জিহাদ সম্পর্কে নতুন আর কী বলার থাকতে পারে, তাই ভাবছেন? ভাবছেন, যে বিষয় নিয়ে সারা বিশ্বে এত চর্চা, সেই প্রসঙ্গে চর্বিতচর্বণ ছাড়া আর কী হতে পারে?
আসলে আমার মনে হয়, জিহাদ শব্দটি নিয়ে খানিকটা ধোঁয়াশা তো রয়েছেই। ধোঁয়াশা এই কারণে যে, এই শব্দটির একরকম ব্যাখ্যা করে জঙ্গি মুসলিম অমুসলিম এবং সেক্যুলারিস্টরা তো অন্যরকম ব্যাখ্যা করে উদারপন্থী মুসলিমরা। তাই কিছু বলার আগে আমরা জিহাদ শব্দটির অর্থ নিয়ে একটু আলোচনা করে নেব। ‘জিহাদ’ শব্দটি এসেছে আরবী শব্দ ‘জাহাদাহ্‘ থেকে, যার অর্থ উদ্যমী হওয়া। জিহাদ শব্দটির অর্থ হল অসৎ-এর বিরুদ্ধে সর্বশক্তি দিয়ে লড়াই করা। এই যুদ্ধ হল আসলে অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ।
এতদূর পর্যন্ত দুই পক্ষেরই কোনও সমস্যা নেই। উভয়পক্ষই মেনে নেয় জিহাদের এই অর্থ। কিন্তু এরপরই শুরু হয় যত গোলযোগ, যত মতান্তর। জঙ্গি মুসলিম,অমুসলিম এবং সেক্যুলারিস্টরা মনে করে, ইসলাম অনুযায়ী ‘অসৎ’ হল অমুসলিম এবং ইসলাম বিরোধীরা। তা সে যেই হোক, যেমনই হোক। যতক্ষণ অমুসলিম ও ইসলাম বিরোধী মানুষরা থাকবে, ততক্ষণই ইসলামের বিপদ। যতোক্ষণ না ইসলাম সারাবিশ্বে প্রসারিত হচ্ছে, ততোক্ষণ এদের বিরুদ্ধে চালিয়ে যেতে হবে সংগ্রাম। আধুনিক জঙ্গিবাদী মুসলিমরাও একথাই মানে। সমসাময়িক কালে গ্রেফতার হওয়ার পর কাসাব নামক জঙ্গির জবানবন্দী একথাই প্রমাণ করে। একথা নাস্তিক, খ্রিস্টান ও হিন্দুসহ ইসলাম-ত্যাগী মানুষেরাও বোঝে। কিন্তু উদারপন্থী সাধারণ মুসলিমরা মনে করে যে, মনের মধ্যেকার অসৎ প্রবৃত্তিকে ধ্বংস করতে সংগ্রামই আসলে আল্লাহর পথে সংগ্রাম। ইসলাম ও মুসলিম বিরোধীরা ইসলামকে কলঙ্কিত করতে জিহাদের অর্থের অপব্যাখ্যা করে, তেমনি অমুসলিমরা এই ব্যাপারটাকে না বুঝে তাঁদের ফাঁদে পা দেয়। কিন্তু প্রশ্ন হল, এই পরস্পরবিরোধী দুটি অর্থের মধ্যে কোনটি ঠিক? জিহাদ শব্দটির সঠিক অর্থ সম্পর্কে কাদের বক্তব্য আমরা মেনে নেব?
আসলে, কিছু মানুষ মিথ্যা প্রচার ও ব্যাখ্যা করে জিহাদ সম্পর্কে মানুষের স্পষ্ট ধারণাকে গুলিয়ে দিচ্ছে খুব উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে। যেমন, জাকির নায়েকের মতে,
“যদি কোনও চাকুরীজীবী মনিবকে খুশি করার জন্য চেষ্টা করে, পরিশ্রম করে, তা সে ভাল কাজ দিয়েই হোক বা খারাপ কাজ দিয়েই হোক, তা হলেই তা জিহাদ”।
আচ্ছা, জাকির নায়েকের দেওয়া অর্থে কোরআনে বা হাদিসে কোথাও জিহাদের উল্লেখ আছে? নেই। বাস্তবে, সংগ্রাম বা লড়াই করার জন্য সবার আগে প্রয়োজন একটি প্রতিপক্ষ। কিন্তু জাকিরের এই উদাহরণে কোন প্রতিপক্ষ নেই। সুতরাং তাকে লড়াই বলা যায় না। তাই তাকে জিহাদও আখ্যায়িত করা যায় না।
তাহলে বোঝা গেলো যে একটি স্পষ্ট প্রতিপক্ষ ছাড়া জিহাদ সম্ভব নয়।
কিন্তু প্রশ্ন হল, জিহাদের ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষ কে? উত্তরে বলা যায়, বিধর্মী এবং ইসলাম বিরোধীরা।
ডঃ ওসমান গনী সাহেব এর মহানবী গ্রন্থেও একটি অধ্যায় আছে ‘মহানবী তার জীবনে কতগুলি জিহাদ পরিচালনা করেছেন?’ পরিষ্কার বোঝানো আছে যে, জিহাদ হল আল্লাহর পথে (ইসলাম প্রসারের জন্য) বিধর্মীদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। জাকিরের ‘সন্ত্রাসবাদ ও জিহাদ’ বইটিতে উপরোক্ত উদাহরণটি দেওয়ার পরে পুরো বইটি জুড়েই যুদ্ধের কথা বলা আছে। অর্থাৎ তিনি পরোক্ষভাবে স্পষ্ট করে দিচ্ছেন যে, জিহাদের অর্থ আল্লাহর পথে সংগ্রাম। কোরআনেও দেখা যায় জিহাদ শব্দটি পারিভাষিক অর্থে গৃহীত, যার অর্থ হল ‘জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ’ অর্থাৎ আল্লাহর পথে সংগ্রাম। এবং কোরআনে এই কথা উল্লিখিত আছে –
“হে নবী! কাফের ও মুনাফেকদের বিরুদ্ধে জিহাদ করো এবং তাদের প্রতি কঠোর হন তাদের ঠিকানা জাহান্নাম”। (আত তাহরিমঃ ৯)
“অবিশ্বাসীগণ (কোরআন আল্লাহ্ ও নবীতে) তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু”! ( নিসাঃ ১১১)
“তোমরা ততক্ষণ তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে যতক্ষণ না আল্লাহর ধর্ম সামগ্রিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়”। (আনফালঃ ৩৮)
এই বক্তব্য তো স্পষ্ট ও প্রাঞ্জল। তাহলে উদারপন্থীদের মনে ধোঁয়াশা তৈরি হওয়ার কারণ কী? আসলে হজরত মোহাম্মদ যে জিহাদ তত্ত্ব চালু করে গিয়েছিলেন, তা সারা বিশ্বে স্থায়ী অশান্তি তৈরি করেছে। মুহম্মদের পরবর্তী সময়ে ইসলামি বাহিনী যখন পারস্য বিজয় করে তখন পারস্যের বহু পণ্ডিত ইসলাম গ্রহণে বাধ্য হয়। এবং প্রায় দুশো বছর আরবের সরাসরি অধীনে থাকে। কিন্তু নবম শতাব্দীর শেষের দিকে আরব পারস্যের উপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম রাখতে ব্যর্থ হয়। কিন্তু ততোদিনে প্রায় সকল পার্সি ইসলাম গ্রহণ করে ফেলেছে। এরা কোনদিনই ইসলামের মূল ধারার সাথে পুরো একমত হতে পারেন নি। একটু স্বাধীনতা পেয়েই তারা ইসলাম নিয়ে নতুন করে আলোচনা ও গ্রন্থ লেখা শুরু করে। তারা জিহাদ তত্ত্বের ভয়াবহতা দেখে ইসলামের জিহাদ তত্ত্বকে আপাদমস্তক পাল্টে তার আধ্যাত্মিক রূপদানের চেষ্টা করেন। ‘চলিত ইসলামি শব্দকোষ’ নামক গ্রন্থে বলা হয়েছে,
“মোহম্মদ পরবর্তী সময়ে জেহাদের ভয়ানক অপব্যবহার দেখে উদার মুসলিম ধর্মতাত্ত্বিক ও পণ্ডিতরা নবম এবং দশম শতকে জেহাদের একটি আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা দেন। তারা বলেন, আল্লাহর সঠিক পথের অন্বেষণে ব্যক্তির আধ্যাত্মিক প্রচেষ্টাই জিহাদ’’।
এইসব উদারপন্থী ও মরমিয়া সাধকদের মতে, জিহাদ দুই প্রকার। বড় জিহাদ আর ছোট জিহাদ। ভেতরের শত্রুকে পর্যুদস্ত করতে আল্লাহর পথে আধ্যাত্মিক লড়াই হল বড় জিহাদ। অন্যদিকে অস্ত্র হাতে বাইরের যুদ্ধ হল ছোট জিহাদ। ‘তবে এ সবই মোহাম্মদ পরবর্তী যুগের ভাবনা-চিন্তা। কারণ কোরআন বা হাদিসে এর কোনও অনুমোদন মেলে না’।
পরবর্তীকালে সূফীদের হাতে পরে জিহাদ তত্ত্ব আরও ব্যাপক রূপ পায়। সূফী সন্তরা পাঁচ প্রকার জিহাদের কথা বলেন –
১) আত্মার জিহাদ: মনের ভিতরের রিপু রূপ শয়তানকে ধ্বংস করা অন্তরের সংগ্রাম ‘তৌহিদ’-এর মাধ্যমে।
২) বাচনিক জিহাদ: খুৎবা,জলসা ইত্যাদির মাধ্যমে সামাজিক শত্রু ও শয়তানদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা।
৩) কলমের জিহাদ: ইসলাম বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে ইজতিহাদ বা ইসলামি জ্ঞানের চর্চা এবং প্রচারের মাধ্যমে সংগ্রাম করা।
৪) হাতের জিহাদ: নিজের অর্জিত সম্পদের মাধ্যমে অর্থাৎ আপন অর্থ ও অন্য সম্পদ দানের মাধ্যমে ইসলাম প্রসারের কাজে অন্য মুজাহিদদের সাহায্য করা।
৫) তলোয়ারের মাধ্যমে: অস্ত্রশস্ত্রের দ্বারা ইসলাম বিরোধী শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া।
এর মধ্যে চতুর্থ ও পঞ্চম প্রকারের জিহাদ বর্তমান বিশ্বের চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইসলামি ধনী দেশগুলি থেকে জিহাদের উদ্দেশ্যে অর্থ সরবরাহ হচ্ছে দরিদ্র মুসলিম দেশগুলিতে। উদ্দেশ্য হল অমুসলিমদের ইসলামে নিয়ে আসা। এবং কোনও মিশনারি কাজের মাধ্যমে নয়, বরং কোরআনের ভাষায় ‘তাদের মনে ভীতি সঞ্চার করে’। অর্থাৎ আতঙ্কের মাধ্যমে। কোনও সন্দেহ নেই যে এটাই জিহাদের প্রকৃত অর্থ।
বর্তমানের উদার এবং শিক্ষিত মুসলিমবিশ্বের মানুষের কাছে জিহাদ একই সাথে আতঙ্ক, লজ্জা ও আশার নাম। তারা বোঝে যে, এই জগতে নিজেকে টিকিয়ে রাখাটাই সবচেয়ে বড় সংগ্রাম, তারা বোঝে বর্তমানে কোরআন আওড়ানোর চেয়ে কম্পিউটার অ্যাপ্লিকেশন পড়া কাজের। তারা কোরআন হাদিসকে শুধুমাত্র ধর্মগ্রন্থের বেশী আর কিছু বলে মনে করে না। এইসব নামেমাত্র মুসলিমরা দিনরাত দেখে যে জিহাদ কীভাবে বর্তমান বিশ্বকে সন্ত্রস্ত করে রেখেছে। এমনকী মুসলিম দেশগুলিও সন্ত্রাসের বাইরে থাকছে না। বিভিন্ন ইসলামি গোষ্ঠীর প্রত্যেকটিই মনে করছে অপর গোষ্ঠী হল তাদের ইসলামের বিরোধী। ফলে, একে অপরের ওপর সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ এবং প্রাণহানী। ভাবতে পারেন, আমেরিকার ‘বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্র‘ ধ্বংসের পর থেকে আজ পর্যন্ত কুড়ি হাজারের ওপর সন্ত্রাসী আক্রমণ হয়েছে! হতাহতের সংখ্যা বেশ কয়েক লক্ষ। অমুসলিমরা তো এর শিকার হচ্ছেই, মুসলিমরা শিকার হচ্ছে আরও বেশী। এরা কী মনে মনে সত্যিটা উপলব্ধি করতে পারে না মনে হয়? পারে।
এর ওপর অন্যধর্মী মানুষদের সাথে তাদের একত্র থাকতে হয়। তাদের মধ্যে মধ্যযুগীয় বর্বরতার লেশমাত্র না থাকলেও রোজকার জেহাদি কার্যকলাপ তাদের প্রতিনিয়ত অস্বস্তিকর প্রশ্নের মুখে ফেলে। রোজ একটা বোমা বিস্ফোরণ হয় কোথাও না কোথাও, আর রোজ অন্যের সন্দেহ ও ঘৃণার পাত্র হতে হয় সাধারণ মুসলিমকে, সারা বিশ্বজুড়ে। কী করতে পারে তারা? না পারে নিজের ধর্ম ত্যাগ করতে, যে ধর্মীয় সংস্কৃতিতে সে জন্মেছে, বড় হয়েছে, যাকে পবিত্র বলে এতদিন মেনে এসেছে, যাকে খারাপ বললে তার বুকে আঘাত লাগে; না পারে ইসলামের ধর্মীয় সহিষ্ণুতা-হীন কদর্যতাকে বিনা বিচারে সমর্থন করতে, যার প্রায়োগিক রূপ পৃথিবীকে সন্ত্রস্ত করে রেখেছে ইসলামের জন্মের সময় থেকেই। বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক জাঁ পল সার্ত্রের অস্তিত্ববাদী দর্শন খুব স্পষ্টভাবেই দেখিয়েছে যে, উদ্বেগ এবং হতাশায় পরিপূর্ণ স্বাধীন জীবনই মানুষের যথার্থ অস্তিত্বকে সূচিত করে। কিন্তু বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা যেহেতু মানুষের মধ্যে উদ্বেগের জন্ম দেয়, তাই উদ্বেগ থেকে মুক্তি পেতে অধিকাংশ মানুষই আশ্রয় নেয় ‘মিথ্যা বিশ্বাস’-এর (false belief)। এক্ষেত্রেও ঠিক তাই ঘটে। তাকে আশ্রয় নিতে হয় অদ্ভুত এক মিথ্যা বিশ্বাসের, জিহাদের উদারপন্থী তত্ত্বের, যা কোরআন-হাদিস সমর্থিত নয়। সযত্নে লালিত আদর্শ ও কঠিন বাস্তবের সংঘাতে আজ এদের অন্তর জর্জরিত।
কোন মানুষ উদ্বেগ থেকে মুক্তি পেতে কোন মিথ্যা বিশ্বাসের আশ্রয় নেবে, সেটা তার নিজের বিষয়। কিন্তু সমস্যা তো এখানেই শেষ নয়। এরকম মিথ্যা বিশ্বাসের বশীভূত হয়ে হওয়ার অর্থ হল নিজে অন্যের হাতের পুতুল বা যন্ত্রে পরিণত হওয়া। বিষয়টি জাঁ পল সার্ত্রের উদাহরণ দিয়েই বোঝান যাক –
“একজন তরুণী প্রথমবার এক পুরুষ বন্ধুর সাথে ডেটিং এ বেড়িয়েছে। সে ভাল করেই জানে যে, তার পুরুষ বন্ধুর উদ্দেশ্য তার ভালবাসা পাওয়া ছাড়াও আরও বেশি কিছু এবং শীঘ্রই এই বিষয়ে তাকে একটা নির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সে পুরুষ বন্ধুটির সঙ্গ ত্যাগ করার সাহস তার নেই অথচ নিজেকে সম্পূর্ণভাবে সমর্পণ করার ইচ্ছাও তার নেই। এই দুটি বিকল্পের কোনও একটিকে বেছে নেওয়ার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা তার থাকলেও সে তা করতে পারে না। এরপর পুরুষ বন্ধুটি যখন তার হাতের ওপর হাত রাখে, তখন সে কী করবে বুঝতে পারে না। কেননা, নিজের হাতটি যদি সে পুরুষ বন্ধুটির হাতে স্বাভাবিক ভাবে রেখে দেয়, তাহলে তার অর্থ হবে পুরুষটিকে এগিয়ে যাওয়ার সম্মতি দেওয়া; অন্যদিকে যদি সে হাতটা সরিয়ে নেয়, তবে এই সুন্দর মুহূর্তটিকে নষ্ট করা হবে। এই মুহূর্তে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে না পেরে সে এমন ভান করে যেন সে কিছুই বোঝেনি। সে তৎক্ষণাৎ পুরুষ বন্ধুটির সাথে ভবিষ্যৎ সংক্রান্ত, আবেগ-বর্জিত ও আদর্শের কথা বলে প্রাণপণে সে দেহ ও মনের বিচ্ছিন্নতা ঘটাতে চায়। হাতটি যেন একটি জড়বস্তু ,যার কোনও অনুভূতি নেই। অচেতন জড়বস্তুর মতো সেটি পুরুষটির উষ্ণ মুঠির ভিতরে ধরা থাকে।”
এরকম অনুভূতি তো সব মেয়েদের ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে। যাই হোক, সার্ত্রের মতে, মেয়েটির সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা ছিল। কিন্তু এই স্বাধীনতা তার মধ্যে উদ্বেগ তৈরি করলো। কেননা তার সিদ্ধান্তের পরিণতি সে জানে না। মানুষ সর্বদায় উদ্বেগ থেকে বাঁচতে চায়। তাই সিদ্ধান্ত নিতে না পেরে নিজেকে ভুল বোঝায়, নিজের কাছেই কিছু না বোঝার ভান করে। অর্থাৎ নিজে সেই বিষয়ে অনুভুতিহীন না হলেও, নিজেকে সেই বিষয়ে অনুভূতিহীন হওয়ার মিথ্যাতে বিশ্বাস করায়। ঠিক এই ঘটনা ঘটে সাধারণ মুসলিমদের সাথে। তারা সব বুঝেও সিদ্ধান্ত নিতে না পারার কারণে কিছুই না বোঝার এবং কিছুই না হওয়ার ভান করে। তারা প্রাণপণে নিজেকে বিশ্বাস করাতে চায় যে এইসবের কারণ ইসলাম নয়। আবার উদাহরণের মেয়েটি যখন ওরকম ভান করে, নিজেকে মিথ্যা বিশ্বস্ত করে তখন কিন্তু সে আসলে উদ্বেগ কাটাতে গিয়ে নিজের চিন্তা ও ক্রিয়ার স্বাধীনতাকে নিজেই হারিয়ে ফেলে। নিজের অস্তিত্বকে হারিয়ে ফেলে। এই অবস্থা এমন এক দুর্বল অবস্থা যে, মেয়েটি শেষমেশ নিজেকে পুরুষটির ইচ্ছার ওপর ছেড়ে দেয়। তার ফল হয় মেয়েটি যা চাইছিল না, সেটাই হয়। মুসলিমদের ক্ষেত্রেও অবস্থা ঠিক এইরকম। অর্থাৎ যে ইসলামি জিহাদ বিষয়ে তারা সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, সেই ইসলামি জিহাদি তত্ত্বের হাতেই তারা নিজেদের ছেড়ে দেয়। তখন জেহাদিদের ইচ্ছাই তাদের ইচ্ছায় পরিণত হয়। নিজের মিথ্যা বিশ্বাসের ফলে তারা হয়ে পড়ে যন্ত্র। জিহাদিরা যা স্বপ্ন দেখায় তারা চোখ বন্ধ করে সেটাই বিশ্বাস করে।
অন্যান্য সন্ত্রাসবাদীদের সাথে জিহাদিদের পার্থক্য একটা বিশেষ ক্ষেত্রে। অন্যান্য সন্ত্রাসবাদীরা নিজেদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য সরকারকে চাপ দেয়। কিন্তু জিহাদিরা যখন জেহাদি কার্য পরিচালনা করে, তখন শুধুমাত্র সরকারই তাদের টার্গেট নয়। বরং এই কাজ করে তারা সম্পূর্ণ মুসলিম জাতিকে উন্নত, জটিল, বহুমাত্রিক এই সমাজ থেকে আলাদা করে দিতে চায়, যাতে সারা সমাজ তাদের দিকে সন্দেহ ও ঘৃণার নজরে দেখে। যাতে তারা আরও গুটিয়ে নেয় নিজেদের, আরও সংহত করে নেয়, আরও সচেতন হয়ে পরে নিজেদের ধর্মীয় পরিচায়ক সম্পর্কে, যেটা তাদের মিথ্যা বিশ্বাসেরই অঙ্গ। ধর্মীয় আইডেন্টিটি সম্পর্কে নিজেদের মিথ্যা বোঝানো এই অতি-সচেতন (!) সংহত একটি মানব- গোষ্ঠীকে অতি সহজেই ধর্ম বিষয়ে বিভ্রান্ত করা যায়। জিহাদিরা সেটা করে খুব দক্ষতার সাথেই। তারা ‘প্যান-ইসলাম’ (অর্থাৎ সারা বিশ্বের ইসলামিকরণের তত্ত্ব)-এর দিবাস্বপ্ন দেখিয়ে তাদের ব্যবহার করে যন্ত্র হিসাবে। আর এই মানুষগুলো অন্যদের ঘৃণা ও সন্দেহ থেকে বাঁচার জন্য এই পথটাকেই সঙ্গত মনে করে। তারা যন্ত্রের মতোই প্যান-ইসলামের সমর্থক হয়ে পড়ে। সমর্থক হয়ে পড়ে জিহাদের, নিজের অজান্তেই।
তবে এটাই শেষ কথা নয়। আশার কথা এই যে, মিথ্যা বিশ্বাস কোনোদিন চিরকালের জন্য থাকতে পারে না। সার্ত্র নিজেই বলেছেন, মিথ্যা বিশ্বাস একটা প্যারাডক্সিক্যাল (paradoxical) অবস্থা। কেননা, সার্ত্রের মতে মানুষ যখন উদ্বেগ থেকে প্রাণপণে পরিত্রাণ লাভের চেষ্টা করে, তখন পক্ষান্তরে সে উদ্বেগ সম্পর্কে আরও বেশি সচেতন হয়ে পড়ে। ছোটবেলায় ভাঙ্গার আগে আলগা হয়ে যাওয়া দাঁতের কথা ভাবুন, যতই ভাবতাম যে ওটা সম্পর্কে ভাববো না, ততই সেখানে জিভ চলে যেত, অর্থাৎ আমরা আরও সচেতন হয়ে পড়তাম। ঠিক সেইরকম এইসব মিথ্যা বিশ্বাসী মুসলিমদের ভবিতব্য হল, তারা একদিন বাস্তবের মাটিতে ফিরে আসবে। তাদের মিথ্যা বিশ্বাসই তাদের ফিরিয়ে আনবে মিথ্যা বিশ্বাস থেকে। নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন হবে তারা। স্বাধীনতা ও উদ্বেগের মুখোমুখি হবে। সেদিন কী হবে, সে সম্পর্কে ভবিষ্যৎবাণী করার ক্ষমতা আমার নেই। কেননা ‘স্বাধীনতা’ শব্দটির মধ্যে অসীম সম্ভাবনা নিহিত।
ডিসেম্বর ২৯, ২০১২; ৩:১৪ পূর্বাহ্ন
প্রেমিক প্রেমিকার যে উদাহরণটি দিলেন তা সত্যিই দুর্দান্ত। প্রেমিকা এক সময় প্রেমিকের হাতে নিজেকে সপে দেয় পরিণতির কথা না ভেবেই। একজন সাধারণ মুসলমান ঠিক হুবহু একাজটিই করে থাকে, তারা জিহাদীদের মতাদর্শে নিজেদেরকে সপে দেয়। যে কারনেই উপরে উপরে সাধারণ মুসলমানরা যতই ওসামা লাদেন সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করুক না কেন , তলে তলে তাকে মহাবীর বা মহাপুরুষ মনে করে। তেমনি ভাবে জাকির নায়েকের বক্তব্য শুনে কিছু কিছু ইসলাম জানা মুসলিম যতই বলুক না কেন জাকির মিয়া ইসলামের অপব্যখ্যা করছে, তলে তলে তাকে বিশাল পন্ডিত ও ইসলামের মহাপ্রচারক জ্ঞান করে। এভাবেই সাধারন মুসলমানরা নিজেদের সাথে প্রতিটা মুহুর্তে প্রতারণা করে চলে। এরও কারন হলো- তাদের মনের গহীনে দৃঢ় বিশ্বাস ইসলাম হলো একমাত্র সত্য ধর্ম।
ডিসেম্বর ২৯, ২০১২; ৩:৪৩ পূর্বাহ্ন
আসলে মুসলিমরা বোঝেই না যে তারা ভিক্টিম। অদ্ভুত ভাবে তারা পরিচালিত হচ্ছে। বুঝেও বোঝেনা। জানেন , একদিন কোন এক প্রসঙ্গে রাতে শুয়েও এই কথাটাই ভাবছিলাম, তখনই এই লেখার খসড়া তৈরি করেছিলাম।
ডিসেম্বর ২৯, ২০১২; ৬:৫১ পূর্বাহ্ন
ইসলামকে অনেকদিন ধরেই গভীরভাবে দেখে যাচ্ছি। আত্মীয় স্বজন সবাইকেই খুব ভালোভাবে খেয়াল করি। ইসলাম প্রশ্ন সবাই যেন আ্ডেনন্টিটি ক্রাইসিসে ভোগে। পরকাল নিয়ে সবাই খুব চিন্তিত। আমার আপা আর দুলাভাই দুজনেই খুব নিষ্ঠাবান মুসলিম।আপা এককাঠি বেশী। এমনিতে তেমন কিছূ গোড়াঁমি নেই। পরকালে কি সুযোগ আছে আপার জন্য এইটা বলতে পারলে ভাল হতো। দেখি সুযোগ বুঝে একদিন বলতে হবে।
জেহাদী মনোভাব প্রত্যেক কলেমা বিশ্বাসী মুসলিমের মনে বিরাজমান। ইসলামের কিছু হয়েছে, এই কথা শুনলে আর ঘরে থাকা যায় না। মানবতাকে ইসলামের উপরে কখনই এরা তুলে ধরতে পারেনা, আফসোস। এখান বছর দুই আগে আমার ব্লগে রোজার সময় একজন পোস্ট দিয়েছিলেন জরুরী রক্ত প্রয়োজন বলে। লোকও পেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি রাজি হলেন না রোজা ভেঙে যাবে বলে!! পরে সেই ব্লগার ধর্মের প্রতি একটু বীতশ্রদ্ধ হয়েছিলেন এই উদাহরনে।
মানবতাকে উপরে তুলে ধরতে সব ধর্মই ব্যর্থ। তবে যুগের সাথে সাথে অন্য ধর্মগুলো কিন্তু নিজেদের বদলাচ্ছে। এখন প্রচুর উদাহরন পাওয়া যাবে যেখানে ধর্মকে অগ্রাহ্য করে মানবতার ডাকে সাড়া দিয়েছেন অন্য ধর্মের মানুষ। কিন্তু ইসলামী বিশ্বাসী মানুষের ক্ষেত্রে এমনটি দুর্লভ হয়ে যাচ্ছে, স্বীকার করতেই হবে।
ডিসেম্বর ২৯, ২০১২; ৬:৫১ অপরাহ্ন
ঠিক বলেছেন! কিন্তু মানবতাকে তুলে ধরতে কোন ধর্মই সফল নয় বা ব্যর্থ, সেটা কথা না। আসল কথা হল, তারা মানবতাকে তুলে ধরতে চেয়েছিল কীনা। কিংবা সেইসময় মানবতার পরিভাষা সেটাই ছিল কীনা! ইসলাম তার উদ্দেশ্যকে ফুলফিল করতে ইসলামকে এত ক্লোজড একটা ধর্মতে রূপদান করেছে যে, তার দরোজা অন্যদের জন্য সর্বদায় বন্ধ।
ডিসেম্বর ৩০, ২০১২; ১:৪৫ পূর্বাহ্ন
ইসলামি জিহাদ নিয়ে আজকাল প্রচুর লেখা দেখা যাচ্ছে। আপনার লেখাটি একেবারে মৌলিক এবং সম্পূর্ণ নতুন আঙিকে। লেখা পড়ে সত্যিই অনেক কিছু জানলাম–বিশেষতঃ সার্ত্রের অভিমত এবং তুলনা। আমি আজ পর্যন্ত কোরানের কোথাও দেখি নাই যে নবি বলেছেন–জিহাদ বিভিন্ন ধরণের- কোরানের কোথাও লেখা নাই যে জিহাদের অর্থ ভালভাবে পড়াশোনা করা, সার্থকভাবে কম্পুটার শেখা…অথবা বাড়ির বাগানের ঘাস কাটা। কিন্তু উদারপন্থী সাধারণ মুসলিমরা মনে করে যে, মনের মধ্যেকার অসৎ প্রবৃত্তিকে ধ্বংস করতে সংগ্রামই আসলে আল্লাহ-র পথে সংগ্রাম। দেখুন, আল্লাহ্ পাক কী লিখেছেন কোরানে। এই ধরণের আরও অনেক আয়াত কোরানে আছে। কোরানের কোথাও লেখা নাই যে জেহাদ হচ্ছে মনের মন্দের সাথে ভালোর যুদ্ধ করা।
এদিকে ইবন কাসিরের কোরানের ব্যাখ্যা থেকে পরিষ্কার হয় যে জেহাদের অর্থ হচ্ছে অমুসলিম এবং মন্দ-মুসলিমদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম চালানো–অর্থাৎ মার এবং মর–রক্তপাত করো।
ডিসেম্বর ৩০, ২০১২; ৭:২৪ পূর্বাহ্ন
@আবুল কাশেম, ধন্যবাদ ! আসলে সার্ত্র অনেক অনেক অনুভবী দার্শনিক। আমি উনার দ্বারা দারুন প্রভাবিত! যখনি কোন কিছুর ব্যাখ্যা খুঁজি, সার্ত্র এর দর্শনে সেই ঘতনার কি ভাষ্য হতে পারে, একবার অন্তত ভেবে দেখি! ব্যাক্তি স্বাতন্ত্রবাদী দার্শনিক হিসাবে উনি আমার খুব পছন্দের একজন।
ডিসেম্বর ৩০, ২০১২; ১০:২৮ পূর্বাহ্ন
সার্ত্রের শুধু নামই শুনেছি। উনার দর্শন ব্যাপারে আমার কোন জ্ঞানই নেই। উনি কী ফরাসি না জার্মান?
আসলে সার্ত্র অনেক অনেক অনুভবী দার্শনিক। আমি উনার দ্বারা দারুন প্রভাবিত!
সার্ত্রের কোন লেখা (মানে বই) আপনার চিন্তাধারাকে এত বিপুলভাবে প্রভাবিত করেছে?
ডিসেম্বর ৩০, ২০১২; ৭:৫৬ অপরাহ্ন
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও তার অব্যবহিত পরবর্তী সময়ের ফরাসী দার্শনিক ছিলেন জাঁ পল সার্ত্র। ইনি একজন বিখ্যাত নাত্যকার ও উপন্যাসিক। অবশ্য সেগুলি তার দর্শনের উপরেই বাস্তব রুপদান। । তার দার্শনিক গ্রন্থ ‘being and nothingness’ , ‘existentialism and humanism’ এই বই দুটো আমার পরা। দ্বিতীয়টার অনুবাদ ও বাংলাদেশে পাওয়া যায় শুনেছি। আর এর আর একটি পরিচয় এ হল মহিলা দার্শনিক সিমঁ দ্য বুভয়া , যিনি the secend sex ( এই বইটির অনুবাদ মনে হয় ডঃ হুমায়ুন আজাদ করেছেন)নামক একটি ক্লাসিক নারী ও নারীবাদী দর্শনের বই লিখেছেন। এর সারা জীবনের প্রেমিক। এদের জিবনী যত পরবেন অবাক হবেন। এরা কেউ কাউকে কখনো প্রতারিত করেন নি সারা জীবনে। আবার বিয়েও করেননি। ভাবছেন লিভ তুগেদার , সেতাও করেন নি। কিন্তু সারা জীবন তারা প্রেমে অটুট থেকেছেন!
ডিসেম্বর ৩১, ২০১২; ১২:২৩ পূর্বাহ্ন
অনেক ধন্যবাদ–ব্যাপারটা পরিষ্কার করার জন্য। যা বুঝলাম তা এই প্রকার–ভুল হলে সংশোধণ করে দিবেন। জাঁ পল সার্ত্র ছিলেন একজন পুরুষ, আর সিম দ্য বুভয়া একজন মহিলা। দুই জনই ছিলেন ফরাসি। দুজনই একে অপরকে মনপ্রাণ দিয়ে ভালবাসতেন–যদিও বিবাহ হয় নাই, বা একসাথে থাকা ছিল না।
এই ধরণের প্রেম সত্যই অপূর্ব–অনেকে এই ধরণের প্রেমকে প্লাটনিক প্রেম বলে থাকেন। আপনার প্রস্তাবিত বইগুলো খুঁজবো। বইগুলো কী খুব লম্বা নাকি? কারণ আমি কিন্তু শম্বুক গতিতে পড়ি। একটা মাঝারি সাইজের বই পড়তে অনায়াসে দুই থেকে তিন মাস লেগে যায়। তারপর বুঝতে লাগে আরও অনেক দিন।
ডিসেম্বর ৩১, ২০১২; ৫:০৫ পূর্বাহ্ন
না না আপনি ঠিকই বুঝেছেন। বইগুলো ছোটই। কিন্তু বুঝতে সময় লাগে।