৭১৪ বার পঠিত
জয়নাল হাজারী ফুসফুসটা স্যানিটাইজ করতে চেয়েছিলেন অ্যালকোহল দিয়ে। বেচারিকে নিয়ে নানা রকম ট্রল হয়েছে। অথচ দেশের যে অবস্থা, ডাকাত, চোর আর বাটপাড়রা যেভাবে বিভিন্ন জায়গা দখল করে বসে আছে, তাতে হাজারী প্রক্রিয়া চালু করা এখন সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এদের কলিজায় এত কালিমা লেগে গেছে তা এখন বের করে স্যানিটাইজ করা ছাড়া অন্য উপায় আর নেই।
বাটপাড় সাহেদ তার নিজ পিতার চিকিৎসা নিয়েও বাটপাড়ি করতে ছাড়েননি। কলিজায় কতটা কালি লাগলে মানুষ বাটপাড়ির এমন পর্যায়ে যায়। তাহলে বুঝুন, ছোটখাটো বাটপাড়রাই যদি এতটা যায়, ডাকাত আর চোরদের অবস্থা কী। এদের কলিজাতো পোড়ামবিল হয়ে গেছে। কালিই কালি। এদের স্যানিটাইজ করতে গেলে স্যানিটাইজারই উল্টো স্যানিটাইজ হয়ে যাবে। ওই যে, সঙ্গদোষে লোহা ভাসে’র মতন। এমপি পাপুলের কথাই ভাবুন কিংবা তার স্ত্রী। ঘরে-বাইরে ডাবল এমপি। কিসের দায়ে অভিযুক্ত হলেন, হিউম্যান ট্র্যাফিকিং। চিন্তা করা যায় দেশের একজন এমপি এমন অভিযোগ অভিযুক্ত হবেন। কালিটা কোন পর্যন্ত পৌঁছেছে!
শর্টকার্টে বড়লোক হওয়ার সোজা পন্থা হলো চক্ষুলজ্জা ঝেড়ে ফেলা। এই লজ্জা ঝেড়ে ফেলার প্রথম পর্যায় হলো বাটপাড়ি, মানে সাহেদ, সাবরিনা, পাপিয়া, শামিম হওয়া। এরা কীভাবে লজ্জা ঝেড়ে ফেলেছে সে কিচ্ছা আর নাই বলি, জানা ব্যাপার বারবার শোনা ও বলাও বিরক্তিকর। টাকা থেকে শরীর সবই ব্যবহার করা হয়েছে বাটপাড়ির এই পর্যায়ে। বাটপাড়িতে সফল হওয়ার পর সাহেদ, সাবরিনা, পাপিয়াদের পরবর্তী মঞ্জিলটা কী ছিলো, এমন প্রশ্নের উত্তরটা খুব কঠিন নয়। বিশেষ করে সাহেদ, পাপিয়াদের আকাঙ্ক্ষাটা যে রাজনীতি, তা বুঝতে সক্রেটিস হতে হয় না। পাপিয়া তো এমপি হবার জন্য রীতিমত রেসে ছিলেন। সুতরাং এদের পরবর্তী টার্গেট ছিলো পাপুল মানে এমপি হওয়া। আর পাপুলদের মিশন ছিলো হয়তো আরেকটু উপরের দিকে। গাড়িতে ফ্ল্যাগ লাগানোর চিন্তা আর কী। সেটা হয়ে গেলে, পরবর্তীতে…। যাকগে অতদূর ভাবার দরকার নেই। তার থেকে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্টের কথা বলি।
জেয়ার বলসোনারো ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট। বিশ্বের ফুসফুস বলে খ্যাত আমাজনে যে সাম্প্রতিক দাবানল, সে দাবানল মনুষ্যসৃষ্ট বলে দাবি করেছে পরিবেশবাদীরা। তাদের অভিযোগ ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট নিজে দাবানলের জন্য দায়ী। তার বানিজ্যিনীতির কারণেই আগুন দিয়ে বন পোড়ানোর ঘটনা বৃদ্ধি পায়। বলে রাখি, বলসোনারো নিজেও কাঠ ব্যবসায়ী। বন পুড়লে তারও নগদনারায়নের প্রাপ্তিযোগ ঘটে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ দাবানল নেভাতে ব্যর্থতার জন্য ব্রাজিলের সাথে বানিজ্যিক চুক্তি বাতিল ও না করার ঘোষণা দেয় সে সময়। পরিবেশবাদীরা ইঙ্গিতে বলসোনারোকে মাফিয়া বলেও অভিহিত করে। ব্রাজিলের অবস্থা দেখে মনে হয় সেখানে মূলত মাফিয়াতন্ত্রের রাজত্ব কায়েম হয়েছে। সর্বশেষ কোভিড নাইনটিন পরিস্থিতিতেও তাই দেখা গেছে। সাধারণ নাগরিকদের প্রতি ন্যূনতম দায়িত্ববোধ দেখায়নি রাষ্ট্রটি। উল্টো মাস্ক পড়া, সামাজিক দূরত্ব বিষয়ে সম্পূর্ন উদাসীন থেকেছে সরকার। ফলে দেশটিতে হুহু করে বেড়েছে মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা। প্রতিদিন আক্রান্ত হচ্ছে বিশ হাজারের উপর। মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে সত্তুর হাজারের উপর। শেষমেশ বলসোনারো নিজেও আক্রান্ত হয়েছেন কোভিডে।
আমাদের দেশের পাপুলেরাও বলসোনারো’র উত্তরসূরি। মাফিয়াতন্ত্রের অংশ। আমাজনের নিরো হলে বলসোনারো। রোম পোড়ার মুখে নিরোর বাঁশিটি বলসোনারো বাজিয়েছেন আমাজনের দাবানলে। আমাদের দেশেও এমন বাঁশিতে ওস্তাদ লোক রয়েছেন। পাপুলদের চেয়েও বেশি ওস্তাদ, যাদের কাছে পাপুলেরা নবিশ। না হলে পাপুলের মতন লোকেরা এমপি হন কীভাবে! যার স্ত্রীও নির্বাচনকে পাশ কাটিয়ে বাইপাসে সংসদের সংরক্ষিত আসনে বসে পড়েন! সুতরাং এমন নবিশদের গুরু কেউ না কেউ আছেন।
এই যে হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি এটা মাফিয়াতন্ত্রের জন্যেই সম্ভব হয়েছে। সাহেদ, সাবরিনা, পাপিয়া, শামিম’রা এই তন্ত্রেরই যন্ত্র। তবে এরা মূল মেশিনারি নয়। নিউক্লিয়াস নয়। এই নিউক্লিয়াস নিশ্চিত ভীষণ শক্তিশালী। যে কারণেই করোনার এই মহাদুর্যোগের মধ্যেও মাফিয়ারা মানুষের মৃত্যুকেও বানিজ্য হিসাবে নিতে পারে। যার ফলেই একমাসের হোটেল বিল হয়ে উঠে বিশ কোটি টাকা। অন্যদিকে মানুষ স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা জানিয়ে হাসপাতাল বিমুখ হয়ে উঠে। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন গণমাধ্যম জানাচ্ছে, হাসপাতালে শয্যা খালি থাকলেও মানুষ হাসপাতালমুখি হচ্ছে না। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রতি আস্থা হারিয়েছে মানুষ। মানুষ যখন জাগতিক বিষয়ে আস্থা হারায়, তখন তাদের আধ্যাত্মিক অস্তিত্বের প্রতি আস্থা রাখা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। বাংলাদেশের মানুষের অবস্থায়ও তাই। তারা এখন ঘরে বসে নিজেদের চিকিৎসা নিজেরা করছে। তাদের চিকিৎসার প্রধান উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে সামাজিকমাধ্যম। সামাজিকমাধ্যম থেকে জানা ওষুধে আল্লাহ ভরসা বলে ঘরে বসেই চিকিৎসা নিচ্ছেন তারা। অবস্থা এতটাই খারাপ দাঁড়িয়েছে যে, সরকারের অংশ সংসদ সদস্য পর্যন্ত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে ‘প্রতারকের মন্ত্রণালয়’ বলছেন।
মাফিয়াতন্ত্র যখন মাথা চাড়া দিয়ে উঠে তখন স্বাভাবিক কর্মকান্ড অস্বাভাবিক ব্যবস্থায় চলে। মারিয়ো পুজো’র ‘গড ফাদার’ যারা পড়েছেন তারা বুঝবেন মাফিয়ারা কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করে পুরো সিস্টেমকে। কীভাবে তাদের ইচ্ছের প্রতিফলন ঘটে প্রতিটি জায়গায়। দেশ তখন গুম, খুন, ধর্ষণ, অপহরণ, দুর্নীতি, ক্যাসিনো, মাদক, প্রস্টিটিউশন, দখল আর টেন্ডারবাজির স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠে। রাষ্ট্রযন্ত্রের খোলসটাই শুধু থাকে, ভেতরে থাকে মাফিয়াতন্ত্র। এই মাফিয়াতন্ত্রের জন্য গণতন্ত্র হারাম। জনগণের কাছ জবাবদিহিতা মানেই, অস্বাভাবিক উপার্জনের পথে বাধা। তাই গণতন্ত্রও মাফিয়াতন্ত্রের পথের বাধা। মাফিয়াতন্ত্র চায় একটা পুতুল সিস্টেম যা তাদের ইশারায় নাচবে। অন্তত মারিয়ো পুজো’র ‘গড ফাদার’ তাই বলে। বই থেকে বেড়িয়ে এই গড ফাদাররা এখন আমাদের নিয়ন্ত্রণ নিতে চাইছে। চারিদিকের আলামত তাই বলে।
যাকগে, শুরু করেছিলাম জয়নাল হাজারীর বক্তব্য দিয়ে। তার স্যানিটাইজ করার ফর্মুলা হাস্যকর, তবে মাঝেমধ্যে মনে হয় এটিই বর্তমানের কার্যকর ব্যবস্থা। সত্যিকার অর্থেই কলিজা, ফুসফুসসহ পুরো সিস্টেমটাই স্যানিটাইজ করা ভীষণ জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন