০
২১২৩ বার পঠিত
‘This fellow’s wise enough to play the fool
And to do that well craves a kind of wit.’ – Shakespeare
ভাঁড়দের নিয়ে প্রথম স্টাডি হয় গ্রিসে। খ্রিস্টিয় ২য় শতকে এথেনিয়াস রচনা করেন ‘দ্য সফিস্ট এট ডিনার’ এতে নানা ধরনের খাবারের বর্ণনার সাথে খাবার টেবিলকে কিভাবে আরো উপভোগ্য করে তোলা যায় তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা আছে। সৌভাগ্যক্রমে এ বইতে ভাল খাবারের সাথে প্লুটার্কের জবানিতে তখনকার বিখ্যাত ভাঁড়দের নিয়েও বিশদ বিবরণ পাওয়া যায়। প্লুটার্ক আমাদের জানান প্যারাসাইট বা পরজীবী শব্দটা প্রথম দিকে খুবই মর্যাদাপূর্ণ ছিল যেটি নির্দিষ্ট ছিল যাজক এবং ম্যাজিস্ট্রেটদের সাথে যারা পদাধিকার বলে নয় বরং বিশেষ নিমন্ত্রণের দ্বারা আপ্যায়িত হতো। পরবর্তীতে এ পদের অবনমন হয় এবং যারা পদাধিকার বলে বা নিমন্ত্রিত না হয়েও বিনা পয়সায় খাবার লোভে ভোজসভায় এসে হাজির হতো তাদেরকে বুঝানো হয়। হেলেনেস্টিক সময়ে সম্রাট আলেক্সান্ডার এবং ফিলিপের দরবারে এবং ধনীগৃহে পরজীবী, ভাঁড়দের দেখা যেত। এদের কারো কারো স্থায়ী পদও ছিল। এছাড়া হাঁটে বাজারে, হাম্মামখানায় ফ্রিল্যান্স ভাঁড়দের অস্তিত্বের প্রমান পাওয়া যায়।
চিত্রঃ ডিনার টেবিলে দার্শনিকেরা আলোচনায় মগ্ন।
সক্রেটিসের শিষ্য জেনোফনের বর্ণনায় কার্যক্ষেত্রে গ্রীক ভাঁড়দের পারফর্মেন্সের বিবরণ পাওয়া যায়। কালিয়াসের ভোজসভায় সক্রেটিস যখন সিরিয়াস দর্শন নিয়ে আলাপ করছিলেন তখন ফিলিপ নামক ভাঁড় সেখানে হাজির হয়ে গুরুভার আলোচনার গতি পরিবর্তন করে পরিস্থিতি হালকা করে দেয়। সক্রেটিস এতে কিছুটা বিরক্ত হয়ে তাকে বকাবকি করলেও ভাঁড়ের আত্মসন্তুষ্টি কমাতে পারেননি।
চিত্রঃ সক্রেটিসের ছাত্র জেনোফন ( খ্রিস্টপূর্ব ৪৩০-৩৫৪)।
কালিয়াসের ভোজ সভায় ভাঁড় ফিলিপ বিনা নিমন্ত্রণে এসে উপস্থিত হয়। সভায় হাজির হয়েই সে ঘোষণা দেয়, ভদ্র মহোদয় গণ আমি পেশায় একজন ভাঁড় তাই আমি আপনাদের দাওয়াত করার ঝামেলা থেকে বাঁচাতে নিজ দায়িত্বে চলে এসেছি। ফিলিপের কথা শুনে গৃহকর্তা কালিয়াস বলল, ঠিক আছে, এসেছ যখন বসে পড়। কিন্তু এখানে ভদ্রলোকেরা সিরিয়াস বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা করছেন, আশা করছি কোন এক সময় তুমি তোমার প্রতিভা দেখানোর সুযোগ পাবে।
ভোজের সময়টা ফিলিপ কয়েকবার সভাস্থ লোকজনকে হাসানোর ব্যর্থ চেষ্টা চালায়। তার কৌতুক শুনে কারও মুখে হাসি ফোটেনি। তারপরে এক সময় সে খাবার টেবিল থেকে বেরিয়ে গিয়ে মুখ ঢেকে একটা বেঞ্চিতে শুয়ে পড়ে। তখনকার গ্রিসে কেউ মুখ ঢেকে ফেললে তার মানে হল সে চরম অপমানিত হয়েছে। গৃহকর্তা কালিয়াস এতে কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাইলেন তার কী হয়েছে, শরীর অসুস্থ কী না ?
ভাঁড় ফিলিপ তখন আর্তনাদ করে বলল, আমার জীবনে আমি এত অপমানিত হইনি। দুনিয়াতে হাস্যরসের কোন জায়গা না থাকলে আমার পেশার কী হবে? এখন আমার মরে যাওয়া ছাড়া আর কিছু করার নেই। মানুষকে আনন্দ দেবার জন্য আজ পর্যন্ত আমি নানা জায়গায় নিমন্ত্রিত হয়েছি। কিন্তু আজকের এই ঘটনার পরে কেউ আমাকে আর ডাকবে না। আমার আর বেঁচে থাকার কোন প্রয়োজন নেই, এখন মরে গিয়ে দেবতা হয়ে গেলেই বাঁচি। এভাবে সে দীর্ঘক্ষণ ধরে আহাজারি করে যেতে লাগল। এর মাঝেও সে কিছুটা আশ্বস্ত হলো যে অন্তঃত সভার একজন বুঝতে পেরেছিল যে তার আহাজারিও আসলে ভাঁড়ামির অংশ।
এক পর্যায়ে সে নিজেকে সামলে নেয় এবং সক্রেটিসের সাথে ঠাট্টা-মশকরা করতে উদ্যত হয়। ভাঁড় সক্রেটিসকে তার সাথে নাচার আমন্ত্রণ জানায়,সক্রেটিস অস্বীকৃতি জানালে সে একাই নাচে। সভাস্থ সবাই তার নাচ উপভোগ করে,কারণ ইতোমধ্যে কালিয়াস অতিথিদের পানীয় দ্বারা আপ্যায়িত করেছেন যার ফলে সবাই কিছুটা আমুদে ভাবে ছিল। খাদ্য-পানীয় পানের পরে আরো দীর্ঘক্ষণ ধরে দার্শনিক আলাপ-আলোচনা চলে তারপরে একসময় সভাস্থ দার্শনিকেরা ফিলিপকে তার ভাঁড় জীবনের শিক্ষা এবং তাৎপর্য কী সেটা জানতে চায়।
ভাঁড় ফিলিপ তখন জবাবে বলে, “আমার নিজের পেশা নিয়ে আমি গর্বিত। দুনিয়ার মানুষেরা যখন সুখে থাকে তখন তারা বিনোদনের জন্য আমাকে ডাকে। কিন্তু যখন দূর্ভাগ্য নেমে আসে তখন তারা আমাকে প্লেগের মত বর্জন করে, তারা ভয় পায় আমি তাদের দূরবস্থা নিয়ে কৌতুক করতে পারি।”
চিত্রঃ গ্রিক রম্য লেখক লুসিয়ান (১২৫-১৮০ খ্রিস্টাব্দ)।
জেনোফনের লেখার কয়েক শতাব্দী পরে লুসিয়ানের লেখা ‘এ ফিস্ট অফ লাপিথা’র বিবরণ থেকে হাস্য কৌতুক নিয়ে গ্রিকদের অবস্থানের পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হয় না। লাফিথার ভোজসভা ছিল বিয়ের উৎসব যেখানে প্রতিদ্বন্দী সব দলের দার্শনিকদের নিমন্ত্রন করা হয়। খাবার শুরু হবার সময়ে সেখানে আলসিডামুস নামক নৈরাশ্যবাদী (সিনিক) দার্শনিক হাজির হন। তাকে যে নিমন্ত্রন করা হয়নি এ নিয়ে তার মধ্যে কোন জড়তা নেই, কোন কিছুর তোয়াক্কা না করে সে সমানে খেয়ে যায়। ইতোমধ্যে গৃহকর্তা অতিথিদের মনোরঞ্জন করতে তার ভাঁড়কে ডাকলেন। সে এসে নেচে গেয়ে নানান কসরত করে, মিশরীয় উচ্চারণে কথা বলে অতিথিদের হাসালো। সব ঠিকমত চলছিল কিন্তু বিপত্তি বাধল যখন ভাঁড় সিনিক দার্শনিককে মাল্টার কুকুর সম্বোধন করল। দার্শনিক তার মেজাজ হারিয়ে ফেলে ভাঁড়ের সাথে মুষ্ঠিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। ভরপেটে দার্শনিক বেশিক্ষণ লড়তে না পেরে ক্ষান্ত হয়। এতে দার্শনিকদের অনেকে মজা পান, কেউবা এরকম কেলেংকারীতে ব্যথিত হন।
ইতিহাসে দার্শনিক বা বিজ্ঞজনের সাথে ভাঁড়ের প্রতিযোগীতার আরো অনেক উল্লেখ দেখা যায়। এতে কখনো দার্শনিক জয়ী হন যেমন হয়েছিল সক্রেটিসের বেলায়, কখনো দার্শনিক নিজে ভাঁড়ে পরিনত হন। অনেক শতাব্দী পরে ইতালীর কবি দান্তে আর ভাঁড়ের প্রতিযোগীতায় দান্তে জয়ী হন। সপ্তদশ শতকে ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ডে বিশপ এবং কবিদের ভাঁড়দের সাথে দ্বন্দে লিপ্ত হতে জানা যায়। সবশেষ দেখা যায় অস্টাদশ শতকে জার্মান অধ্যাপকরা তাদের আয় বাড়াতে রাজসভায় ভাঁড়ের ভূমিকায় অভিনয় করে।
” If I wish to look at a fool, I have not far to go ; I have only to look in a mirror.” – Seneca
“He who hath not a drachma of folly in his mixture hath pounds of much worse matter in his composition.”
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন