পত্র-পত্রিকায় কতগুলি সাধারণ বিষয় থাকে যার একটি ‘ইন্ট্রো’। যে কোনো লেখার ‘ইন্ট্রো’ দেখেই সারাংশের মোটামুটি ধারণা মেলে। গত ১২ আগস্ট বাংলাদেশ প্রতিদিনে জনাব সাইফ ইমন এর ‘স্টালিনের করুণ পরিণতি’ নামে একটি অটোবায়োগ্রাফ/প্রতিবেদন/প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে, যার ইন্ট্রো পড়েই যে কেউ বুঝে নিতে পারবেন লেখাটি নিকৃষ্টমানের, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, কুৎসা রটনা এবং বিদ্বেষপ্রসূত, তদুপরি ইতিহাসের বিকৃতি। কারো সমালোচনা করতে গেলে ন্যুনতম পড়াশুনা করতে হয় এই বাস্তবতাটিও লেখক পাত্তা দেননি। বিদ্বেষ উগরে দিতে গেলেও ইতিহাস বিষয়ে সাধারণ জ্ঞান থাকতে হয়। যার কোনোটিই লেককের নেই। একজন মানুষ মোটামুটি পূর্ণ বয়সে (৭৪ বছর) হৃদরোগে মারা যাওয়াকে যিনি বা যারা ‘করুণ পরিণতি’ নামে শিরোনাম দেয় তাদের উদ্দেশ্য আর যা-ই হোক সৎ নয়।
শুরুতেই ভুল। বলা হয়েছে-
“রুশ সমাজতন্ত্রী রাজনীতিবিদ জোসেফ স্টালিন। সাধারণ দরিদ্র মুচি পরিবারের সন্তান ছিলেন।”
তিনি ‘রুশ সমাজতন্ত্রী রাজনীতিবিদ’ নন, তিনি ছিলেন রুশ কমিউনিস্ট পার্টি (বলশেভিক) এর সদস্য। ক্রমান্বয়ে পদাধিকারবলে পার্টি সাধারণ সম্পাদক। তিনি মোটেই ‘মুচি পরিবারের’ (ঘৃণা অর্থে এই ইতিহাস বলতে গিয়ে মিনিমাম সৌজন্যবোধটুকুও খুইয়েছেন লেখক) সদস্য ছিলেন না। তাঁর বাবা ছিলেন ছোট কৃষক। চাষবাদে সংসার ভালোভাবে চলত না বলে বাড়িতেই জুতো তৈরির কুটির শিল্প গড়েছিলেন। জুতো তৈরি করে সাপ্লাই দিতেন।
এরপর লিখলেন,
“জোসেফ স্টালিন একজন রুশ সমাজতন্ত্রী রাজনীতিবিদ। তিনি ১৯২২ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের ইতিহাসে ওই সময়ে স্টালিনের নেতৃত্বে প্রচলিত রাজনৈতিক মতবাদ ‘স্টালিনবাদ’ নামে পরিচিত। এ মতবাদ গোটা বিশ্বে হৈচৈ ফেলে দেয়।“
সোভিয়েত ইউনিয়নে কোনো কালেও ‘স্তালিনবাদ’ হিসেবে কোনো মতবাদ ছিল না। মার্কসবাদ এবং লেনিনবাদ ছিল। সুতরাং ‘স্তালিনবাদ’ নিয়ে বিশ্বে হৈচৈ পড়ার কিছু ছিল না। সোভিয়েতের শাসনভারও ‘গ্রহণ’ করেননি। নেতৃত্বের গুণে, পার্টির সিদ্ধান্তে এবং সর্বপরি লেনিনের ইচ্চাতেই তাকে পার্টির দায়িত্ব নিতে হয়। এ প্রসঙ্গে-
উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারে যাই বলা হোক না কেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, লেনিনই স্তালিনকে কেন্দ্রীয় কমিটিতে নিয়ে এসেছিলেন এবং পার্টি পত্রিকা ‘প্রাভদা’ পরিচালনার মতো এক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিয়েছিলেন। ট্রটস্কি খুবই প্রতিভাবান কিন্তু অদ্ভুত রকমের নিষ্ঠুর, তিনি সবসময়েই লেনিনের খুঁত ধরতেন, তাঁর ভাষায় ‘পরশ্রীকাতরতা’ সম্পর্কে, এবং যখন লেনিনকে উত্ত্যক্ত করছিলেন তখন লেনিনের সম্মতিক্রমেই স্তালিন ১৯১৩ সালের ১২ই জানুয়ারি ট্রটস্কিকে “এক ভুয়ো পেশাদারি মামুলি হামবড়া চ্যাম্পিয়ন” আখ্যা দিয়ে এক তীব্র ভাষায় চিঠি লিখেছিলেন। এই আক্রমণ ট্রটস্কি কখনো ভোলেননি। সেটাই ছিল, বলা যেতে পারে, সোভিয়েত ইতিহাসে বিখ্যাত মতাদর্শগত বিরোধের (ভালো বা মন্দ যাই হোক) সঙ্কেত। অবশ্য ট্রটস্কি নিজের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলেন। তিনি বিদ্রুপ করে বলতেন “কীরকম সব কুঁড়ে, স্থূল-বুদ্ধির লোকদের সঙ্গে রয়েছেন লেনিন”। এটা স্মরণ করিয়ে দেয় তাঁর একসময়কার (১৯০২) অনুভব যে ‘ওস্তাদ কলহপরায়ণ’ লেনিন ছিলেন ‘রাশিয়ার শ্রমিক আন্দোলনে পশ্চাৎপদতা’-র এক উদাহরণ (আইজাক ডয়েটশার, ‘স্তালিন’, পৃষ্ঠা: ১৩০-১৩১ দ্রষ্টব্য)।
এর পর হঠাৎ করেই স্তালিন কত মানুষ ‘হত্যা’ করেছিলেন তা না বলা অব্দি পেটের ভেতর গুড় গুড় করছিল! এবার বললেন-
“১৯৩০-এর দশকে স্টালিন নিজের ক্ষমতা শক্ত করার জন্য জনসাধারণের ওপর নিপীড়ন শুরু করেন। ইতিহাসের পাতা ঘাটলে দেখা যায় এই নেতা প্রায় ১৫ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী। শুধু ১৯৩২ থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত প্রায় ৬০ লাখ মানুষ মারা যায় সরকারি বাহিনীর অত্যাচারে।“
তাই? দেখুন তাহলে। স্তালিন আমলে সোভিয়েত ইউনিয়নে গুলাগ লেবার ক্যাম্পগুলোতে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু ও খুন সম্পর্কে যেসব ভয়াবহ গল্প চালু আছে তার একটাও কখনো শোনেননি, এরকম মানুষ আজকের দুনিয়ায় মাইক্রোস্কোপিক। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের ওইসব বন্দিশিবিরে লক্ষ লক্ষ বন্দীকে অনাহারে উপবাসে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। এরকমই আরও লক্ষ লক্ষ মানুষকে সেদিন সেখানে হত্যা করা হয়েছিল, শুধু এই কারণে যে তারা ক্ষমতাসীনদের বিরোধী। স্তালিন আমলের সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্কে এইসব কাহিনীও বহুল প্রচারিত। পুঁজিবাদী দুনিয়ায় এইসব গল্প বারে বারে নানা বইয়ে, খবরের কাগজে, রেডিওতে, টেলিভিশনে, চলচ্চিত্রে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। তাদের সরবরাহ করা এইসব মনগড়া তথ্যে গত ৬০ বছরে সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার তথাকথিত হৃদয়হীন নিষ্ঠুরতার শিকার এইসব মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
আজ সোভিয়েত আমলের সমস্ত গোপন নথিপত্রই ঘেঁটে দেখে খুব সহজেই বের করা সম্ভব, ঠিক কতজন সেদিন সোভিয়েত ইউনিয়নে বন্দী ছিলেন, কে কত বছর সেখানে বন্দিশালায় কাটিয়েছেন, কতজন বন্দী অবস্থায় মারা গেছেন, বা ঠিক কতজনকে সেদিন মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রকৃত সংখ্যা জানার ক্ষেত্রে আজ আর কোনো বাধা নেই। কিন্তু কী পাওয়া গেল সেখানে? দেখা গেল, এতদিনের বহুল প্রচারিত গল্পের সাথে প্রকৃত সত্যের মিল নেই। কারা এই গল্পগুলো রটিয়েছিল তা খুঁজলে দেখা যাবে, হিটলার থেকে হার্স্ট, কনকোয়েস্ট থেকে সোলঝেনিৎসিন, সকলেই এর সঙ্গে যুক্ত।
প্রথমদিকে বলা হতো ৬ লাখ। তার পর দফায় দফায় ২০ লাখ থেকে এক লাফে ৬০ লাখ। এরও পরে বলা হতে থাকল আড়াই কোটি মানুষকে হত্যা করেছে স্তালিন!
কিন্তু এসব কাহিনীর সত্যতা কতখানি? কোথা থেকে এসব কাহিনী এলো? এই কাহিনীগুলোর লেখকরা বার বার দাবি করে এসেছেন যে, স্তালিন আমলে সোভিয়েত ইউনিয়নে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর যে কথাগুলো তারা বলে আসছেন তা নাকী অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। যেদিন সেদেশের সরকারি তথ্যভাণ্ডার খুলে গোপন নথি সকলের সামনে প্রকাশিত হবে সেদিন নাকী সবাই বুঝতে পারবে, এই কাহিনীগুলোর সত্যতা। সোভিয়েত ইউনিয়ন আজ আর নেই। ১৯৯১ সালেই তার পতন ঘটেছে। ইতিহাস গবেষকদের কাছে তার সমস্ত গোপন নথিপত্রই আজ সম্পূর্ণ উন্মুক্ত। কিন্তু ওইসমস্ত গল্পগুলোর সপক্ষে কোনো তথ্যপ্রমাণ সেখানে পাওয়া গেল না কেন? এই প্রশ্নটিই কী কেউ করেছেন?
সেখান থেকে এক লাফে লেখক চলে এলেন স্তালিনের নাম কী ছিল সেই প্রশ্নে! লিখলেন-
“স্টালিনের আসল নাম ‘জোসেফ বেসারিওনি জুগাসভিলি’। ‘স্টালিন’ ছিল তার ছদ্মনাম। এর আগে তাকে ‘কোবা’ এবং ‘সোসেলো’ নামেও ডাকা হতো।“
এখানেও ভুল। সত্যি হলো- তাঁর ডাক নাম ছিল ‘সোসো’। স্তালিনের প্রথম দিককার অন্যতম ছদ্মনাম ছিল ক্যাটো (‘কোবা’ থেকে ধাপে ধাপে উত্তরণ করে স্তালিন, ইস্পাত মানব’), ক্যাটো ছিলেন প্রাচীন ইতিহাসে এক রোমান কনসাল যাঁকে রোম সাম্রাজ্যের আগ্রাসনকে রুখে দাঁড়ানো কের্থিজ-এর অনমনীয় শত্রু হিসেবে স্মরণ করা হতো। ক্যাটোর প্রতিটি ভাষণ শেষ হতো ‘কের্থিজ নিপাত যাক’ ধ্বনি দিয়ে। একইরকম অনমনীয় ঘৃণার সঙ্গে স্তালিন তাঁর যৌবনের শুরু থেকে মৃত্যুর শেষ দিন পর্যন্ত পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে শিখিয়েছিলেন।
তাঁর শিক্ষাজীবন নিয়ে বলতে গিয়ে অহেতুক তার বাবাকে ‘অত্যাচারী’ বানিয়ে এক অদ্ভূত বিমলানন্দ লাভে সচেষ্ট হলেন লেখক। লিখলেন-
“১০ বছর বয়সে মিশন চার্চ স্কুল দিয়ে শিক্ষাজীবন শুরু করেন তিনি। তখন স্কুলে জর্জিয়ান শিশুদের রুশ ভাষা শিখতে বাধ্য করা হতো। কৈশোরের শুরুতেই মারাত্মক আঘাত আসে স্টালিনের জীবনে। মাত্র ১২ বছর বয়সে গাড়ি দুর্ঘটনায় স্টালিনের বাম হাতটি চিরদিনের জন্য অচল হয়ে যায়। একসময় স্টালিনের অত্যাচারী বাবা তার স্কুলে যওয়া বন্ধ করে তাকে কাজে লাগিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু স্টালিনের মা তাতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। স্টালিন ১৬ বছর বয়সে জর্জিয়ান অর্থাডক্স বৃত্তি পান। কিন্তু সেখানে তিনি সাম্রাজ্যবাদ ও ধর্মীয় শাসনের বিরুদ্ধাচরণ করেন। ১৮৯৯ সালে চূড়ান্ত পরীক্ষায় অনুপস্থিত থাকায় তিনি বহিষ্কার হন। তবে সোভিয়েত নথি থেকে জানা যায়, তৎকালীন নিষিদ্ধ বই পড়ার দায়ে এবং গণতান্ত্রিক পাঠচক্র গড়ে তোলায় তাকে বহিষ্কার করা হয়। স্কুল ছাড়ার পর বিপ্লবী লেনিনের লেখা পড়ে মার্কসবাদী বিপ্লবী হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন স্টালিন।”
এই অংশটুকু পড়লে মনে হবে লেনিনের লেখা পড়েই স্তালিন মার্ক্সবাদী বিপ্লবী হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন! আশ্চর্য অনুমান ক্ষমতা লেখকের এবং পত্রিকাটির!
১০ নয়, ৯ বছর বয়সে গোরির এক যাজক স্কুলে ভর্তি করানো হয়। ওখানে পড়াশুনা করাকালীন ধর্মীয় এবং সাম্রাব্যাদের বিরোধীতা করাটা লেখকের ভাষায় ‘অপরাধ’! তবে তিনি এই ‘অপরাধ’ করার কারণেই অন্য যে কারুর চেয়ে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ ভালো বুঝতে পেরেছিলেন। মাত্র ১৫ বছর বয়সে যখন সকলে ফ্যান্টাসি পড়তে ভালোবাসে, সোসো তখন সাম্রাজ্যবাদ, নিপীড়ন, পরাধীনতা নিয়ে গভীরভাবে ভাবতেন। স্কুলেই গোপন গ্রুপ গড়ে তুলেছিলেন। এর লেনিনের লেখা পড়ে মার্কসবাদী বিপ্লবী হওয়ার সিদ্ধান্ত নেননি। বিপ্লবী হওয়ার ব্যাপারটা হুট করে সিদ্ধান্ত নেয়ার ব্যাপার নয়। অবশ্য এটা লেখকের ঊর্বর মস্তিষ্কে ঢোকার কথা নয়।
এবার তার রাজনৈতিক উত্থান নিয়ে বলা চেষ্টা হয়েছে, এবং যথারীতি ভুলভাল ইতিহাস উগরে। বলা হয়েছে-
“১৯০৩ সালে লেনিনের বলশেভিকে যোগ দেন স্টালিন। কিছুকাল পরেই তার সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী কর্মকাণ্ডের জন্য জারের সিক্রেট পুলিশের নজরে পড়েন। এরপর গড়ে তোলেন গুপ্ত প্রতিরোধ। বলশেভিক থেকে তাকে ককেশাস অঞ্চলের বিপ্লবী প্রধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়। সেখানেই তিনি গড়ে তোলেন গুপ্ত আধা-সামরিক বাহিনী। তার নেতৃত্বে গুপ্তহত্যা, ব্যাংক ডাকাতিসহ নানা ঘটনা ঘটে।“
শুরু করলেন বলশেভিক পার্টিতে যোগ দেয়া নিয়ে। শেষে টেনে আনলেন ব্যাংক ডাকাতি অব্দি! পার্টি আর পার্টির জটিল সব আইন-কানুন, নিয়ম-শৃঙ্খলা, পার্টির বিকাশ ইত্যাদি বিষয়গুলো এনার লিখতে ভালো লাগল না। ইনি সোজা চলে গেলেন সাইবেরিয়ায় নির্বাসন পর্যন্ত! লিখলেন-
“ ১৯০৭ সালে ‘তিফিলস’ ব্যাংক ডাকাতির জন্য চরমভাবে নিন্দিত হন তিনি। এতে স্টালিনের রাজনৈতিক ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিপ্লবের সময় তিনি বহুবার ধরা পড়েছিলেন। এমনকি সাইবেরিয়াতে নির্বাসিত জীবন যাপন করেছিলেন। কিন্তু প্রতিবারই তিনি কোনো না কোনোভাবে পালিয়ে আসতে সমর্থ হন। শেষবার যখন তিনি আটক হন তখন তাকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বাধ্যতামূলক রুশীয় সেনা দলে যোগদানের আদেশ দেওয়া হয়। কিন্তু তার অচল বাম হাতের জন্য সেই যুুদ্ধে যেতে হয়নি। ১৯১৮-১৯২২ সাল পর্যন্ত রাশিয়ার সিভিল ওয়ারের কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের আধা সামরিক সংগঠনকে বলা হতো রেড আর্মি যা ১৯৩০ সালে বিশ্বের বৃহৎ সেনাবাহিনীর স্বীকৃতি পায়। ১৯২১ সালের রেড আর্মি দ্বারা জর্জিয়া আক্রমণের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন স্টালিন। ওই সফলতায় লেনিনের সঙ্গে স্টালিনের সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটে। পরবর্তীতে পার্টির প্রতি আনুগত্য, দৃঢ় প্রত্যয়ী স্টালিনকে পার্টির সাধারণ সম্পাদকের পদে মনোনয়ন দেওয়া হয়।“
ব্যাপারটা যে ‘দেয়া হয়’ না হয়ে ‘অর্জন করেন’, এই ছোট্ট অথচ গুরুত্বপূর্ণ কখাটি লিখতেও আড়ষ্ট হলেন সাইফ ইমন।
“স্টালিন দ্রুত শিল্পায়ন ও কৃষিকার্যের কেন্দ্রীয়করণের মাধ্যমে পুরো দেশটি অল্প সময়ের মধ্যে শিল্পোন্নত দেশে পরিণত করেন। কিন্তু একই সময়ে অর্থনৈতিক উত্থান-পতনের দরুন কোটি কোটি মানুষ দুর্ভিক্ষে মারা যান।“
এর পর যা যা লিখলেন তার এক কথায় উত্তর হয় এটাঃ
ভয়ংকর রকম অসুবিধার মধ্য দিয়ে সোভিয়েত সমাজতন্ত্র নির্মাণের কাহিনী সংক্ষিপ্ত আকারে প্রকাশ করা খুবই কঠিন। কিছু মোটা দাগের রূপরেখা দেওয়া যেতে পারে। প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক মতাদর্শের বিনিময় ও সমন্বয় ছাড়া প্রধানত ট্রটস্কি, জিনোভিয়েভ ও কামেনেভ (একত্রে বা আলদাভাবে) প্রভৃতির ‘বাম’ চিন্তাধারা প্রসূত প্রভাব পড়েছিল যে, যখন সোভিয়েত ইউনিয়নের বাইরের বিশ্বে পুঁজিবাদ সর্বোচ্চ অবস্থায় চলতে থাকবে তখন দেশের অভ্যন্তরে সমাজতন্ত্র নির্মাণের সমস্ত প্রয়াস অসার ও ব্যর্থ হতে বাধ্য। বুখারিন, রাইকভ ও ট্রটস্কি পরিচালিত দক্ষিণপন্থীদের, তাদের কিছু বিপ্লবী বুলি সত্ত্বেও, শোক প্রকাশ করতে দেখা গেছে যে, পুঁজিবাদকে যখন আপাতদৃষ্টে উৎখাত করা যাচ্ছে না তখন তাদের সঙ্গে আপস করে নেওয়াই ভালো। এটা একটা সরলীকৃত বিবরণী হবে যদি না মনে রাখা হয় প্রাক্তন জার সাম্রাজ্যর একটা বিশাল বিভিন্ন প্রকৃতির অসমর অঞ্চলের সমষ্টির মানুষের জীবনকে রূপান্তরিত করার কঠিন বৈপ্লবিক প্রক্রিয়ার অকল্পনীয় দুঃসাধ্যতা। এখন আর সিডনি ও বিয়েত্রিচ ওয়েব-এর ঐতিহাসিক গ্রন্থ ‘সোভিয়েত কমিউনিজম’কে স্মরণ করার প্রচলন নেই, কিন্তু ঘটনায় পরিপূর্ণ এর পৃষ্ঠাগুলো, সোভিয়েতের শত্রুভাবাপন্ন পর্যবেক্ষকদের উল্লেখ এবং সোভিয়েত কর্তৃপক্ষের কাছে পেশ করা রিপোর্ট ও প্রকাশনা, সোভিয়েতের মতাদর্শ থেকে লেখকদ্বয়ের পার্থক্য তুলে ধরার সাথে সাথে আশ্চর্যরকম পক্ষপাতহীন বস্তুনিষ্ঠ দৃষ্টিভঙ্গি যদি কোনো সৎ গবেষক চর্চা করেন তাহলে দেখতে পাবেন তাদের আলোচনার ব্যাপ্তি ও সময়কালের ঘটনার এক অকাট্য বিবরণী।
কেউ হয়তো স্মরণ করতে পারেন ১৯২০ সালের কাছাকাছি যখন বার্ট্রান্ড রাসেল ঝটিকা সফর সেরে ‘দ্য থিয়োরি অ্যান্ড প্র্যাকটিস অব বলশেভিজম‘ নামে একটি সমালোচনামূলক বই লিখেছিলেন, তখন সেই বইটির পর্যালোচনা করতে গিয়ে সুপরিচিত রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক কার্ল র্যাডেক লিখেছিলেন, যখন সোভিয়েত জনগণ ও তাঁদের নেতৃবৃন্দ সমস্ত অসুবিধাকে জয় করে কঠিন কাজ করে চলেছেন তখন রাসেলের পক্ষে খুবই সহজ ও স্বাভাবিক, দেশে ফিরে গিয়ে নিজের বাড়ির ঘরের মধ্যে চুল্লির উত্তাপের সামনে আরামে বসে হাতে তৈরি পানীয়র পাত্র নিয়ে পাইপ টানতে টানতে বলশেভিকদের দুষ্কর্মের রোমন্থন করা। এমনকী যদি উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া সাবেক আমলের ইট দিয়ে সাহসী নতুন বিশ্বকে গড়ে তুলতে হয় সেখানে বলশেভিকদের কাছে পরিপাটি করে কাজ করা সম্ভব ছিল না। লেনিনের মৃত্যুর পর স্তালিন যিনি ট্রটস্কি ও জিনোভিয়েভের মতো নন, লেনিন ও তাঁর শিক্ষার প্রতি সর্বদাই বিশ্বস্ত ছিলেন, খুব দ্রুতই সমকক্ষদের মধ্যে প্রথম স্থানে উঠে যান। এর কারণ, ট্রটস্কির মতে, স্তালিন ছিলেন ‘নিঃসঙ্গ নেকড়ে’, আশপাশের মধ্যে সবসময়ই উদ্ধত, ‘মাঝারি ধরনের ব্যবস্থা’। কিন্তু সেটাই যখন ছিল হাতের কাছে একমাত্র ব্যবস্থা তখন আর কোনো উপায় ছিল না। এটা এই নয় যাকে বলা হয় ‘ন্যায্যতা প্রতিপাদন করা’, অর্থাৎ যাই ঘটকু না কেন তাই যথার্থ বলার প্রয়াস। এটা সেইরকমই হতো যদি মহান অক্টোবর বিপ্লব হতো একটা দুর্ভাগ্যজনক ভ্রান্তি, যদি মানব ইতিহাসে সোভিয়েত হতো একটি নেতিবাচক ঘটনা। তবে যে চরম ক্ষতিকর প্রচার বছরের পর বছর ধরে চলছে তা ইতিহাসের রায় নয়, হতেও পারে না। এমনকী আইজাক ডয়েটশার কখনো কখনো স্তালিনকে ভেবেছেন ‘প্রাচ্য জাতীয়’ ধূর্ততায় (এমনকী তাঁর মতো সংবেদনশীল লেখককেও ‘পশ্চিমা’ পক্ষপাতমূলক মনোভাব ত্যাগ করা কঠিন হয়েছে) সজ্জিত এক গভীর প্রতারণাপূর্ণ রাজনৈতিক চালক, যিনি অসীম ধৈর্যের সঙ্গে একজনকে আরেকজনের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়েছেন এবং অবশেষে শীর্ষ অবস্থানে উঠে গেছেন। হয়তো তিনি মনে মনে নিজের কোনো উচ্চাশা পোষণ করতেন, কিন্তু অন্ততপক্ষে এমনকী তাঁর সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের দৃষ্টিতেও, তিনি ছিলেন একজন ধীর, স্থির ও শান্ত স্বভাবের দক্ষ সহকর্মী যাঁর কোনো দর্শনীয় গুণ ছিল না এবং বাহ্যত নিজেকে সাধারণ হিসেবেই তুলে ধরতে চাইতেন। এটা যদি তাঁর কোনো মুখোশ হয়ে থাকে তাহলে এতো বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে তিনি তা করেছেন যে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীরাও হার মেনে গেছে। এটাও ধরা পড়ে স্তালিনের সময়-জ্ঞান ছিল প্রায় অতিপ্রাকৃত। নিঃসন্দেহে তিনি শিক্ষা নিয়েছিলেন ট্রটস্কির কাছ থেকে যাঁর ছিল প্রকৃতই এক অতি তৎপর মানসিকতা এবং কৃষির যৌথ-খামারিকরণ ও অর্থনৈতিক পরিকল্পনা রচনার (শিল্পায়নের প্রয়োজনে) চিন্তাধারা, যার মূল নির্যাস স্তালিন আয়ত্ত করে যথাসময়ে যতদূর সম্ভব কঠিন অবস্থাতেও কার্যকরী করেছেন। বাস্তবক্ষেত্রে তাঁকে সুসজ্জিত করেছিল তাঁর তৃণমূল সংযোগ ও পার্টি সংগঠনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। একসময়ে লেনিনের পরেই অবস্থিত ট্রটস্কি নিজেরই সৃষ্ট সমস্যার শিকার হয়েছিলেন, যা বিভিন্ন সময়ে আরও প্রকট হয়েছে সুবিধাবাদী জননেতাসুলভ ব্যক্তি শ্রদ্ধাপূর্ণ ব্যবহার করেছেন ট্রটস্কির সঙ্গে (সেটা কী স্তালিনের চতুরতা?) এবং জিনোভিয়েভদের উদ্যোগেই ট্রটস্কির অবনমন শুরু হয়েছিল। ১৯২৬ সালের অক্টোবরে তাঁকে পলিটব্যুরো থেকে অপসারিত করা হয়; ১৯২৭-এর অক্টোবরে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে তিনি বহিষ্কৃত হন; ১৯২৭ সালের নভেম্বর মাসে মহান বিপ্লবের ঠিক দশ বছর পরে, ট্রটস্কি পার্টি বিরোধী কাজে লিপ্ত হওয়ার অভিযোগে পার্টি থেকে বহিষ্কৃত হন; ১৯২৮-এর জানুয়ারিতে কাজাখস্তানের আলমা আটায় নির্বাসিত করা হয়; ১৯২৯ সালে দেশ থেকে বহিষ্কৃত হন, চলে যান তুরস্ক ও নরওয়ে হয়ে মেক্সিকোতে (জানুয়ারি ১৯৩৭)। তাঁর মতো আগুন ঝরানো বিপ্লবী অভিমানহত হয়ে বসে থাকতে পারেন ভাবা যায় না, কিন্তু তিনি সবসময়েই রাগে গরগর করেছেন নিঃসঙ্গভাবেই, কারণ তিনি পরিবেষ্টিত ছিলেন বিভিন্ন ধরনের সোভিয়েত-বিরোধী শক্তির দ্বারা, এবং চেষ্টা করছিলেন তাঁর নিজের চতুর্থ আন্তর্জাতিককে পুনরুজ্জীবিত করতে, যা ১৯৩৫ সালে এসে সোভিয়েত ইউনিয়নকে দখল করে নিতে নিজেকে প্রস্তুত ও সক্ষম বলে ভেবেছিলেন! ১৯৪০-এর এপ্রিলে ট্রটস্কি ‘সোভিয়েত শ্রমিক ও কৃষকদের কাছে’ আবেদন করেন “Cain* who is Stalin”-কে ধ্বংস করতে [কেইন ছিল আদম-পুত্র, যে তার ভাই আবেলকে হত্যা করেছিল)]। একটি দীর্ঘ রোমাঞ্চকর কাহিনীর সমাপ্তি ঘটে ট্রটস্কির ‘নিজের গলায় ফাঁস’ লাগানোর মতো যখন জনৈক গুপ্তঘাতক, যে নিজেই ছিল একজন ট্রটস্কিপন্থী (অভিযোগ করা হয় স্তালিনের উদ্যোগে), ১৯৪০-এর ২০ আগস্ট মেক্সিকোতে তাঁকে হত্যা করে।
ইতোমধ্যে, লেনিনের মৃত্যুর পর, স্তালিন তাঁর দোষ-গুণসহ দৃঢ়ভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টিকে পরিচালিত করেছেন বিরামহীন অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক শত্রুতার বিরুদ্ধে লড়াই চালাতে এবং সোভিয়েত রাষ্ট্রকে যতোটা সম্ভব গড়ে তুলতে ও সংহত করতে। স্তালিনই সমাজতান্ত্রিক শিল্পায়ন ও কৃষির খামারিকরণের লাইনকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে সোভিয়েত পার্টি ও জনগণকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। আবার, স্তালিনই (যদি একজনের নাম উচ্চারণ করতে হয় যদিও তিনি বলতেন ‘একজন ব্যক্তি কখনই স্থির করতে পারেন না’) পরে পার্টি ও জনগণকে নেতৃত্ব দিয়েছেন যখন সোভিয়েত লাল ফৌজ এক অকল্পনীয় কঠিন লড়াইয়ে (১৯৪১-৪৫) জয়ী হয়েছেন এবং ভয়ংকর ফ্যাসিস্ট অক্ষশক্তিকে পরাজিত করে এক বিশ্বব্যাপী ঐতিহাসিক বিজয় সংগঠিত হয়েছে। এই দায়িত্ব পালনের মধ্যবর্তী সময়ে স্তালিনই পার্টিকে নেতৃত্ব দিয়েছেন যখন পার্টি সর্বপ্রকার সুবিধাবাদ ও বিকৃতিবাদ-এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে, ট্রটস্কি, জিনোভিয়েভ ও কামেনেভ এবং পরে বুখারিন ও রাইকভ পরিচালিত গোষ্ঠীর কার্যত পরাজিত মনোভাব ও বিভেদকামী কার্যকলাপকে উচ্ছেদ করে মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে রক্ষা ও বিকশিত করেছে। সাফল্যের এই প্রেক্ষাপটে (কেউ কেউ সমাজতন্ত্রের বিজয়ের সঙ্গে একীভূত হয়ে গেছে এবং তাঁর নাম হৃদয়ে ও ঠোঁটে নিয়ে যোদ্ধারা স্তালিনগ্রাদে, বার্লিনের মুখে এবং যুদ্ধক্ষেত্রের সমস্ত ফ্রন্টে ইতোপূর্বে অজেয় বলে কথিত ফ্যাসিস্টদের কণ্ঠনালি ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে দিয়েছে।
যেহেতু স্তালিনকে নিয়ে কথা হবে আর সেখানে কেজিবি থাকবে না তা কী করে হয়? তাই সাইফ সাহেব বুদ্ধি করে লিখলেন-
“স্টালিন কেজিবির মাধ্যমে মেক্সিকোতে অবস্থানরত সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্যতম রাজনৈতিক প্রতিভা ও লেনিনের ঘনিষ্ঠ সহচর লিওন ট্রটেস্কিকে হত্যা করেন। ট্রটেস্কি ছিলেন রুশ বিপ্লবের অন্যতম উদ্যোক্তা এবং লেনিনের শিষ্য। রেড আর্মি গঠনেও ট্রটেস্কি প্রশংসিত ভুমিকা রেখেছিলেন। ১৯২০ সালে গৃহযুদ্ধ শেষ হলে স্টালিনের সঙ্গে ট্রটেস্কির বিরোধ শুরু হয়েছিল। ১৯৩০-এর দশকে স্টালিন নিজের ক্ষমতা শক্ত করার জন্য নিপীড়ন শুরু করেন। যার ফলে কমিউনিস্ট পার্টির শত্রু সন্দেহে লাখো মানুষকে বিনা বিচারে হত্যা করা হয়।“
এই কথামালা দিয়ে শুরু করে বারে বারে ফিরে ফিরে এসেছে ৫০ লাখ থেকে ১ কোটি মানুষের মৃত্যুর কথা। ফেনিয়ে ফেনিয়ে বলা হয়েছে দূর্ভিক্ষের কথা। তাঁর ভয়াবহতার গপ্পটি সাজানো হয়েছে যথেচ্ছা এলোমেলোভাবে। কনকোয়েস্ট হাস্ট বা প্রতিষ্ঠিত স্তালিনবিরোধীরা অবশ্য এধরনের বালখিল্যতা করতেন না। করেননিও। তারা বিরোধীতা করেছিলেন যথেষ্ট আটঘাট বেঁধেই।
এইসব রূপকথার গল্পের প্রধান উপজীব্য ছিল গুজব, পরনিন্দাচর্চা এবং অসমর্থিত জনশ্রুতি। একটা বিপুল সমর্থিত জনশ্রুতি আছে ইতিহাস নিয়ে। ‘ততক্ষণ পর্যন্ত সঠিক ইতিহাস লেখা যায় না যতক্ষণ ইতিহাসবিদ কোনো না কোনোভাবে যার বিষয়ে বা যাকে নিয়ে লিখছেন তার সাথে মনস্তাত্ত্বিক যোগাযোগ স্থাপন করতে পারেন’। আর নির্মম সত্য হচ্ছে অধিকাংশ মানুষ এই পরামর্শটি অবজ্ঞা করেন!
স্তালিনকে নিয়ে লক্ষ লক্ষ পৃষ্ঠা নিন্দা, বিষোদগার, হিংসা বর্ষণ, সমালোচনা করা হয়েছে। মানব সভ্যতার ইতিহাসে কোনো একজন মানুষকে নিয়ে এত এত নিন্দুকের তীর ছুটে গিয়েছে যা রীতিমত অভূতপূর্ব। স্তালিন পার্টিতে গুরুত্বপূর্ণ পদ পাওয়ার পরও তাকে নিয়ে কমিউনিজমবিরোধীরা এতোটা সরব ছিল না। কিন্তু স্তালিনের হাতে জার্মানির পতন হলে সকল কৃতিত্ব স্তালিনের হাতে ওঠাটা মেনে নিতে পারেনি রুজভেল্ট, চার্চিলরা। জার্মান অগ্রগামী বাহিনী যখন মস্কো দখলের জন্য তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে তখনো প্রতিআক্রমণের বদলে ‘কৌশলগত পশ্চাদপসারণের’ নাটক করতে চেয়েছে রুজভেল্ট, চার্চিল।
বিশ্বযুদ্ধের আয়ুষ্কাল ৫ বছর ৮ মাস। এই দীর্ঘ সময়ে একের পর এক জনপদ দখল করে নিয়েছিল জার্মান বাহিনী। প্রায় ৬ কোটি মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছিল। যার মধ্যে ৬০ লাখ মানুষকে বন্দিশিবিরে প্রাণ দিতে হয়েছিল। একদিকে জার্মান বাহিনীর অগ্রাভিযান অন্যদিকে জাপানের অগ্রাভিযান। বিশ্বের দুই প্রান্ত থেকে দখলদারিত্ব কায়েম হতে থাকলে সে সময়কার ব্রিটিশ শাসনাধীনের ভারতকেও ২৫ লাখ সৈন্য সরবরাহ করতে হয়েছিল ইয়োরোপ, এশিয়ায়। তাদের মধ্যে অনেক বাঙালিও ছিল। তারা কে কোথায় শহীদ হয়েছে সেই পরিসংখ্যানটিও আমাদের হাতে নেই। পুঁজিবাদীরা সোভিয়েত ইউনিয়ন আর সমাজতন্ত্রের সবকিছুর বিরোধিতা করলেও এটা স্বীকারে কুণ্ঠাবোধ করে না যে বিপুলবিক্রমে অগ্রসর হওয়া জার্মান বাহিনীর হাতে রাশিয়ার পতন হলে সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বের অর্ধেকটা হিটলারের অধীনে চলে যেতো এবং বিশ্বের মানচিত্র নতুনভাবে আঁকতে হতো। সেই ভয়াবহ বিপদ থেকে বিশ্বকে রক্ষা করেছিলেন জোসেফ স্তালিন। তার বিচক্ষণ আর সাহসী নেতৃত্বে জার্মান বাহিনীর অগ্রাভিযান রুখে দিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের লাল ফৌজ। ইয়োরোপ-আমেরিকা যুদ্ধজয়ের এবং আত্মত্যাগের যে বড়াই করে সেটিও বাতিলযোগ্য, কারণ ওই যুদ্ধে সোভিয়েত সৈন্য মারা গিয়েছিল প্রায় ২ কোটি ৬০ লাখ! তার বিপরীতে বাকি মিত্র বাহিনীর নিহত সৈন্য সংখ্যা মাত্র ১০ লাখ!
কিন্তু স্তালিনের সেই কৃতিত্বকে খাটো করার দুরভিসন্ধী সমালোচকদের এমন এক জায়গায় দাঁড় করিয়েছে যেখান থেকে তারা কেবলই পশ্চিমা কৃতিত্ব দেখে। কখনোই আসল বীরত্ব দেখে না। এমনকী কখনো কোনো আলোচনায় সোভিয়েত ইউনিয়নের কথা বলা হলেও স্তালিনের অবদানের প্রসঙ্গ কৌশলে বাদ দেয়া হয়। স্তালিনের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের জন্য রীতিমত আমেরিকা ব্রিটেনে ফান্ড তৈরি করা হয়। শত শত লেখক, সাংবাদিক, ইতিহাসবিদ ভাড়া করা হয়। তাদের একমাত্র কাজ হয়ে ওঠে যে যেখান থেকে পারে স্তালিনবিরোধী নোট, ঘটনাবলীর বর্ণনা, বিবরণ, দলিল, চিঠিপত্র যোগাড় করে তার সাথে মনের মাধুরী মিশিয়ে রূপকথার গল্প তৈরি করে বিশ্বময় ছড়িয়ে দেয়া।
কীভাবে সেই প্রপাগান্ডা চালানো হতো তার বিবরণ পাওয়া যায় সুইডিশ কমিউনিস্ট পার্টির নেতা কমরেড মারিয়া সোসা’র গবেষণায়। সোসা স্তালিন-বিরোধী এইসব অপপ্রচার সম্পর্কে একটি অনুসন্ধান চালান।
শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিজ্ঞান, কৃষি, শিল্প ও সামরিক সবদিক থেকে সোভিয়েত সমাজতন্ত্রকে শান্তির পক্ষে এক মহাশক্তিধর রাষ্ট্রে পরিণত করেছিলেন তিনি। বিশ্বের শোষিত মানুষের চোখে তাই স্তালিন হয়ে ওঠেন শোষণমুক্তি ও স্বাধীনতার প্রতীক। আর অন্যদিকে বিশ্বসাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদের চোখে তিনি মৃত্যুর আতঙ্কস্বরূপ। বিশ্বসাম্রাজ্যবাদ বুঝেছিল, স্তালিনকে কালিমালিপ্ত করতে না পারলে সাম্যবাদী আন্দোলনের অগ্রগতি আটকানো যাবে না, শোষণমূলক পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী নিষ্ঠুর ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখা যাবে না। তাই মিথ্যাপ্রচারের নিশানা বানানো হলো স্তালিনকেই। স্তালিনকে আঘাত করা ও কালিমালিপ্ত করার দ্বারা তারা শোষিত মানুষের মুক্তির হাতিয়ার মার্কসবাদ-লেনিনবাদকেই নিশানা বানিয়েছে এবং নির্ভেজাল মিথ্যাকে প্রচারের জোরে এমন পর্যায়ে নিয়ে গেছে যে স্তালিনকে দানব বা স্বৈরশাসক বলার জন্য কারো যোগ্যতা ক্ষমতা বা প্রমাণের দরকার হয় না। যে স্তালিন ছিলেন হিটলার-মুসোলিনি-ফ্রাঙ্কোর ফ্যাসিবাদী আগ্রাসন ও অন্ধতার বিরুদ্ধে শান্তি, যুক্তিবাদ ও মানবতার রক্ষক, আজ তাকেই হিটলার বা অন্য যে কোনো স্বৈরশাসকের সাথে এক কাতারে তুলে দেওয়া হয়!
স্তালিনবিরোধী মিথ্যাপ্রচার শুরু হয় হিটলারের হাত দিয়েই
১৯৩৩ সালে জার্মানিতে ফ্যাসিবাদের অভ্যুত্থানের ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। পরবর্তী কয়েকদশক জুড়ে সারা পৃথিবীর ওপরই এর প্রভাব পড়ে। ওই বছর ৩০ জানুয়ারি হিটলার জার্মানির চ্যান্সেলর হন এবং নতুন সরকার গঠন করেন। প্রচণ্ড হিংসা ও প্রচলিত বিভিন্ন আইনকানুনের প্রায় কোনোরকম তোয়াক্কা না রেখেই এই সরকার শুরু করে তার কাজ। দেশের সমস্ত ক্ষমতা পুরোপুরি নিজেদের কুক্ষিগত করতে ৫ মার্চ তারা নতুন করে নির্বাচনের ডাক দেয়। তার আগেই অবশ্য তারা সমস্ত প্রচারযন্ত্রকে নিজেদের কব্জায় এনে ফেলেছিল। এইভাবে নিছক প্রচারের জোরে তারা নির্বাচনে নিজেদের জয়কে সুনিশ্চিত করার চেষ্টা করে। জনগণকে বিভ্রান্ত করতে নির্বাচনের সপ্তাহখানেক আগে, ২৭ ফেব্রুয়ারি নাৎসিরা নিজেরাই জার্মানির পার্লামেন্ট ‘রাইখস্টাগ’ ভবনে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং মিথ্যা সাক্ষ্যপ্রমাণ সাজিয়ে এই অগ্নিকাণ্ডের সমস্ত দায়ভার চাপিয়ে দেয় কমিউনিস্টদের ওপর। এই অবস্থায় যে নির্বাচন হয়, তাতে সারা জার্মানির প্রায় ১ কোটি ৭৩ লক্ষ ভোট পায় নাৎসিরা, যা ওই নির্বাচনে প্রদত্ত ভোটের প্রায় ৪৮ শতাংশ। রাইখস্টাগে তাদের ২৮৮ জন ডেপুটি নির্বাচিত হয়। কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। নাৎসিদের আক্রমণ এরপর পরিচালিত হয় সোস্যাল ডেমোক্র্যাট ও ট্রেড ইউনিয়নগুলোর দিকে। প্রথমদিকে যেসব কনসেনট্রেশন ক্যাম্পগুলো গড়ে ওঠে, নারীপুরুষ নির্বিশেষে বামপন্থি কর্মীসমর্থকদের ধরে ধরে এসব বন্দিশিবির ভর্তি করা হয়। এদিকে ওই একই সময়ে অন্যান্য দক্ষিণপন্থিদের সহায়তায় রাইখস্টাগে হিটলারের ক্রমাগত শক্তিবৃদ্ধি ঘটতে থাকে। ২৪ মার্চ, সেখানে একটা আইন পাস করানো হয়, যার বলে পরবর্তী চার বছরের জন্য হিটলারের হাতে দেশের সর্বময় ক্ষমতা তুলে দেওয়া হয়। এই ক্ষমতার বলে তিনি তখন থেকে পার্লামেন্টের অনুমতি ছাড়াই যে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা হাতে পান। এই সময় থেকেই শুরু হয় খোলাখুলি ইহুদি নিধন। তাদেরকেও দলে দলে ধরে চালান করা হয় ওই কনসেনট্রেশন ক্যাম্পগুলোতে। ১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানির উপর বিজয়ী সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো আন্তর্জাতিক চুক্তির মাধ্যমে যেসব সামরিক নিষেধাজ্ঞা জারি করে, সেগুলোকেই অজুহাত করেন হিটলার। সওয়াল করা শুরু হয়, তার সর্বময় ক্ষমতার সময়সীমা আরও বাড়ানো হোক। প্রচণ্ড দ্রুতগতিতে শুরু হয় নতুন করে জার্মানির সামরিকীকরণের কাজ। নতুন করে জার্মান সেনাবাহিনীকে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করা হয়। জার্মানির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে স্তালিনের রাশিয়া। ব্রিটেন-আমেরিকা-ফ্রান্স তখন সোভিয়েতের বিরুদ্ধে হিটলারকে প্রশ্রয় দিচ্ছে। গোটা সাম্রাজ্যবাদী দুনিয়ার লুঠের পথে কাঁটা সোভিয়েত ইউনিয়ন। এরকম একটি আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে হিটলারের প্রচারদফতর সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্কে এমন সমস্ত ভয়াবহ গল্পকাহিনী তৈরি করে যা বিশ্বব্যাপী প্রচার করার দায়িত্ব নিয়েছিল মার্কিন দেশের সেইসব সংবাদপত্র, যারা চটকদার চাঞ্চল্যকর খবর ছেপে ব্যবসা করে।
এবার সরাসরি স্তালিনকে হিটলারের সঙ্গে এক করে ‘ফ্যাসিস্ট’ বানানোর মেঠো কৌশল অবলম্বন করে লেখা হল-
“মানুষ হত্যা করে অথবা ভয় দেখিয়ে নিজের ক্ষমতার আধিপত্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে হিটলার, স্টালিন দুজনেই ছিলেন পারদর্শী। দুজনকেই নিষ্ঠুর স্বৈরশাসক হিসেবে পৃথিবীর মানুষ জানে। দুজনের বাল্যকাল পর্যালোচনা করলে দেখা যায় কিছু মিল রয়েছে দুজনের মধ্যে। স্টালিন এবং হিটলারের বাল্যকালে কিছু অদ্ভুত মিল রয়েছে। দুজনেই অত্যাচারী মদ্যপ পিতার সন্তান। মায়েরাই অনেক কষ্টে মানুষ করেছেন এবং জীবনের প্রথম থেকে দুজনই ব্যক্তিগত জীবনে নিষ্ঠুরতার শিকার হয়েছেন। স্টালিনের মদ্যপ পিতা বেসেরিয়ান তাকে ১২ বছর বয়সে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে জুতার ফ্যাক্টরিতে কাজে দিয়েছিলেন। স্টালিনের মা কিটোভেন স্টালিনকে আবার স্কুলে ভর্তি করান। এই ঘটনায় স্টালিনের বাবা তার মাকে চিরতরে ত্যাগ করেন। অথচ স্টালিন ১৯৩৩ সালে মার মৃত্যুর পরও মাকে দেখতে যাননি। একবারের জন্যও তার মনে আসেনি তার শিক্ষার পেছনে তার মা কিটোভেনের আত্মত্যাগের কথা।“
এই অধ্যায়টি ভারী অদ্ভূত! এখানে স্তালিনের প্রতি অজানা কোনো এক কারণে (হতে পারে লেখকের কমিউনিস্টদের কথা শুনলেই উল্টি আসে!) তীব্র ঘৃণা প্রকাশ পেয়েছে। স্তালিনকে কালিমালিপ্ত করবার জন্য তুলনা বিচারে হিটলারকে টানা হয়েছে, এবং মিথ্যা স্ট্যাট দিয়ে স্তালিনকে হিটলারের চেয়েও ‘নৃশংস’ প্রমাণের কোশেশ করা হয়েছে। দুজনের বাবা মদ্যপ ছিলেন! (এই মূর্খকে কে বোঝাবে জর্জিয়া, রাশিয়া, জার্মানিতে প্রচণ্ড শীতে মদ্যপান এক স্বাভাবিক বিষয়। এটা নিয়ে সেখানকার সমাজে সামাজিক বা ধর্মীয় কোনো ট্যাবু নেই। লেখক বোধ করি স্তালিনকে মুসলিম বাটখারা দিয়ে মাপতে চাইছেন!) হিটলারকে আর স্তালিনকে এক করে দেখানোর এমন ইতরামি নজিরবিহীন!
স্তালিন কখনো ফ্রন্টে কোনো সময় সম্পূর্ণ পরিদর্শনে যাননি, কখনো যুদ্ধরত সৈনিকদের সঙ্গে ব্যক্তিগত যোগাযোগ গড়ে তোলার কথা ভাবেননি, কিন্তু সবসময়ই সেখানে কী ঘটছে তার ওপর সযত্ন নজর রেখেছেন। সেনানায়কদের সঙ্গে তাঁর মতানৈক্য হয়েছে, কখনো-সখনো রূঢ়, কিন্তু রকসোভস্কি ও জুকভ-এর মতো ব্যক্তিরা (সাময়িক রণকুশলী হিসেবে নিজস্ব ধারণার কোনো অভাব ছিল না) সাক্ষ্য দেন যে স্তালিন দৃঢ়চেতা ও ধৈর্যশীল ছিলেন, যে মত তিনি এর আগে মেনে নেননি কিন্তু যুক্তিতর্কের পর তা মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলেন এবং যোগ্য কাজের জন্য যোগ্য ব্যক্তির পছন্দ সুনিশ্চিত করতে অসাধারণ দৃঢ়তা দেখিয়েছেন। যদিও কিছু নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে বোনাপার্টবাদের বিপদসূচক কয়েকজন তারকাখচিত সামরিক কর্তাব্যক্তি সম্পর্কে তাঁর সন্দেহ ছিল, জুকভের সঙ্গে (তাঁর স্মৃতিকথায় বর্ণিত) তাঁর সম্পর্ক তুলে ধরে যে তাঁর অন্য সদগুণ (ত্রুটি-বিচ্যুতিও) ছাড়াও তিনি জানতেন সামরিক নেতারা, চিকিৎসকদের মতোই, মতানৈক্য হলেও শ্রদ্ধা ও বোঝাপড়ার ভিত্তিতে তাঁদের সাহায্য করতে হবে (যদিও স্তালিন তাঁর দীর্ঘকালব্যাপী নেতৃত্বের মধ্য দিয়ে জেনেছিলেন তখন তাঁর সিদ্ধান্তকে কার্যকরী করতে হবে) লাল ফৌজের সামনে কঠিন পরিস্থিতিতে এক কার্যকরী টিম হিসেবে কাজ করতে। এটা পরিতাপের বিষয় যে, ১৯৪১-৪৫ সালে যুদ্ধের সময় স্তালিনের ভূমিকার এই দিকটি উপেক্ষিত থেকে গেছে এবং কেবল বিক্ষিপ্তভাবে পক্ষপাতমূলক কিছু আলোচনা হয়েছে।
প্রত্যক্ষ দৃঢ়, কখনো অসহনীয়, কিন্তু একই সঙ্গে সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের দৃষ্টিতে আত্মোৎসর্গিত জনগণ কর্তৃক বিপ্লবকে রক্ষা করার এক মহান দৃষ্টান্তস্বরূপ এই যুদ্ধের (১৯৪১-১৯৪৫) অভিজ্ঞতা আরও দৃঢ়মূল করেছিল স্তালিনের চিন্তাধারাকে যে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ও দেশের অভ্যন্তরে শ্রেণিশত্রুরা তাদের হিংস্র নখ আরও শাণিত করবে যতোই সমাজতন্ত্রের অগ্রগতি ঘটবে। হয়তো যখন কিছু ক্লান্ত ব্যক্তি ‘সমকেন্দ্রিকতা’ নিয়ে চিন্তা করছিলেন এবং শান্তিপূর্ণ ‘সহ-অবস্থান’ সম্পর্কিত মূলত বিপ্লবী ভাবধারাকে ‘গণতান্ত্রিক’-কোমলতায় প্রয়োগ করার কথা ভাবছিলেন, তখন স্তালিন তাঁর নিজের ও সমসাময়িক বিশ্বের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ভিন্ন প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছিলেন এবং আশা করেছিলেন বিপ্লবের মিত্ররা যেন ঐকান্তিক ও সক্রিয়ভাবে ‘সতর্ক’ থাকেন। এই দায়িত্ব পালন করতেই তাঁর ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ, কখনো যন্ত্রণাক্লিষ্ট কিন্তু সদা-সংগ্রামরত জীবনের শেষের দিনগুলো নিয়োজিত হয়েছিল। তাঁর গড়ে তোলা ভিতকে তাঁর উত্তরসূরিরা আরও দৃঢ়, না আলগা করে দিয়েছে তা বিচার করবে ভবিষ্যৎ।
স্তালিনের মৃত্যু নিয়ে গুজব
আসলে কী ঘটেছিল? ৬০ বছর আগে ১৯৫৩ সালের ৫ মার্চ মস্কোর উপকণ্ঠে রাষ্ট্রীয় খামারবাড়িতে জোসেফ স্তালিন মারা যান। সরকারি ভাষ্য অনুযায়ী, ৭৪ বছর বয়সী স্তালিনের মৃত্যুর কারণ ছিল মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ, কিন্তু খুব শিগগিরই তার মৃত্যুর সাথে সোভিয়েত সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের জড়িত থাকার গুজব ছড়িয়ে পড়তে থাকে, আর পরবর্তীকালে নবনিযুক্ত শাসক কর্তৃপক্ষ খোলাখুলি ঘোষণা করে, যে সোভিয়েত ইউনিয়নের ইনটেলিজেন্স দফতরের তৎকালীন মূখ্য পদাধিকারী লাভ্রেন্তি বেরিয়ার চক্রান্তের শিকার হয়েছিলেন স্তালিন, আসলে কী ঘটেছিল? ২৮ ফেব্রুয়ারি স্তালিন তার খামারবাড়িতে বেরিয়া ও নিকিতা ক্রুশ্চভ কমিউনিস্ট পার্টির পলিটব্যুরোর কয়েকজন সদস্যকে জড়ো করেছিলেন। কী নিয়ে সেখানে কথাবার্তা হয়েছিল জানা না গেলেও, এটুকু জানা আছে যে বাক্যালাপ চলেছিল ভোর ৪টা পর্যন্ত, তারপরে যে যার গন্তব্যে রওনা দেন আর স্তালিন যান শয্যাকক্ষে, ১ মার্চ মধ্যাহ্নের পর স্তালিনের প্রহরীরা উদ্বিগ্ন হতে শুরু করে। স্তালিন তার মহল থেকে বেরোননি বা কাউকে ডেকেও পাঠাননি। নির্দেশমতো, না ডাকলে প্রহরীদের স্তালিনের কাছে যাওয়ার অধিকার ছিল না। অবশেষে রাত ১১টার সময় একজন দেহরক্ষী সাহস করে স্তালিনের কাছে গিয়ে তাকে মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখে। তখনো তাঁর দেহে প্রাণ ছিল, কিন্তু বাকশক্তি লোপ পেয়েছিল, সন্ত্রস্ত প্রহরীরা তাঁকে ডিভানে শুইয়ে বেরিয়াকে ফোন করতে শুরু করল, বেরিয়ার অনুমতি ছাড়া স্তালিনের জন্য ডাক্তারদের কল করা ছিল নিষিদ্ধ। বেরিয়াকে দীর্ঘক্ষণ ধরে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না (প্রসঙ্গত, যেটা বেশ আশ্চর্য্যজনক) অবশেষে রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা দফতরের প্রধানকে অতিকষ্টে খুঁজে পাওয়া গেল, তিনি এলেন ও গটগট করে ঢুকলেন সেই ঘরে, যেখানে অচৈতন্য অবস্থায় শায়িত ছিলেন স্তালিন।
(ছবি: স্তালিনকন্যা স্ভেতলানা আলুলায়েভা)
স্তালিনের কন্যা স্ভেতলানা আলুলায়েভা তাঁর পিতার জীবনের অন্তিম মূহুর্তগুলোর স্মৃতিচারণা করেছেন। মৃত্যুর ঠিক পূর্বক্ষণে স্তালিন হঠাৎ চোখ মেললেন, তাকালেন তাঁকে ঘিরে থাকা মুখগুলোর দিকে, তারপর বাঁ হাতটা তুললেন, উপরের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করলেন, নাকী কোনো সঙ্কেত দিলেন! যাই হোক, তার কয়েক মূহুর্ত পরেই স্তালিন শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
বেরিয়ার পক্ষে ক্ষমতা জবরদখল করা সম্ভব হয়নি। ১৯৫৩ সালেরই ২৬ জুন তাকে গ্রেফতার করা হয় ও অনতিবিলম্বে গুলি করে হত্যা করা হয়। কে-জি-বিতে তাঁর ঘনিষ্ঠ সহকারীদেরও খতম করা হয়। দেশের শাসন ক্ষমতায় জোসেফ স্তালিনের উত্তরসূরি হন নিকিতা ক্রুশ্চভ। তিনিই বিপজ্জনক প্রতিদ্বন্দ্বীকে সমূলে উৎপাটিত করার পরে বেরিয়া ও তার ঘনিষ্ঠদের স্তালিনের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করে তাকে হত্যা করার জন্য দোষারোপ করেছিলেন। ততদিনে কে-জি-বির শিখণ্ডী ও তার সাকরেদরা কেউ আর জীবিত ছিল না, সুতরাং তাদের যে কোনো অপরাধে অভিযুক্ত করা যেতে পারত।
খুব সম্ভবত আজ আমরা সুনিশ্চিত করে বলতে পারব না, যে স্তালিন গত হয়েছিলেন বেরিয়ার চক্রান্তের ফলে নাকী তাঁর স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছিল। অথবা হয়তো বা চক্রান্ত হয়েছিল, কিন্তু তার সংগঠক আদৌ বেরিয়া ছিলেন না ? আমরা শুধু এইটুকু বলতে পারি, যে স্তালিনের মৃত্যু সোভিয়েত নেতৃবৃন্দের মধ্যে ক্ষমতার জন্য লড়াইয়ের চাপা আগুন উস্কে দিয়েছিল, যে লড়াইয়ে বেরিয়াকে কুপোকাত করে জয়ী হয়েছিলেন ক্রুশ্চভ, আর সকলেই বোধহয় জানেন, যে ইতিহাস সর্বদাই রচনা করেন বিজয়ীরা।
স্তালিনের অবদান
সমাজতান্ত্রিক শিল্পায়নে লেনিনের কর্মসূচি বাস্তবায়িত করে সোভিয়েত ইউনিয়ন নিজেকে একটি পশ্চাৎপদ কৃষিপ্রধান দেশ থেকে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী শিল্প-সমৃদ্ধ দেশে রূপান্তরিত করেছিল; এমন এক শিল্প-শক্তি অর্জন করেছিল যার দ্বারা নিঃস্বার্থ সাহায্য দেওয়া সম্ভব হয়েছিল ইয়োরোপের জনগণতান্ত্রিক দেশগুলো ও চীনের অর্থনীতি পূনর্গঠিত করতে; এমন এক শিল্প-শক্তি যা ভারত ও অন্যান্য প্রাচ্য দেশকে পূর্বতন সাম্রাজ্যবাদী শাসকদের দ্বারা চাপানো ঔপনিবেশিক পশ্চাৎপদতা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করেছে।
ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছড়িয়ে থাকা কৃষকদের একক জমিজমাকে বৃহৎ যন্ত্রচালিত সমাজতান্ত্রিক খামারে ঐক্যবদ্ধ করার লেনিনের পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করা হয়েছিল। এইসব পরিকল্পনাগুলোর বাস্তবায়নের জন্য সেগুলোকে নির্দিষ্ট রূপ দেওয়ার ও আরও ব্যাপ্ত করার কার্যকরী নেতৃত্বদানে জে ভি স্তালিন এক বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেছিলেন।
মার্কসবাদ-লেনিনবাদের বিকাশে স্তালিনের অনেকগুলো তাত্ত্বিক রচনা খুবই উল্লেখযোগ্য ছিল। এইসব রচনায় তাঁর চিন্তার-পাণ্ডিত্যের তুলনাহীন সহজ সরল প্রকাশ, অগ্রণী শ্রমিকদের মধ্যে সমাজতান্ত্রিক চেতনা সঞ্চারে এবং সমগ্র কমিউনিস্ট প্রজন্মকে গড়ে তোলার কাজে বিপুল অবদান রেখেছিল।
সোভিয়েত ইউনিয়নে মানবসমাজের ইতিহাসে সবচেয়ে জটিল সমস্যার অন্যতম, জাতি সম্পর্কিত সমস্যার সমাধানকল্পে অবিচ্ছেদ্যভাবে স্তালিনের নাম জড়িয়ে আছে।
বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদের প্রতিটি রূপের দৃঢ় বিরোধী লেনিন একই সময়ে বারবার গুরুত্ব আরোপ করেছেন যে শ্রমিকশ্রেণির পার্টি অবশ্যই জাতি-সম্পর্কিত সমস্যার ওপর গুরুত্ব দেবে যাতে জাতিগত অসাম্য-বৈষম্য দূর হয় এবং সকল জাতিসমূহ বিকাশের জন্য পূর্ণ সুযোগ পায়।
জাতি-সম্পর্কিত সমস্যা প্রসঙ্গে লেনিনের শিক্ষাকে স্তালিন আরও ব্যাপক ও উন্নত করেছিলেন। জার শাসনে নিপীড়িত জাতিসমূহ নবজীবনে জেগে উঠেছে; প্রতিটি ক্ষেত্রে অগ্রগতি ঘটিয়েছে এবং সোভিয়েত ইউনিয়নকে জাতিসমূহের একটি পরিবারে পরিণত করেছে।
স্তালিন ইয়োরোপের শ্রমিকশ্রেণির দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন প্রাচ্যের দেশগুলোর জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের প্রতি, যে আন্দোলনগুলো ছিল সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বজোড়া সংগ্রামে এক বিপুল বিপ্লবী তাৎপর্যপূর্ণ। সেই ১৯১৮ সালেই এক বিশেষ তত্ত্ব সূত্রায়িত করেছিলেন যার যথার্থতা বিগত ৩৮ বছরের ইতিহাস বহন করে যে অক্টোবর বিপ্লব সৃষ্টি করেছে সমাজতান্ত্রিক পশ্চিম ও পদানত পূর্বের মধ্যে সেতু, যার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এক নতুন লাইন, পশ্চিমা দুনিয়ার প্রলেতারিয়েতদের প্রসারিত করেছে রুশ বিপ্লবের মধ্য দিয়ে প্রাচ্যের নিপীড়িত জাতিসমূহের দিকে।
অমর হয়ে থাকবে তাঁর নাম
আজ যখন বিশ্ব ব্যবস্থা হিসেবে সমাজতন্ত্রের অভ্যুদয় ও প্রাচ্যের দেশগুলোর ক্রমবর্ধমান সংখ্যায় সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশের চাপে সমগ্র সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে, যখন সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব ও প্রাচ্যের স্বাধীন দেশগুলোর মধ্যে ঘনিষ্ঠ মৈত্রী ও সহযোগিতার বন্ধন গড়ে উঠেছে, যখন এই বন্ধন মিশরের স্বাধীনতার সপক্ষে ইঙ্গ-ফরাসি আগ্রাসন বন্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের নিয়ামক ভূমিকার মধ্য দিয়ে আরও দৃঢ়ভিত্তিক হয়েছে, তখন এই সময়ে স্তালিনের উল্লিখিত কথাগুলো এক নতুন ও গভীরমাত্রা অর্জন করেছে।
স্তালিনের শিক্ষা বলে, শান্তি তখনই সুরক্ষিত হতে পারে যদি বিশ্বের জনগণ শান্তির স্বার্থ নিজেদের হাতে তুলে নেয় ও তার জন্য লড়াই করে এবং সারা বিশ্বজোড়া লক্ষ লক্ষ শান্তিকর্মীদের এক নতুন যুদ্ধের প্ররোচনাকারীদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে চালিত করে। সোভিয়েত ইউনিয়নই হলো আজ শান্তি ও জনগণের মধ্যে মৈত্রীর দৃঢ় রক্ষক।
খুবই কঠিন এক ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে সমাজতন্ত্রের নির্মাণ প্রক্রিয়ায় স্তালিন কিছু ভুল করেছিলেন, তথাপি, এই ভুল-ভ্রান্তি সত্ত্বেও, সমগ্র মানবজাতির কাছে স্তালিনের নাম অমর হয়ে থাকবে সর্বকালের এক মহান মার্ক্সবাদী হিসেবে, চিন্তা ও প্রয়োগের এক শীর্ষ ব্যক্তিত্ব হিসেবে, সমাজতন্ত্রের স্বার্থে সমগ্র শ্রমজীবী জনগণের সেবায় উৎসর্গীকৃত প্রাণ এক মানুষ হিসেবে। মানবজাতির মুক্তির স্বার্থে তাঁর অবদান সারা বিশ্বজুড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষকে প্রেরণা জোগাবে।
(ছবি: হিটলারের নাৎসি বাহিনীর পতনের পর বার্লিনের রাইখস্ট্যাগে পতাকা উড়িয়ে জনতার বিজয়োল্লাস)
১ মে, ১৯৪৫ কমরেড স্তালিনের নেতৃত্বে সোভিয়েত লালফৌজ বার্লিনের রাইখ্স্ট্যাগে রক্তপতাকা উড়িয়ে মানবজাতির চরমতম শত্রু ফ্যাসিবাদের পরাজয় ঘোষণা করেছিলেন।
ফ্যাসি-বিরোধী যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল প্রথম স্থানে। এই যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছিলেন ২ কোটি সোভিয়েতবাসী। যুদ্ধের সময় শিশুসহ ৫০ হাজারের বেশি মানুষকে জার্মানিতে দাস শ্রমিক হিসেবে বন্দী করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। যুদ্ধ চলাকালীন সোভিয়েতে ৫৩ লক্ষ যুদ্ধবন্দির মধ্যে যুদ্ধের শেষে মাত্র ১০ লক্ষকে জীবিত পাওয়া গিয়েছিল। ফ্যাসিস্টদের আক্রমণে চরম ক্ষতি স্বীকার করতে হয়েছিল সোভিয়েতের ছোট-বড় মিলিয়ে ১ হাজারেরও বেশি শহরকে, ৭০ হাজার গ্রামকে, ৩২ হাজার শিল্প সংস্থাকে এবং ৯৮ হাজার যৌথ ও রাষ্ট্রীয় খামারকে। যুদ্ধ যখন চলছে, মিত্রশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েতকে ৬০০ কোটি ডলার ঋণ দেবার প্রতিশ্রুতি দেয়। তখন রুজভেল্ট ছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। রুজভেল্টে’র জীবনাবসানের পর ট্রুম্যান মার্কিন প্রেসিডেন্ট হয়েই সেই প্রতিশ্রুতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। এতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র প্রকাশ হয়ে পড়ে। অবশ্য কমরেড স্তালিন তাতে বিন্দুমাত্র বিচলিত হননি। তাঁর সুযোগ্য নেতৃত্বে সমস্ত যুদ্ধকালীন ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রমাণ করে দিয়েছিল তার সমাজতান্ত্রিক দৃঢ়তা। শুধু তাই নয়, পূর্ব ইয়োরোপের সদ্য মুক্ত হওয়া দেশগুলোতে সমাজতান্ত্রিক গঠনকার্যেও সোভিয়েত তার সমগ্র শক্তিকে ব্যবহার করেছিল। এইভাবে যুদ্ধে বীভৎসতা কাটিয়ে কমরেড স্তালিনের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে দুনিয়ার তাবৎ শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে অন্যতম হয়ে উঠেছিল।
এর পরের ইতিহাস পৃথিবীকে বারে বারে চমকে দেয়ার ইতিহাস। গোটা বিশ্ব অবাক বিস্ময়ে দেখল এক অকুতোভয় যোদ্ধা জাতি কী বিপুল বিক্রমে পৃথিবীকে রক্ষা করল। গোটা পৃথিবীকে এক রক্তপিপাসু জাতির দাসত্ব করা থেকে বাঁচাল রেড আর্মি, বিশেষত কমরেড স্তালিনের তীক্ষ্ণ ক্ষুরধার বুদ্ধি, অকপট দেশপ্রেম আর জনগণের ওপর অগাধ বিশ্বাস।
(ছবি: হিটলারের নাৎসি বাহিনীর হাতে আটক স্তালিনপুত্র ইয়াকভ জুগাসভিলি)
জানা যায় যুদ্ধে তাঁর প্রিয় পুত্র ইয়াকভ জুগাসভিলি‘কে বন্দী করে জার্মানরা। বন্দিবিনিময় করতে চায় তাদের ফিল্ড মার্শাল ফ্রেডরিখ পউলাসের সাথে। তিনি রাজি হননি! এই একটি ঘটনাই প্রমাণ করে দেয় স্তালিনের কাছে দেশ আর নিজের সন্তানের মধ্যে কোনটি গুরুত্বপূর্ণ? লাল ফৌজের সর্বাধিনায়ক স্তালিন বললেন-
“I will not trade a Marshal for a Lieutenant!”
যারা গড় চিন্তাধারায় তাঁর ‘স্বজনপোষণ’ নিয়ে কুৎসা করে তাঁরা অবশ্য কল্পনাও করতে পারেননি যে দেশের জন্য স্তালিন উৎসর্গ করে দেবেন নিজের ছেলেকেই!দুনিয়ায় শ্রেণিহীন সমাজ গঠনের সংগ্রাম যতদিন ধরে চলবে, নিপীড়িত হৃদয়ের প্রতি স্পন্দনে অনুপ্রেরণার স্ফুলিঙ্গ হয়ে রইবেন কমরেড স্তালিন।
সহায়ক গ্রন্থপঞ্জিঃ
১) স্তালিন মিথ্যাচার এবং প্রাসঙ্গিকতা, মনজুরুল হক (ঢাকা, ২০১৭) ঐতিহ্য প্রকাশন।
২) স্তালিন ফিনমিন্যান আইজ্যাক ডয়েটশার (লন্ডন-১৯৭৬)।
৩) সোভিয়েত সাম্যবাদ এক নতুন সভ্যতা সিডনি ও বিয়েত্রিচ ওয়েব (১৯৩৫ সংস্করণ)।
৪) Long Live the Universal Contributions of Comrade Joseph Stalin. Posted on December 20, 2009
৫) The Ukrainian famine-genocide myth – John Puntis, July 2002
৬) Making Sense of Stalin, Peter Myers, October 2000
৭) Conquest, Robert: The Great Terror – Stalin’s Purge of the Thirties, New York 1968.
৮) Origins of the Great Purges – The Soviet Communist Party Reconsidered, J. Arch Getty, 1933-1938. New York 1985, p 3.
৯) L. Trotsky. The Third International After Lenin, New York, 1973.