৭৭১ বার পঠিত
দ্রোহ এবং সাথে সংকল্পের প্রতীক হিসাবে ধরা হয় ঝাঁসীর রাণীকে। ইংরেজদের বিরুদ্ধে দ্রোহের শুরুর ইতিহাসে ঝাঁসীর রাণী লক্ষী বাঈকে উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই। ঘোড়ায় চড়া একজন যোদ্ধাকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। যারা আজকে নারী মুক্তির কথা বলেন, তারা হয়তো অস্বীকারের বাতিকে লক্ষী বাঈকেও অস্বীকার করে বসবেন। বলবেন, সে যুগের নারী নিগ্রহের বানানো আলাপ।
আজকের সো-কল্ড ফেমিনিস্টরা কেনো বানানো আলাপ করেন সে কথাটি বলি। মূলত নারীবাদ আর নারী মুক্তির আসল কথাটা তাদের জানা নেই বলেই তারা এমনটা বলেন, করেন। ‘মুক্তি’ কথাটির ব্যবহার হয়তো খুব সহজ। কিন্তু সে ‘মুক্তি’র মূল লক্ষ্য আত্মস্থ করাটা কঠিন। লেনিনও বলেছেন, মামুলি সমান অধিকার নয়, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকারের কথা। অর্থাৎ মানুষ হিসাবে অধিকার প্রাপ্তি। আজকে কথায় কথায় নারীবাদের চিৎকার শুনি। ব্যতিক্রমী কিছু ঘটলেই সেটাকে নারীবাদ আর নারীমুক্তির সাথে যুক্ত করে দেয়া হয়। যশোরের একটি মেয়ে বাইক চালিয়ে গায়ে হলুদের নামে উল্টোপাল্টা কিছু করলেন, তাকেই অনেকে নারীবাদ ও নারীমুক্তির সাথে জুড়ে দিলেন। সেই মেয়েকে ঝাঁসীর রাণী বানিয়ে দিলেন কেউ কেউ। আমাদের সংস্কৃতিতে, কথিত নারীবাদীদের মতে পুরুষতান্ত্রিক যে সংস্কৃতি, সেখানে কোনো পুরুষও বাইক চালিয়ে তার গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান উদযাপন করেন না। সেখানে একজন নারীর এই উদযাপন অনেকটাই উচ্চিংড়েপনা। এর সাথে যারা নারী মুক্তি মিলিয়ে ফেলেন তারা ঝাঁসীর রাণী আর কাশির রাণী’র মধ্যে পার্থক্য খুঁজে পান না। ঝাঁসীর রাণী হলেন মুক্তির প্রতীক। আর কাশি’র রাণী হলেন স্রেফ অ্যাটেনশন সিকার। যারা কাশি দিয়ে মানে উল্টোপাল্টা কাজের মধ্যে দিয়ে নিজের উপস্থিতি জাহির করেন। এমনটা হলে সম্প্রতি ব্যাংককের প্যাগোডায় ন্যাংটো হয়ে উঠে যাওয়া মদ্যপ নারীর কান্ডও তবে নারীমুক্তি।
আমাদের সমাজে এমন কাশি’র রাণীদের দেখা মেলে অহরহ। কথায় কথায় তারা পুরুষতান্ত্রিক সমাজ বলে গলা ফাটান, আর পুরুষের সমান হতে চান। একবারও মানুষ হতে চান না। তাদের কাছেই গায়ে হলুদের ‘বাইকিআনা’ নারী জাগরণের চিত্র। আর প্রকৃত নারীবাদীদের কাছে এই চিত্র লজ্জার, এই চিত্র উচ্চিংড়েপনার। এই মহামারীর সময় এমন উচ্চিংড়েপনা উল্টো তিরস্কৃত হবার কথা, অথচ হচ্ছে পুরস্কৃত। গণমাধ্যমগুলোর দিকে চোখ বুলালে মনে হয়, ঝাঁসীর রাণী’র অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করতেই ঘোড়ার বদলে বাইকে করে সেই নারী পথে নেমে এসেছেন। এটা এক ধরণের পারভার্সন। যারা এমন পারভার্সনকে জাগরণ বলেন বলিহারি তাদের।
সাধারণ আইনে বাইক চালকের হেলমেট পড়তে হয়, আর এই করোনাকালে মাস্ক। দুটোর কোনটাই নেই সেই কাশি’র রাণীর। তার বাহিনীর কেউই হেলমেট ও মাস্কের ধার ধারেননি। অথচ গণমাধ্যম এটাকেই সেলিব্রেট করছে। একবারও তাদের মাথায় এলো না, করোনাকালে সামাজিক দূরত্ব আর স্বাস্থ্যবিধির সাথে নিয়মিত আইনকে বুড়ো আঙুল দেখালো সেই মেয়ে। গণমাধ্যমের নিউজ ট্রিটমেন্টের যোগ্যতা এমন খবরে প্রশ্নবিদ্ধ হয়। মেধাশূন্যতার বিষয়টি চোখে লাগে। টিআরপি’র কাঙ্ক্ষায় আমাদের গণমাধ্যম চিলের পেছনে ছুটে চলেছে কানটা সঠিক জায়গা রয়েছে কিনা সেটা না দেখেই।
সার্বিক ভাবে আমাদের চিন্তার দৈন্যতার জন্যই এমন ঘটছে। আমরা আসল নকলের পার্থক্য করতে পারছি না। ‘চকচক করলেই সোনা হয় না’, এই প্রবাদ জেনেও নকল সোনার পেছনে ছুটছি। পণ্ডিত না হয়েও সাজার চেষ্টা করছি। আর এসব করছি শুধু দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য। ‘অ্যাটেনশন সিকার’ যাকে বলে, তাই হয়ে উঠছি আমরা। মানুষের রিয়েকশন ভাবারও সময় নেই আমাদের, শুধু চাচ্ছি মানুষ আমাদের দেখছে কিনা সেটুকু। মানুষ আমাদের নিয়ে হাসলেও আমাদের কিছু যায় আসেনা। কাঁদলেও না। বিচিত্র এক অবস্থা!
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন