন্তু হাসানের বক্তব্য সমর্থন করছেনা। এতে বলা হয়েছে, “খলিফা না থাকলে (অমুসলমানদের বিরুদ্ধে সামরিক জিহাদের জন্য) অনুমতির প্রয়োজন নেই।
জিহাদ নিয়ে এমনকি আপাতদৃষ্টিতে চরম যুদ্ধংদেহী সুরাও আত্মরক্ষাত্মক ।
এই ‘সত্য’ ব্যাখ্যায় হাসান যে দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েছেন তাতে একটি গুরুত্বপূর্ণ সুরা অনুল্লেখিত রয়েছে
এবং একটি সুরা নিয়ে ভুল ধারনা রয়েছে একই সাথে। কোরানের নবম অধ্যায় মহম্মদের কাছে নাজেল হওয়া সর্বশেষ পূর্ণাঙ্গ অধ্যায় বলে বিবেচিত হয়। ‘আত্মরক্ষার্থে’ জিহাদ প্রসঙ্গে নবম অধ্যায় থেকে কয়েকটি সুরার উল্লেখ করেছেন কিন্তু পঞ্চম সুরাটির উল্লেখ করেননি। পঞ্চম সুরায় বলা হয়েছে: পবিত্র মাসের পর যেখানে পাবে সেখানেই মুশরিকুন কাতেল করো, বন্দী করো এবং অবরুদ্ধ করো,তা দের জন্য ওঁৎ পেতে থাকো… এই সুরাটি শেষ হয়েছে এই বলে , যে মুশরিকুন বা অমুসলমানরা ইসলাম গ্রহণ করলেই শুধু নিজেদের রক্ষা করতে পারবে।
ধর্মীয় স্বাধীনতা রক্ষা ও উৎসাহিত করার জন্য সামরিক জিহাদ বিধিবদ্ধও করা হয় ।
এই ‘সত্য’-এর সমর্থনে হাসান মক্কা পর্বের সুরা(১০৯:৬) এবং মদিনা পর্বের দুটি খুব আগের সুরা (২২:৩৯-৪০)-র উপর নির্ভর করছেন। তিনি এখানেও বাতিলকরণ তত্ত্ব (Doctrine of Abrogation) এড়িয়ে গেছেন। ফলে তিনি মদিনা পর্বের পরবর্তী সময়ের সুরা (৮:৩৯)উল্লেখ করেননি। এই সুরায় বলা হয়েছে,ততক্ষণ তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করো। যতক্ষণ একটাও ফিৎনাহ অবশিষ্ট থাকে।
কোরানের স্বীকৃত ভাষ্যগুলি ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছে যে, এই সুরা বলছে যতক্ষণ ইসলামই একমাত্ ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায় ততক্ষণ অমুসলমানদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।
সামরিক জিহাদের সাথে সবসময়ই জোরালো নৈতিক বিধিনিষেধের শর্ত জুড়ে থাকে।
হাসান হাদীসের উল্লেখ করেন যেগুলিতে “নারী, শিশু, বৃদ্ধ, কৃষক, সন্ন্যাসী এবং অন্যান্যদের যুদ্ধে” হত্যা করা থেকে বিরত থাকার কথা বলা হয়েছে।কিন্তু বাস্তব ইতিহাসে এর সমর্থন মেলে না।
পুনরায় বলা যায়, জিহাদ অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের লড়াই।
এবারও কিন্তু হাসান তার এই বক্তব্যের সমর্থনে মক্কা পর্বের সুরার (২২:৭৮) উপর নির্ভর করেছেন।এই সুরায় আল্লাহর উদ্দেশ্য হাসিলের স্বার্থে কঠোর প্রয়াস চালানোর কথা বলা হয়েছে।
মদিনা পর্বের সুরা ৯:১১১ বলছে, অন্যায়ের (অন্যান্য ধর্ম) বিরুদ্ধে ন্যায় মানে অন্য সব ধর্মের উপর ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করা।
মুসলমানগণ যদি তা প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করে মারে এবং মরে তবে বেহেস্ত হবে তাদের জন্য পুরস্কার।
বাইরের জিহাদের সাথে বরাবরই জড়িয়ে আছে ভেতরের জিহাদ।
এই বক্তব্যের সমর্থনে হাসান একটি উদ্ধৃতির উপর ভরসা করেছেন। উদ্ধৃতিটি এই রকম: “ আমরা তুলনায় নিম্ন স্তরের জিহাদ থেকে ফিরে এসেছি উচ্চতর জিহাদে।”এর অর্থ নিম্নতর সামরিক জিহাদ থেকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমরন সংগ্রামে ফেরা।
হাসান দাবী করেছেন এটি একজন মুসলমান গবেষকের উক্তি এবং এটি নবীর নিজস্ব উক্তি বলে দাবী করা হয়েছে ,এমন কথাও যোগ করেছেন হাসান।কিন্তু মুসলমান গবেষকগণ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বলে আসছেন মহম্মদ নিম্নতর এবং উচ্চতর জিহাদ নিয়ে কিছু বলেছেন এমন ধারনা ঠিক নয়।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন